কবিকন্ঠে একদিন ধ্বনিত হয়েছিল – “আমি চঞ্চল, আমি সুদূরের পিয়াসী”। কবির এই আকাঙ্ক্ষা। সুদূরকে নিকট করা, অজানা কে জানার ইচ্ছা মানুষের স্বভাবজাত। তাই দেশ বিদেশের পাহাড়, নদী, সমুদ্র, মরুভূমি, মানুষের কথা জানতে আমরা আগ্রহী।
ভারতবর্ষে এমন অনেক ঐতিহাসিক স্থান আছে যা ভারতে ঘটে যাওয়া না না মর্মান্তিক ঘটনার প্রতীক।প্রায় সব ঐতিহাসিক স্থানই বীরত্ব, দেশভক্তি, মানবতা, ভালোবাসা ও কঠোর ত্যাগের চিহ্ন। সেলুলার জেল ও সেইরকম একটি স্থান।
২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে আমি ও আমার মা ও বাবা সেলুলার জেল ভ্রমণের সুযোগ পাই।নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে প্লেনে যাত্রা করে আন্দামান–নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের রাজধানীর পোর্ট ব্লেয়ার এর বীর সাভারকর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌঁছাই। পরে বাসে করে আমরা পৌঁছালাম সেলুলার জেলে।
সেলুলার জেলের মেন গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই আমার রক্ত হিম হয়ে গেল।সেখানের হাওয়া যেন প্রতিটি কারাগারের দেওয়ালে খোদিত এক মর্মান্তিক ঘটনার বাণী শোনাতে লাগল।প্রতিটি কারাগার এক বীর ক্রান্তিকারীর কাহিনী শোনায়, যে নিজের জীবনের পরোয়া না করে দেশের জন্য এই কঠোর বেদনা সহ্য করেছে।
সেলুলার জেলের সম্পর্কে কিছু তথ্য:
- সেলুলার জেল নির্মাণের কাজ শুরু হয় ১৮৯৬ সালে এবং শেষ হয় ১৯০৬ সালে। জেল তৈরী করার জন্য পোড়া মাটির রঙের ইট আনা হয়েছিল বর্মা অর্থাৎ মায়ানমার থেকে । জেল স্থাপন করতে খরচা হয়েছিল ৫,১৭,৩৫২ টাকা।
- সেলুলার জেলে তৈরী করা হয়েছিল সাতটি তৃতল বেষ্টিত ইমারত যেখানে নির্মাণ করা হয়েছিল শত শত সেল বা কারাগার এবং স্থাপন করা হয়েছিল একটি প্রধান মিনার যেখান থেকে বন্দিদের উপর কড়া নজর রাখা হত। জেলে মোট ৬৯৮টি সেল বা কেক্ষর নির্মাণ করা হয়েছিল।
- সেলুলার জেল নামাঙ্কিত হয় ক্ষুদ্র কারাগার বা ‘সেল’ শব্দটি থেকে। এই সেলগুলিতে কয়েদিদের নির্জন কারাবাসে রাখা হত যার দ্বারা এক কয়েদি আর এক কয়েদির সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করতে পারত না।
- সেলের তালা এমন ভাবে তৈরী করা হয়েছিল যাতে বন্দিরা কোনোভাবেই তালা পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারে। সেলে বন্ধ করার পর চাবিটি সেলের ভেতরে ছুঁড়ে ফেলা হত কিন্তু চাবি থাকা সত্ত্বেও বন্দিরা কোনোভাবেই তালা খুলতে পারতো না।
- যেই আসামীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত তাদের ফাঁসি দেওয়ার আগে একটি বিশেষ কারাগারে রাখা হত।
- সেলুলার জেলের সামনে বীর সাভারকর এর স্মরণে একটি মূর্তি ও পার্ক তৈরী করা হয়েছে।বিনায়ক দামোদর সাভারকর সেলুলার জেলের একমাত্র কয়েদি যিনি সেখান থেকে পালাতে পেরেছিলেন।
- জাপানি হামলায় জেলের সাতটি ইমারতের মধ্যে দুটি ইমারত ধ্বংস হয়ে যায় ও স্বাধীনতার পর আরো দুটি ইমারত ভেঙে ফেলা হয়।
- প্রধান মিনারে খোদিত আছে প্রতিটি বীর বিপ্লবীর নাম যারা জেলে থেকে ব্রিটিশদের অমানবিক অত্যাচার সহ্য করেছিলেন।
সেলুলার জেলের ইতিহাস :
সেলুলার জেল তৈরী হওয়ার আগেও ব্রিটিশরা আন্দামান দ্বীপপুঞ্জকে কারাগার হিসাবে ব্যবহার করত। এই দূরবর্তী দ্বীপপুঞ্জকে ক্রান্তিকারীদের সাজা দেওয়ার উপযুক্ত জায়গা বলা হত কারণ প্রথমত, আন্দামান একটি পৃথক স্থান হওয়ায় রাইরের মানুষের সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করা যেত না। দ্বিতীয়ত, জলপথে যাত্রায় ধর্ম ভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা ছিল যার কারণে বিপ্লবীদের সমাজে আর গ্রহণ করত না। তৃতীয়ত, সেখান থেকে পালানোর কোনো পথ ছিল না আর পালাতে পারলেও হিংস্র জীবজন্তুর হাতে প্রাণনাশের আশঙ্কা ছিল।
বন্দিদের দিয়ে কঠোর পরিশ্রম করানো হত– সর্ষের তেল নির্যাস করানো, হাজার হাজার নারকেল ছাড়ানো, ব্রিটিশদের বাড়ি ও অন্য কারাগার তৈরী করানো হত।এই কাজ করতে না পারলে বা কোনোরকম বিরোধিতা করলে কয়েদিদের উপর অকথ্য নির্যাতন করা হত।
১৯৩৩ সালের মে মাসে কয়েদিরা অনশন ধর্মঘট শুরু করে। এই ধর্মঘটের প্রভাব পুরো দেশে দেখা যায়। যখন ব্রিটিশরা এই ধর্মঘটের প্রভাব দেখতে পায় তখন মহাবীর সিং, মোহন কিশোর নামদাস ও মোহিত মৈত্র নামক তিনজন কয়েদিকে মেরে ফেলা হয়। পরে মহাত্মা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুরোধে এই হরতাল রোধ করা হয়েছিল। সেলুলার জেলে বন্দি থাকা কিছু উল্লেখযোগ্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাম হল– বারীন ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, বটুকেশ্বর দত্ত ও ছত্তর সিং ।
১৯৪২ সালে জাপানি আক্রমণের পর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু পোর্ট ব্লেয়ারে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। ১৯৪৫ সালে জেলের অধিকার আবার ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়।
আমার অভিজ্ঞতা:
সেলুলার জেলের ইতিহাস জানার পর আমার হাড় হিম হয়ে গেল। আমার মাথা নত হয়ে গেল সেই সকল সংগ্রামীদের প্রতি শ্রদ্ধায়, যারা দেশের কল্যাণ ও দেশবাসীর মঙ্গলের জন্য নিজেরা মৃত্যু বরণ করেছেন। সন্ধ্যা বেলায়, ওম পুরির গলায় “লাইট এন্ড সাউন্ড শো”-তে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের লোমহর্ষক কাহিনী শুনে আমার চোখে জল এসে গেল। এত বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার শিকার হওয়া সত্ত্বেও, সংগ্রামীরা হেরে না গিয়ে, রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন, দেশের জন্য জীবন দান করতে একটুও কুণ্ঠিত হন নি। প্রতিটি সেল এক একটি কয়েদির বীরত্ব ও সহনশীলতার প্রতীক । আজ আমরা এই দেশে ঘুরে বেড়াতে পারছি এই সকল সংগ্রামীদের জন্য। সেলুলার জেল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
সেলুলার জেল কীভাবে যেতে হবে:
- আকাশপথে: যেকোনো এয়ারপোর্ট থেকে বীর সাভারকর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে নেমে সেখান থেকে সেলুলার জেলে যাওয়া যায়। এয়ারপোর্ট থেকে সেলুলার জেলের দূরত্ব ৪ কি মি।
- জলপথে: কলকাতা , চেন্নাই বা বিশাখাপত্তনম থেকে জাহাজে করে আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ার জেট্টিতে পৌঁছাতে হবে। সেখান থেকে সেলুলার জেলের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার এবং গাড়িতে করে যেতে সময় লাগবে আধ ঘন্টা।
পোর্ট ব্লেয়ারে ভ্রমণ করার আরো কিছু জায়গা:
রাজীব গান্ধী ওয়াটার স্পোর্টস্ কমপ্লেক্স , করবিনস্ কোভ বীচ, সামুদ্রিকা মেরিন মিউজিয়াম, এনথ্রোপোলজিকাল এন্ড ফিশারিজ মিউজিয়াম।
কলমে সৃজা বন্দ্যোপাধ্যায়, সালকিয়া, হাওড়া
১১ শ্রেণীর ছাত্রী। আমার ভালো লাগে বই পড়তে, গান গাইতে, রান্না করতে ও সিনেমা দেখতে । আমি ভ্রমণ করতে ও নতুন নতুন খাবার খেতে খুব পছন্দ করি ।