সকালের চা তে চুমুক দিয়ে ফ্ল্যাটের সামনে একচিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে যখন মেঘমালা দেখে চির সবুজের সমারোহ আর তার সাথে আছে একটা ছোট্ট জলাশয় মনটা যেন রোজকার সেই একঘেঁয়েমি থেকে কাটিয়ে ওঠে।গত ৫-৬ বছরে যেন গাছপালা নিধনের যজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে!মানব সভ্যতা আজ অগ্রগামী লোভ,টাকাপয়সার হাত ধরে।কিন্ত এই ফ্ল্যাট টার লোকেশনের জন্য শুভায়ুর কাছে চিরঋণী, বিয়ের পর অনেক খুঁজে প্রকৃতির কোলে একখানা ফ্লাট সে বের তো করেছে। যেখানে তাদের দুজনের হবে নতুন সংসার। হঠাৎ বৃষ্টি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে একে অপরকে জড়িয়ে চলে আসবে ব্যালকনিতে, বৃষ্টি পড়া উপলব্ধি করবে একসাথে।শুভ ডাকার সঙ্গে সম্বিত ফিরে এল মেঘের।একটু গাল টিপে শুভ বললো,’নাও সুন্দরী তৈরী হয়ে নাও আর ভালো করে প্রেজেন্টেশন দিও আজ পরিবেশ দিবসে।’ড.মেঘমালা দত্ত,এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের। আজ আন্তর্জাতিক কনফারেন্স আছে পরিবেশ দিবসের উপর।দেশ,বিদেশ থেকে অনেক বিজ্ঞানীদের আসার কথা।কিন্ত করোনার জন্য তারা ভিডি কনফারেন্সে লেকচার দিয়ে দেবেন।তাড়াতাড়ি শাড়ি পড়ে সেজে গুজে তৈরি  হয়ে নিল মেঘ।শুভ চোখ ফেরাতে পারছে না।জড়িয়ে ধরে পিছন থেকে গালে চুমু দিয়ে বললো, ‘চলুন ম্যাডাম খেয়ে বেরোতে হবে তো!’ খাওয়ার টেবিলে বসে শুভ বললো,’আগাম শুভেচ্ছা।তোমার টপিক কি আজ কনফারেন্সে?’মেঘ বলল,’কার্বন সিকিউষ্ট্রেশন ও কার্বন ক্রেডিট।’শুভ বললো,’সেটা আবার কি!’মেঘ বললো,’এই ধরো গ্লোবাল কনফারেন্স যেমন কিয়েট প্রটোকল,প্যারিস শান্তি সম্মেলনে বিশ্বের সব দেশ অংশ গ্রহন করে এই উদ্দেশ্যে কি করে সারা বিশ্বে কার্বন এমিশন কমিয়ে দূষণের মাত্রা কমানো যায়!তাতে ঠিক হয় প্রথম বিশ্বের দেশ অর্থাৎ আমেরিকা,গ্রেট ব্রিটেন ইত্যাদি দেশ গুলো দূষণের মাত্রা কমাতে না পারলেও তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলো প্রচুর পরিমানে গাছ লাগিয়ে কার্বন সেকুইস্ট্রেশন করবে প্লান্টেশনের মাধ্যমে।গ্লোবালি ব্যাপারটা দাঁড়ায় একজন দূষন করলেও অপর জন যে কমজোর অর্থাৎ তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলো গাছ লাগিয়ে কার্বন কে ব্যালান্স বা মিনিমাইজ করে ফেলবে। অবশ্যই প্রথম বিশ্ব এই কাজের জন্য তৃতীয় বিশ্বকে টাকা দেবে।এটাই হল কার্বন ব্যবসা বা কার্বন ট্রেডিং।’শুভ বললো,’সত্যি কি অবস্থা আমাদের!দূষণ করবে ওরা তার মাশুল গুনবো আমরা!গাড়িতে যেতে যেতে শুভ বলল,’একটু সাবধানে থেকো  কনফারেন্সে গিয়ে মানুষজনের সাথে দূরত্ব বজায় রেখো।পরের সপ্তাহ থেকে জানো লকডাউন হবে বলছে।যাতে সংক্রমণ না বাড়ে।’মেঘ বললো,’আচ্ছা বাবা মনে থাকবে।বাই।’মেঘ ভাবছে বাড়ির চার পাশেই কি অবস্থা!ইতস্ততঃ  বিক্ষিপ্ত ভাবে নোংরা পড়ে থাকে।বৃক্ষরোপণের বদলে নতুন নতুন ফ্ল্যাট বা কনস্ট্রাকশন এর জন্য হচ্ছে বৃক্ষনিধন যজ্ঞ।অথচ আজ সেই ব্যাপারটা যাতে দূষণ কমানো যায় আর গাছ লাগানো যায় সেটা  নিয়েই কিছু সমাধান নিয়ে তার প্রেজেন্টেশন।রেজিস্ট্রেশন ডেস্কে নিজের নাম রেজিস্টার করে কনফারেন্স হলে ঢুকে সোজা স্টেজে আয়োজনের দিক টা দেখতে গেল।মাননীয় রাজ্যপাল মহাশয় উদ্বোধন করার পর শুরু হয়ে গেল তিন দিন ব্যাপী আন্তর্জাতিক কনফারেন্স।আজ প্রথম দিনেই লাঞ্চ ব্রেকের পর আছে প্রফেসর মেঘমালা দত্তর প্রেজেন্টেশন।একটু নার্ভাস এখনও লাগে।ওঠার পর সে শুরু করলো যে বাতাসে গ্রীন হাউস গ্যাসের পরিমান আস্তে আস্তে বাড়ছে কাঠ কয়লা,জ্বালানি পোড়ানো,গাড়ি,কলকারখানার ধোঁয়া থেকে।এর বদলে ইউরো-টু-টায়ার বা ফোর ব্যবহার,চিমনী লাগানো,কার্বন-ডাই-অক্সাইডএর উৎস স্থলে দূষণ নিয়ন্ত্রক বসানোই একমাত্র  সমাধান।সব শেষে কার্বন সেকুইস্ট্রেশন ও কার্বন ট্রেডিং আলোড়ন ফেলে দিল।অনেক তর্ক-বিতর্ক ও প্রশ্নবাণের সঠিক উত্তর দিয়ে সে নেমে এল অনেক প্রশংসা কুড়িয়ে।শেষ দিনে পুরস্কার ছিল সেরা প্রেসেন্টশনের জন্য।নাম ঘোষণা হলো প্রথম পুরস্কারের জন্য ড.মেঘমালা দত্তর।সাথে আর একটা সারপ্রাইজ প্যারিস শান্তি সম্মেলনে তার দেওয়া সমাধান চলে যাবে, সে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করবে।আনন্দের বারিধারা চক্ষু থেকে অনর্গল নির্গত হতে লাগল।দেখলো তার বর মহাশয় যে কিনা কাজের চাপে উঠতে পারে না সে ঠিক চলে এসেছে স্ত্রীর গর্বে গর্বিত হতে।উষ্ণ আলিঙ্গনে মেঘের হ্যাং ওভার কেটে গেল।পরের দিন টাইমস অফ ইন্ডিয়াতে মেঘের বিজয়িনী হবার খবর,প্রধানমন্ত্রীর থেকে অর্থমূল্য পাবে আর প্যারিস যাওয়ার ছাড়পত্র আনতে যেতে হবে।
আর পাশেই সেই ভয়াবহ খবরাখবর করোনা আক্রান্তের বেশ কয়েকটি খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে তাই অনির্দিষ্টকালের জন্য লক ডাউন শুরু হবে দুই দিন পর থেকে।খবরটা শুনে মন খারাপ হয়ে গেল।যাই হোক এ ভাবেই হয়তো জীবন থেমে গেল।বিয়ের পর এ বারেই ছিল প্রথম পুজো দুজনের একসাথে।পুজোর আগে আগে মেঘের পাহাড় পছন্দ বলে কথা ছিল একসাথে শিলংয়ে যাওয়ার।কিছু একান্ত সময় কাটবে শীতের আদুরেপনায় আলতো রোদের আলসেমিতে মেঘ-বৃষ্টির লুকোচুরিতে শুভ-মেঘের আদুরে আলিঙ্গনে সমগ্র সময়কে পিছু ফেলে মিশে যাবে ভালোবাসার রাসলীলায়।যেখানে থাকবে না কোন কোলাহল,একঘেঁয়েমি, কৃত্তিম জীবনযাত্রা।শুধু থাকবে ভালোবাসার আল্পনায় কল্প মেদুরতা।আর পুজোর প্ল্যান ছিল কলকাতায় কদিন কাটিয়ে সবাই মিলে যাবে শুভর দেশের বাড়ির নিজেদের পুজোতে।কিন্ত যেখানে সর্বক্ষণ অস্তিত্বের জন্য চলছে সংগ্রাম সেখানে এসব নিয়ে ভাবাটাও এখন বিলাসিতা।পাক্কা দুই মাস কেটে গেল,যেটা ১ থেকে শুরু হয়েছিল সংখ্যাটা আজ ৫০০০।তাই আর শুভ-মেঘ নিজেদের কথা ভাবে না।বাড়ি থেকে কাজ করে শুভ বিদেশী ক্লায়েন্টদের সাথে আর অনলাইন কলেজে লেকচার দেয় মেঘ।মেঘ বললো ‘শুভ,জানতো লকডাউনে আমরা যে শুধু স্বনির্ভর হয়েছি তা না।বিশ্ব উষ্ণায়ন অনেক কমেছে।আজকে একটা পেপার লিখছিলাম জার্নালে সার্ভে রিপোর্টে দেখছি যে গাড়ি না চলা বা ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ থাকার দরুন কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমান অভাবনীয় হারে কমেছে।প্রকৃতি নিজেকে ঠিক করে নিতে শুরু করেছে।’শুভ বললো,’আসলে আমাদের লোভ-লালসা চরিতার্থ করার জন্য তো বৃক্ষ নিধন,আমাজনের জঙ্গলে আগুন লাগানো,অবলা প্রাণীদের উপর ক্রমাগত অত্যাচার করে প্রকৃতি মাকে রুষ্ট করেছি।সব পাপেরই যে অন্ত হয় মানব জাতি তা ভুলে যায়।তাই প্রকৃতির প্রতিশোধ আজ মানবজাতির উপর হানে করোনা মহামারী।’ মেঘ বললো,’সত্যি, জানিনাগো মুক্তির পথ কোথায়!তবু বাঁচতে হবে নতুন করোনা মুক্ত প্রভাতের সন্ধানে।’মেঘ আর শুভ তাদের সঞ্চিত অর্থের অনেকটাই দান করেছে ফান্ডে।স্থানীয় মানুষদের রেশন দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে।এভাবেই সবাই হয়তো মানবতার জয়গান গাইবে। এই ঘোর দুর্দিনে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে সন্ধান করবে নব প্রভাতের কলুষমুক্ত পৃথিবীর।

কলমে সুনন্দা দিকপতি যশ, হুগলি

পেশায় রিসার্চ স্কলারনেশায় আর ভাবনায় লেখা আর ভালো বইয়ের পোঁকা।শিখতে আর পড়তে ভালো লাগে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here