ঘড়ির কাঁটা দুটো থমকে দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে |
নির্ধারিত সময়ের এক ঘন্টা আগেই পৌঁছে গেছে আলোক |ঘড়ির ডায়েলের দিকে আর একবার চোখ রাখল|বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পোশাকটা ঠিক করে নিল| এই নিয়ে প্রায় চারবার করল| সত্যি বলতে কি ঠিক মনে করতে পারল না কতবার| তাড়াহুড়োতে চিরুনিটাও আনতে ভুলে গেছে| না হলে চুলটা একবার আঁচড়ে নিত| আলোকের হাসি পেল| তবে কি ও নার্ভাস? তাই হবে হয়ত তাছাড়া আর কি হতে পারে| অথচ কম্পুটারে লক্ষ্য লক্ষ্য প্রোগ্রাম লেখার সময় প্রত্যেকটা রুটিন আর সাব রুটিন ওর ছবির মতো মনে থাকে| অফিসের সবাই অবাক হয়ে যায় ওর স্মরণশক্তি দেখে| ক্লায়েন্টদের সবথেকে কঠিন কাজগুলো তাই আলোককেই দেওয়া হয়| আর সেই কারনেই অফিস থেকে যখন দুজনকে আমেরিকায় পাঠানোর কথা উঠল তখন আলোকের নাম উঠাতে কেউই অবাক হয়নি| আলোক নার্ভাস হলে কি এসব হত? তবে আজকের এই পরিস্থিতে নার্ভাস হওয়ার কারন অবশ্যই আছে| অলককে প্রথমে খুঁজে বের করতে হবে একটা লাল রঙের ছাতা| ছাতাটি খুঁজে পাওয়ার পর তাকে ভালো করে লক্ষ্য করতে হবে সেই মেয়েটিকে, যার ডান হাতের কব্জি থেকে ঝুলছে ওই ছাতাটি | এই হবে সেই মেয়েটি যার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল আজথেকে প্রায় দেড় বছর আগে| পরিচয় বলাটা ঠিক নয়, বলা উচিত ই-মেলের পরিচয়| আজই প্রথম তাদের চাক্ষুষ দেখা হওয়ার কথা | কোথায় ? হাওড়া স্টেশনে|
কাকলির ওপর একটু অসন্তুস্ট যে হয়নি তা নয় , কিন্তু চিঠিতে অর্থাৎ ই-মেলে অবশ্য তা প্রকাশ করেনি| এত জায়গা থাকতে হাওড়া স্টেশন কেন? তাও তাদের প্রথম দেখা হওয়ার দিনে| আলোক বলেছিল কোন রেস্টুরান্টে প্রশ্নটার উত্তর অবশ্য কাকলির চিঠিতেই ছিল| কাকলি কলেজে পড়ায়, নতুন চাকরি | কলেজের পরে ওকে হাওড়া স্টেশনে আসতেই হবে অতএব এটাই শ্রেষ্ঠ জায়গা দেখা করার| এই চিঠির ব্যাপারটাও আর একটা বিতর্কের বিষয় | ই-মেলকে আলোক চিঠি বলে, কাকলি সেটা মানতে চায়না | চিঠি বলতে কাকলি বোঝে খামে মোড়া স্ট্যাম্প লাগানো একটা জিনিষ, যেটা অনেক লোকের হাত ঘুরে কোন একটা নির্দিষ্ট সময় তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছায়| সেই চিঠির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অনেক অপেক্ষা , অনেক আশা, অনেক পথ চেয়ে থাকা,রক্ত মাংসের সম্পর্ক, অনেকটা হাঁটা পথ, অনেকের জীবিকা আরো অনেক কিছু | কাকলি ভাবপ্রবণ. আলোক প্রাকটিক্যাল |
মতের অমিল ওদের এখনই শেষ নয়| আলোকের সন্দেহ ওদের এই সম্পর্কটাকে ঠিক আলাপ বা পরিচয় বলা যায় কিনা| মানুষের সঙ্গে মানুষির মুখোমুখি অথবা সামনা সামনি বসে কথাই না হলো তবে তাকে পরিচয় বলা যায় কি? ককলি বলে ঠিক তার উল্টো , আলাপ বা পরিচয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার কোন সম্পর্ক নেই|মনের মিলটাই সব থেকে বড় কথা | কাকলির নিজের নামটা পছন্দ নয়| কেমন যেন কাক দিয়ে শুরু বলে মনে হয় তার কাছে| আলোক বলে হতে পারে কাক দিয়ে শুরু কিন্তু কলি দিয়ে তো শেষ | সব ভালো যার শেষ ভালো|
কাকলির সঙ্গে আলাপটা হয়েছিল অদভুতভাবে | আমেরিকায় আসার ঠিক দুদিন আগে আলোক অফিস থেকে বেরিয়েছিল কয়েকটা জরুরি কাজ সেরে ফেলার জন্য| কাজগুলো সময়ের আগেই শেষ হয়ে যাওয়ায় খুশি মনে আলোক একটা টাক্সি ডেকে উঠে পড়ল বাড়ি ফেরার জন্য| পিছনের সিটে বসে ড্রাইভারকে নির্দেশ দেওয়ার পরেই মনে হলো সিটের নিচের দিকে শক্ত একটা কিছু খোঁচা মারছে তার পিছনে | মাথাটা নিচু করে দেখার চেষ্টা করল, দেখতে পেল না| মাথাটা আরও একটু নিচু করে শরীরটাকে নামাল| একটা বই বা খাতার মতো কিছু একটা উঁকিঝুঁকি মারছে সিটের ভাঁজে, পুরোটা দেখা যাচ্ছে না| কৌতুহল বশত হাতটা ঢুকিয়ে বের করল| খাতা নয় , একটা সম্পূর্ণ বই উঠে এল হাতে| আলোক বইটার পাতা ওল্টাতে লাগল|| একটা দুর্নিবার আকর্ষণ ওকে পেয়ে বসল| বইটার জন্য নয় , বইটার প্রত্যেকটা পাতার ডানদিকে আর বাঁদিকে মেয়েলি হাতের লেখা নোটগুলোর জন্য| আলোক হস্তরেখা বিশারদ নয়, তবু বুঝতে অসুবিধে হলো না যে লেখিকা বুদ্ধিমতি| বইটার প্রথম পাতায় লেখিকার নাম আর ই-মেল আড্রেসটাও পেয়ে গেল| কল্পনার ডানা মেলে দিল আলোক|
তারপর যা হওয়ার তাই হলো| বইটার প্রাপ্তি সংবাদ জানিয়ে ই-মেল পাঠাল আলোক | ভেবেছিল আমেরিকায় আসার আগে চিঠির উত্তর এসে যাবে, দেখা হবে, বইটা ফেরৎ দেবে| সেই সুত্রে আলাপ হবে, পরিচয় হবে হয়ত বা অন্তরঙ্গতাও হবে| কিন্তু কোনটাই হলো না| চিঠির উত্তর এল না, দেখা করার সুযোগও হলো না| আলোক পাড়ি দিল আমেরিকায়|
আমেরিকায় পৌঁছে আলোকের বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে| ভুলেই গিয়েছিল বইটার কথা, কাকলির কথা| দিনকয়েক পরে যখন সুযোগ পেল নিজের ই-মেল খোলার, সেইদিন প্রথম দেখতে পেল কাকলির লেখা ছোট্ট চিঠিটা|
“ধন্যবাদ বইটা খুঁজে পাওয়ার জন্য| ফ্যামিলির সঙ্গে দক্ষিন ভারত বেড়াতে যাওয়ার ফলে আগে উত্তর দেওয়া সম্ভব হয় নি, তার জন্য দুঃখিত| বইটা খুঁজে পওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম, তাই আর একটা বই কিনে ফেলেছি| বইটা আমার খুব প্রিয় , তাছাড়া অনেক কিছু নোট্ করেছিলাম পাতায় পাতায়| আপনার যদি অসুবিধা না হয় তাহলে কয়েকদিনের মধ্যে যোগাযোগ করে বইটা আপনার কাছ থেকে নিয়ে যাব|
শুভেচ্ছা নেবেন|
-কাকলি”
সাদামাঠা চিঠি, নেই কোন ভাব, নেই কোন উচ্ছাস| তাও চিঠিটা পড়ল বার কয়েক| এক অপরিচিতার কাছ থেকে পাওয়া প্রথম চিঠি| আলোকের বুঝতে অসুবিধে হলো না যে কাকলি তাকে আকর্ষণ করছে| অথচ নাম আর
ই –মেল টা ছাড়া কিছুই জানে না সে কাকলির ব্যাপারে | মেয়েটি হয়ত বিবাহিতা, হয়ত বা অন্য কাউকে ভালবাসে| অনেক চেষ্টা করল কিন্তু কিছুতেই মন থেকে কাকলিকে সরাতে পারল না| ই-মেলের উত্তর লিখল, পছন্দ হল না , ডিলিট করে দিয়ে আবার লিখল আবার ডিলিট করে দিল| অবশেষে যে চিঠিটা লিখল সেটাও সাদামাঠা |
“ঘটনাচক্রে আপনার বইটি পাওয়ার পরেই আমাকে আমেরিকায় পাড়ি দিতে হয়েছে| আপনার প্রিয় বইটিও আমার সঙ্গে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছে, অবশ্যই বিনা টিকিটে| যদি জিজ্ঞাসা করেন কেন-আমার সঠিক কোন উত্তর নেই| আপনার অসুবিধে না হলে আপনার প্রিয় বইটিকে আমি যত্নের সঙ্গে আমার কাছে রেখে দেব| দেশে ফিরে মালিককে খুঁজে বের করে ফেরৎ দেব, কথা দিলাম| উত্তরের আশায় রইলাম|
আলোক
উত্তর এল , উত্তরের উত্তর ফিরে গেল| চলতে লাগল দুজনের মধ্যে ই-মেলের আদান প্রদান| আলোক অপেক্ষা করে থাকে কখন বাড়ি ফিরে কাকলির ই-মেল পড়বে| কত কথাই না হয় দুজনের মধ্যে | মনেই হবে না যে দুজনে দুজনকে কোনদিন দেখেনি পর্যন্ত| ককলি বলে ছেলেরা ওয়ান ডায়মেনসানাল| ছেলেরা শুধু মেয়েদের রূপটাই দেখে| আলোক বলে ছয়টা ঋতুর সমন্বয় দেখা যায় একটি মেয়ের মধ্যে| কাকলি ঠাট্টা করে বলে মেয়েদের সমন্ধে এত কিছু জানাটা খুব সন্দেহজনক | একটা সময় এল দুজনে দুজনকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল| বিরহ ,আর সহ্য হচ্ছিল না|
অবশেষে আলোকের বিদেশে কাজের মেয়াদ একদিন শেষ হল | আলোক রওনা দিল দেশের পথে| ই-মেলে কাকলিকে জানিয়েছিল তার ফেরার খবর| কাকলি উত্তর দিয়েছিল| সেই উত্তর আর কাকলির নির্দেশ মতই আলোক আজ এই হাওড়া স্টেশনে একটা কোনায় দাঁড়িয়ে আছে শবরীর প্রতিক্ষায়|
আলোক ঘড়ির কাঁটাটা আর একবার দেখল| নির্ধারিত সময়ের আর তিন মিনিট মাত্র বাকি | চোখটা একবার বুলিয়ে নিল চারদিকে | চোখে পড়ল না কিছুই | তবে কি কাকলি এল না| কাকলি কি ভুলে গেল আজ ওদের দেখা করার কথা| কাকলি কি শুধুই খেলা করছিল ওর সঙ্গে| আলোক আর একবার চোখটা ঘোরাল চারদিকে| ওইত একটু দুরে একজন মহিলা একটা লাল রংয়ের ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে| আর তাঁর ডান হাতের কব্জি থেকেই ঝুলছে ছাতাটা| আলোক কয়েক পা এগিয়ে গেল ভাল করে দেখার জন্য| একজন মাঝবয়সি ভারী চেহারার ভদ্রমহিলা ডান হাতে একটি লাল রংয়ের ছাতা হাতে নিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন| আলোক ইতস্তত করল কিছুক্ষণ | একবার ভাবল ফিরে যাবে, কেউ জানবে না| কি মনে করে হঠাৎ আলোক মনস্থির করে দৃড় পদক্ষেপে এগিয়ে গেল ভদ্রমহিলার দিকে| অনেকটা কাছকাছি এসে গেছে | একটু অন্যমনস্ক ছিল, হঠাৎ বলা নেই কথা নেই একটা ধাক্কা, কিন্তু খুব জোরে নয়| এক সুন্দরী তরুনীর সাথে| আলোক তাড়াতাড়ি মেয়েটিকে সাহায্য করল মাটিতে পড়ে যাওয়া ব্যাগটি তার হাতে তুলে দিয়ে| মেয়েটি চলে গেল আলোককে ধন্যবাদ দিয়ে| না শুধু চলে গেল না , যাবার আগে ধন্যবাদের সঙ্গে দিয়ে গেল একটি মিষ্টি মধুর হাসি| আলোকের মনে হল মেয়েটিকে আগে কোথাও দেখেছে কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারল না| একটু হেসে বিদায় জানিয়ে আলোকও এগিয়ে গেল লাল ছাতাধারী ভদ্রমহিলার দিকে|
“ কিছু যদি মনে না করেন, একটা কথা জিগ্যেস করব? আপনার নাম কি কাকলি ? আমি আলোক. আপনার হাতে লাল রংয়ের ছাতা আছে বলে জিজ্ঞেস করছি| “
“না, না আমার নাম কাকলি হবে কেন| আমার নাম সরলা|আমাকে একটি মেয়ে একটু আগে এসে এই লাল রঙের ছাতাটা ধরিয়ে দিয়ে বলল আমার সাহায্য চায়| তার মনের মানুষের পরীক্ষা নিতে চায়| কেউ একজন নাকি তাকে খুঁজতে এখানে আসবে| সে যদি এসে আমাকে জিগ্যেস করে কাকলির নাম ধরে তা হলে তাকে যেন এই ছাতাটা দিয়ে দি | আর এটাও বলেছে আপনাকে বলতে যে সে অপেক্ষা করছে আপনার জন্য টিকিট কাউন্টারের কাছে| আপনাকে চিনতে তার কোন অসুবিধে হবে না| কি জানি বাপু আজকালকার ছেলেমেয়েরা যেন কিরকম | যাকগে এই নিন আপনার ছাতা |”
আলোক লাল রঙের ছাতাটা নিয়ে এগিয়ে গেল টিকিট কাউন্টারের দিকে |
লেখক পরিচিতি : সুব্রত মজুমদার
বিঃ দ্রঃ লেখাটি জানুয়ারি,২০২০, “মাসিক জনপ্রিয় লেখনী” প্রতিযোগিতার অন্তর্ভুক্ত।