সেই কোন ছোটবেলায় তার বাপ মফস্বলের এই ছোট্ট রেলেস্টশন লাগোয়া ঝিলের ধারে ঝুপড়ি বানিয়েছিল তা আর তার মনে নেই ।মার কাছে শুনেছে সে তখন তিন বছরের । আগে থাকত শহর লাগোয়া রেলওয়ে সাইডিংয়ে ।পরে সেখান থেকে উঠে যেতে হয় ।তাদের আসল দেশ বিহার , গিরিডি। সেখানে অবশ্য কোনোদিন যায়নি । বাপ কাজ করত মিলে ঠিকা শ্রমিক । সে মিল কবে উঠে গেছে ! পরে এটা ওটা করতে করতে বন্ধুর পরামর্শে ঘর বাঁধে এখানে।একটা রিক্সাও কেনে ।বেশ যাচ্ছিল ।সেই সব দিনের কথা রাতে শুয়ে প্রায়ই ভাবে ছুপকলি ।বুকটা হুহুকরে কেঁদে ওঠে । বড় ভাল ছিল লোকটা ।সেও ছিল খুব বাপ সোহাগী । কিন্তু ঐ একটাই দোষ ।রাতে মদ গিলে বাড়ি ফিরত ।মদ খেলে অবশ্য তার ভালই লাগত ।এই সময় তার বাপ তার সব বায়নাক্কা মেনে নিত । সাজগোজের জিনিস…..! সত্যি , তার তিরিশ বছরের জীবনে যৌবনের দেখা মেলেনি ।রুগ্ণ অপুষ্ট শরীরে প্রায় সমতল বুকে কোনও অপটু শিল্পী কালো পাথরে খোদাই করে দিয়েছে কোমলতা হীন একটি মুখ ।কে জানে ! যদি তার বাপ অমন বেঘোরে ট্রেনে কাটা পড়ে না মরত তবে হয়তো তার জীবণ অন্য খাতে বইত ।তখন তার বয়স কতইবা হবে, বড়োজোর নয় ।কুঁড়ি অবস্থাতেই কঠিন বাস্তবের অভিঘাতে তার যৌবনে চড়া পরে যায় ।সে ভুলেই যায় যে সে একজন নারী ।যদিও তার শরীরে ঋতু নিয়ম মেনেই আসে অন্যান্য প্রাকৃতিক ক্রিয়া কম্মের মতোই ।
সে যখন খুব ছোট চু-কিত্ কিত্ বয়স , তখন বাবার সঙ্গে স্ট্যান্ডে ভাড়ার রিক্সা চালাত বুধি কাকা । প্রায়ই তাদের ঝুপড়িতে আসত । ওর জন্য এটা ওটা কিনে আনত । সেও ছিল ভীষন কাকুর ন্যাওটা ।প্রায়ই আদর করার আছিলায় খারাপ জায়গায় আঙুল খেলা করত । তখন না বুঝলেও এখন বোঝে ।কে জানে ! হয়তো কুঁড়ি অবস্থায় এই অকাল দংশনেই তার যৌবনের স্বাভাবিক গতিধারা রুদ্ধ হয়ে যায় । এই বুধা কাকাই বাবা মারা যাওয়ার পর বাবার রিক্সাটা ভাড়ায় নেয় ।মাসে মাসে টাকা দিত ।কিন্তু সে ওই বছর খানেক । তারপর টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয় । শেষে মাকে কিছু টাকা ধরিয়ে একরকম জোর করেই নিয়ে নেয় । বহু কষ্টে কেটেছে সেই সকল দিন ।
এখন সে  স্টেশন বাজারে একটা হোটেলে বাসন ধোয় আর সকাল সকাল দুটো ফাস্ট ফুড দোকানে জল তুলে দেয় । মা পাশের বাজারে এক কোনে মাছ কাটা বাছা করে ।ভালই চলে যায় দিন । তার এই তিরিশ বছরের জীবনে আর কখনও বসন্ত আসেনি । হঠাৎ কি এমন ঘটল যে রাতে ঘরের মাচার ওপর শুয়ে এপাশ ওপাশ নানান চিন্তার স্রোতে কিছুতেই ঘুম আসছেনা । তার পৃথিবীটা বুকের পাঁজরের ভেতর ছোট্ট থলিতেই সীমাবদ্ধ।এর বাইরে তার আর কোন চাহিদা আছে বলে মনে করে না । সে জানে , সে দেখতে খারাপ ।সাজলে আরোও কুৎসিত লাগে । আসলে তার সংক্ষিপ্ত যৌবন কখন বয়ে গেছে দেহে তা টেরও পায়নি ।গত সপ্তাহে এরকম ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা যে তার জীবনে ঘটতে পারে; তা কল্পনাও করেনি ।কি কুক্ষনেই যে ভোলাকে দেখতে গিয়েছিল ! আসলে দু দিন হল কাজে আসছে না ।শুনেছে ছেলেটার জ্বর ।ও থাকে ট্রেন লাইনের ওপারে ।তাই ভাবল, যাই একবার দেখা করে আসি ।রাতে কাজের পর হোটেলের কিছু বাড়তি খাবার নিয়ে দেখতে গিয়েছিল । চেনা পথ অন্ধকারে ফিরতে অসুবিধা হচ্ছিল না ।আসলে ভোলার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বেশ রাতই হয়ে গিয়েছিল ।তাতে আবার শীতকাল ।রেললাইনের এপারটায় লোকবসতি একটু কম । মোবাইলটায় ব্যাটারি কম ,চেনা রাস্তা তাই আলোর দরকার নেই । আচমকা এভাবে কেউ তার মুখে কাপড় পেঁচিয়ে টেনে নিয়ে যাবে সামনে খেলার মাঠে তা জীবনে কল্পনাও করেনি ।ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল ।মুখ দিয়ে শব্দ করারও শক্তি ছিলেনা । লোকটার গায়ে ছিল অসুর শক্তি আর তীব্র মদের গন্ধ । প্রায় অচেতন হয়ে পরেছিল ছুপকলি ।
লোকটা যেমন অন্ধকারে এসেছিল তেমনি অন্ধকারেই হারিয়ে যায় । অন্ধকারে ঠিকমত ঠাহর করতে পারেনি তবু কেমন যেন চেনা চেনা গন্ধ পাচ্ছিল। যাওয়ার আগে করকরে একটা নোট ধরিয়ে দেয় ।সেটা মুঠোয় দলা পাকাতে থাকে । আরো কিছুক্ষণ বসে ছিল ছুপকলি ।গলা শুকিয়ে কাঠ । প্রবল তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছিল । কোনওক্রমে টলতে টলতে ঝুপড়িতে ফিরে এক ঘটি জল খেয়ে বালতি বালতি জল ঢেলে  স্নান করেছিল ।মা শব্দ পেয়ে জিগ্যেস করেছিল, ” কলি , আবাথই ? ইতনা রাত ! নাহা রহা হ্যায় ক্যা ? ভাত খা লেনা।”
কোন জবাব দেয়নি কলি ।শুধু বিরক্তি দেখিয়ে বলেছিল ,”তু শো যানা ! “
সে রাতে আর কিছুই খায়নি । শুয়ে পড়েছিল । তার খুব কান্না পাচ্ছিল ।
   পরদিন সকালে কাজে বেরিয়ে তার কেবলই মনে হতে লাগল এই বিশ্বসংসার সবাই তাকে দেখছে বিদ্রূপের চোখে । গোপনে চোখের জল মুছেছে ।প্রায় দু দিন লেগেছিল ট্রমা কাটাতে ।তারপর এল ভয় ।যদি তার পেটে এসে যায় অবাঞ্ছিত সন্তান !
         আর এখন ! ঘটনার এক সপ্তাহ পর বিছানায় শুয়ে এসব কি হিজিবিজি ভাবছে ছুপকলি ! সে কি ক্রমশ পাগল হয়ে যাচ্ছে ? দিনরাত চোখের সামনে ভাসছে একটা কচি মুখ ।ছোট্ট শিশু -তাকে আদর করবে , চটকাবে , চুমু খাবে, বুকের দুধ দেবে , আধো আধো বুলিতে তাকে মা ডাকবে ….ধ্যাত্ এসব আবার হয় নাকি ! কেন হয়না , হলে বেশ হয় ।সে তার মা আর ছেলেকে নিয়ে চলে যাবে দুরে কোথাও অন্য কোনখানে ।শুরু করবে নতুন জীবন ।সে তো কোনওদিন পুরুষের ভালবাসা পাবেনা ।স্বামী পাবে না ।সংসার পাবে না ।না হয় পাবে সন্তানের ভালবাসা ।তার ভবিষ্যতের সাহারা । আর একটা ব্যাপার ভীষন টের পায় ছুপকলি । কে যেন পাথরের শক্ত দেওয়াল ভেঙে দিয়ে মুক্ত করেছে নির্ঝরিনী । রাতে ঘুম আসেনা । রাতের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া মানুষটার জায়গায় অন্য পরিচিত মানুষদের বসিয়ে কিসব উল্টোপাল্টা ভাবে । তবে ঠিক ওরকম নয় বরং সোহাগে সোহাগে খুলে দিক পাপড়ি । অনাবাদি জমিতে মাটির কর্ষণে ছড়িয়ে দিক বীজ ।

                 ***

অবাক হয়ে যায় ছুপকলি । এ কোন জায়গা ! চারপাশে টিলা দুরে পাহাড় জঙ্গল । এ কাদের দেখছে ! সবাই তার মত অসুন্দর কদর্য রুক্ষ । ঐ তো তার মা ! পাশে কালো ল্যাংটো ছেলেটি কে ? হামাগুড়ি দিচ্ছে ।তার ছেলে ? কিন্তু ঝুপড়ির পাশে মদ গিলে বসে আছে কে লোকটা কে ? তার বাবা ? না …….
         -এ কলি , জলদি ওঠ ! কামমে কব যাওগে ? ইদনা বেলা তক্ নিদ রহে ।
ঘুম ভেঙে যায় কলির ।সে তাহলে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল ! উঠতে গিয়ে মাথা টাল খেয়ে যায় ।দ্রুত দৌড়ে যায় ।হড়হড় করে বমি করে ফেলে ।

কলমে আশিস ভৌমিক, পূর্ব মেদিনীপুর

SOURCEকলমে আশিস ভৌমিক
Previous articleবড় সেইজন
Next articleভা ই রা স
Avatar
Disclaimer: Monomousumi is not responsible for any wrong facts presented in the articles by the authors. The opinion, facts, grammatical issues or issues related sentence framing etc. are personal to the respective authors. We have not edited the article. All attempts were taken to prohibit copyright infringement, plagiarism and wrong information. We are strongly against copyright violation. In case of any copyright infringement issues, please write to us. লেখার মন্তব্য এবং ভাবনা, লেখকের নিজস্ব - কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত..................

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here