….. অ্যাডামের গলায় আটকে যাওয়া আপেলের টুকরো যেভাবে আজও চিহ্নস্বরূপ সমস্ত পুরুষ জাতি বহন করে যাচ্ছে, পরিবারের চাপে পড়ে বিয়ে করাটাও আমার সেই আপেলের মতই লাগতো। না গিলতে পারা যায় না ফেলতে। ৩০ বছর বয়সেও বিয়ের তেমন কোনো ইচ্ছা জাগেনি আমার। দিব্বি তো ছিলাম অফিস, কাজ, লেখা লিখি নিয়ে। হঠাৎ শুরু হল মা,মাসি, দিদা,ঠাম্মার মিলিত ব্রেন ওয়াশ। সাথে যোগ দিলো আমার অলরেডি বিবাহিত বন্ধুগণ। ওদের দেখলেই একটা গান মনে আসতো ” হাম যো ডুবে সানাম.. তুমকো ভি লে ডুবে!”। অনেক না না সত্ত্বেও একদিন অফিস থেকে ফিরেছি, এমন সময় মা সুযোগ বুঝে হাতে এনে দিলো একটা ছবি, -“দেখনা কি মিষ্টি মুখ খানা..”। মায়েরা কিভাবে জানিনা ছেলেদের পছন্দ ঠিক বুঝে যায়। জানতে পারলাম ছবিতে সুদৃশ্য তন্বীর নাম মৃণালিনী। হঠাৎ মনে পরে গেলো মামার বাড়ির সামনে ছোট্ট পুকুরে পদ্ম ফুলের সমাবেশ কিভাবে মন কাড়তো, আর ব্যাস্, এবার আমি যাই কোথায়। এমনি আমার প্রগ্রেসিভ পরিবার। যৌতুক,পণ প্রথা এইসবের তীব্র বিরোধী। তাই আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম শ্বশুর মশাইয়ের থেকে উনার মেয়ের হাত ছাড়া আর কিছুই চাইব না। কিন্তু বিগত কয়েক বছরের এক্সপিরিয়েন্স থেকে বলছি, আপাতদৃষ্টিতে বউকে একা আসতে দেখলেও সে সঙ্গে করে যে চাহিদার তালিকাটাও নিয়ে আসে তার শেষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। জন্মদিন, অ্যানিভার্সারি তো ছেড়েই দিলাম, ম্যাডামের মন ভালো করতেও প্রয়োজন গিফ্ট। খুব দামি কিছু না হলেও, কিছু একটা চাই। আবার উনি জানতে পারলে হবে না, হতে হবে সারপ্রাইজ। মেয়েদের মন খারাপের উপর সেপারেট একটা পেপার চালু করা উচিত মধ্য শিক্ষা পর্ষদের, নিইলে চুপচাপ চায়ের কাপ রেখে চলে যাওয়া কিংবা হুঁ আর না… টুকু উত্তর পেলে সারাদিন এই ভেবেই কেটে যায় – ও কি আমার উপর রেগে আছে? আমি কি কিছু ভুল বললাম? আজ কি কোনো স্পেশাল দিন যা আমি ভুলেগেছি ?…. সাথে যত আনুমানিক পুরনো পাপ আছে সব একবার করে স্মরণ করে নিতে হয়। পরে জানতে পারি বাইরে মেঘলা আকাশ হালকা বৃষ্টি সেই কারণেই ওনার মন খারাপ। মানলাম বাঙালি প্রকৃতিপ্রেমী, তাই বলে এতো বাড়াবাড়িটাও কি ঠিক?। কালক্রমে এটুকু টের পেয়ে গেছিলাম এইসব পূর্বানুমান করাও একপ্রকার আর্ট, আর আমিতো ছিলাম কমার্সের স্টুডেন্ট।
কখনো রাগের কারণ জানতে চাইলে উত্তর আসে… “এটাও কি এখন আমাকেই বলে দিতে হবে ? নিজেই ভেবে দেখো….!”। তাই অফিসের একটা দাদার পরামর্শ মেনে আওড়ে নিলাম সুখী দাম্পত্য জীবনের দুটি মূল গুরু মন্ত্র ‘সরি’ আর ‘আই লভ ইউ’। একদিন বাড়ি ফিরেছি, একটু লেট হয়ে গেছিল আর্জেন্ট ক্লায়েন্ট মিটিং থাকায়, মিনু দেখি দরজা খুলে একবার আমার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ খাটের এককোণে গিয়ে বসে পরলো। ফ্রেশ হয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম ও একই যায়গায় বসে হাতে মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে। আমার দিকে না তাকাচ্ছে, না কোনো কথা বলছে। এতো চুপচাপ তো ও থাকেনা। আমি ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলাম “শরীর ঠিক আছে তোমার?”… উত্তর কিছু এলো না। চিন্তা বাড়লো। সকালে বিকালে ফোনে কথা হল, সবকিছুই ঠিক ছিলো তবে এখন এমন আচরণ? আবার কিছু গন্ডগোল করে ফেললাম না তো। এইসব ভাবতে ভাবতে ওর সামনে খাটে গিয়ে বসলাম। মৃদুস্বরে বললাম “দেখো… আই এম সরি”। হঠাৎ মাথা তুলে অভিমানী সুরে মিনু বলে উঠলো “এইবার ফ্লিপকার্ট সেলে কিচ্ছু কিনে দিলে না আমায় বলো!..আজকেই লাস্ট ডে”। একবারেই জবাব পেয়ে গেলাম, চমৎকার কান্ড! । গুরুমন্ত্র দেখি পেনকিলার ইনজেকশনের থেকেও দ্রুত কাজ করে। আর মাঝে মাঝে হোয়াটসঅ্যাপ-এ টেক্সট করে আর রাতে ঘুমাবার আগে বলে নিতে হয় দ্বিতীয় মন্ত্রটি “আই লাভ ইউ”, ব্যাস! স্বর্গ সুখ।
বড্ড ভালো গানের গলা ওর। ছুটির দিন সন্ধ্যে হলেই গানের আসরে মেতে উঠতাম বাড়ির সবাই। আজও প্রতি রাতে শুনতে পাই ওর গুন গুন গলায় গান। তবে বিগত দু-সপ্তাহ ধরে আমার টানা ঘুম নেই। অনেক ওষুধ খেয়েছি। ডক্টর বলছেন ইনসোমনিয়ার কারণে অবচেতন অবস্থায় আমার সাবকন্সিয়াস মাইন্ড এই কাল্পনিক পরিবার ও স্ত্রীর ডিলিউসন গুলো তৈরি করেছে।
—“কিন্তু কিভাবে এগুলো ডিলিউসন হতে পারে! আমার পরিবার, মৃণালিনী সবাইকে যে চোখের সামনে দেখতে পাই আমি। আমার স্ত্রী আমার সাথে থাকে, গল্প করে, রোজ রাতে গান শোনায়। মাঝে মধ্যে ওর সাথে কোথায় একটা যেন যেতে বলে। কি করে এইসব মনের ভুল হতে পারে ডক্টর! “
আজ রাতে মিনুকে জিজ্ঞেস করলাম তুমি কোথায় যেনো যেতে বলো আমায়, আজ ডক্টরও জান্তে চাই ছিলেন। ও নিজের মনে গান গাইছিল খাটের কোণে বসে, হঠাৎ প্রশ্নটা শুনে একটু মৃদু হেসে, বেডের পাশ থেকে ধীরগতিতে আমার কাছে এসে কানে কানে বলল “যাবে?”।
শীতের ঠান্ডা হাওয়ার সাথে ধোঁয়াশার কালো মেঘ শহরের অট্টালিকা ও ইমারত গুলির মাথা ছুঁয়ে ভেসে বেরাতে দেখছি, এই মেন্টাল অ্যাসাইলাম-এর ১৫ তলার ছাদে দাঁড়িয়ে। পাশ থেকে মিনু আঙুল তুলে একটি নির্দিষ্ট দিকে তাকানোর নির্দেশ করলো। আমার চোখ আঙুলটি অনুসরণ করা মাত্র দেখতে পেলাম ছাদের রেলিঙের ওপারে হাওয়ায় ভাসমান একটা গোপন দরজা খুলে গেলো আমার দিকে। ছাদের কার্ণিশ থেকে পা বারিয়ে এগিয়ে গেলাম….।
লেখক পরিচিতি : প্রীতম ঘোষ, অফিস ফাঁকে অজানার খোঁজে ।