সাল টা ছিলো 2012 । সদ্য মা কে হারিয়েছি ফেব্রুয়ারী মাসের 27 তারিখে । মনটা সবসময় থাকতো বেদনাচ্ছন্ন । চোখ মাঝে -মাঝেই হয়ে উঠতো সজল। মোবাইল টার দিকে তাকিয়ে কান্না পেতো। আর কখনো মায়ের গলার স্বর শুনতে পাবো না। “সোনা মা” বলে কেউ ডাকবে না। কিন্তু জীবন চলে তার ছন্দে। এইমতো অবস্থায় আমার স্বামীর পোস্টিং হলো নয়ডা অফিসে। এবার তল্পি- তল্পা গুটিয়ে জব্বল্পুর কে বিদায় জানাবার পালা। ভরাক্রান্ত মনে, বন্ধু-বান্ধবদের কাছে বিদায় নিতে-নিতে, এগিয়ে এলো যাবার দিন। পৌঁছলাম নয়ডা।
প্রথমে উঠলাম অফিসের গেস্ট হাউস। এরপর শুরু হলো ছেলে মেয়ে কে স্কুলে ভর্তি করার যুদ্ধ এবং বাড়ি খোঁজার পালা। ছেলে-মেয়ে দুজনে নয়ডা DPS স্কুলে এ ভর্তি হয়ে যাওয়াতে আমরা নিশ্চিন্ত হলাম।
গরিমা-বিহার বলে একটি জায়গায় বিকেলে একটি বাড়ি দেখতে গেলাম । বাড়িটি একটু নিরালায়। গাছ -গাছালি দিয়ে ঘেরা। আমাদের সবার পছন্দ হল।বাড়িটি তে একটি সুন্দর লাগোয়া ছাদ ছিল। আমার ও ছেলে- মেয়ের মনময়ূরী আনন্দে নেচে উঠলো, ছাদের বড় দোলনাটি দেখে । আমাদের বহু দিনের ইচ্ছে ছিলো এরকম একটি দোলনা থাকবে বাড়িতে।
পাঁচ দিনের মাথায় ট্রাক আমাদের মালপত্র নিয়ে পৌঁছালো । আমরাও বাড়ির মালিকের কাছ থেকে চাবি নিয়ে, গেস্ট হাউস ছেড়ে, চলে এলাম বাড়িটিতে। ঢুকতেই কেমন যেন একটা হিমশীতল হওয়া বয়ে গেল। ভাবলাম উত্তর খোলা বাড়ি, ভালোই হল। নয়ডার গরমের হাত থেকে বাঁচবো ।
সব কিছু গুছিয়ে শুরু হলো দৈনন্দিন জীবন। বাড়িটা কিন্তু অদ্ভুত ঠান্ডা। মাঝে- মাঝে মনে হতো একটা আঁশটে গন্ধ আমার চারিদিকে ভেষে বেড়াচ্ছে। গা গুলিয়ে উঠতো । কর্তা কে বললে সে হেঁসে উড়িয়ে দিতো। বলতো, এটা কোনো বুনো গাছের কিংবা লাগোয়া নালীর গন্ধ।
সকালে স্বামী ও ছেলে মেয়েরা বেরিয়ে যাবার পর ভীষণ একটা ভয় আমাকে জড়িয়ে ধরতো। একদিন রান্নাঘরে আচমকা খালি কড়াই তে দাউ-দাউ করে আগুন জলে উঠলো l কর্তা বাড়িতে ফিরতেই, বললাম ব্যাপারটা। সে বললো, নিশ্চই তুমি ভুলো মনে তেল দিয়ে চলে গেছিলে, সেই জন্য এই ঘটনা। সাবধানে কাজকর্ম করো। তোমাকে একটা অযথা ভয় পেয়ে বসেছে।কিন্তু আমার পরিষ্কার মনে আছে যে আমি ভেজা কড়াই জল শুকবার জন্য গ্যাসের ওপর রেখেছিলাম, তাও আবার অল্প আঁচে। আমি মন কে বোঝালাম হয়তো কিছু একটা ভুল আমারই হয়েছে । আমাকে অদ্ভুত একটা ভয় পেয়ে বসেছে। মন কে শক্ত করতে হবে।
পরের দিন সন্ধেবেলা ছেলে মেয়ে দুজনে নিজেদের স্কুলের কাজে ব্যাস্ত। আমি ছাদে এলাম। দোলনাটা আধো আলো ছায়ায় ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে দুলে উঠলো। অবাক চোখে তাকালাম। কোনো হাওয়া বাতাস নেই। দোলনায় বসতে গেলাম । মনে হলো কে যেন জোর করে ধাক্কা মেরে তুলে দিলো। ভয়ে এক ছুট্টে নিচে চলে এলাম।
একদিন ঠিক হলো, সবাই মিলে বাইরে একটু খাওয়া দাওয়া করবো। মুখ হাত ধুতে বাথরুমে গেছি। হটাৎ মনে হলো আয়নার ভেতর দিয়ে একজোড়া হিংস্র চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার চিৎকারে সবাই ছুটে এলো। কিন্তু ততক্ষনে সব স্বাভাবিক। জানিনা কেনো, এগুলো শুধু আমার সাথেই ঘটছিলো। কর্তা কে বলতে শুরু করলাম বাড়ি বদলাবার কথা। সবে এতো ঝক্কি- ঝামেলা পুইয়ে, নিজেদের থিতু করা হয়েছে ,বাড়ি বদল করার কথা উনি কানে তুলতে নারাজ।
মাঝে মধ্যে মনে হতো কেউ যেন আমার পেছনে দাঁড়িয়ে। বরফ ঠান্ডা একটা নিঃস্বাশ পড়ছে আমার ঘাড়ে। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ালে কাউকে দেখতে পেতাম না। আস্তে আস্তে আমি যেন কিরকম হয়ে যাচ্ছিলাম- রুগ্ন, জুবু -থুবু। আমার কর্তা ,আমার অবস্থা দেখে আমাকে ডক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। আমাকে কিছু টনিক জাতীয় ঔষুধ দিলেন উনি । দিনে যেমন তেমন, সন্ধ্যা হলে আমি নিস্তেজ হয়ে পড়তাম। রাতে বাথরুম যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেলো। যেতে হলে কর্তা কে ডাকতাম। উনি বিরক্ত হলেও, মুখে কিছু বলতেন না। ছেলে মেয়ে কিন্তু মাঝে –মাঝে ছাদে গিয়ে দোলনা দুলতো , হুটোপাটি করতো। শুধু আমি দোলনায় বসতে গেলেই একটা আঁশটে মরা মাছের গন্ধ আমাকে ঘিরে ফেলতো। আমি থাকতে না পেরে চলে আসতাম।
একদিন রাতে আচমকা দরজা খোলার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো। ঘরের ফিকে নীল আলোতে দেখলাম আমার ছেলে আলতো করে দরজা খুলে বললো, মা আমি চাবি নিয়ে একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসছি , ঘুম আসছে না। ছেলের তখন ক্লাস টেন । বুঝলাম পড়াশুনার চাপ বেড়েছে। একটু রিলাক্স করতে যাচ্ছে। কিন্তু আমিও থাকতে না পেরে, কিছুক্ষণ পর ওর পিছু পিছু ছাদে এলাম। দেখি দিব্যি দোলনায় দুলছে। ডাকতে উত্তর দিলো না। আমি একটু জোরে ডাক দিলাম। আব্ছা অন্ধকারে ধীরে -ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালো। চোখ দুটো জ্বলছে। কি তীব্র চাহনি। খল খল করে হেঁসে উঠলো।একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। পলক পড়ছে না। এগিয়ে আসছে, বাড়িয়ে দিচ্ছে আমার গলার দিকে দুটো হাত। আমি বোবার মত তাকিয়ে আছি, নিজের ছেলের দিকে। চারিদিকে সেই গা গুলানো আঁশটে গন্ধটা। কোথায় যেন কর্কশ সুরে ডেকে উঠলো একটা পেঁচা। ফ্যাঁস- ফ্যাঁসে গলায় ছেলে বললো- “যখন ছাদে নিয়ে এসে মেরেছিলি, তখন মনে ছিল না।‘’ বলে কি পৈচাশিক হাঁসি। দম বন্ধ হয়ে আসছিলো আমার। চোখের সামনে নেমে এলো ঘন অন্ধকার।
হটাৎ নাকে ঠেকলো মৃদু চন্দনের গন্ধ। মা যেই সুগন্ধিটা মাখতো। মায়ের হাত আমার কপালে। মমতা মাখা ঠান্ডা হাত । ‘মা’ ডেকে জ্ঞান হারালাম। তারপর কিছু মনে নেই। ভোর পাঁচটা নাগাদ দেখি মা আমার শিয়রে বসা। মায়ের আঁচল ধরে কেঁদে বললাম আমি তোমার সাথে যাবো। মা স্পষ্ট বললো, “দূর পাগলী তোর এখন অনেক কাজ বাকি। তুই কোথায় যাবি। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠ।’’ চোখ খুলে দেখি হস্পিটালের বেডে শুয়ে আছি। সবাই উদ্বিগ্ন মুখে আমার দিকে চেয়ে আছে। ওরা জানতে চাইলো কি হয়েছিল সেদিন। কি করে এতো রাতে আমি ছাদে পৌঁছলাম ? সব বিস্তারিত বললাম। ছেলে শুনে আকাশ থেকে পড়লো। ও নিজের ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিলো। ছাদে ও মোটে যায়নি। কিন্তু কে আমায় উদ্ধার করলো ছাদ থেকে ? আমার স্বামী জানালেন যে আচম্কা মোবাইলটা বেজে উঠতে ওনার ঘুম ভেঙে যায়। অদ্ভুত, মোবাইল টা বেজে উঠে থেমে যায়। উনি আবিষ্কার করেন আমি বিছানায় নেই।রাতে যেহেতু আমি ইদানিং একা উঠতাম না, তাই উনি চিন্তিত হয়ে পড়েন। সারা বাড়ি না পেয়ে উনি ছেলে ও মেয়ে কে নিয়ে ছাদের দিকে পা বাড়ান এবং আমায় অজ্ঞান অবস্থায় দোলনাটি ওপর খুঁজে পান ।
পরে সুস্থ হয়ে উঠতে, আমরা বাড়ি খোঁজা শুরু করলাম এবং খুব শীঘ্রই ময়ূর বিহার , দিল্লীতে ,একটি সুন্দর এপার্টমেন্ট জোগাড় হয়ে গেলো । ১০ দিনের মাথায় বাড়িটি ছেড়ে দিলাম। বাড়ির মালিক চাবি ফেরত নিতে এলে, তাকে চেপে ধরলাম। প্রথমে সে কিছুই বলতে চায় না। খুব পীড়াপীড়ির পর মুখ খুলো। এই বাড়িটি ছিল এক বৃদ্ধ ভদ্রলোকের। ওনার টাকা পয়সা ছিল প্রচুর। ভদ্রলোক বিয়ে থাওয়া করেননি। খুব একটা কারো সাথে মিশতেন না। থাকার মধ্যে এক ভাইঝি। মাঝে -মাঝে কাকাকে দেখতে আসতো।
এক সকালে, আসে- পাশের লোকজন দুর্গন্ধ পেয়ে পুলিশে খবর দেয়। তারা এসে ভদ্রলোকের পচা -গলা দেহটি খুঁজে পায় তার প্রিয় দোলনাটির ওপর। পুলিশের ধারণা এই ভাইঝি পয়সার লোভে হত্যা করেছিল কাকাকে। কিন্তু সেই ভাবে কিছু প্রমান করা যায়নি। ভাইঝিটি ও লোক চক্ষুর আড়ালে গা ঢাকা দেয়। পরে কোনো এক দূর সম্পর্কের আত্বিয় এসে বাড়িটি জলের দরে বিক্রি করে দেন, এবং উনি কিনে নেন।
খোঁজ নিয়ে জানলাম, কোনো ভাড়াটেই এই বাড়িতে তিন মাসের বেশি টিকতে পারে নি। প্রতিশোধ স্পৃহা নিয়ে আজও সেই আত্মা খুঁজে বেড়ায় তার শিকারদের। সব জেনে শুনে বাড়ির মালিক আমাদের ভাড়া দেওয়ার জন্য ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিলেন।
এই প্রতিশোধ –প্রবন, নিঃসঙ্গ আত্মাটির জন্য দুঃখ হল। ভগবানের কাছে তার আত্মার মুক্তি কামনা করি।
তবে এইটুকু উপলব্ধি করলাম যে মৃত্যুর ওই পারে গিয়েও, মায়েরা ছুঁটে আসে সন্তানদের অমঙ্গল দেখলে। একটি পবিত্র আত্মা পারে নিশ্চিত কালো বিপদের ছায়া কে ঠেকাতে। সেইদিন মায়ের পবিত্র বিদেহী আত্মা আমাকে বাঁচিয়েছিলো সুনিশ্চিত মৃত্যুর অতল অন্ধকারে তলিয়ে যাবার থেকে । হস্পিটালে ভোর রাতে মায়ের সাথে কথা বলা, চন্দনের অপুর্ব গন্ধ , মোবাইলের বেজে ওঠা- কোনো কিছুর ব্যাখ্যা নেই আমার কাছে। এতদিন পরেও আমার চোখ মা কে খোঁজে , ভোরে ওঠে জলে। কার যেন নরম হাতের স্পর্শ পাই পিঠে।
( উপরোক্ত কাহিনীটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
কলমে মহুয়া মল্লিক
শ্রীমতি মহুয়া মল্লিক পেশায় একজন শিক্ষিকা, ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে এবং বই পড়ে ওনার সময় কাটে। ।সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ঘাত- প্রতিঘাত ওনাকে আকর্ষণ করে। এদের নিয়েই সহজ সরল ভাষায় লিখতে ভালোবাসেন।