প্রথম হাততালি

কলমে চন্দন মিত্র

0
221

প্রথম হাততালির গুরুত্ব অপরিসীম। সেটাই সূত্রপাত। তারপর তা ক্রমে সংক্রমিত হয়। এমনকি এমনও হয়, হাততালি না-দিতে-চাওয়া হাত দুটি কখন যে অজান্তে এক হয়ে যায়, তা তার  মালিকও বোঝে না। প্রতিবর্ত ক্রিয়ার মতো এক প্রবল ঝাঁকুনিতে কাজটি করে সে হয়তো ভয়ও  পেয়ে যায়। কী জানি যদি জানাজানি হয়ে যায়, হাততালি দেওয়া লোকগুলোর দলে সেও ছিল ! স্বপন অতশত ভাবে না, তার ওসব ভাবতে বয়েই গেছে ! সে তো নিছক এলেবেলে কেউ নয়,   এলাকার সুপ্রসিদ্ধ খ্যাপা-স্বপন। রাতের অন্ধকারে যখন পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়ে, তখন তার   কাজকারবার শুরু হয়।

  স্বপন এক গুরুতর প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। নিশুতি রাতের নিগুম অন্ধকারে সে তার ল্যাবরেটরিতে যাঁদের ডেকে আনে তাঁরা প্রত্যেকেই সুপরিচিত, শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। স্বপন প্রথমে  নেতাজিকে, তারপর গান্ধিজিকে, তারপর জওহরলালকে অনুনয়-বিনয় করে ব্যর্থ হয়ে, অতঃপর  খুদিরামের শরণাপন্ন হয়। খুদিরাম এককথায় রাজি হয়ে যায়। কিন্তু একটা শর্ত রাখে, বেদির উপর তারও একটা প্রতিকৃতি রাখতে হবে। নচেৎ তার কিচ্ছুটি করার থাকবে না। হাতে মাত্র দু-দিন। সকাল হতে না-হতে স্বপন চলল হেড মাস্টার সঞ্জয়বাবুর বাড়িতে। তিনি তখনও ঘুম থেকে  ওঠেননি। স্বপন কলিং বেল বাজিয়ে দেয়। খ্যাপা হলে অনেক বিষয়ে ছাড় পাওয়া যায়। তাছাড়া স্বপন তো ওই স্কুলের একসময়ের কৃতী ছাত্র ছিল।

    ফিজিক্সের গোল্ড মেডালিস্ট, ইউনিভার্সিটির টপার স্বপনকে ঘিরে স্বপ্ন ছিল অনেকের।  তারপর কোথা থেকে কী যে হয়ে গেল ! গবেষণার কাজে জাপানে গিয়ে একদল তরুণের সঙ্গে আলাপ হয় স্বপনের। তারা এক্টোপ্লাজম নিয়ে কাজ করছিল। জীবন বিজ্ঞানের পরিভাষায়  এক্টোপ্লাজম হল, কোশের বাইরের স্তর। তবে বিশিষ্ট প্রেততাত্ত্বিক স্বামী অভেদানন্দ প্রণীত ‘মরণের পারে’ বই পড়ে সে জেনেছে, প্রেততত্ত্বের পরিভাষায় এক্টোপ্লাজম হল কম্পনশীল সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম  জড়কণার সমষ্টি, যা আসলে বিদেহী আত্মার উপাদান। অভেদানন্দের বইতে এই এক্টোপ্লাজম তথা  দেহ বহির্ভূত আত্মার ছবিও রয়েছে। এতদিন সে অভেদানন্দের যুক্তিকে বৈজ্ঞানিক বিচার দিয়ে অস্বীকার করে আসছিল। আর আজ জাপানি আত্মা-বিজ্ঞানীদের সঙ্গে গবেষণায় অংশ নিয়ে সে বুঝতে পারে— মৃত্যুর পর আত্মার দেহ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়াকে যেমন অনায়াসে প্রমাণ করা যায়,   তেমন ওই বিদেহী আত্মাকে কাউন্সেলিং করিয়ে তাকে দিয়ে আশ্চর্য সব কাজও করিয়ে নেওয়া যায়। একদিন হোক্কাইদো-র মাউন্ট সাহোরো-র পাদদেশে এক রিসর্টে স্বপনের রক্তাক্ত দেহ উদ্ধার করে সেখানকার পুলিশ। দেহের কোথাও তেমন ক্ষত ছিল না, কেবল পেটটা ছিল ফালা করে কাটা ; যেন হারাকিরিতে আত্মহত্যা। আসলে প্রেততত্ত্বের গবেষণায় সে এতটাই এগিয়ে গিয়েছিল যে, সহ-গবেষকরা তার থিসিস চুরির জন্য এমন কাজ করেছিল। শোনা যায় সে যাত্রায় এক সামুরাইয়ের আত্মা তাকে ঘাতকদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। এক্টোপ্লাজম নিয়ে বাড়াবাড়ির জন্য হোক্কাইদো ইউনিভার্সিটি স্বপনকে বরখাস্ত করে। স্বপন ফিরে আসে। পৈতৃক বাগানবাড়িতে নিজের মতো করে গবেষণাগার বানিয়ে নেয় সে। লোকজন বলে অতিরিক্ত পড়াশোনা করে তার মাথা বিগড়ে গেছে। যে কখনও স্কুলের ধারে-কাছে যায়নি, সেও এই অদ্ভুত গবেষণার কথা শুনে খিল্লি শুরু করে। অচিরেই স্বপনের নামের আগে ‘খ্যাপা’ শব্দটি জুড়ে যায়।

—মাস্টারমশাই, শুনলাম এবছর নাকি নন্তুবাবু পতাকা তুলবেন ?                         

—ঠিকই শুনেছ বাবা। আমার হাত-পা বাঁধা। আমি আপত্তি করেছিলাম বলে কম জলঘোলা হয়নি। এই বয়সে আমি ওদের সঙ্গে পেরে উঠব না।

—মাস্টারমশাই, আমার একটা অনুরোধ ছিল। আমি খুদিরামের একটা বাঁধানো ফোটো দেব।  পতাকা তোলার সময় বেদির উপর অন্যান্যদের ফোটোর সঙ্গে ওটাও রাখতে হবে।

 —তা, রাখতে পারব। এতদিন কেবল নেতাজি, গান্ধিজি ও নেহেরুর ফোটো থাকত, এবার থেকে খুদিরামও থাকবে, ভালোই হবে।

    নন্তুবাবু এলেন। ধবধবে সাদা গাড়ি থেকে ধবধবে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত তিনি নামলেন, যেন পবিত্রতার প্রতিমূর্তি। তাঁকে স্বাগত জানিয়ে মঞ্চে নিয়ে গেলেন হেডমাস্টার স্বয়ং। মাইকে ঘোষিত হল, ‘বিশিষ্ট সমাজসেবী, মানবহিতৈষী, জনরদী মহান নেতা নন্তুবাবু … ।’ পতাকা উত্তোলনের আগে শুরু হল মাল্যদান পর্ব। একজন ছাত্রী হাতে মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সে নন্তুবাবুর হাতে একটি করে মালা তুলে দিচ্ছিল। নন্তুবাবু প্রথমে নেতাজি, তারপর গান্ধিজি,  তারপর নেহেরুকে মাল্য দান করলেন। এবার খুদিরামকে মাল্যদানের পালা। নন্তুবাবু যথারীতি  ছাত্রীটির হাত থেকে মালা নিলেন। তারপর খুদিরামের ফোটোতে মালাটি দেওয়ার জন্য নীচু হয়েই তিনি অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করলেন। তাঁর দীর্ঘ শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল, কেউ যেন তাঁর গলা ধরে ঝাঁকাচ্ছে। নন্তুবাবুর হাত থেকে মালা খসে পড়ল। দুহাত  দিয়ে তিনি নিজের গলা চেপে ধরলেন। জড়ানো গলায় বলতে লাগলেন, ‘ছেড়ে দে বাবা, এবারের মতো ছেড়ে দে, আর কোনোদিন এসব…।’ আর কিছু বোঝা গেল না। কারণ ঝাঁকুনি তখন মাত্রা ছাড়িয়েছে।

    একজন খুনি ও ধর্ষক নেতার অদ্ভুত রঙ্গ দেখে সমবেত ছাত্রছাত্রী ও এলাকার লোকজন হঠাৎ   সহাস্যে হাততালি দিয়ে ওঠে। কেউ খেয়াল করেনি প্রথম হাততালিটি দিয়েছিল এলাকার স্বঘোষিত  প্রেত-বিজ্ঞানী খ্যাপা স্বপন।

কলমে চন্দন মিত্র, ভগবানপুর (হরিণডাঙা)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here