প্রাকৃতিক এবং সুপ্রাচীন ইতিহাসের সৌন্দর্যের নিরিখে ভারতবর্ষ অতুলনীয়। প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরনো হরপ্পার প্রাচীন জনজীবন হোক বা আজকের প্রতিনিয়ত উন্নত হয়ে চলা আধুনিক জনজীবন, ভারতবর্ষ পরিবর্তনের সাক্ষী থেকেছে প্রতিনিয়ত। আভ্যন্তরীন রাজাদের শাসন হোক বা বহিরাগত আক্রমণ ভারতবর্ষ বিবিধের মাঝে মহান মিলনের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে বারবার। তার ইতিহাসকে ব্যপ্ত ও সুপ্রসিদ্ধ করেছে। আজ এমন একটি দুর্গ সম্পর্কে আলোচনা করব, যা প্রায় হাজার বছরের বহু ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে আজও সগর্বে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করে চলেছে।
জিনজি বা সেনজি বা চেনজি ফোর্ট-টি তামিলনাড়ু রাজ্যের ভিল্লুপুরম জেলায় অবস্থিত। রাজধানী চেন্নাই থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৬০ কিলোমিটার, আর চেন্নাই বিমানবন্দর থেকে ১৫০ কিলোমিটার। তিনটি পাহাড় দ্বারা পরিবেষ্টিত এই দুর্গটি আনুমানিক হাজার বছরের প্রাচীন। সম্ভবত ১১৯০ সালে কোন্ -রাজা আনন্দ কোন্ এই দুর্গ প্রতিষ্ঠা করেন। এর পরবর্তীতে রাজা কৃষ্ণ কোন্ এই দুর্গের পরিকাঠামোর পুনর্বিন্যাস করে এই দুর্গকে আরো শক্তিশালী করেন। রাজা আনন্দ কোন্-এর নামানুসারে পশ্চিমের পাহাড়টির নামকরণ করা হয় রাজগিরি বা আনন্দ গিরি , উত্তরের পাহাড়টির নামকরণ করা হয় রাজা কৃষ্ণ কোন্-এর নামানুসারে কৃষ্ণগিরি, এবং দক্ষিণ-পূর্বের পাহাড়টির নাম চন্দ্রায়ণদূর্গ। গ্র্যানাইট পাথরের এই তিনটি পাহাড় ছাড়াও আরো একটি ছোট এবং অপেক্ষাকৃত কম প্রচার পাওয়া চিক্কিলিয়া দুর্গ বা চমন টিকি -ও এই দুর্গের অন্যতম উল্লেখযোগ্য একটি অংশ। এই তিনটি, বা সূক্ষ্ম হিসাবে চারটি পাহাড়কে নিয়েই গড়ে উঠেছে সম্পূর্ণ দুর্গটি। প্রায় ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রাচীর দ্বারা তিনটি প্রধান পাহাড়কে যুক্ত করা হয়েছে সুপরিকল্পিত জিনজি দুর্গের গঠনকালে, যার আয়তন প্রায় ১১ বর্গকিলোমিটার এবং উচ্চতা প্রায় ৮০০ ফুট। সমুদ্র সমতল থেকে এই দুর্গের অবস্থান প্রায় ৩০২ ফুট উপরে।
প্রায় ৮০ ফুট দীর্ঘ পরিখা বেষ্টিত এই দুর্গের গঠনশৈলী অত্যন্ত আকর্ষক। বর্তমানে প্রায় ভগ্নদশায় পরিণত হলেও জায়গায় জায়গায় কারুকার্য অনেকাংশে ইতিহাসের অমূল্য স্মৃতি রক্ষা করে চলেছে আজও । দুর্গের অভ্যন্তরে সাতটি ধাপে নির্মিত মহল বর্তমান, যা কল্যাণ মহল নামে পরিচিত। এই মহলটি বিবাহ তথা আনন্দানুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত হত। কয়েদি দের রাখার জন্য একটি ছোট জেলখানা এবং সবুজ ঘাসে ঢাকা একটি খোলা জায়গা আজও বর্তমান। সম্ভবত এই চারদিক খোলা প্রশস্ত সবুজ অংশটি রাজাদের বিশ্রামের জন্য ব্যবহৃত হত। দুর্গের প্রান্তে একটি মন্দির আজও বর্তমান। চেনজিআম্মা বা সেনজিআম্মা নামের এই কুমারী দেবী দুর্গের রক্ষাকর্তা হিসাবে পূজিত হতেন। এই দুর্গ বা দুর্গের আশেপাশের সমস্ত অঞ্চলের বিভিন্ন মন্দির ও পূজিত দেবীদের মধ্যে সবচেয়ে পুরাতন দেবী সেনজিআম্মা ও তার মন্দির। সম্ভবতঃ সেঞ্জীবী বা সঞ্জীবনী গাছের নাম থেকে এই দেবীর নামকরণ হয়। জিনজি দুর্গে প্রাপ্ত একটি শিলালিপিতে খোদাই করা একটি ধনুক, পাঁচটি তীর, একটি মহিষ এবং চারটি মানুষের মাথার চিত্র থেকে অনুমান করা হয় নরবলি এবং পশুবলির চল ছিল এখানকার বিভিন্ন বাৎসরিক পূজা বা উৎসবে। মহিষবলির প্রথা কিছু বছর আগেও বর্তমান ছিল।
স্থানীয় লোককথা অনুযায়ী শোনা যায় মহাভারতের যুগে দ্রৌপদী-র জন্ম হয় এই জিনজি তে। দেবী সেনজিআম্মা , দ্রৌপদীর-ই আরেকটি অবতার। বিভিন্ন শুভ অনুষ্ঠান বা উৎসবে এই জিনজি-র মাটি নিয়ে যাওয়া হত এবং এই মাটি খুব-ই পবিত্র মানা হত। পন্ডিচেরী বা অধুনা পুদুচেরী-তে মেলাছরী দ্রৌপদী উৎসবে আজও এই অঞ্চল থেকে বালি, মাটি নিয়ে যাওয়া হয়। মহিষ বলি-র প্রথা আজও পালন করা হয়। যাজ্ঞসেনী-র সম্মানে আগুনের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার প্রথাও পালিত হয়।
জিনজি বা সেনজি দুর্গের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় বিক্রম চোল লিপিতে। কোন্ সাম্রাজ্যের পর চোল বংশের শাসনকালে এই দুর্গের গঠন সম্পূর্ণভাবে সম্পন্ন হয় এবং প্রতিরক্ষার দিক থেকে সর্বোচ্চ শক্তিশালী গঠনের দাবি রাখে। চোল রাজাদের পর কিছু সময়ের জন্য বিজয়নগরের অধীনে আসে এই দুর্গ। রাজকীয় স্থাপত্য নিদর্শনগুলিতে উত্তর দাক্ষিণাত্য সুলতানির প্রভাব স্পষ্ট ভাবে দেখা যায়। দক্ষ প্রশাসন ও বৈদেশিক বাণিজ্যের কল্যাণে বিজয়নগর সাম্রাজ্য শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিল। কন্নড়, তেলুগু, তামিল ও সংস্কৃত সাহিত্যের নিদর্শনের ছোঁয়া এই দুর্গের বহু লিপিতে পাওয়া যায়। ছত্রপতি শিবাজি-র মারাঠা আক্রমণ প্রতিহত করার কৌশল হিসাবে একের পর এক দুর্গ জয়, মারাঠা ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। ছত্রপতি শিবাজি সেনজি দুর্গের কিছুটা অংশ দখল করেন এবং এই দুর্গের গঠনশৈলী -র জন্য একে ‘সবচেয়ে মজবুত এবং সহজে না দখল করতে পারা দুর্গ’ হিসাবে চিহ্নিত করেন (The most impregnable fortress)
ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য বিজয়ের সময় শিবাজি পুত্র ছত্রপতি রাজারাম ও তার সেনাপতি শান্তাজি মহালোজি ঘোরপাড়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন। শান্তাজি ও ধানাজী যাদব মুঘল সেনার বিরুদ্ধে সুকৌশলে যুদ্ধ করে চলেন ১৬৮৯ থেকে ১৬৯৬ পর্যন্ত। মুঘল সেনাপতি জুলফিকার খান, আসাদ খান এবং কম বখস , ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য আক্রমণের সময় পর পর পরাজিত হন শান্তাজির হাতে। শান্তাজির অবর্তমানে ছত্রপতি রাজারাম জিনজি দুর্গ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন, যদিও যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। অবশেষে ১৬৯৮ সালে, দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর এই দুর্গ মুঘল দের দখলে আসে।
দাউদ খান-কে দাক্ষিণাত্যের সুবেদার নিযুক্ত করলে তিনি জিনজি থেকে আরকট-এ তার প্রধান কার্যালয় স্থানান্তরিত করেন। ফলে এই দুর্গ তার জৌলুস কিছুটা হলেও হারায়। এরপর সাতাদউল্লাহ খানকে দেওয়ান ও ফৌজদার নিযুক্ত করেন দাউদ খান। সাতাদউল্লাহ খান পরে নিজাম উল মূলকের বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠেন ও দুটি জায়গার নবাব-এর পদমর্যাদা লাভ করেন।
মুঘল সেনাবাহিনীর এক সেনাপতি স্বরূপ সিংহের পরাক্রমে খুশি হয়ে তাকে জিনজি দুর্গ উপহার হিসাবে দেওয়া হয় মুঘল সম্রাটের তরফ থেকে। স্বরূপ সিংহের মৃত্যুর পর তার পুত্র রাজা তেজ সিংহ বা রাজা দেসিংহের সাথে সাতাদউল্লাহ খানের কর সংক্রান্ত বিবাদ ক্রমে যুদ্ধে পরিণত হয়। নবাবের ৮০০০ ঘোড়সওয়ার ও ১০০০০ সৈন্যের সামনে মাত্র ৩৫০ ঘোড়সওয়ার আর ৫০০ সৈন্য নিয়ে খুব বেশী সময় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেননি দেসিংহ। তার প্রধান সেনাপতি মাহবুব খান বা মহবত খানের যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু হলে কিছু সময়ের জন্য ভেঙে পড়লেও প্রবল পরাক্রমে একাই যুদ্ধ চালিয়ে যান দেসিংহ। তবে শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যু হয়।
এরপর কিছুদিনের ব্যবধানে এই দুর্গ-টি ১৭৫০ সালে ফরাসিদের ও ১৭৬১ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও পরে ব্রিটিশ শাসনাধীন হয়। ১৯২১ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার এটিকে National Monument হিসাবে চিহ্নিত করে। বর্তমানে এই দুর্গটি দেখার জন্য ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ভারতীয়দের জন্য মাথাপিছু ২৫/- ও বিদেশীদের জন্য মাথাপিছু ৩০০/- প্রবেশমূল্য ধার্য করা হয়েছে।
সকল পুরাতন এবং ঐতিহাসিক স্থান নিয়েই কোনো না কোনো ভৌতিক কাহিনী থেকে থাকে। এই দুর্গও তির ব্যতিক্রম নয়। শোনা যায় এখনও রাত্রে ঘুঙুরের শব্দ বা গগনবিদারী হাহাকারের আর্তনাদ শোনা যায় মাঝে মাঝে। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল এখানকার লোকগীতি হিসাবে বিভিন্ন স্ট্রিট পারফরমেন্স , যেমন থেরুকোঠু, পোই-কাল-কুঠিরাই বা বুরাকথা নামক লোককথাতে দেসিংহের বীরত্বের কাহিনীর বর্ণনা । দেসিংহের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিলেন তার সেনাপতি মাভুঠুকারান বা মহবত খান। তাদের বন্ধুত্বের কাহিনী বা নবাবের সঙ্গে যুদ্ধের মর্মস্পর্শী কাহিনী , মহবত খান-এর মৃত্যু ও দেসিংহের মাটিতে পড়ে যাওয়ার পরেও একা যুদ্ধ করার বীরত্বের কাহিনী আজও বহুচর্চিত। ১৯৬০ সালে ‘রাজা দেসিংহ’ নামের একটি তামিল সিনেমাতে এই বীরত্বের কাহিনী তুলে ধরা হয়।
প্রায় হাজার বছরের বহু ঘটনার সাক্ষী হিসাবে আজও জিনজি বা সেনজি দুর্গ তামিলনাড়ুর একটি ছোট্ট শহরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এই দুর্গে্র প্রতিটি পাথর আজও হয়তো চিৎকার করে তার বুকে ঘটে যাওয়া হাজার বছরের ইতিহাসের বর্ণনা করতে চায়। শুধু সময় করে একবার আমাদের সেখানে পৌঁছানোর আর কান পেতে সেই ইতিহাস শোনার অপেক্ষা করে চলেছে আজও এই সেনজি বা জিনজি দুর্গ।
কলমে হিমবন্ত দত্ত