ডে ওয়ান —– বেলা ১:৩০
” মা তোমার কি হয়েছে ..কথা বলছনা কেন ..কোথায় কষ্ট হচ্ছে মাগো আমাকে বল …”
মিতা কথাগুলো বলে যায় কিন্তু মানুষটা একভাবে পাশের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে ..যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছেনা l হঠাৎ ডান হাতটা কাঁপতে কাঁপতে উপরের দিকে উঠছে , মিতার মনে হয় এবার হয়ত কিছু বলতে চাইছে ….কিন্তু না ….মা এরকম করছে কেন ..ডান হাত ভীষণ জোরে কাঁপছে …সাথে ডান পা …মুখটা অসম্ভব লাল যেন সাড়া দেহের রক্ত এসে জমেছে …মুখ যেন বেঁকে যাচ্ছে .ঠোঁট দুটো থর থর করে কাঁপছে ..দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে ..চোখ দুটো স্থির ….l
মিতা ঘটনার আকস্মিকতায় কি করবে বুঝতে পারেনা ..কয়েক সেকেন্ড ..তারপর চেঁচিয়ে ওঠে ..” রিনি শিগগির নিচের দিদাকে ডাক আর শর্মীমাসিকে ফোন কর, বল হসপিটালে ফোন করতে l নিচের কাকিমা এসেই মায়ের অবস্থা দেখে হয়ত কিছু না বুঝেই পায়ের তলা ঘষে দিতে থাকেন.. মিতা মায়ের হাত চেপে ধরে রাখার চেষ্টা করে ..আর পাগলের মত বলে চলে ” কাকিমা মায়ের কি হল বলতো …মা আর বাচঁবেনা তাইনা ..!!!” l
ডে টু —- রাত ১২:৩০
আজ হসপিটাল থেকে ফেরার সময় রিনিকে সুপর্ণার বাড়িতে রেখে এসেছে মিতা l সুপর্ণার মেয়ে এষা আর রিনি এক স্কুল এক ক্লাস ..রিনি ওদের বাড়িতে খুব ভাল থাকে l ভাই সকালে চলে এসেছে ..গতকাল নতুন চাকরি জয়েন করেছে ও আর প্রথমদিনই এই দুঃসংবাদ দিতে হল, যদিও গতকাল মিতার মেজমাসি ,মাসতুতো বোন আর বড়মাসির মেয়ে আর জামাই সকলেই চলে এসেছিল হসপিটালে আর মিতা গত কয়েক বছরে মায়ের অসুস্থতা আর হসপিটাল সামলিয়ে এখন আর সেরকম ভয় কিছু পায়না , তবে গতকাল মার সিজার ওকে এবার বেশ ভয় পাইয়ে দিয়েছে ..সবাই বলেছে ভাইকেও ডেকে নিতে তাই …,মিতা ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিয়ে এসব ভাবছিলো …আজ আই সি ইউ এর বেডে মাকে পাশ ফিরে শোয়ানো হয়েছে …সবরকম টেস্টের রিপোর্ট চলে এসেছে তবে ব্রেইন স্ক্যান এর রিপোর্ট আগামীকাল পাওয়া যাবে , এখনো কিছু বোঝা যাচ্ছেনা …ডক্টর এটাই বিকেলে জানিয়েছেন l গত কয়েক বছর ধরে মায়ের রক্তের একটি বিশেষ রোগের চিকিৎসা চলছে ..যে রোগের ডাক্তারি পরিভাষায় নাম অটোইমিউন হিমোলাইটিক আনিমিয়া কিন্তু সে রোগের এরকম সিম্পটম আছে বলে জানা নেই , আবার এদিকে সেরিব্রাল স্ট্রোক ও হয়নি …অন্তত রিপোর্ট তাই বলছে …তাহলে কি হতে পারে …এসব ভাবতে ভাবতে কখন যেন দুচোখের পাতা এক হয়ে যায় ….l
ডে থ্রি — বেলা ১১:৩০
মোবাইলটা অনেক্ষন ধরে বেজে চলেছিল ….মিতা রান্নাঘরে ছিল তাই শুনতে পায়নি …ঘরে ঢুকতেই রিংটোনের আওয়াজ ….স্ক্রিনে লেখা ‘ ভাই ‘ …বুকটা এক অজানা আতঙ্কে কেঁপে উঠল যেন …কিন্তু মিতা কেন ভয় পাচ্ছে …..মায়ের অসুস্থতা হসপিটাল এসবে ও এখন অভ্যস্ত , হয়ত জ্ঞান ফিরেছে এসব ভাবতে ভাবতে মোবাইলটা হাতে তুলে নিয়ে রিসিভ বাটন প্রেস করে …” কিরে কি খবর স্ক্যান রিপোর্ট এসেছেকি …ডক্টর কি বললেন ..!!!” এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে মিতা দম নেয় …l এবার ওপার থেকে ভাইয়ের শান্ত গলার স্বর “হ্যা রিপোর্ট এসেছে ,ডক্টরের সাথেও কথা হল … মায়ের ‘Brain Cancer last stage'” , বলে ও চুপ করে যায় …মিতার মনে হয় ও হয়তো ভুল শুনছে …বলে ওঠে “ডক্টর সিওর ,এই ডক্টর কি ‘Cancer specialist… কিছু একটা বলে দিলেই হল ..আসলে বুঝতে পারছেনা …”
ওপার থেকে উত্তর এল ” আমি বাড়ি ফিরে কথা বলছি ….রাখছি ” l
মিতা মোবাইল হাতে নিয়ে বিছানায় বসে পরে , cancer এই শব্দটা নিয়ে ও নিজেও পড়াশুনো করেছে M.Sc. তে ..এর cause… Genetic analysis at molecular level…proto-oncogene, oncogene…সবকিছুই সে পড়েছে , কিন্তু শব্দটার বাস্তব রূপ নিজের জীবনেই প্রতক্ষ্য করতে হবে এটা কখনো দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি …মাথাটা শুন্য মনে হয় …জানেনা কতক্ষন ..আবার মোবাইলের শব্দে ওর সম্বিৎ ফেরে , মেজমাসির ফোন ,মিতা জানায় ভাই ফেরেনি ফিরলে সব জানা যাবে l
মায়ের স্ক্যান রিপোর্ট ..Metastatic Brain Tumor….লেখাগুলো কেমন ধূসর হয়ে আসছে , সন্দীপ বলে চলে ” ডক্টর বলেছেন last stage এখন আর কিছু করার নেই ..ওনাকে বাড়ি নিয়ে যান , যে কদিন আছেন বাড়িতেই রাখুন ” ….মিতা যেন ঘোরের মধ্যে আছে …যা শুনছে সেটাকি আদেও সত্যি হতে পারে ..কি করে ..মিতা আর ভাবতে পারছেনা …
চলবে .. দ্বিতীয় পর্ব >>
লেখিকা পরিচিতি : জয়িতা সুর সরকার, উত্তরবঙ্গ,শিলিগুড়ি (M Sc in Botany and B.Ed.from NBU)। একজন ফ্রিল্যান্স রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট এবং “সমর্পন- Samarpan the joy of sharing” NGO এর সাথে যুক্ত।লেখালেখির সূত্রপাত ২০১৪ সাল থেকে , তবে লেখালেখি নিয়ে বিশেষ ভাবে ভাবনাচিন্তা ২০১৮ সাল থেকে। লেখালেখি এখন আবেগের অনেকটা অংশ জুড়ে আছে।
পরবর্তী পর্ব : ক্রমশঃ >>
[…] << প্রথম পর্ব . তৃতীয় পর্ব >> […]