ফিতে

0
1449

প্রজাপতিটা কি  সদ্য ওড়া শিখেছে? ওরকম ঘুড়ির মতন ওলোট পালোট উড়ছে কেনো ? আচ্ছা কতটা দূরে আছে প্রজাপতিটা? মনে মনে মাপলো বিরাজ , প্রায় ১০০ সেমি দূরে ওর থেকে প্রজাপতিটা। এই এক খারাপ অভ্যাস ওর সব কিছু মাপতে চায় ও। একটু অন্যমনস্ক দেখে মিন্টু ওকে প্রশ্নটা করলো, “কোথায় হারিয়ে গেলি রে ?”  আরো খানিকটা অন্যমনস্ক ভাবে উত্তরটা দিলো বিরাজ  এই ১০০ সেমি দূরে এবার বাকিরাও তাকালো ওর দিকে এই উত্তর শুনে। বিরাজ যে প্রজাপতি টাকে মুগ্ধ হয়ে দেখছে, আর ওটা কতটা দূরে আছে সেটা মাপছে এটা বুঝে সবাই হো হো করে হেসে দিল। সবাই বলতে মিন্টু, তমোঘ্ন, তৃষা আর মধুরিমা। ওদের এই পাঁচ জনের গ্রুপ। তমোঘ্ন হাসি থামিয়ে প্রশ্ন করলো বিরাজকেএই এক ব্যামো, এটা আর ঠিক করা গেলনা। তা কোনো মেয়েকে চুমু খেতে গেলেও বুঝি, ঠোঁটের মাঝের দূরত্ব মাপবি ?” বিরাজ কটমট করে তাকালো ওর দিকে। এই মজা গুলো একদম পছন্দ না বিরাজের। বিরাজকে রাগতে দেখে তমোঘ্ন জিভ কেটে বললোসরি ভাই” , বলে খিলখিল হাসিটা থামিয়ে মুচকি হাসতে লাগলো। বিরাজের আর কিছু ভালো লাগছে না, কেমন যেনো মন মরা ভাব। মধুরিমা পাশেই বসে সব শুনছিল আর সবে সিগারেট টা ধরিয়েছে, বিরাজ এক টানে ওটা নিয়ে নিল। মধুরিমা কিছু বলতে গিয়েও বললো না, হাসলো শুধু অল্প। ভালো আর খারাপ একসাথে লাগা একটা ভারী অদ্ভুত জিনিস। এখন সেটাই হচ্ছে বিরাজের সাথে। কারণ জানেনা তবু মন টা খারাপ ভালোর মাঝে যেনো ঝুলে আছে। বৃষ্টি হবে মনে হয় আজ। বঙ্গ কলেজের  বিরাট মাঠটায় বসে আকাশটা একবার দেখলো ও। ঠিক তখনই মধুরিমার গলাটা শুনলো বিরাজআজ একবার আমাদের বাড়ি আসবি? কিছু দেখানোর আছে তোকেমধুরিমার দিকে তাকালো বিরাজ, ঘাড় অবধি এসে অদ্ভুত একটা ঢেউ আছে ওর চুলে, একটাউত্তর চাইমার্কা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে মধুরিমা। মধুরিমার ভালো লাগে বিরাজকে, সেটা সবাই জানে। তৃষা ইচ্ছা করে সবাইকে শুনিয়ে আবার বললকিছু একটা দেখানোর আছে মধুরিমার ফরসা মুখটা অল্প লাল হয়ে গেলো, বাকি সবাই একসাথেওওওওকরে চেঁচিয়ে উঠলো তখনই। মধুরিমার লাল মুখটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বিরাজ বললোইসস বেচারি” , সবার দিকে একটা ধমকের সুরে বললতোরা থামবি?” মিন্টু বলে উঠলোআরে ভাই রাগলে চলে” , বিরাজ এবার মধুরিমার হাতটা ধরে টেনে তুললো ওকে আচমকা।চল তো মধু, এই অসভ্য গুলোর সাথে থাকিস না মধুরিমার হাত ধরে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে এলো বিরাজ। যেতে যেতেই পিছনে শুনতে পেলোমানাচ্ছে বস তোমাদের মাঠটার বাইরে যে বড়ো বকুল গাছটা আছে তার সামনে এসে থামলো ওরা। মধুরিমা বললআজ আসবি প্লিজ? ,এমনিতেও তো অনেকদিন আসিসনা, আজ একবার আয়, আসতেই হবে  মধুরিমার কথায় কিছু একটা ছিল, বিরাজ বললআচ্ছা আসবো, পাক্কা টার সময়

মধুরিমা চুল ঠিক করতে করতে বললমনে করে কিন্তু বিরাজ হেসে বললপাক্কা, এখন আসি একটা কাজ আছেমধুরিমা বাই বলে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। বিরাজ চলে এলো। যেতে যেতেও একবার পিছনে ফিরে তাকালো , মেঘলা দিনেও অল্প একটু রোদ যেনো ঠিক মধুরিমার মুখে এসে পরেছে। মিষ্টি করে হাসছে তাকিয়ে। বিরাজ চলে এলো। মেঘলা দিন, একটুকরো রোদ, অল্প ঢেউ খেলানো চুল, মিষ্টি একটা হাসি সবাইকে পিছনে রেখে চলে এলো ও।

কাজটা মিটিয়ে বাড়ি আসতে আসতেই চারটে বেজে গেলো। ঘরে ঢুকে হোম থিয়েটার  টা চালিয়ে জানলা টা খুলে দিলো ও। “blowin in the wind” চলছে। শান্ত , নিস্তেজ একটা রোদ ঘরে ঢুকে এলো ওর। মধুরিমার মুখটা মনে পড়ে গেলো ওর। আগে তো কখনো হয়নি এমন। তবে কি ? … লিপিকা ছেড়ে যাওয়ার পর আর এসব নিয়ে ভাবেনি কখনো বিরাজ। কারোর  কাছে আসতে কেমন যেনো ভয় করে ওর। মধুরিমা ভালো মেয়ে, সেই কলেজের প্রথম দিন থেকে ভালোবাসে ওকে। ভালোবাসে কথাটা নিজের কাছেই কেমন যেনো শোনালো বিরাজ এর। মধুরিমা কখনো তো কিছু ফেরত চায়নি ওর কাছে থেকে। একটানা ভালোবেসে গেছে। তাহলে কি মনে মনে বিরাজ ?…. কোথাও কি ওর মনেও ভালোবাসা আছে ওর জন্য? একজনের একটানা ভালোবাসা কি আর একজনের মনেও ভালোবাসার জন্ম দিতে পারে? বিরাজের মনে পরে গেলো সরস্বতী পুজোতে হলুদ শাড়ি পড়েছিল মধুরিমা। কিন্তু বিরাজের কেনো মনে আছে এটা? ভালোবাসা সত্যিই অদ্ভুত। বাইরের আকাশে দুটো ঘুড়ি উড়ছে। একটা কালো আর একটা সাদা। ঠিক যেনো ভাল আর খারাপ। ঘুড়ি গুলো কতটা দূরে ওর থেকে? না সেটা মাপতে আর ইচ্ছা করলো না বিরাজের। সব কিছু মাপা যায়না। বব ডিলান থেমে গেছে ততক্ষনে। ঘড়িতে দেখলো বিরাজ। টা বাজে। একটু বিশ্রাম দরকার। ঘড়িতে .৩০ এর অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো ও।

অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলো ও। একটা বিশাল ক্যাকটাস, আর তার মধ্যে একটা ঘুড়ি আটকে আছে। বিরাজ প্রাণপণে সেটা টানছে। ছাড়াতে চাইছ। কিন্তু যত চেষ্টা করছে, নরম ঘুড়িটা তত ছিড়ে যাচ্ছে। ঘুড়িটা কি রঙের?… সেটা বোঝার আগেই ঘুমটা ভেঙে গেলো বিরাজের। অ্যালার্ম এর আওয়াজে ঘুম টা ভেঙেছে। .৩০ বাজে পুরো। এমন অদ্ভুত স্বপ্ন আগে দেখেনি কখনো ও। তাড়াতাড়ি উঠে পরলো ও। রেডি হয়ে নিল। তারপর সারা পাড়া বিখ্যাত ওর হলদু রঙের স্কুটারটা নিয়ে রওনা দিলো মধুর বাড়ির দিকে।

দুবার ধাক্কা দেওয়ার পর দরজা খুললো মধুরিমা।যাক এলি তবে, আয় ভিতরেবলে সরে দাড়ালো মধুরিমা। জুতো খুলে ঢুকে এলো বিরাজ।আমার রুমে গিয়ে বস , আমি আসছিএটা বলেই মধুরিমা পাশের ঘরে চলে গেল। মুখের হাসিটা নজর এড়ালো না বিরাজের। বোকা মেয়েটা খুশি হয়েছে খুব, বুঝল বিরাজ। মধুরিমার রুম কোথায় সেটা বিরাজ জানে। সামনের ঘরটা টপকে দান দিকের ছোট্ট ঘরটায় গিয়ে বসলো ও। সুন্দর করে সাজানো ঘরটা। বেশিক্ষণ না , পাঁচ মিনিট পরেই মধুরিমা এলো। হাতে একটা জুসের গ্লাস।জানিস তো আমি রান্না বান্না পারিনা, আর বাড়িতে কেউ নেই , এটাই খা তাইবলে গ্লাস টা এগিয়ে দিলো ও। ওর হাত থেকে গ্লাস টা নিয়ে একটু হেসে বিরাজ বললবেশি নেকামি করিসনা , আমি কি বাইরের লোক নাকিকথাটা বলে বিরাজ নিজেই ভাবলো সত্যিই কি ভিতরের লোক নাকি?…

কোথায় গেছে সবাই?” জুস টা শেষ করে , গ্লাসটা নিচে নামিয়ে রাখতে রাখতে  প্রশ্ন টা করলো বিরাজ। সামনের টেবিল হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ছিল মধুরিমা।মাসী বাড়ি গেছে, আজ রাতেই ফিরবেএকটা ছাইরঙা টিশার্ট পরে মধুরিমা। সুন্দর লাগছে ওকে।  কি এমন সুন্দর ছিল? নাকি আজ একটু বেশি? বিরাজ বুঝল না।আচ্ছা কি একটা দেখবি বলেছিলি, কই?” জানলা থেকে আবছা একটা রোদ ঢুকেছিল ঘরে, সেটাকে একপাশে রেখে মধুরিমা বিছানার পাশের আলমারির কাছ গেলো। আলমারিটা খুলে বার করলো একটা কাঠের বাক্স। তার ভিতর থেকে আরো একটা জিনিস।

দুটো প্রজাপতি জানলার বাইরে উড়ছে, খুব সুন্দর লাগছে ওদের। মাঝে মাঝে ওরা একে অপরকে ছুয়ে যাচ্ছে। মিষ্টি লাগছে খুব। বিকেল শেষ হয়ে এসেছে। পুরনো টর্চের নিভু নিভু আলোর মতন বাইরের আকাশে অল্প আলো লেগে আছে। শহরটাকে একটা নরম আভায় ঢেকে রেখেছে যেনো কেউ। বিরাজ বসে আছে বিছানায় , আর সামনে মধুরিমা। শান্ত দেখাচ্ছে ওকে। অনেক কথা একসাথে বলার পর মানুষ যেমন শান্ত হয়ে যায় অল্প, সেরকম ঠিক। বিরাজের পাশে রাখা কাঠের একটা ছোটো বাক্স। একটি আগেই যেটা আলমারি থেকে বের করলো মধুরিমা। প্রথমে বিরাজ বোঝোনি কি ওটা। একটা হালকা লাল রঙের কাপড় কি? একটু পরেই বুঝলো, ওটা একটা ফিতে। চুলের ফিতে। একটু অবাক হয়েছিল বিরাজ। এটা দেখাতে ডেকেছে মধুরিমা ওকে? মধুরিমার হাতে দিল ফিতেটা। আর বললোএটা তোকে দিলাম হাতে নিয়ে বিরাজ বুঝলো এটা এমনি ফিতে না। অদ্ভুত কায়দায় জট পাকিয়ে তৈরি। একটা ঘাড়ে আর একটা সুতো যেনো অদ্ভুত ভাবে ঢেউ খেলে মিশেছে। ওটা হাতে নিয়ে বোকার মতন মুখ করে বসে ছিল বিরাজ। তখন ফিতের গল্পঃ বলা শুরু করলো মধুরিমা। কিভাবে ওর ঠাকুরদার বাবা জাপানের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েকে প্রাণে বাঁচিয়েছিল, আর তার জন্যই ওখানের এক মন্দিরের এই ফিতে নাকি উপহার পায় উনি। তারপর থেকে ওদের পরিবারে এটা থাকে। মধুরিমা আরো বললো কিভাবে ওর ঠাকুমা ওকে শেষের দিন গুলোয় এই ফিতেটা দিয়ে বলেছিলেনযাকে সব থেকে বেশি ভালবাসবি, তাকে এটা দিবি, এটাই নিয়ম, সে যে কেউ হোকসব শুনলো বিরাজ। মধুরিমা মাথা নামিয়ে বললোতুই জানিস এটা কেনো দিচ্ছি তোকে, আজ থেকে এটা তোর , এটা কাছে রাখা শুভ খুবআরো আওয়াজ টা নামিয়ে বললতোর ইচ্ছা হলে তুই অন্য কাউকে দিতে পারিস এটা।বিরাজ তাকিয়ে রইলো ফিতে টার দিকে মানুষ কি সত্যিই বোঝে কাকে চায় সে? কর সাথে কর মন অদৃশ্য ফিতে দিয়ে বাঁধা , সেটা কি জানে কেউ? নাকি সেটা বোঝাতে দরকার হয় এমন বিকেলের , এমন একটা মুহূর্তের। বিরাজের মন তখন একটা নরম পালকের মতন। অপ্রতিরোধ্য যেই দেওয়ালে নিজেকে আটকে রেখেছিল এতদিন, এবার বুঝলো সেটা ভেঙে পরবে। সেই বিকেলকে সাক্ষী রেখে, ওই দুটো প্রজাপতি কে সাক্ষী রেখে, বিরাজ ঠিক সেটাই করলো যেটা ওর করা উচিত। উঠে গিয়ে মধুরিমার পিছনে দাড়ালো। মধুরিমা কিছু বলার আগেই দুটো হাত সস্নেহে ওর চুলে জড়িয়ে দিতে লাগলো ফিতেটা। অজান্তেই

বিরাজের হাত মাঝে মাঝে মধুরিমার ঘাড় ছুয়ে যাচ্ছে, ঠিক ওই প্রজাপতিদের পাখা ছুয়ে যাওয়ার মতন মিষ্টি সেটা। বিরাজ বুঝলো সব কিছু সত্যিই মাপা যায়না। ভালোবাসা তো না ই। মধুরিমার সামনে এসে বসলো বিরাজ , আর আস্তে করে বলল  ঠিক বুঝেছি এতদিনে, আর ওই ফিতেটা এখন তার কাছেই আছে যাকে আমি ভালবাসি” , মধুরিমার চোখের এক বিন্দু জল টা ঢেকে দিলো ওর মুখের সুন্দর হাসিটা। হাসি খুব ছোয়াচে , বিরাজ হেসে দিল ওকে দেখে। মধুরিমা একবার তাকালো বিরাজের দিকে, বিরাজেরও দৃষ্টি স্থির। একটু কাছে এলো ওরা। মাঝের দূরত্ব টা কমলো ওদের। ঠিক কতটা কাছে এসেছিল ওরা? বিরাজ মাপেনি আর।

কিন্তু বিরাজ স্পষ্ট বুঝলো দুটো প্রজাপতি উড়ছে তখনও। ছুয়ে যাচ্ছে ওকে। নরম একটা স্পর্শ।

 

লেখক পরিচিতি : রোহিত দত্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here