ফিক করে হাসল কি একবার?
সামনে ঝুঁকে পড়ে ভালো করে দেখে নিল পুলি। কই না তো! দিব্বি গোমড়া মুখে দাঁড়িয়ে সে আয়নার সামনে। জুত করে মাছের মুড়োটা চিবোতে পারলো না দাঁতে পোকা ধরেছে বলে। ডাক্তার রাতে খাওয়ার পর আরেকবার ব্রাস করতে বলেছে।
সে হাসেনি অথচ আয়না হাসল! আশ্চর্য! মাছের মুড়োর শোকে কি শেষে ভুলভাল দেখছে? তাইই হবে!
কিন্তু ব্রাস হাতে আয়নাটার দিকে এক ভাবে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই একটা আশ্চর্য খেয়াল পেয়ে বসলো তাকে। কোন একটা ভূতের সিনেমায় সে একবার দেখেছিলো যে আয়নার ভেতরেও নাকি আস্ত একটা জগত আছে। সেখানেও দিন হয়, পাখি ওড়ে, মানুষজন কাজে যায়, জন্ম আছে, মৃত্যু আছে, হিমালয়-অ্যামাজন-তাজমহল সবই আছে। পার্থক্য শুধু এতটাই যে সেসব ঠিক আমাদের উল্টো। ঠিক যেমন আয়নার সামনে দাঁড়ালে আমাদের ডান হাত হয়ে যায় বাম হাত, সেইরকম।
ভুরূ কুঁচকে এলো পুলির।
তাই যদি হবে, আয়নার ভেতরের পৃথিবীটা তবে নিশ্চয়ই পূব থেকে পশ্চিমে ঘুরছে; আর তার মানে সেখানে সূর্য পশ্চিমে উঠে পূবে অস্ত যাচ্ছে? ঘড়ির কাঁটা উল্টো দিকে ঘুরছে? শামুকের খোলা উল্টো দিকে পাক খেয়ে উঠছে? এমনকি কলকাতার মিমি মাসির বাড়িতে যে কাঠের পাকানো সিঁড়িটা তেতলার ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে, সেটাও নিশ্চয়ই উল্টো মুখে ঘুরে গেছে!
বিছানায় শুয়ে এই সবই সে ভাবছিল; আর তাই বোধয় অমন বিদঘুটে স্বপ্নটা দেখল সে রাতে।
একটা স্টুডিও ঘরে দাঁড়িয়ে সে। ঘরের আকার-আয়তন দেখে বুঝল সেটা ছাদের চিলেঘর। ঘর ভর্তি আঁকার সরঞ্জাম। ঘরের দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাখা সারসার ক্যানভাস। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে তেল-রঙ, তুলি, ব্রাশ। ঘরের বাতাসে টারপিন আর তুঁষের তেল মেশানো অদ্ভুত একটা গন্ধ। ঘরে কেউ নেই নাকি? না ওইতো একজন আছে- ঘরের এক কোণায় প্রকাণ্ড একটা আয়নার সামনে বসে সে; পুলির দিকে পিঠ। লোকটা ছবি আঁকছে, আর মাঝে মাঝে ক্যানভাসের পাস দিয়ে উঁকি মেরে পেছনে রাখা আয়নাটায় কি একটা দেখে নিচ্ছে, দিয়ে আবার তুলি চালাচ্ছে। হটাত লোকটা পেছন ফিরল। লোকটা একটা সাহেব। লোকটাকে কেমন চেনাচেনা লাগলো পুলির। কোথাও দেখেছি কি আগে?
আর ঠিক তখনই পুলির চোখ পড়লো পেছনে দাঁড় করানো ক্যানভাসটার উপর; আর পড়তেই চমকে উঠলো সে।
আরে! এটা তো ভ্যানগফের সেই বিখ্যাত বাম-কানে ব্যান্ডেজ জড়ানো শেল্ফ-পোরট্রেটটা! আর তাই যদি হয়, এই সাহেবই কি তাহলে…? হ্যাঁ, সেই একই সোনালী চুল, বহুদিন ক্ষুর না লাগানো দাড়িগোঁফ, সেই তোবড়ানো গাল, সেই নীল চোখ। গরমিল কেবল একটা জিনিসে; আর সেটা ওই জখম কানটা। সাহেবের ডান কানে ব্যান্ডেজ আর পোরট্রেটের বাঁ কানে।
কি হল ব্যাপারটা?
আর ঠিক তখনই বিদ্যুতের মতো পুরো ব্যাপারটা পুলির মাথায় খেলে গেলো। আর খেলে যেতেই বুকটা ধড়াস করে উঠলো তার। ইতিহাস তো তাহলে নতুন করে লিখতে হয় আবার। আসলে সাহেবের ডান কানই জখম হয়েছে। এদিকে সাহেব আয়নাতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে আঁকছেন পোরট্রেট; স্বাভাবিক ভাবেই তার জখম ডান কান হয়ে গেছে পোরট্রেটের বাম কান।
ভারী অদ্ভুত স্বপ্ন!
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে পুলি যাচ্ছিল রান্নাঘর থেকে স্নানঘরের দিকে। হাতে বালতি। শীতকাল। মা স্নানের জল গরম করে দিয়েছেন। আর ঠিক তখনই হটাত একটা জিনিস খেয়াল হতে থমকে দাঁড়ালো সে!
ডান হাতটা উপরে উঠে আছে কেন তার? তার মানে ভারি বালতিটা কি তার বাম হাতে ধরা? অথচ ভারী জিনিস তো সে ডান হাতেই তোলে! আজ তবে…? তাড়াহুড়োতে কি? তাইই হবে।
কিন্তু সেটা যে নয় সেটা পুলি বুঝল আরেকটু পর; আর সেটা ব্রাস করতে গিয়ে। টুথব্রাশটাও আজ তার বাম হাতেই ধরা।
ঘাড়ের কাছে রোঁয়াগুলো খাড়া হয়ে উঠলো পুলির। কাউকে কিছু বলল না সে।
আরও কয়েকটা পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে সে ইতিমধ্যে। জলের মগ বাম হাতেই তুলেছে, ভাত বাম হাতেই মেখেছে, চুল আঁচড়েছে বাম হাতেই, সিঁথি করেছে ডান দিকে, ঘড়িটা পরেছে ডান হাতে। আর ঘড়িটা পরতে গিয়ে আরও একটা জিনিস খেয়াল করে চমকে উঠলো সে। কিভাবে কি জানি কব্জির কাছে স্টারফিশের মতো জরুলটাও রাতারাতি হাত পরিবর্তন করে ফেলেছে। ঘড়ির লেদার বেল্টের নিচ থেকে সেটা এখন উঁকি দিচ্ছে পুলির ডান হাতে। সাইকেলে চাপতে গিয়েও একই কাণ্ড। সাধারণত একটু গড়িয়ে নিয়ে বাম দিক থেকে ওঠে সে। আজ হল উল্টোটা। আর সবথেকে অবাক যেটা, সেটা হল- এই সবকিছুই সে করছে খুবই সহজাত ভাবে, যেন প্রক্রিয়া গুলো এতবছর ধরে এভাবেই করে আসছে সে। আর এটা মনে হতেই আরও একটা কথা মনে পড়ে গেলো তার- সেই সাধুবাবার কথা।
এই পরিবর্তগুলোর কথাই কী বলেছিলেন সাধুবাবা?
মাস দুয়েক আগের কথা। পাড়ার কিনারায় কেতুদের পেয়ারা বাগান ছাড়িয়ে বুড়ো জামরুল গাছটার নিচে এক সাধুবাবা এসে আস্তানা গেড়েছিল। ছোটমামার যদিও সাধু সন্ন্যাসীতে ভক্তি-বিশ্বাস নেই, তবুও তিনি বলেন যে মানুষ যখন কোনও একটা বিষয় নিয়ে একমনে নিরন্তর সাধনা করে যায় দিনের পর দিন, সেটাও এক ধরণের গবেষণা বৈকি। গবেষণা শব্দের অর্থই হল বিশেষভাবে অনুসন্ধান করা। আর সেদিক দিয়ে বলতে গেলে শুধু বিজ্ঞানীদেরই গবেষক বলা ঠিক নয়। সাধু সন্ন্যাসীরও তো দিনের পর দিন জপ-তপ-ভূত-ভগবান নিয়ে সাধনা করে চলেছেন, কাজেই তারাও এক ধরণের গবেষক। এই দুই গোষ্ঠীর মতের মিল নেই বলেই যে একে অপরের সাধনার ফলাফলকে হেসে উড়িয়ে দেবে সেটাও ঠিক নয়। সে জন্যেই বোধয় জট পাকানো দাড়িগোঁফের ফাঁক দিয়ে স্মিত হেসে সাধুবাবা যখন ছোটমামাকে উদ্দেশ্য করে বললেন “বেটা, তোর খুব নামডাক হবে শিগগিরি, লোকে তোর খুব প্রশংসা করবে, তোর শিষ্য তোর মুখ উজ্জ্বল করবে”, তখন ছোটমামা বেশ বিনীত ভাবেই সে আশির্বাদ গ্রহণ করেছিলেন। ছোটমামা তো এমনিতেই বিখ্যাত লোক। কতো বিখ্যাত জার্নালে তার লেখা বেরিয়েছে, কতো দেশি-বিদেশী অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। বিলেত থেকে ডাক তো আকছারই আসে। তবে সাধুবাবা যে ঠিক এই ‘নামডাকের’ কথা বলেনি, সেটা বোঝা গেলো দু’সপ্তা পর। কাজের মেয়ে নিনু এসে খবর দিলো বাজারে নাকি ‘হেমেন মণ্ডামিঠাই’ বলে একটা নতুন মিষ্টির দোকান খুলেছে, আর তাদের স্পেশাল আমসত্ত্বের পুর দেওয়া সিঙ্গারা আর মোচার চপের স্বাদ নাকি লোকের মুখে মুখে ঘুরছে। ছোটমামার নামও হেমেন, কাজেই হেমেন মণ্ডামিঠায়ের সুনাম মানে তো ছোটমামারই সুনাম একদিক দিয়ে। কয়দিন পরে এও জানা গেলো যে মিষ্টির দোকানের মালিক নেমু। এই ‘শিশ্যের’ কথাই বলেছিলেন সাধুবাবা। নেমুকে ছোটমামার শিষ্য বলার কারণ আর কিছু নয়, বছর কয়েক আগে মোটা মাইনে দিয়ে নেমুর বাবা বালেশ্বরবাবু ছোটমামাকে রেখেছিলেন ছেলেকে হায়ার-সেকেন্ডারির গেরো পার করে দেওয়ার জন্যে। দুদিন বাদেই ছোটমামা চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বাড়িতে এসে প্রায় কাঁদোকাঁদো হয়ে বলেছিলেন- “গতো জন্মের সব পাপ ধুয়ে গেলো রে খুকু!”। সাধুবাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে বলতে হবে। তবে আজ পুলি বুঝতে পারছে সাধুবাবা সত্যিই একজন ত্রিকালজ্ঞ পুরুষ, কারণ শুধু ছোটমামা নয়, তার নিজের ক্ষেত্রেও আশ্চর্য ভাবে ফলে যাচ্ছে সাধুবাবার ভবিষ্যতবাণী। তিনি বলেছিলেন “তোর জীবনেও একটা বড়োসড়ো বদলাও আসবে রে বাচ্চা। তবে ভয় পাসনে, আখেরে তোর মঙ্গলই হবে তাতে”
স্কুলে গিয়ে বাঁধল বিপত্তিটা। কেউ খেয়াল না করলেও, নিরুর চোখ কিন্তু এড়ালো না, সে পুলির বেস্টফ্রেন্ড।
“আজ যে বাম হাতে লিখছিস বড়?” বাঁকা চোখে জিজ্ঞেস করলো নিরু। ব্যাপারটা যে পুলিও খেয়াল করেনি তা নয়। তার ধারণা ছিল লেখার মতো জিনিস যেটা বাম দিক থেকে ডান দিকে যায়, সেটা ডান হাতেই বেশী সহজে হয়। কিন্তু দেখে অবাক হল যে ইতিহাস ক্লাসের মতো ক্লাসে, যেখানে তাড়াতাড়ি হাত চালিয়ে লিখে লিখে পাতা ভরিয়ে ফেলতে হয়, সেখানেও দিব্বি সরসর করে হাত চলছে তার, কোনও অসুবিধাই হচ্ছেনা। বরং লেখাটা যেন একটু বেশী সুন্দরই হচ্ছে বলতে হবে। একটা বোকাটে হাসি হেসে ‘ও কিছুনা, ডান হাতে ব্যাথা তাই…’ বলে কাটিয়ে দিলো পুলি ব্যাপারটা। নিরুর ভ্রূকুটি কিন্তু গেলো না।
টিফিনের ঘণ্টা পড়লো।
প্রায় বাউন্ডারি থেকে বাম হাতে বল ছুড়ে পুলি যখন ঘেপুকে রান আউট করলো, শুধু সে কেন, ওর নিজের দলের সবাই, ব্যাট হাতে থতমত ঘেপু, কানামাছি খেলা ক্লাস টু-থ্রির বাচ্চাগুলো, এমনকি নিম গাছের কাকটা পর্যন্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। কারণ আর কিছুই নয়, উৎসাহ-উদ্দীপনা অদম্য থাকলেও, ক্রিকেটটা পুলির ঠিক আসেনা।
বল তো করতেই পারে না, ব্যাট ধরাটাও খুব একটা সুবিধের নয়; তাই দলে রাখলেও বেশীরভাগ দিনই ফিল্ডিং ছাড়া আর কিছু দেওয়া যায় না তাকে। নেহাতই যেদিন ম্যাচের ফল আগে থেকেই ঠিক হয়ে যায়, এই যেমন জিততে গেলে এক ওভারে আশি রান করতে হবে বা শেষ ওভারে অন্য দলকে এক ওভারে আশি রান তুলতে হবে, সেইসব দিনে সে ব্যাট বা বল পায়। আর এমনি দিনে ফিল্ডিঙে রেখেও যে খুব নিশ্চিন্ত হওয়া যায় এমনটি নয়, সেটাতেও নড়বড়ে সে। ক্রিকেট বলকে ছটকানো কইমাছের মতো ওরকম করে ধরতে আর কেউ কখনও দেখেনি। উইকেট-কিপারের পেছনে যেখানে হয়তো কালে-ভদ্রে এক-আধটা বল যায়, সেইসব জায়গায় দাঁড় করানো হয় তাকে।
সেই পুলি কিনা আজ চল্লিশ গজ দূর থেকে এক টিপে ঘেপুকে রান আউট করে দিলো? শুধু এতটা হলেই তো হত, কিন্তু এর পরে যা ঘটলো, রাজ্য সরকারের তরফ থেকে দিনটাকে যে ‘পুলি দিবস’ ঘোষণা করা হল না, সেটাই আশ্চর্য।
আট জনের দলে পুলি যখন সাত নম্বরে ব্যাট করতে নামলো, তখন জিততে গেলে পাঁচ বলে চাই আঠাশ রান। নিশ্চিত হার। পুলিকে ব্যাট হাতে ক্রিসে আসতে দেখে বল হাতে ঘেপু বাঁকা হাসল, ভাবটা এমন ‘কপাল একবারই সাথ দেয়, বেশ তো আমার হাফ সেঞ্চুরিটা আটকে দিলি, এবার দাঁত ভেঙে তোর হসপিটাল যাওয়াটা কে আটকাবে?’
হাসপাতাল সত্যিই যেতে হয়েছিলো। তবে পুলিকে নয়, ঘেপুকে। মাথায় বরফ দিয়ে পাক্কা আধটি ঘণ্টা বেঞ্চে শুয়ে থাকতে হয়েছিলো তাকে। কারণ পাঁচ বলে পাঁচটা ছয় এর আগে কেউ তাকে কখনও মারেনি; শুধু তাকে কেন, হরিণডাঙ্গা স্কুলের ইতিহাসেই এই প্রথম।
খেলার পর একটা জিনিস পুলি বুঝল- এতদিন কেন সে ক্রিকেটটা আয়ত্ত করতে পারেনি। সে ভুল হাতে ব্যাট-বল ধরেছে এতকাল।
আর এটা বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই মাথায় এলো আশ্চর্য ফন্দিটা!
বেশ কিছু বছর আগের কথা। পুলি তখন ক্লাস ফোর কি ফাইভ। অন্ধকারে ঠাকুরঘরের উঁচু তাক থেকে পুজোর বাতাসা চুরি করতে গিয়ে পেল্লায় ভারী পেতলের ঘণ্টিটা পড়ে তার ডান পায়ের উপর। তারপর প্লাস্টার নিয়ে টানা তিনটি মাস বিছানায়। ডাক্তার আস্থিচরণ বাবু এক্সরে দেখে গম্ভীর মুখে বলেছিলেন, “কম্পাউন্ড ফ্র্যাকচার। জুড়বে না পুরোটা”। না, পুলিকে ক্র্যাচ বগলে লেংচে লেংচে চলতে হয়নি ঠিকই, কিন্তু ফুটবল খেলা তার ওখানেই শেষ হল। বলে শট নিতে গেলেই টনটন করে উঠছে ডান পা। অথচ সেই ছোটবেলা থেকে স্কুলের, পাড়ার, ক্লাবের এক নম্বরের ফুটবলার সে। ওইটুকু বয়সে ওরকম পায়ের জাদু ও অঞ্চলে আর ছিলোনা। জন্মদিনে ছোটমামা কোলকাতা থেকে দামী জুতো, মেসির সই করা বার্সেলোনার জার্সি, পুমার সাইড ব্যাগ আর একটা সুন্দর স্পোর্টস ওয়াচ এনে দিয়েছিল। হাড় ভাঙ্গার পর সেসব চিরকালের জন্যে আলমারিতে উঠলো। কোনও এক ম্যাজিক করে হাড়টা যদি জোড়া লাগানো যেতো বা ঘণ্টাটা আচারের বয়ামের বামদিকে রাখা যেতো, তাহলে জখম হতো বাম পাটা, ডান পা অক্ষত থাকতো, এইসব কতবার ভেবেছে পুলি। আর ভেবে ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। আর বোধয়ও কোনোদিন খেলা হবেনা তার ফুটবল।
অন্তত পুলি তাইই ভেবেছিল! কিন্তু আজ ব্যাপার অন্য!
স্কুল ফেরত বাড়ির রাস্তা না নিয়ে ক্লাব-মাঠের রাস্তাটা নিলো সে। ব্যাগ রেখে, প্যান্ট গুটিয়ে যখন দাঁড়ালো সে সাইডলাইনের পাসে, বাঁকা চোখে তাকাল সবাই। বছর দুয়েক আগে হলেও এতক্ষণে দু’দলের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত কাদের হয়ে খেলবে পুলি। কিন্তু এখন ব্যাপার অন্য। পুলি এখন জখম ঘোড়া। তাকে আর রেসে নামানো চলে না। কেউই তাই খুব একটা উৎসাহ দেখাল না। শেষে নেহাতই গোড়ালি মচকে নিলুদের টিমের স্ট্রাইকার বোঁচাদা মাঠের বাইরে বেরোতে একরকম জোর করেই ঢুকে পড়লো পুলি।
বুক ঢিপঢিপ করছে তার, এই যেন খুলে আসবে সেটা হাতে। তালু শুকনো। পেটটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠছে। চোখেও হালকা ঝাপসা দেখছে কি? একমাত্র আরামদায়ক অনুভূতিটা আসছে পায়ের দিক থেকে। ঠাণ্ডা ঘাসের ছোঁয়াটা খুব চেনা চেনা, যেন পুরনো বন্ধুর সাথে হ্যান্ডসেক।
দুপায়ের দশটা আঙুল বার কয়েক নাড়াচাড়া করে দেখে নিলো। একটা খ্যাচ লাগলো; তবে তাতে অস্বস্তির পরিবর্তে আশ্চর্য একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো পুলির মুখে।
ঠিক এই সময়েই একটা জিনিস গড়িয়ে এসে থামল তার পায়ে। সাদাকালো পঞ্চভুজে মোড়া রাবারের একটা গোলক। চোখ বুজে গভীর একটা শ্বাস নিলো পুলি। কতদিন পর পায়ের নিচে তার ফুটবল। এবার দেখার একটাই জিনিস।
চোখ খুলল পুলি।
পাগলা একটা ষাঁড়ের মতো তার দিকে তেড়ে আসছে নেকুদা। বাম দিক থেকে তীরের মতো ছুটে আসছে বাদু। আর ডানদিক থেকে রানাদা। তার সামনে দাঁড়িয়ে এখন রতনপুর ইয়াং টাইগার্সের বিখ্যাত ত্রিফলা ডিফেন্স ‘দা টেরর ট্রাও’। ডিফেন্স তো নয়, একটা দুর্লঙ্ঘ্য পাঁচিল যেন। আর সেই পাঁচিলটা খুব দ্রুত এগিয়ে এসে ঘিরে ফেলছে পুলিকে তিনদিক থেকে। এই চরম মুহূর্তেও একটা জিনিস আবিষ্কার করে পুলি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস না ফেলে পারলো না। একটুও ঘাবড়ে যাচ্ছেনা সে, দৃঢ় একটা আত্মবিশ্বাসে শান্ত তার শরীর-মন, ঠাণ্ডা তার মাথা। স্নায়ু কঠিন কিন্তু অস্থির নয় মোটেই। ঠিক আগের মতো।
পাঁচহাতের মধ্যে এসে পড়েছে নেকুদা। ‘টেরর ট্রাও’র মূল স্তম্ভ। ওকে টপকে বল আর খেলোয়াড় এক সাথে যেতে পারেনা, যেকোনো একজন যাবে, হয় বল আর না হয় খেলোয়াড়। তবে বেশীরভাগ দিন বলই যায়, কারণ খেলোয়াড় তখন মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাতরায়। কপাল খারাপ থাকলে প্লাস্টার জড়িয়ে সোজা চার মাসের বেড-রেস্ট। সেবার ঊর্ধ্বগগন চ্যাম্পিয়নস কাপের ফাইনালে নেকুদার ল্যাঙ খেয়ে বাঘাহরিণ ক্লাবের স্ট্রাইকার পিলাই সেই যে মাঠের বাইরে গেলো, আর সে কখনও ফেরেনি মাঠে। ক্র্যাচ বগলে এখন সে ক্যারাম খেলে। লোকের মুখে শোনা যায় এখনও নাকি সে রাতের বেলা স্বপ্নের ঘোরে ‘বাঁচাও! নেকুসরাস আমাকে গিলে নিলো’ বা ‘না মহারাজ, আমাকে প্লিজ নেকুতে খাইয়ে দেবেন না’ বলে চিৎকার করে ওঠে।
সেই নেকুদা সুযোগ বুঝে মারল স্লাইড ট্যাকেল। মুখে পৈশাচিক হাসি। লক্ষ্য পাটকাঠির মতো সরু লিকলিকে দুটো পা।
আআআআআআঃ
একটা কাতর আর্তনাদ ভেসে এলো। হাঁটু ধরে শুয়ে কোঁকোঁ করছে একজন। যন্ত্রণায় বিকৃত মুখ। না পুলি নয়, এ হল ‘টেরর ট্রাও’র মূল স্তম্ভ শ্রীমান নেকুরাম। সরু পাটকাঠির মতো লিকলিকে দুটো ঠ্যাঙে নয়, মাঠের পাশের প্রাইজ দেওয়ার ইটের থামে সজোরে ধাক্কা খেয়েছে নেকুরামের লোহার পা দুটো, আর তাতেই এরকম গোঁত খাওয়া ঘুড়ির মতো মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছে সে।
আর পাটকাঠির মতো লিকলিকে ঠ্যাঙ দুটো? ম্যাজিকের মতো বলটা ডান পা থেকে বাম পায়ে নিয়ে বাদুকে কাটিয়ে, রানাদাকে ধাপ্পা দিয়ে তার দু’পায়ের মধ্যিখান দিয়ে বলটাকে গলিয়ে ডি-বক্সের ভেতর এসে দাঁড়িয়েছে সেটা। সামনে ভ্যাবাচ্যাকা গোলকিপার। তার ঠিক পেছনে হলুদ জালে ঘেরা একটা আয়তক্ষেত্র, আর হাত আটের বেশী দূর নয় সেটা। তারপর আর কি?
একবার নয়, দুবার নয়, ছয়-ছয় বার জালে জড়িয়ে যাওয়া বলটা ব্যাজার মুখে কুড়িয়ে আনল গোলকিপার নেপু।
হ্যাঁ, পুলি আজ জোড়া হ্যাট্রিক করেছে। খেলার পর তাকে নিয়ে যা হৈহৈ পড়ে গেলো সে আর কি বলবো। বিশেষ করে ক্লাবের নতুন প্রেসিডেন্ট প্রধানবাবু তো হাততালির চোটে হাত লালই করে ফেললেন। তিনি ঠিক করে ফেললেন আগামী গোলন্দাজ মেমোরিয়াল শিল্ডে টিমের ক্যাপ্টেন হবে শ্রীমান পুলিন বিশ্বাস।
পুরনো পঞ্চায়েত বাড়ির সিঁড়িতে বসে সাতপাঁচ ভাবছিল পুলি। পঞ্চায়েত বাড়িটা মেরামত হচ্ছে। উপরে আরেকটা তলা হবে। চারিদিকে ইট কাঠ আর বালি। খেলার পর এখানে এসে একটা সিঁড়িতে বসেছিল সে চুপচাপ। মুখে তার নরম হাসি। বুকটা ফুরফুরে হালকা। পশ্চিমে সূর্য ঢলে আসছে। একঝাক বাদুড় হুশহুশ করে উড়ে গেলো মাথার উপর দিয়ে। এবার উঠতে হয়। পা বাড়াল সে।
আর ঠিক তখনই বাঁধল বিপদটা।
অতো দেখেছে কি না দেখেছে, সবে পা টা ফেলেছে পরের ধাপে, কিন্তু পা ঠেকল কই! বরং বেসামাল হয়ে কাত হয়ে গড়িয়ে পড়লো পুলি- সোজা নিচের দিকে। ভিত গাঁথার কাজ তখনও শেষ হয়নি। এখানে ওখানে বেরিয়ে আছে কাঠের তক্তা আর লোহার রড। আর এরকমই একটা লোহার রডে…
তারপর আর কিছু মনে নেই পুলির।
তিনদিন পর যখন সে চোখ খুলল, ওষুধের গন্ধ আর সাদা ফ্রক পরা নার্সদের ছোটাছুটি দেখে বুঝল সে এখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে। একদিকে মা মাথা নিচু করে বসে, বড়মামা একটা বুড়ো ডাক্তারের সাথে কি কথা বলছেন। ছোটমামা দিদার সাথে কথা বলছেন ঘরের মুখটায়।
“বাবা কোথায়?”
চমকে উঠে মুখ তুললেন পুলির মা। তারপর হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। বড়মামা ছুটে এলো, পেছনে সেই বুড়ো ডাক্তারটা। লাঠি ঠুকেঠুকে দিদাও এগিয়ে এলো।
পড়ে যাওয়ার পর তার ঠিক কি হল, কিভাবে ভবেশ দাদু পঞ্চায়েত বাড়িটায় লুকিয়ে লুকিয়ে বিড়ি খেতে এসে তাকে আবিষ্কার করলো, কিভাবে ছোটমামা নলীনি দিদিদের মারুতিটা ধার করে একশো চল্লিশে গাড়ি চালিয়ে বা উড়িয়ে তাকে হাসপাতালে নিয়ে এলো, কিকরে আইসিইউ তে টানা সাত ঘণ্টার একটা সার্জারি হয়ে গেলো তার উপর, আর কিকরে আজ তিনদিন পর জ্ঞান ফিরে এলো, সব শুনেটুনে পুলির চোখ দুটো টেনিস বলের মতো গোলগোল হয়ে গেলো। বাবা খবর পেয়ে ছুটে আসছেন- লন্ডনে একটা কনফারেন্সে ছিলেন তিনি।
সবার মুখে একটা স্বস্তির ছাপ। দিদা কপালে চুমু খেলেন। বড় মামা মাথায় ধারে দাঁড়িয়ে আছেন নরম মুখে। বড় মামাও বাইরে ছিলেন, সেই সিঙ্গাপুরে, খবর পেয়ে কালই ছুটে এসেছেন। শুধু মা এখনও হাউহাউ করে কেঁদে চলেছে। ছোটমামা মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। সবার মুখেই খুসির ছাপ কেবল একজন ছাড়া। সে ওই বুড়ো ডাক্তারটা। তারই কেবল ভুরূ কুঁচকে আছে। একটু পর সবাই শান্ত হতে ডাক্তারটা পুলির কাছে এগিয়ে এলেন। মুখ নামিয়ে পুলির কানে প্রায় ফিসফিস করেই বললেন-
“তোমাকে বাঁচাতে পারবো ভাবতে পারিনি। রডটা বুকে ঢুকে পুরো এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেছিল। কিন্তু ঈশ্বরের কি আশ্চর্য বিধান আর তোমার কি আশ্চর্য কপাল, অপারেশন করতে গিয়ে দেখি তোমার হার্ট তো বুকের ডান দিকে।”–
কলমে সোহেল রেজা
Write and Win: Participate in Creative writing Contest & International Essay Contest and win fabulous prizes.