নার্সিংহোমে আই সি উ র সামনে বসেছিল নীলাঞ্জনা। তখন আই সি উ তে মেশিনের তৎপরতায় সম্পূর্ণ অচৈতন্য অবস্থায় বিছানায় পড়ে ছিল সাত বছরের ছেলে রূপম। মাথা নিচু করে কপালে হাত দিয়ে বসে ছিল নীলাঞ্জনা। চোখের জল বাঁধ মান ছিল না। শুধুই আফসোস, আর আত্মপর্যালোচনা। এমন সময় মেট্রন ডেকে পাঠালেন নীলাঞ্জনাকে। এক অসহায় মা নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়ালো মেট্রনের সামনে। মেট্রনের রূঢ় কণ্ঠস্বর সজোরে ধাক্কা দিলো নীলাঞ্জনার অন্তরের আবাসস্থলে — আপনি কিধরনের মা বলুন তো? এত ছোট বাচ্চাকে কেউ এইভাবে ঘরে বন্ধ করে রেখে চলে যায় ? আপনি কি নিষ্ঠুর, কিভাবে করতে পারলেন ? বাচ্চাটি প্রচন্ড শক পেয়েছে। এখন আর চোখের জল ফেলে কী হবে ? আপনার স্বামী কোথায় ? তাকে খবর দিন
— আমার স্বামী নেই— নেই মানে ? মৃত, না থেকেও নেই ?— না না, জীবিত, আমার সাথে সম্পর্ক নেই— তাহলে তো বাচ্চার দায়িত্ব একান্তই আপনার— আজ্ঞে হ্যাঁ, জানেন কোনদিন ওকে একা রেখে আমি কোথাও যায়নি। রঞ্জা থাকে ওর সাথে। আজ সারাদিন বৃষ্টি হওয়ার কারণে রঞ্জা আসতে পারেনি। আমাকে কাজে বেরতেই হত। তাই বিকেলবেলা ওকে ঘরে রেখে দরজায় তালা দিয়ে যেতে বাধ্য হই— কি এমন কাজ করেন যে এত বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে যেতে হলো ?— আমি একজন গণিকা— কি !মেট্রনের চোখে-মুখে ঘৃণার ছাপ— থাক থাক আর শুনতে চাই না আপনার উপাখ্যান— বিশ্বাস করুন দিদি আমি নিজের ইচ্ছায় এপথে আসেনি। আমি ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে। কোতুলপুর এ আমাদের বাড়ি। মা বাবা ও আমরা দুই ভাইবোন মিলে চারজনের পরিবার। আমি যেবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিই সে সময় বাবার স্ট্রোক হয়। সম্পূর্ণ প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে যান। সঞ্চিত অর্থটুকু বাবার তৎকালীন চিকিৎসাতেই শেষ হয়ে যায়। মা সংসার সামলানোর পর ঠোঙা তৈরি করতে আরম্ভ করেন। চারজনের সংসার, বাবার ওষুধ, খানিক পথ্য এসবের জন্য বেশ অনেকটা অর্থের প্রয়োজন ছিল। তাই আমি ছাত্র পড়ানো আরম্ভ করি। তাও যেন সংসারের চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছিল না। ছোট ভাইয়ের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় মাঝপথে। পাড়ার বখাটে ছেলেদের পাল্লায় পড়ে চুরি-বাটপারি শিখলো। লোকচক্ষুর আড়ালে বোমা বাঁধতে শুরু করলো। একদিন পুলিশের তাড়া খেয়ে পালাবার সময় হাতের বোমা হাতেই ফেটে গেল। তখন ওকে নিয়ে যমে-মানুষে টানাটানি। সেই সময় আমার পাগল পাগল অবস্থা। আমাদের পাড়ার সুধীর কাকু এগিয়ে এলেন আমাদের সাহায্য করার জন্য। সুধীর কাকু মানুষটা খারাপ ছিলেন না কিন্তু ওর ছেলের শ্যেন দৃষ্টি পড়লো আমার উপর। আমাকে বিয়ে করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো। প্রথমটায় সুধীর কাকু তেমন রাজি ছিলেন না কিন্তু পরবর্তীতে ছেলের পাগলামির জন্য রাজি হতে বাধ্য হলেন। বিয়ের পর আমার স্বামী আমাকে নিয়ে চলে আসে কলকাতায়। ও কলকাতায় চাকরি করতো। ওর সঙ্গে থাকতে থাকতে ওর বদঅভ্যাসগুলো ক্রমশ আমার চোখে ধরা পড়তে আরম্ভ করলো। মদ, জুয়া, মেয়ে মানুষ কিছুই বাদ ছিল না। আমার ওপর শারীরিক অত্যাচার ও হয়েছে বহুবার। একসময় তার চাকরিটা চলে গেল। তখন আমি অন্তঃসত্ত্বা। সংসার চালানো মুশকিল হয়ে পড়লো। ও একদিন আমাকে নিয়ে এলো শ্রীরামপুরে ওর এক মাসির বাড়িতে। ওখানে আমাকে রেখে একটু আসছি বলে বাইরে বেরিয়ে যায়। পরে জানতে পারি নেশার খোরাক জোগানোর জন্য ও আমায় বিক্রি করে দিয়েছে। ব্যাস, সেই রাতেই আমি নষ্ট মেয়ে মানুষে পরিণত হয়ে গেলাম। ও দেশের বাড়িতে গিয়ে রটিয়ে দিল আমি পর পুরুষের সাথে পালিয়ে গেছি। সুতরাং সুধীর কাকু আমাদের পরিবারকে সাহায্য করা বন্ধ করে দিলেন। সেই রাতের পর থেকে আমি এই মহল্লাতে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে আরম্ভ করি। গর্ভস্থ সন্তানকে নষ্ট করে দিতে পারিনি। একজন সজ্জন ব্যক্তি সেই সময় আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওই অবস্থায় আমি কাজ করতে পারতাম না। উনি সমানে আমায় টাকার যোগান দিয়ে গেছেন কিন্তু শর্ত ছিল একটা — পরবর্তীতে প্রত্যহ আমার ওনার কাছে যেতে হবে। কোন অবস্থাতেই ফাঁকি দেওয়া যাবে না। তাই আমি রঞ্জাকে রাখি ছেলের দেখাশোনা করার জন্য। রোজগার করে কোতুলপুরে মাকেও টাকা পাঠাই। প্রায় সময়ই আমি নিজে যাই। আমি নষ্ট মেয়ে মানুষ তাই গ্রামে ঢোকার অধিকার নেই। গ্রামের বাইরে বটগাছের নিচে প্রতি মাসের পাঁচ তারিখে মা দাঁড়িয়ে থাকেন। আমি গিয়ে মায়ের হাতে টাকা দিয়ে আসি।
কথাগুলো শোনার পর মেট্রনের চোখের কোনে জমে থাকা জল টপটপ করে পড়ল মাটিতে। নীলাঞ্জনা কে বললেন —  বাড়ি যাও, দেখবে তোমার ছেলে ঠিক ভালো হয়ে যাবে..ভারাক্রান্ত মন নিয়ে নীলাঞ্জনা ফিরে আসে বাড়িতে। ছেলের পড়ার টেবিলে চোখ পড়তেই দেখে অংক খাতার পাতায় লেখা রয়েছে কটি বাক্য — মা তুমি কোথায় ? আমার খুব খিদে পেয়েছে, দেওয়ালে অনেক টিকটিকি, বুকের ভেতরটা ব্যথা করছে, লোডশেডিং হয়ে গেছে, চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, খুব ভয় করছে, মা, আমার কাছে এসো..লেখাগুলি পড়তে পড়তে কান্নায় ভেঙে পড়ল নীলাঞ্জনা । বলল — হায়রে, কত হতভাগী মা আমি, ঈশ্বর আমার কোলে ফিরিয়ে দাও আমার সন্তান কে..হঠাৎ তখনই হাসপাতাল থেকে ফোন আসে — রূপমের জ্ঞান ফিরেছে। যত শীঘ্র সম্ভব আসুন…উদভ্রান্তের মতো তখনই নীলাঞ্জনা ছুটে যায় হাসপাতালে। গিয়ে জড়িয়ে ধরে রূপমকে। রূপম ও মাকে কাছে পেয়ে যেন স্বর্গ পেল…মেট্রন নীলাঞ্জনা কে ডেকে বললেন — আমি যদি তোমায় একটা চাকরি জোগাড় করে দিই তুমি কি করবে ? সেখানে তুমি সসম্মানে থাকবে— কোথায় দিদি ?— চার্চে, সেখানে তোমার মত অনেক মহিলা আছে। তুমি তোমার ছেলেকে নিয়ে থাকবে সেখানে। চার্চের স্কুলে রূপমকে ভর্তি করে দেওয়া হবে। সেখানকার ছোট ছোট বাচ্চাদের তুমি পড়াবে। ভালো বেতন পাবে। ওখানে গেলে দেখবে তোমার খুব ভালো লাগবে। চার্চের ফাদার আমার খুব পরিচিত। খুব ভালো মানুষ— ধন্যবাদ দিদি, আপনি আমাকে পুনর্জীবন দিলেন। ভগবান আপনার মঙ্গল করুন। যত শীঘ্র সম্ভব চলে যেতে চাই। আপনি ব্যবস্থা করুন।

কলমে নিপা রায়, শিউলী,তেলেনিপাড়া

SOURCEকলমে নিপা রায়
Previous articleসেদিনও কী!
Next articleএমনটাও হয়
Avatar
Disclaimer: Monomousumi is not responsible for any wrong facts presented in the articles by the authors. The opinion, facts, grammatical issues or issues related sentence framing etc. are personal to the respective authors. We have not edited the article. All attempts were taken to prohibit copyright infringement, plagiarism and wrong information. We are strongly against copyright violation. In case of any copyright infringement issues, please write to us. লেখার মন্তব্য এবং ভাবনা, লেখকের নিজস্ব - কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত..................

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here