একদিন প্রতিদিন _ছোটগল্প

0
571
Photo: pixabay
         দুপুরের তাতানো রোদে অনেক্ষণ ধরে মহল্লার আঁকাবাঁকা গলিপথ ধরে হেঁটে হেঁটে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন শাহেদ সাহেব। এ মহল্লায় তিনি নতুন এসেছেন বলেই তিনি ধরতে পারছেন না লাভলু অথবা রফিককে। ঘরে ক্যবল-লাইনের নতুন সংযোগ নিতে হবে। তিনতলা ছাদের ওপর থেকে জানালার রেলিং পেরিয়ে সামনের একচিলতে ব্যলকনীর সাথেই ইলেক্ট্রিক-পোলে বাঁধা আছে মূল অংশ। হাত বাড়িয়ে নিজেও নেয়া যায়, তবে একটু কসরৎ করতে হবে।
বাড়ন্ত-যৌবনা কিশোরীর মতো চৈত্রের উদাস দুপুরে নতুন পাতা গজানো মেহগনি গাছটা কেমন লকলক করছে। ব্যলকনীর গ্রীল থেকে ধাপ বাড়ালেই চড়ে বসা যায় মেহগনি গাছটার মগডালে। ষোড়শীর উরু’র মত খাঁজ কেটে দু’দুটো ডাল ভাগ হয়ে গেছে যেখানটায়, ঠিক সেইখানে একজোড়া কাক তাদের বাসা বানাতে অষ্টপ্রহর মখে করে তারের-টুকরো,মরা-ডাল,ভাঙা টিনের পাত নিয়ে আসছে কোন দূর দূরান্ত থেকে। একজন নিপূন করে বাসা গড়ছে ঠোঁট দিয়ে ঠুঁকরে ঠুঁকরে। অন্যজনা ঘাড় বেঁকিয়ে তীর্যক-দৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে। কখনোবা দু’জনে মিলে খুনসুটি।
               কাকের এ বাসা বানানো দেখে শাহেদ সাহেবের বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস ঝরে পড়ে। তিনি ছেলেবেলা থেকেই শুনে এসেছেন, কোকিল সাধারণত কাকের বাসা-তে ডিম পাড়ে। যে ডিমে তাঁ দিয়ে কাক-মা বাচ্চা ফোটায়। তারপর একদিন সেই বাচ্চাটাকে লাথি মেরে ফেলে দেয়, ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপরও মাতৃত্বের অপরিমেয় সুখ-ময়তায় কাক বাসা বানায়। যখন সে বুঝতে পারে তার জরায়ুতে নিষিক্ত হয়েছে পুরুষ কাকের শুক্রানূ, ঠিক তখন থেকেই তাদের এ অপপ্রয়াস।
মিলন সুখে সুখি কাক-দম্পতি ঘর বেঁধে স্বপ্ন দেখে অজানার!
      স্বপ্ন একদিন শাহেদ সাহেবও দেখেছিলেন! বাবা-মা মারা যাওয়ার পর একগোছা ছোট ছোট ভাইবোনের ভাঙা হাট সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়ে তিনি যখন ভাবলেন এবার একটু থিতু হয়ে বসা যায়! তখন দূরের গাঁয়ের সম্মন্ধ এলো তার বয়সের অর্ধেক এক কন্যার সাথে।
বয়সের দূরত্বের অসমবয়সী বউটা বাসর-রাতেই মন থেকে মেনে নিতে পারলোনা শাহেদ সাহেবকে। কচি বউটার মন যোগাতে তিনি তাঁর সাধ্যের একান্ত করেছেন! তাঁর এই অতি-উৎসাহী প্রাণ-চঞ্চলতাকে কচিবউ আদিখ্যেতা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেনি। ফলে নিরুত্তাপ-নিরুৎসাহে পার করতে হয়েছে একসাথে অনেকটা দিন। যদিও চিন্তা-চেতনায় দু’জনের মতের মিল হয়নি আজ অবধি। এভাবেই দিনের পর দিন। অনেকটা ছেঁড়া শাড়ী জোড়া দেওয়ার অপপ্রয়াসেই পার হয়েছে শীত-বসন্তের আটপৌরে নিতান্ত অচ্ছ্যূৎ জীবন। ইচ্ছেয় হোক অনিচ্ছেয় হোক ততদিনে ঘরে এসেছে ফুটফুটে চাঁদের মতন মুখশ্রী’র এক মেয়ে।
  খুঁপরীমার্কা কবুতরের ঘরের মতন ছোট্র পরিসরে মেয়েটা অসহ্য যন্ত্রনায় নারকীয় পরিবেশে  বেড়ে উঠবে ! ভাবতে পারে না বউ। নিজের জীবনটা তো প্রায় শেষ হয়ে গেছে বুড়ো-ভাঁমের সাথে। অভাবের সাথে সহবাস করে মেয়েটাও নিঃশেষ হয়ে যাবে, ভাবতে পারে না আর। অকারণের সামান্য অজুহাতে একদিন ধলপ্রহরের আলো ফোঁটার আগেই মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে স্বচ্ছল বাবার বাড়ী চলে গেছে সে। সেই যে গেছে, আর ফেরেনি। নিজের আত্মসম্মানবোধ আর প্রচন্ড আত্মাভিমানে শাহেদ সাহেবও আর চেষ্টা করেনি তাদের ফিরিয়ে আনতে! ছাঁ-পোষা চাকুরে তিনি। নিজের খরচের যৎসামান্য রেখে বাকী সব পাঠিয়ে দেন মেয়েটাকে, প্রতিমাসের স্যালারী ড্র করার সাথে সাথেই।
     মেয়ে-বউ চলে যাওয়ার পর নিজের পুরনো ডেরাটা পাল্টে ফেলেছেন তিনি অতি-দ্রুত।
এবং এভাবেই নিয়ম করে ছ’মাসে ন’মাসের মাথায় বাসা বদলানোর এক নেশায় তাঁকে পেয়ে বসেছে। ঘরের আসবাবপত্র বলতে তেমন মূল্যবান কিছু নেইও তেমন। প্রতিবার বাসা পাল্টানোর সময় অতিরিক্ত সামগ্রীগুলো কাজের-বুয়াদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন। শামুকের পিঠে ঘরবাড়ি! বলা যায়,কচ্ছপ-খোঁলের ভেতর বসবাস। নিতান্ত যা না হলেই নয়,হাঁড়িপাতিল রান্নার গ্যাস,একটা ক্যাম্পখাট। আর বিনোদন ব্যবস্থার জন্য টিভিসেট। নির্বান্ধব শহরে তাঁকে পাড়ি দিতে হয় পথ একা একা। অফিসের কলিগদের কাছে তিনি হাস্যপদ। সহজ-সরল নির্লোভ মানুষটাকে বোকা ভেবে কেউ সখ্যতা গড়ে তোলেনি! আর তিনি নিজেও সেভাবে আগ্রহ বোধ করেন না। আপন মনে পড়ে থাকেন নিজের ভূবনে।
     কুঁটনো-কোঁটা, ধোয়া-মোছা’র কাজ করে দিয়ে যায় মাস-কাবারী কাজের বুয়া। স্বপাকহারী তিনি। ভালো হোক মন্দ হোক কেউ তো আর মন্তব্য করে না কোন! একা একা খেতে বসে পরিপূর্ণ সংসারটা ভেবে থাকেন তিনি। যেন মেয়ে-বউ পাশে বসে, একসাথে খেতে বসেন তিনি।
“তরকারীতে তুমি আজ হলুদ বেশী দিয়েছো! ইসস কী বিশ্রী! “বউটা ঝাম্টা মেরে ওঠে।
“কই পাপা? দেখি দেখি! ” পাশে বসা মেয়েটা বলে ওঠে।
“এই নাও পাপা! মুখটা আর একটু হা করো! হ্যাঁ, আর একটু…! ” বাম হাততে ভাতের থালাটা ধরে ডান হাতে ভাতের দলা! কল্পনায় ছোট্ট মেয়েটার মুখে একটা লোকমা তুলে দিতে চেয়ে দু’চোখ ভরে আসে লোনাজলে! ঝাঁপসা জলের প্রতিবিম্বয় একটা মুখ অনেকগুলো মুখ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে,ভাতের থালায় অসংখ্য সাদা সাদা যুঁইফুলের মতন শ্বেত-শুভ্র ভাতের দানায়।
    দূরে সরে থাকা মেয়েটার মুখ ভেসে আসে। টিনের বেড়ার ফুটো দিয়ে সে মুখটা দেখা যায় বিশাল আকাশের মতই বড়! অথচ আকাশের মত পবিত্র মেয়েটা, অতদূর থেকে দেখতে পায় না ছোট্র ছিদ্রের এ পাশে লুকিয়ে থাকা, প্রত্যাশায় ভরানো একজোড়া চোখের চাহনী! তীব্র ভাবাবেগে এভাবে পার হয়ে যায় দিনের পর দিন!
“মেয়েটা এখন কত বড় হয়েছে? কেমন হয়েছে দেখতে? ” প্রশ্নগুলো প্রায়শঃ বিদ্ধ করে শাহেদ সাহেবকে!
    সে কোন আগে, অনেকগুলো ঠিকানা রি-ডাইরেক্ট হওয়া একটা চিঠি এসেছিলো এক সময়। কচি হাতের কাঁপা কাঁপা লেখাঃ,”পাপা-কে জন্মদিনের শুভেচ্ছা! “
হয়তো ওর মা অন্য একটা কাগজে লিখে দিয়েছিলো। সেটা দেখে দেখে বহু সময় নিয়ে, যত্ন করে, কষ্ট করে লিখে পাঠিেয়ছিলো মেয়েটা। ওই একমাত্র চিহ্নটুকু স্মৃতি করে, বুকের গোপন পকেটে সযতনে যক্ষের-ধণের মতন আগলে রেখেছেন শাহেদ সাহেব। ঘামে ভিজে ভিজে সেটা এখন বিবর্ণ শতধারা হয়ে আছে। তবুও স্মৃতি!
      কতবার ভেবেছেন শাহেদ সাহেব, সব ফেলে দিয়ে ছুটে যেতে! পারেন নি তীব্র অভিমানের আভিজাত্যে। তিনি নিজেও জানেন,”অভিমানের মূল্য পৃথিবীতে কেউ কখনোই দেয় না! বরঞ্চ অভিমানের খেসারত দিতে দিতে পার হয়ে যায় অনেকটা সময়! বেড়ে যায় দূরত্ব! তাছাড়া আর কোন মুখে মেয়েটার সামনে যেয়ে দাঁড়াবেন তিনি? যদি সে প্রশ্ন করে, “কেমন পাপা তুমি? এতদিনে মেয়েটার কোন খোঁজ নিলে না! “
কেউ জানুক আর না জানুক – শাহেদ সাহেবব নিজে জানে, সে তার মেয়েটাকে কী ভীষন অনুভব করে! প্রতিটা শ্বাসে-প্রশ্ববাসে জপমালার মতো জপতে থাকে মেয়েটাকে! তসবীদানা-র সুতো গাঁথা থাকে,গুনে গুনে তা বলা যায়। শাহেদ সাহেবের শূণ্যবুকে অগ্রন্থিত, সুতোহীন তসবীদানা-য় কত অসংখ্যবার তিনি মেয়েটাকে! এ জনমে তো হলো না, অন্যকোন জনমে যদি সম্ভব হয়,তাহলে তিনি অবশ্যই মেয়টাকে নিজের আদলে গড়ে তুলবেন! এ ভাবনাটা তাঁর অহর্নিশি!
    রিটায়ারমেন্টের টাকাগুলো সব মেয়টাকে বুঝিয়ে দিয়ে, একাকি একটা জীবন নিয়ে তিনি চলে যাবেন দূর কোন তীর্থের পথে! হোক না সে আজমীর,গুরুদুয়ারা,গয়া বা কাশী! এলোমেলো জীবনের বাকী দিনগুলো নিতান্ত ঝাঁমেলা মুক্তত হয়ে কেটে যাবে,পথে পথে।
অহেতুক এতদিন পরে মা-মেয়ের সংসারে ঢুকে পড়ে উটকো ঝামেলা হয়ে কিইবা লাভ? কথাটা গততরাত থেকে তার মনে-মগজে ঘুরপাক খাচ্ছে। রাতে হঠাৎ করেই শরীরটা খারাপ হয়ে এলো। আজকাল প্রায়ই এ রকম হচ্ছে। সকালে কাজের বুয়া আসেনি। ময়লা হয়ে পড়ে আছে বাসন-কোশন! প্রচন্ড ক্ষিধে, অথচ চা খাবেন সে উপায় নেই। চা-পাতা নিঃশেষ মনে ছিলো না সে কথা। ফ্রিজ এ রাখা পাউরুটি মুখে দিতেই চিমসে একটা গন্ধে মুখ ভরে এলো। মুক্ত-হাওয়ায় ব্যলকনীতে এসে দাঁড়ালেন।তাঁর মাথার ভেতরটা কেমন যেন টিপটিপ চিনচিন ব্যথায় ভরে উঠছে! তিনি অনুভব করছেন মেহগনি গাছের মগডালে বসা কাক-দম্পতির কথপোকথনঃ
“এ্যই, তুমি একটু আড়ালে সরে যাও! পোয়াতি বউ! পরপুরুষেরর সামনে দাঁড়াতে লজ্জা হচ্ছে না? “
“যাহ্! উনি তো একজন মানুষ! মানুষের সামনে পাখিদের আবার লজ্জা কি? “
” পুরুষ পুরুষ-ই! তা সে পশুপাখি হোক বা মানুষ-ই হোক! “শ্লেষের সাথে কথাগুলো বলে ওঠে পুরুষ-কাকটা। হয়তো আরো কতকিছু বলার ছিলো তার।
নীচের দিক থেকে কান্নার একটা সুর ভেসে এলো শাহেদ সাহেবের কানে। ঠিক কোথা থেকে তা ঠাঁহর করা গেলো না। ভালো করে ঠাঁহর করার জন্য খোলা ব্যলকনীতে দেহটা ঝুঁকিয়েছেন শাহেদ সাহেব।
“গেলো, গেলো, গেলো! “- তারস্বরে চিৎকার করে ওঠে মেয়ে কাকটা!
পুরুষ-কাকটা সবেমাত্র আবেশে দু’চোখ মুঁদে মেয়ে-কাকটার ডানা’য় মুখ লুকিয়ছে। চিৎকার শুনে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে দেখে, তিনতলার ব্যলকনী থেকে শাহেদ সাহেবের দেহটা ডাবের-কাঁদি’র মতন হুড়মুড় করে নীচের শান বাঁধানো শক্ত মেঝেতে আছড়ে পড়লো।
লেখক পরিচিতি : ©সিরাজুল ইসলাম,বাংলাদেশ ।কবি, গল্পকার, নাট্যকার, নাট্যশিল্পী, বাংলাদেশ বেতার খুলনা।
SOURCESirajul Islam
Previous articleআমার ছিল
Next articleনীরবতার কাছে
Avatar
Disclaimer: Monomousumi is not responsible for any wrong facts presented in the articles by the authors. The opinion, facts, grammatical issues or issues related sentence framing etc. are personal to the respective authors. We have not edited the article. All attempts were taken to prohibit copyright infringement, plagiarism and wrong information. We are strongly against copyright violation. In case of any copyright infringement issues, please write to us. লেখার মন্তব্য এবং ভাবনা, লেখকের নিজস্ব - কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত..................

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here