পরাধীন ভারতের মাটিতে স্বাধীনতা এনে দেবার জন্য বহু বীর বিপ্লবীর আত্মবলিদান অবিস্মরণীয়। কিন্তু তাঁদের মধ্যে থেকেই অনেক মানুষ বিস্মৃতির গহ্বরে হারিয়ে যান। তৎকালীন ভারতবর্ষে স্বদেশী আন্দোলনে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও সমানভাবে এগিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু তাঁদের নাম আমাদের অনেকের কাছেই অজানা। তাঁরা যদি নিজেদের জীবন বিসর্জন না দিয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়াতেন তাহলে আজকের এই উন্নয়নশীল ভারতবর্ষ সেই তিমিরেই রয়ে যেতো। তবুও তাঁরা উপেক্ষিতা, তাঁদের নিয়ে কোনো বীরগাথা রচিত হয়নি।
ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যাওয়া একজন বীর নারী যোদ্ধার নাম ননীবালা দেবী— বাংলার প্রথম মহিলা রাজবন্দী।
জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৮৮ সালে হাওড়া জেলার বালিতে। বাবার নাম সূর্যকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, মা গিরিবালা দেবী। সেই সময়ের সামাজিক রীতি মেনে ১৮৯৯ সালে মাত্র এগারো বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় ১৯০৪ সালে তাঁর স্বামী মারা যান। তাঁর বয়স তখন মাত্র ষোলো। এরপর তিনি তাঁর বাবার কাছেই ফিরে আসেন।
১৯১৪ সালে বেঁধেছিলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। সেই সময় ভারতে যুগান্তর দলের বিপ্লবীরা জার্মানির কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ভারতব্যাপী একটা বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে স্বাধীনতা আনবার রাস্তা পরিষ্কার করতে চেষ্টা করছিলেন।
চারিদিকে চলছে তখন আহত ব্রিটিশ সেনার আক্রমণ ও নির্মম অত্যাচার। সেই অত্যাচারের ধরন ছিলো ফাঁসি, দ্বীপান্তর, পুলিসি নির্যাতন, নিত্য নতুন বীভৎস অত্যাচার। এইরকম অসহায় বিপদভরা দিনে, সম্পর্কে ভাইয়ের ছেলে বিপ্লবী অমরেন্দ্র চ্যাটার্জীর কাছে বিপ্লবের দীক্ষা পেলেন বাল্যবিধবা ননীবালা দেবী। দেশকে ভালোবেসে বিপ্লবীদের হয়ে তিনি নানা ঝুঁকিপূর্ণ কাজের দায়িত্ব নিতেন ও নিপুণ দক্ষতায় সে কাজ সম্পন্ন করতেন। অনেক কাছের মানুষও টের পেত না যে, তিনি বিপ্লবী দলের সক্রিয় সদস্যা। তিনি বিপ্লবীদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করতেন, এক জায়গার নেতাদের নির্দেশ ও নানা দরকারি খবর অন্য জায়গার বিপ্লবীদের কাছে পৌঁছে দিতেন। অস্ত্রশস্ত্র নিজের কাছে লুকিয়ে রাখতেন, আবার গোপনে বিপ্লবীদের কাছে পৌঁছেও দিতেন।
১৯১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারত-জার্মান যোগাযোগ এবং তার পরে বিভিন্ন ঘটনার খবর পেয়ে, সেই সম্পর্কে পুলিস কলকাতার “শ্রমজীবী সমবায়” নামে এক প্রতিষ্ঠানে তল্লাশি করতে যায়। তল্লাশির সময় অমর চ্যাটার্জী পলাতক হন এবং এক সঙ্গী রামচন্দ্র মজুমদার গ্রেপ্তার হন।
পলাতক অমর চ্যাটার্জী এবং তাঁর কয়েকজন সহকর্মীকে প্রায় দুই মাস আশ্রয় দিয়ে রাখলেন ননীবালা দেবী রিষড়াতে। এদিকে গ্রেপ্তারের সময় রামচন্দ্র মজুমদার একটা ‘মাউজার’ পিস্তল কোথায় রেখে গেছেন সে কথা দলকে জানিয়ে যেতে পারেননি। বিপ্লবীদের দরকার ছিল সেটির, কিন্তু কিভাবে সন্ধান জানা যাবে?
অতএব জেলে ঢুকে রামচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করে পিস্তলের খোঁজ আনতে চললেন দুঃসাহসী ননীবালা দেবী। সেদিনের সমাজে যা কেউ কল্পনা করতেও পারত না তাই করলেন তিনি। বিধবা ননীবালা দেবী রামচন্দ্র মজুমদারের স্ত্রী সেজে, তাঁর সঙ্গে প্রেসিডেন্সি জেলে দেখা করতে এলেন। ১৯১৫-১৬ সালে সে যুগে তখন বাঙালি বিধবাদের পক্ষে সিঁদুর মাথায় এরকম পরস্ত্রী সেজে জেলে গিয়ে পুলিসের কড়া দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে কাজ হাসিল করার কথা কেউ চিন্তাও করতে পারত না। পুলিস তো নয়ই, কোনো সাধারণ মেয়েও নয়। আজকের সমাজ ও সেদিনকার সমাজের মধ্যে আছে বিরাট ব্যবধান। বিধবা ননীবালা সধবার সাজে সিঁদুর পরে ঘোমটা দিয়ে রামচন্দ্রের স্ত্রী সেজে স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন জেলে। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পিস্তলের সন্ধান জেনে বেরিয়ে এলেন প্রেসিডেন্সি জেল থেকে।
পুলিস অনেক পরে জানতে পারল যে, ননীবালা দেবী রামচন্দ্র মজুমদারের স্ত্রী নন। কিন্তু এটা জানতে পারেননি যে, তিনিই রিষড়াতে ছিলেন আশ্রয়দাত্রী।
পুলিশের নজর এড়াতে ১৯১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চন্দননগরে আবার বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছিলো। তবে রিষড়ার মতো এখানেও মেয়েরা না থাকলে বাড়ি ভাড়া পাওয়া যেতো না। তখন আবার এলেন ননীবালা দেবী, গৃহকর্ত্রীর বেশে। এখানে এইসময়ে আশ্রয়দানের উদ্দেশ্যে তাঁর বড়পিসিকেও এনেছিলেন বিপ্লবী ভোলানাথ চ্যাটার্জী। এই বড়পিসি ও ননীবালা দেবী দুটো আলাদা বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে রেখেছিলেন পলাতক বিপ্লবীদের। পলাতক হয়ে আছেন সেখানে বিপ্লবী নেতা যাদুগোপাল মুখার্জী, অমর চ্যাটার্জী, অতুল ঘোষ, ভোলানাথ চ্যাটার্জী, নলিনীকান্ত কর, বিনয়ভূষণ দত্ত ও বিজয় চক্রবর্তী।
এইভাবে চন্দননগরের বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটি বাড়িতে তল্লাশি ও বিপ্লবীদের নিমেষে পালাবার পর ননীবালা দেবীকে আর চন্দননগরে রাখা নিরাপদ হলো না। কারণ পুলিস তৎপর হয়ে উঠেছিল ননীবালা দেবীকে গ্রেপ্তার করতে।
ননীবালা দেবী পলাতক হলেন। তাঁর এক বাল্যবন্ধুর দাদা প্রবোধ মিত্র কাজের জন্য যাচ্ছিলেন পেশোয়ার। বাল্যবন্ধু তাঁর দাদাকে অনেক অনুনয় করে রাজী করালেন ননীবালাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। ননীবালা দেবী পলাতক অবস্থায় তাঁর সঙ্গে পেশোয়ার গেলেন। এও এক অনন্য কাজ, এক বাঙালি বিধবা অচেনা এক পুরুষের সাথে কয়েক হাজার কিমি দূরে সম্পূর্ণ অন্য এক জায়গায় চলে গেলেন লুকিয়ে থাকতে! প্রায় ষোলো-সতেরো দিন পরে পুলিস সন্ধান পেয়ে যখন ননীবালা দেবীকে গ্রেপ্তার করতে পেশোয়ার গেছে, তখন ননীবালা দেবীর কলেরা চলছে তিনদিন ধরে। প্রথমদিন বাড়ি ঘিরে রেখে তার পরদিনই নিয়ে গেল তাঁকে পুলিস হাজতে স্ট্রেচারে করে। কয়েকদিন পেশোয়ার হাজতে রাখার পর একটু সুস্থ অবস্থায় তাঁকে নিয়ে আসা হয় কাশীর জেলে। একদিন দুইজন জমাদারনী ননীবালা দেবীকে একটা আলাদা সেলে নিয়ে গেল। দুজনে মিলে তাকে জোর করে ধরে মাটিতে ফেলে দিল। তারপর সমস্ত কাপড় খুলে নিয়ে দু’বাটি লঙ্কাবাটা ওঁর শরীরের ভেতরে দিয়ে দিতে লাগলো। ননীবালা দেবী চিৎকার করে লাথি মারতে লাগলেন সমস্ত শক্তি দিয়ে। অসহ্য, অসম্ভব, অসহনীয় এক বীভৎস জ্বালা, যার বর্ণনা করার ভাষা নেই। এভাবেই অত্যাচার চলত, তার পর আবার জেরা। এত অত্যাচার, শরীরের ভেতরে লঙ্কার জ্বালা, তবু তাঁকে ভাঙা সম্ভব হলো না।
কাশীর জেলে মাটির নিচে ননীবালা দেবীকে আলো-বাতাসহীন অন্ধকার সেলে তালাবন্ধ করে আটকে রাখা হতো। কবরের মতো সেলে আধঘণ্টা পরে দেখা যেতো, ননীবালা দেবীর অর্ধমৃত অবস্থা, তবু মুখ দিয়ে স্বীকারোক্তি বের করতে পারলো না। স্নায়ুর শক্তিকে চূর্ণ করে দেবার চূড়ান্ত প্রচেষ্টা। সেদিন তালা খুলে দেখা গেলো, ননীবালা দেবী পড়ে আছেন মাটিতে, জ্ঞানশূন্য।
হাল ছেড়ে দিয়ে পুলিস ননীবালা দেবীকে কাশী থেকে নিয়ে এল কলকাতা প্রেসিডেন্সি জেলে। ১৮১৮ সালের তিন নম্বর রেগুলেশনের ধারা প্রয়োগ করা হল তাঁর বিরুদ্ধে, প্রথম মহিলা রাজবন্দি হিসাবে প্রেসিডেন্সি জেলে এলেন তিনি। দুই বছর এইভাবে বন্দীজীবন কাটিয়ে দিলেন তিনি। ১৯১৯ সালের এক দিন ননীবালা দেবীর মুক্তির আদেশ এলো।
জেল থেকে ফিরে এসে বালিতে তাঁর পৈতৃক বাড়িতে তিনি ঠাঁই পেলেন না। প্রথমত সকলেই পুলিসকে ভয় পায়। এছাড়া বিধবা হয়েও পরস্ত্রী সাজা, পরপুরুষের সাথে একঘরে থাকা বা পেশোয়ার যাওয়া, এইসব কারণে সেই সময়ের সমাজের এক পক্ষ তাঁকে মেনে নেয়নি, মেনে নেয়নি তাঁর নিজের বাড়ির লোকেরা। অন্যদিকে তাঁর নিজস্ব বিপ্লবী সংগঠন বা চেনাজানা সবটাই ব্রিটিশ পুলিশের অত্যাচারে শেষ হয়ে গেছে, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। এই অবস্থায় তখন উত্তর কলকাতার এক বস্তিতে তাঁকে আশ্রয় নিতে হয়। (অন্য মতে, কোনো পূর্ব-পরিচিতের অনুগ্রহে একটি কুঁড়ে ভাড়া করেছিলেন হুগলিতে)। সমাজ এবং নিজের আত্মীয়-স্বজনদের ওপর রাগে, দুঃখে, অপমানে তিনি সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। নিজেকে একপ্রকার লুকিয়ে রাখলেন, এমনকি পরবর্তীকালের কোনো দেশনেতাদের কাছেও গেলেন না। যিনি সমাজকে উপেক্ষা করে দেশের কাজে নিজেকে বিলিয়ে দিলেন, তিনি কোথায় গেলেন সে ব্যাপারে কেউ জানতেও পারল না, খোঁজও করলো না।
দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় কুড়ি বছর পরে ১৯৬৭ সালের মে মাসে তিনি মারা যান। না, ইতিহাস তাঁর জন্মদিন বা মৃত্যুদিনের তারিখ মনে রাখার প্রয়োজনবোধ করেনি। কেউ মনে রাখেনি যাঁদের আত্মত্যাগের কথা তাঁদের দলেই ছিলেন বাংলার প্রথম মহিলা রাজবন্দী ননীবালা দেবী। তবে স্বদেশীদের নিয়ে তৈরি একটি বাংলা চলচ্চিত্রে (ছায়াছবির নাম ‘বিয়াল্লিশ’) তাঁকে নিয়ে কিছু দৃশ্য ছিলো, এইটুকুই। সামান্য একটা গোটা কাঁচালঙ্কা শুধু খেতে বললেই আমরা ভয় পাই। এইরকম দু’বাটি লঙ্কাবাটা তাঁর শরীরের গোপন জায়গার ভেতরে দিয়ে দেওয়া হয়েছিলো! কি অপরিসীম যন্ত্রণা তিনি সহ্য করেছিলেন, আমরা সুস্থ অবস্থায় কেউই তা অনুভব করতে পারবো না! উনিশ শতকের গোড়ার বিধবা মহিলা হওয়া সত্ত্বেও নিজ চেষ্টায় তিনি সামান্য লেখাপড়া শিখেছিলেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর কোনো ভাষা নেই, তবুও এই সামান্য প্রবন্ধের মাধ্যমে তাঁকে নিবেদন করছি অন্তরের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
কলমে সুপ্রিয়া মণ্ডল, চুনাপুর, মুর্শিদাবাদ
লিখতে খুব ভালবাসি; এছাড়াও কবিতা আবৃত্তি, গল্প পাঠ ইত্যাদিও অন্তরের অনুভূতি দিয়ে করি। লেখালেখির যাত্রাপথ সবে শুরু, আপনাদের সকলের আশীর্বাদ ও সমর্থন নিয়ে অনেক দূর চলতে চাই।
[…] অগ্নিকন্যা ননীবালা দেবী শতাব্দী, ভালো থাকিস […]
[…] অগ্নিকন্যা ননীবালা দেবী সৌন্দর্য শতাব্দী, ভালো থাকিস […]
[…] অগ্নিকন্যা ননীবালা দেবী অন্য ভারতবর্ষ সৌন্দর্য শতাব্দী, ভালো থাকিস […]