নমিতা ধীর পায়ে সতর্কতার সাথে এগিয়ে আসছিলেন রুদ্রপ্রসাদের জন্য সদ্য বানানো গরম চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে। অকস্মাৎ কানে এল বেতারে ভেসে আসা ঘোষকের স্বরধ্বনি। গ্রানাইট্ কাউন্টারটপের ওপরে রাখা তাঁর প্রিয় ছোট্ট টিভির স্ক্রিনে শিরিষের আঠার মত চোখটা আটকে গেল। হাত থেকে চায়ের কাপটা আচমকা পড়ে গেল, ঝন্ঝনিয়ে বোন–চায়নার পাতলা কাঁচ মার্বেল পাথরের শক্ত মেঝেতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। সারা শরীরটা কেঁপে উঠল, শরীরের অনুপরমানুতে প্রাণঘাতী বিষ ছড়িয়ে পড়লে যে মরণশীল আতঙ্কের সৃষ্টি হয় সেই রকমের এক অনুভূতি হঠাৎ এসে গ্রাস করল নমিতাকে। একটা অব্যক্ত কান্নার রোল গলার কাছে উঠে এসে আটকে গেল। অবশ হয়ে এল তাঁর সর্বাঙ্গ, বেসামাল শরীরটা মাটিতে পড়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য শেষ চেষ্টা করলেন দুটো হাত দিয়ে সজোরে কাউন্টারটপটাকে চেপে ধরে।
বেঁহুস হয়ে পড়ে যাওয়ার আগে শরীরের সব শক্তিকে একত্র করে নমিতা চিৎকার করে উঠলেন ‘ওগো শুনছো।’’
‘‘মুম্বাই পুনে এক্সপ্রেস্ওয়ের ওপর এক আকস্মিক কার একসিডন্টে প্রখ্যাত সাহিত্যিক ঋষি সেনগুপ্ত নিহত– এত কম সময়ে —এই অল্পবয়স্ক সাহিত্যিক—বুকার প্রাইজের জন্য মনোনিত তাঁর সদ্যপ্রকাশিত বই— আকস্মিক এই দুর্ঘটনা যেমন মর্মান্তিক— পুলিশ ঘটনাস্থলে—আগুন– অর্ধদগ্ধ দেহটি–তদন্তকারী অফিসার আরও বলেন–।’’
ব্রেকিং নিউজের ভাষ্যকারের ঘোষণা গল্পের মত শোনাচ্ছিল কিন্তু শোনার জন্য কোন শ্রোতা ঘরে উপস্থিত ছিল না।
গল্পের কোন আরম্ভ থাকে না, কোন অন্ত থাকে না, একটি অভিজ্ঞতার মুহুর্ত থেকে হয় গল্পের জন্ম, তারপর হয় কখন সে পূর্ণগতিতে এগিয়ে চলে কখন মন্থরগতিতে পিছিয়ে আসে আপন খেয়ালে।
দিনটা আজ অন্যরকম। যেমন কন্কনে ঠান্ডা তেমনই কুয়াশাচ্ছন্ন, আর ভেজা ভেজা। ঘরের সব জানলার ব্লাইন্ডস্গুলো নামানো, বসবার ঘরে মনোযোগী ও দ্বন্দ্ব যুদ্ধে মত্ত দুটি প্রাণী, একজন প্রবীণ ও অন্যজন নবীন, ডক্টার রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত ও হূষি সেনগুপ্ত। অদুরে মৌন হয়ে বসে আছেন আরো একজন, শুধু তাঁর হাত দুটো চলছে মেসিনের মত।
‘‘মনে আছে তো যে আজ বাদল আসছে?’’ রুদ্রপ্রসাদ তাঁর রাজাকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করার প্রয়াসে দাবায় কোনরকমে একটা চাল দিয়ে গলাটা একটু তুলে প্রশ্নটা করলেন নমিতার উদ্দেশ্যে। অদুরেই শান্তভাবে বসে উলের কাঁটায় সোয়েটার বুনছিলেন শুভ্রকেশী নমিতা সেনগুপ্ত। চালটা যে রুদ্রকে বাঁচাতে পারবে না সেটা নমিতারও বুঝতে অসুবিধে হল না এতদুর থেকেও। নমিতা তাঁর স্বামীর এই স্বভাবের সঙ্গে পরিচিত। পরাজিত হবার ঠিক আগের মুহুর্তে ছেলের কাছে সম্মান বাঁচানোর জন্য এবং ছেলেকে অন্যমনস্ক করার জন্য রুদ্রের এই সর্বশেষ প্রচেষ্টা এতই ক্যালকুলেটেড্ যে এক চিলতে হাসির কনা উঠে এসে লেগে রইল তাঁর ঠোঁটের কোনায়। উত্তর না দিয়ে ঘাড়টা কাৎ করে সম্মতি জানালেন তিনি। কর্নেল সরকার ওরফে ডক্টার সরকার যে আজ আসছেন সেটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে এতবার যে সেকথা কারোর অজানা থাকার কথা নয়।
‘‘শীতটা আজ বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। বাইরে এত জোরে হাওয়া দিচ্ছে যে, ঘরের ভিতরে বসেও সেই আওয়াজ কানে আসছে, তাই না?’’ প্রশ্নটা প্রায় ছুঁড়ে দিলেন ছেলের দিকে, নমিতার দিক থেকে কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে। তাঁর শেষ চেষ্টা যদি ঋষিকে অন্যমনস্ক করা যায়, যদি সে তাঁর চালটা ধরতে না পারে, যদি সে ভুল করে অন্য কোন চাল দিয়ে দেয়।
কিন্তু কোন কাজ হল না।
‘‘হাঁ, আমিও পাচ্ছি, চেক্ এন্ড মেট্ বাবা।’’ ৠষি নিরস মুখে উত্তর দিল দাবার শেষ চাল অর্থাৎ কিস্তিমাৎ করার ঠিক আগের মুহুর্তে।
রুদ্রপ্রসাদ চুপ করে বসে রইলেন।
নমিতার কাছে এই সময়টা সব থেকে অস্বস্তিকর। না পারেন ছেলেকে বাহবা দিতে, না পারেন স্বামীকে স্বান্তনা জানাতে।
তাই যেটা করা তাঁর পক্ষে সবথেকে স্বাভাবিক সেটাই করলেন তিনি।
‘‘যাক্ খেলা যখন শেষ হয়েছে, আর তোমাদের যদি খিদে পেয়ে থাকে তাহলে আমার ডিনার ইজ্ রেডি। রাত তো অনেক হল, বাদলবাবু তো এখনও এলেন না। যদি বল তাহলে সব খাবার গরম করতে শুরু করি। যা ঠান্ডা পড়েছে সব কিছু নিশ্চয় জমে গেছে এতক্ষনে।’’ নমিতা উলের বোনা থামিয়ে উত্তরের জন্য দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
‘‘আজকের এই দিনে বাদলকাকু হয়ত নাও আসতে পারেন, বাবা। হয়ত কাল সকালেই আসবেন ঠিক করেছেন।’’
‘‘আসার সময় তো এখনো চলে যায়নি ৠষি, আরো একটু অপেক্ষা করতে ক্ষতি কি? আমরা তো বাড়িতেই আছি, সে আসছে এত দুর থেকে, তাও আমাদের অনুরোধে। আমরা যদি সবাই খাওয়া দাওয়া সেরে বসে থাকি বাদল আসার আগে, সেটা খারাপ দেখায়। আর তাছাড়া এতদিন মিলিটারিতে কাজ করা লোকের কাছে এই ধরনের আবহাওয়া এমন একটা কিছু নয় যে সে প্ল্যান্ চেঞ্জ্ করবে। শুনেছি তো সে নাকি কারগিলের মত দুর্গম আর ঠান্ডা জায়গায় কাটিয়েছে বেশ কয়েকটা বছর।’’
‘‘দেখো সেটা ছিল চাকরীর ব্যাপার। চাকরী করার জন্য লোকে অনেক কিছু রিস্ক নিয়ে থাকে আর নিতেও হয়, তাই বলে রিটায়ার করে ভেকেশান্ করতে গেলেও ওই ধরনের রিস্ক নিতে হবে এমন কোন কথা নেই।’’ বাদল কাকুর ওপর বাবার উইক্পয়েন্টটা হূষির অজানা নয় তবু তর্কের খাতিরে বলতে বাধ্য হল। উত্তরটাও যে তার জানা নেই এমন নয়, আর সেটার জন্যেই অপেক্ষা করে রইল ৠষি। তার বাবা ভীষণ প্রেডিক্টেবল্, আর সেই জন্যেই বোধ হয় বাবাকে তার এত ভালো লাগে।
উত্তর এল রুদ্রপ্রসাদের কাছ থেকে। কিন্তু ছেলের কথার প্রতিবাদ করলেন না তিনি। তার বদলে যে উত্তর এল তার জন্য প্রস্তুত ছিল না ৠষি ।
‘‘এই তোমার মার জন্যেই তো এই জঘন্য পান্ডব বর্জিত একটা জায়গায় বাড়ি কিনলাম রিটায়ার করার পর। আগে তোমায় কখন বলিনি। তুমি তখন খুব ছোট, একবার এই জায়গাটায় এসেছিলাম তোমার মাকে নিয়ে বেড়ানোর জন্য। এখন মনে হয় কেন এসেছিলাম কে জানে। তোমার মার যে জায়গাটা এত ভাল লেগে যাবে কখন ভাবিনি। বলতে গেলে লাভ্ এট্ ফাস্ট্ সাইট্। সবই ভবিতব্য বুঝলে না, সবই ভবিতব্য। ভাগ্যের লেখা কেউ খন্ডাতে পারে না। এখানে নেই কোন বন্ধুবান্ধব নেই কোন কোলাহল। আছে শুধু পাহাড়, নদী, নীরবতা, শব্দহীনতা আর বর্ণনাতিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। প্রথম প্রথম যে ভালো লাগত না তা নয়, কিন্তু আজকাল আর ভালো লাগে না। এসব জায়গা ভেকেশান করতে এলে হয়ত ভালো লাগে, কিন্ত দৈনন্দিন জীবন যাত্রায় জন্য এই জায়গা উপযুক্ত কিনা আমার সন্দেহ হয়। বড় একা একা লাগে, তাই বাদলকে বলেছিলাম এখানে একবার আসার জন্য। বুড়ো হয়ে গেছি, পুরনো বন্ধুবান্ধব্দের সঙ্গে একটু সুখ দুঃখের কথা বলতে ভালোই লাগে। ’’
বাবার কথাগুলো স্বগোতোক্তির মত শোনাল ৠষির কাছে, অবাকও হল সে বাবার কথায়। তার ধারণা ডাক্তারী পেশার থেকে রিটায়ার করার পরে এই বাড়ি কেনার জন্য বাবার তাগিদই বেশী ছিল তার মায়ের থেকে। তার মা চিরকাল চুপচাপ, বাবার ওপর জোর খাটাতে কখন দেখেনি সে। মায়ের মুখের দিকে একবার তাকাল ৠষি। তার মা নীরব, কোন উত্থান পতন বোঝবার উপায় নেই। মনে হল হঠাৎ সুযোগ পেয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে একটা কুৎসিত নীরবতা। অশুভ একটা কিছুর ইংগিত সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে, ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছে সবকিছু, সমস্ত আবহাওয়াটা হয়ে উঠেছে থমথমে, বিষাক্ত ও অসহনীয়। অস্বস্তি লাগছিল ৠষির। তার মা হয়ত উত্তর দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, কিন্তু ঠিক সেই সময়ে সমস্ত নীরবতাকে ভেঙ্গে দিয়ে দুরে গেট খোলার আওয়াজ পাওয়া গেল, আর মাটিতে পড়ে থাকা ঝরাপাতার ওপর ভারী জুতোর মচ্মচ্ শব্দ ক্রমশ এগিয়ে এল দরজার দিকে।
‘‘ওই বাদল এসে গেছে। কি তোমাদের বলেছিলাম না বাদল আসবেই, ওয়েদার যতই খারাপ হোক না কেন ও আসবেই। আমি জানতাম বাদল আসবেই। কি ডানপিঠে ছিল কম বয়সে। কে বলে বা–বাঙালিদের মিলিটারিতে নেয় না। বাদলের মত বাঙালি হলে তবে তো নেবে?’’
রুদ্রপ্রসাদের উচ্ছাসে বাধা পড়ল, তিনি দেখলেন মা আর ছেলের মধ্যে ক্ষণিকের জন্য চোখাচোখি হয়ে গেল। নমিতা তাড়াতাড়ি সামাল দিলেন।
‘‘ঠিক আছে এখন তাড়াতাড়ি যাও দরজাটা খুলে বাদল বাবুকে ভিতরে নিয়ে এসো। যা ঠান্ডা, ভদ্রলোককে আর বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখো না। ’’
বসার ঘর থেকে সদরের দরজা একটু দুরে। রুদ্রপ্রসাদ যথাসম্ভব দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন তাঁর বন্ধুকে স্বাগত জানাতে। নমিতা আর হূষির কানে এল দুই বন্ধুর মধ্যে আদর ও আপ্যায়নের বিনিময়। অল্পক্ষন পরেই রুদ্রপ্রসাদ ঘরে ঢুকলেন লম্বা, স্থুলকায়, ছোট ও গোল গোল চোখের এক ভদ্রলোককে প্রায় বগলদাবা করে।
‘‘আমার বন্ধু, কর্নেল বাদল সরকার।’’ রুদ্রপ্রসাদ পরিচয় করিয়ে দিলেন ৠষি ও নমিতার সাথে।
সকলের সাথে নমস্কার ও পরিচয় আদান প্রদানের পরে কর্নেলকে সম্মানের সাথে বসানো হল একটি সোফায়। রুদ্রপ্রসাদ তাড়াতাড়ি ভিতরে চলে গেলেন হুইস্কি ও সোডার সরঞ্জাম জোগাড় করার জন্য। কর্নেল সরকার গল্প শুরু করে দিলেন নমিতা আর ৠষির সাথে।
কর্নেল বাদল সরকার যে আমুদে আর আসর জমিয়ে রাখার উপযুক্ত লোক অচিরেই তার প্রমান পাওয়া গেল। আরাম করে শরীরটা সোফায় এলিয়ে দিয়ে হুইস্কির গ্লাসে মাঝে মাঝে চুমুক দিতে দিতে তিনি শুরু করে দিলেন একের পর এক গল্প। দেশে ও বিদেশের নানান জায়গায় তাঁর ভ্রমন, বিভিন্ন ধরনের স্মরণীয় মানুষের সঙ্গ ও কৌতুলোদ্দীপক অভিজ্ঞতা চিত্তাকর্ষক ও আকর্ষণীয় ভাবে মুনসিয়ানার সাথে বলতে শুরু করলেন। আগ্রহী শ্রোতারা নীরবে ও অনন্যচিত্তে সেইসব গল্প শুনতে লাগলেন।
ডিনার টেবিলে বন্ধু গর্বে গর্বিত রুদ্রপ্রসাদ থাকতে না পেরে বলে উঠলেন ‘‘ওকে তো এখন এরকম দেখছো, কম বয়েসে ওর চেহারা ছিল ফিল্মস্টারের মত, তার ওপর পেশায় ডাক্তার। দৃষ্টি আর্কষণ করা চেহারা আর সতেজ ও আনন্দোচ্ছল ব্যবহার মেয়েদের আকর্ষণ করত চুম্বকের মতন। ও ছিল আমাদের সবার প্রিয় আবার হিংসার পাত্র। তার ভাবীকাল ছিল স্বচ্ছ, উজ্জ্বল ও গৌরবময়। সেই বাদল অঢেল পয়সা রোজগারের প্রলভনকে প্রত্যাখান করে হঠাৎ যখন সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করার সিদ্ধান্ত নিল তখন আমরা সেই অপ্রত্যাশিত খবরে বিস্মিত ও বিহ্বল হয়ে ছিলাম। আজও জানিনা কেন সে এই কাজ করেছিল। ’’
ৠষি লক্ষ্য করল তার মা কর্নেল সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। ৠষি আরো লক্ষ্য করল কর্নেল সরকারের দৃষ্টিও আটকে আছে তার মায়ের দৃষ্টির সাথে। ৠষি নামিয়ে নিল তার চোখ, কারুর নজরে ধরা পড়ার আগে।
‘‘ওনার চেহারা এখনও এমন কিছু খারাপ নয়। ’’ নমিতা উত্তর দিলেন।
খাওয়া দাওয়ার পরে আরেক রাউন্ড গল্প শূরু হল। যদিও কর্নেল সরকারই ছিলেন মধ্যমনি কিন্ত দেখা গেল প্রত্যেকেই অংশ নিল এক এক করে। গল্পের রেশ এক সময়ে ঘুরতে ঘুরতে চলে এল ভুত, প্রেত, ঐন্দ্রজালিক ও জ্যোতিষবিদ্যা সংক্রান্ত বিষয়ে। দেখা গেল কর্নেল সরকারের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা এ ব্যাপারে গভীর ও অকৃত্রিম। চুরুটে একটা টান দিয়ে কর্নেল সরকার আর একটা নতুন গল্পের ভুমিকা শুরু করতে যাচ্ছিলেন ঠিক সেই সময়ে প্রশ্নটা করলেন রুদ্রপসাদ।
‘‘আচ্ছা তোমার ওই বাঘের নখের গল্পটার কি হল? ওই যেটা আমাকে টেলিফোনে বলতে শুরু করেছিলে তারপর হঠাৎ থেমে গেলে, চলে গেলে অন্য কথায়। মনে আছে তুমি বলেছিলে সেই বাঘের নখটা নাকি অভিশপ্ত, এক ফকিরের কাছে থেকে পাওয়া, খুব ইন্টারেস্টিং যাই বল। খুলে বল না ভাই, তোমার মুখে শুনতে খুব ভালো লাগবে।’’
‘‘বাঘের নখ?’’ অত্যুৎসুক হয়ে প্রশ্ন করলেন নমিতা।
রুদ্রপ্রসাদের মুখের কথাটা শেষ হওয়া মাত্র কর্নেল সরকারের সারা মুখ চোখের চেহারাটা পালটে গেল। যে মানুষটাকে এতক্ষন আমুদে হাসিখুশি আর আনন্দোচ্ছল বলে মনে হচ্ছিল তাঁর মুখটা হঠাৎ মুহূর্তের জন্য গম্ভীর হয়ে গেল। চোয়ালটা শক্ত হয়ে উঠল। নিমেষের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিলেন কর্নেল সরকার। আর কারো নজরে ধরা না পড়লেও নমিতার চোখকে ফাঁকি দিতে পারলেন না কর্নেল সরকার।
‘‘এটা নিয়ে কাউকে বলতে ইচ্ছে করে না। ব্যাপারটা তোমরা যাকে বলো জাদুবল বা অনেকটা ভোজবাজির মত। অনেকে হাসবে আবার অনেকে রসিকতা করবে। আমার সেটা ভালো লাগবে না।’’ কর্নেলের গলাটা গম্ভীর ও রাশভারী শোনালো।
উপস্থিত তিনজন মনোযোগী এবং আগ্রহী শ্রোতা ঝুঁকে পড়ল সামনের দিকে আর একটা অতীন্দ্রিয় ও রহস্যময় ঘটনার বিবরণী শোনার প্রত্যাশায়।
কর্নেল সরকারের হুইস্কির গেলাস খালি হয়ে গিয়েছিল। গৃহকর্তা উঠে হুইস্কি গেলাসে ঢেলে দিলেন। নতুন ভরা গেলাসে একটা চুমুক দিলেন কর্নেল সরকার।
‘‘একটা বাঘের নখ।’’ পকেটের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে হাতড়াতে লাগলেন ‘‘অসাধারণ কিছু নয়। জুয়েলারীর দোকানে একটু ঘোরাঘুরি করলেই পাওয়া যায়। ইংরেজ আমলে এক সময়ে বাঘের নখ, শিকারের বিজয়স্মারক স্মৃতিচিহ হিসেবে খুব লোকপ্রিয় ছিল।’’
অবশেষে কর্নেল সরকার পকেট থেকে বের করলেন একটি ছোট বাঘের নখ।
নমিতা মুখবিকৃতি করে ঘাড়টা ঘুরিয়ে নিলেন। হূষি হাতটা বাড়িয়ে বাঘের নখটি হাতের মধ্যে তুলে নিয়ে জুহুরী যেভাবে উৎসুক ও সতর্কতার সাথে দামি হীরকনির্মিত কোন সামগ্রীর মুল্যায়ন করে সেই ভাবে পরীক্ষা করতে লাগল। একটি রুপোর আধারের ভিতরে বসানো বাঘের নখ। দৈর্ঘ্যে এক ইঞ্চির থেকেও কম, আধারের ওপর খোদাইকৃত লেখা আর নকশাদ্বারা শোভিত করা। লেখাগুলো পড়ার চেষ্টা করল ৠষি কিন্ত পারল না।
‘‘কিন্ত বিশেষত্বটা কি এই বাঘের নখের?’’ হাতটা বাড়িয়ে বস্তুটি ছেলের হাত থেকে তুলে নিয়ে একবার পরখ করে টেবিলের ওপর সযত্নে রেখে দিলেন রুদ্রপ্রসাদ।
‘‘এই নখটি একাধারে যেমন অভিশপ্ত তেমনই আবার পয়মন্ত। লোকমুখে শুনেছি এক তান্ত্রিক তাঁর দেহ অবসানের অল্পক্ষণ আগে তাঁর অন্তর্নিহিত সমস্ত শক্তি এই নখটির ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। এও শুনেছি এই তান্ত্রিক ছিলেন বড়রকমের সাধক। মন্ত্রবলে তিনি নিজেকে নিয়ে যেতে পারতেন বহু ক্রোশ দুরে তাঁর ইচ্ছেমত যে কোন জায়গায়। অদৃষ্টের ওপর ছিল তাঁর অগাদ বিশ্বাস। মানুষের জন্ম মৃত্যু আর বিবাহ হল নিয়তির
বিধান আর এর ব্যতিচার হল ধ্বংস, দুর্ঘটনা ও চরম পরিনতি এই ছিল তাঁর ধর্মীয় অভিমত। নিয়তিকে নিয়ে পরিহাস করা বরদাস্ত করতেন না। দুর্বাশার মত রাগ আবার শিবের মত ছিল তাঁর অনুরাগ। তাঁর সমকালিন অনেকেই তাঁর কোপে পড়ে যেমন শাস্তি পেয়েছে তেমনি অনেকে আবার পেয়েছে যশ ও প্রতিষ্ঠা। এককথায় বলতে গেলে মানুষকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি এই বাঘের নখটির ভিতরে নিজেকে শরীরবন্দক করে রেখেছেন।’’ ডগায় জমে থাকা ছাইশুদ্ধ চুরুটটা অ্যাশ্ট্রের ওপর রেখে হুইস্কির গেলাসটা তুলে নিয়ে চুমুক দিলেন গম্ভীর মুখে কর্নেল সরকার।
‘‘তার মানে তুমি বলছো বাঘের নখটি অনেকটা তাবিজ্,মাদুলি বা নীলা ধারণ করার মত। যদি সাহস করে পরতে পারো তো ভালো হতে পারে আবার খারাপও হতে পারে, তাই তো?’’ রুদ্রপ্রসাদ প্রশ্ন করলেন।
‘‘অনেকটা ওই ধরনের তবে সম্পূর্ণ একরকম নয়। এটা ধারণ করে থাকতে হয় না। আসলে ব্যাপারটা খুব সহজ নয়, বরঞ্চ বেশ গোলমেলে। সত্যি কথা বলতে কি এটা নিয়ে যত কম কথা বলা যায় ততই ভালো। তার থেকে এসো না আমরা অন্য কিছু নিয়ে আলোচনা করি।’’
‘‘সত্যি অলৌকিক কিনা তুমি হলফ্ করে নিশ্চই বলতে পারবে না। সবই শোনা কথা। একটা বাঘের নখ নিয়ে তুমি এত সিরিয়স্ কেন হচ্ছো বুঝতে পারছি না। ’’ রুদ্রপ্রসাদ তাঁর বৈরী মতামত প্রকাশ করলেন।
‘‘থাক না উনি যখন বলতে চাইছেন না, তোমারই বা জোর করার কি দরকার। ’’ নমিতা পরিবেশটা শান্ত করার চেষ্টা করলেন।
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ তারপর কি মনে করে কর্নেল সরকার নিজের থেকেই আবার শুরু করলেন।
‘‘ঠিক আছে তবে শোন। অলৌকিক বা বিস্ময়কর ঘটনা কিনা তার প্রত্যক্ষ কোন প্রমান আমার নেই, তবে এমন সব ঘটনা এর সাথে যুক্ত আছে যে সেগুলোকে সমস্থানিক বা কোইন্সিডানস্ বলে অ্যাগ্নস্টিকেরা উড়িয়ে দিলেও ক্ষীণ একটা সংশয় মনের দুর্বল কোনায় থেকেই যায়। নখটির বিশেষ একটি গুন আছে। নখটির মালিক তাঁর বাঁ হাতের মুঠোর মধ্যে এটিকে নিয়ে হাতটি ওপরে তুলে দুটো চোখ বন্ধ করে যদি কিছু কামনা করেন তাহলে এই বঘের নখ সেই মনস্কামনা পূর্ণ করবে। মোট তিনবার মালিকটি এই সুযোগ পাবেন। তিনবারের পর সেই মালিকের আর কোন কামনা বা বাসনা পূর্ণ হবে না। নখটি যদি কোন নতুন মালিক পায় তাহলে সেই নতুন মালিক পুনরায় তিনবার সেই সুযোগ পাবেন। এইভাবেই চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।’’
‘‘আরে এতো আরব উপ্যানসের মত গল্প। সেই ম্যাজিক্ কারপেট্ ! না না অনেকটা সেই জিনির রূপকথার গল্পের মত। বোতলের মধ্যে বন্দী হয়ে থাকা সেই জিনির বোতল ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে বিকট দৈত্যের আকার ধারণ করে মালিককে তিনটে বর দান করা– অবিকল সেই রকম। ’’ ৠষি আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল।
নমিতা আড়চোখে একবার কর্নেল সরকারের দিকে তাকালেন। তাঁর আকারের কোন পরিবর্তন নজরে ধরা পড়ল না, একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন তিনি।
‘‘আচ্ছা আপনি তো এই নখটির বর্তমান মালিক। আপনার কি তিনটি মনস্কামনা পূর্ণ হয়ে গেছে?’’ ৠষির প্রশ্ন।
‘‘হ্যাঁ।’’ ছোট্ট উত্তর এল।
‘‘আপনার আগের নখধারিরও তিনটি মনস্কামনা পুর্ণ হয়েছিল নিশ্চই?’’ ৠষি প্রশ্ন করল।
‘‘বলতে পারব না তাঁর মনস্কামনা সম্পুর্ণ হয়েছিল কিনা, হয়ত হয়েছিল কিংবা হয়নি। এ ব্যাপারে কোন আলোচনা তাঁর সঙ্গে করার সুযোগ পাইনি। আমি ডাক্তার হিসেবে গিয়েছিলাম তাঁকে পরীক্ষা করার জন্য এক বন্ধুর অনুরোধে। একেবারে আন্তিম মুহুর্তে পৌঁছেচ্ছিলাম। আমার আর করার কিছু ছিল না। তার থেকেও বড় কথা অসুখটা যে কি সেটাই ধরতে পারিনি। এটা যে একজন ডাক্তারের কাছে কত বড় ব্যর্থতা শুধু রুদ্র আর আমি সেকথা জানি। সেই দুঃখ আমি জীবনেও ভুলতে পারব না। তিনিও বোধহয় সেকথা বুঝতে পেরেছিলেন। মারা যাবার আগের দিন আমাকে এই বাঘের নখটি সন্তর্পনে আমার হাতে তুলে দিয়ে বিস্তারিত ভাবে সব কিছু খুলে বললেন। মৃত্যুর আগের মুহুর্তে কেউ মিথ্যা বলে না। আমি বেদবাক্যের মত তাঁর সব কথা বিশ্বাস করেছিলাম, এবং আজও করি।’’
‘‘তোমার তো তিনটি বর শেষ হয়ে গেছে, তবে এই নখটি তুমি ধরে রেখেছ কেন তোমার কাছে? ’’ রুদ্রপ্রসাদ জানতে চাইলেন বন্ধুর কাছে।
‘‘কি করি বল। এটা এমন একটা সামগ্রী নয় যে আমি বাড়ি বাড়ি ঘুরে এটাকে বিক্রি করতে পারি। তাছাড়া জেনেশুনে এটা আমি কাউকে বেচতেও চাইনা বা বিনা মুল্যে দিতেও চাই না। একবার এক জুহুরীর দোকানে নিয়ে গিয়েছিলাম যদি সেখানে এটাকে বিক্রি করতে পারি, কিন্তু সুবিধে হল না। তারা আমায় জানাল যে এটির কোন মুল্য নেই। এই ধরনের জিনিষ তারা কেনা বেচা করে না। তারপর থেকে হাল ছেড়ে দিয়েছি। আমার কাছে আছে থাক, কোন ক্ষতি তো নেই।’’
‘‘তোমার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমি এই বাঘের নখটি তোমার কাছ থেকে কিনতে রাজি। তুমি কি আমায় এটি বিক্রি করবে?’’ রুদ্রপ্রসাদ প্রশ্ন করলেন।
‘‘দেখ তুমি আমার ছেলেবেলার বন্ধু। এই বাঘের নখের ব্যাপারে সব কথা এখন জেনে গেছ। জেনেশুনে তোমাকে বা তোমার পরিবারের কাউকে আমি এটা দিতে পারি না। তুমি প্লিজ্ আমাকে এই অনুরোধ করো না।’’
কর্নেল সরকার বিদায় নিলেন সকাল বেলায়। বন্ধুবর রুদ্রপ্রসাদ গেলেন স্টেশনে তাঁকে পোঁছে দিতে।
রাত্রিবেলা ডিনারের পর হেলানো বেতের চেয়ারে বসে নমিতা আর ৠষি, অদুরে পিয়ানোর সামনে রুদ্রপ্রসাদ।
মিঠে গলায় রুদ্রপ্রসাদ গাইছিলেন –
‘‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা পরা ঐ ছায়া
ভুলাল রে ভুলাল মোর প্রাণ !
ওপারের ঐ সোনার কুলে আঁধার মুলে কোন মায়া
গেয়ে গেল কাজ–ভাঙানো গান। ….’’
রুদ্রপ্রসাদের উদাত্ত কণ্ঠস্বর সান্ধ্য–প্রকৃতির গায়ে যেন মায়াজাল রচনা করে চলেছে। চেনা গলা তবুও সবাই মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনছে।
‘‘ওরে আয়। আমায় নিয়ে যাবি কে রে
দিনের শেষে শেষ খেয়ায়-’’
ধীরে ধীরে রুদ্রপ্রসাদ গানটা শেষ করলেন।
‘‘কাল ঠিক এই সময়ে বাদল আমাদের সঙ্গে ছিল। ’’
‘‘তোমার গান তো ওনাকে শোনালে না।’’ নমিতা বলে উঠলেন।
‘‘আমার গান কলেজে অনেক শুনেছে, নতুন করে শোনার কিছু নেই। ভাল সময় কি করে কাটানো যায় বাদল কাল তা আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেল। তোমরা কি বল?’’
‘‘বাদলকাকুর মত এমন জমাটি লোক বড় একটা দেখা যায় না। তবে ওনার সাথে একটা ব্যাপারে বাস্তবিকপক্ষে আমার মতপার্থক্য আছে। যাই বল ওই বাঘের নখটি নিয়ে উনি একটু বাড়াবাড়ি করছিলেন। একবিংশ শতাব্দীতে কেউ যে এইসব কথা বিশ্বাস করে আমি ভাবতেই পারি না। ওনার মত এত পন্ডিত ও অভিজ্ঞ ভদ্রলোকের কাছ থেকে তো কখনই নয়। এমন কি উনি যখন ওই বাঘের নখটি তোমায় দিতে অস্বীকার করলেন তখন ওনার মানসিক প্রকৃতি সম্বন্ধে আমার একটু সন্দেহ হচ্ছিল। ’’ ৠষি উত্তর দিল উত্তেজিত ভাবে।
‘‘ওরকম করে বলে না ৠষি। হাজার হোক উনি তোমার বাবার বন্ধু।’’
‘‘বাদল কিন্তু বাঘের নখটি আমাকে দিয়েছিল, ঠিক ট্রেনে ওঠার আগের মুহুর্তে। ’’
‘‘সে কি! তোমায় দিয়েছিল! তুমি এতক্ষণ বলনি কেন আমাদের। তুমি বদলে ওনাকে কিছু দিয়েছিলে?’’ ৠষি আবেগকম্পিত গলায় প্রশ্ন করল।
‘‘কিছুতেই নেবে না, আমি একশোটা টাকার একটা নোট ওর হাতে জোর করে গুঁজে দিয়েছিলাম।’’
‘‘কই দেখি?’’ ৠষি হাতটা বাড়িয়ে দিল।
বাঘের নখটি হাতে নিয়ে ৠষি হাসতে হাসতে বলে উঠল ‘‘এখুনি আমাদের সামনে একপ্লেট্ মটন্ বিরিয়ানি হাজির কর।’’
অল্পক্ষণ অপেক্ষা করেই ৠষি আবার বলে উঠল ‘‘ কই কিছু হল না তো? আমার বলার মধ্যে নিশ্চই কোন খুঁত ছিল, গলাটাকে আরো হয়ত গম্ভীর করা উচিৎ ছিল। দেখি আরেকবার চেষ্টা করি।’’
‘‘এখন রাত দশটা এটাকে দিনের বেলা দশটা করে দাও তো এক্ষুনি।’’ এবারে ৠষির গলা এবার অনেক গম্ভীর।
নমিতা এতক্ষণ ছেলের বালখিল্যতায় হেসে লুটিয়ে পড়ছিলেন, রুদ্রপ্রাসাদও তাঁর স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য্য বজায় রাখতে পারছিলেন না।
‘‘যত্ত সব বুজরুকি। ধন্য তোমার বন্ধু ধন্য তোমার এই বাঘের নখ। নাও তোমার বাঘের নখ, তোমার কাছেই রাখ।’’
‘‘এমন হতে পারে যে তুমি এটির যথার্থ মালিক নও, এই নখটিও হয়ত সে কথা জানে, তাই সে কিছু করল না। ’’ রুদ্রপ্রসাদ হেসে উত্তর দিলেন।
‘‘তাহলে তুমি কিছু কর না। তুমি কিছু চাও না।’’
‘‘সত্যি কথা বলতে আমার কিছুই চাওয়ার নেই। টাকা পয়সা যা রোজগার করেছি তাতে আমার স্বচ্ছলভাবে চলে যাবে। না না আমার কিছু চাওয়ার নেই। ’’
‘‘তারমানে তুমি সবকিছু বিশ্বাস করছ। তাহলে এক কাজ কর না। আমাদের গাড়িটা পাল্টাবার সময় হয়েছে, নতুন গাড়িটার জন্য দশ লাখ টাকাটা চেয়ে নাও না। যদি দেয় তো ভাল, যদি না দেয় তাহলেও কোন ক্ষতি নেই। চেয়ে দেখতে তো কোন ক্ষতি নেই।’’ নমিতা প্রস্তাব দিলেন সহজভাবে।
‘‘তাহলে তোমরা যখন বলছ তবে তাই চেয়ে দেখি।’’
রুদ্রপ্রসাদ বাঘের নখটি বাঁ হাতের তালুতে নিয়ে, মুঠো করে, হাতটি ওপরে তুলে চোখ বন্ধ করে বলে উঠলেন ‘‘যেভাবে পারো আমাকে দশ লাখ লাখ টাকা জোগাড় করে দাও।’’
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ, হঠাৎ রুদ্রপ্রসাদের চিৎকারে সবাই চমকে উঠল।
রুদ্রপ্রসাদ তাঁর বাঁ হাতটা চেপে ধরে ছট্পট্ করতে লাগলেন। নমিতা ও ৠষি তাড়াতাড়ি উঠে এলো উদ্বিগ্ন হয়ে।
রুদ্রপ্রসাদ বাঁ হাতটা খুলে দেখালেন।
‘‘মনে হল বাঘের নখটা যেন জ্যান্ত হয়ে আমাকে আঁচড়ে দিল। অথচ দেখ হাতে কোন আঁচড়ের দাগ নেই।’’
‘‘সবাই সরে দাঁড়াও। একটু ফাঁকা জায়গা কর। নাহলে সবাইকার মাথার ওপর পড়বে একলাক্ টাকার বস্তাটা। ’’ ৠষি উঠে বাবা মাকে সরিয়ে বেতের টেবিলটাকে ঘরের মাঝখানে টেনে এনে করজোড়ে নতজানু হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। নমিতা আর রুদ্রপ্রসাদ হেসে উঠলেন ৠষির ছেলেমানুষী দেখে।
হূষি চলে গেল ভোর বেলা। যাবার আগে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে গেল খুব সাবধানে থেকো, কখন কোথা থেকে একলাখ টাকা মাটি ফুড়ে বেরোবে বা আকাশ থেকে পড়বে কেউ জানে না। বাবার মাথায় ওপর যদি অতগুলো টাকা একসঙ্গে পড়ে তাহলে কি হবে কে জানে। নমিতা একগাল হেসে তাকে বিদায় জানালেন।
ৠষি চলে গেল। চিরদিনের মত চলে গেল। যে চলে যায় দুঃখকষ্ট তাকে আর বিচলিত করে না, কিন্তু যারা থেকে যায় তাদের কাছে বিগতজনের মর্মপীড়া অবিরাম অনুবৃত্তির মত চলতেই থাকে, বন্ধ হয় না। রুদ্রপ্রসাদ নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছেন, সামলাতে পারেননি নমিতা। বাঁধ ভাঙ্গা বন্যার মত বিরামহীন ভাবে কয়েকদিন ধরে তাঁর চোখ দিয়ে জল পড়েছিলো। তারপর নমিতাকে কোনদিন কাঁদতে দেখেননি রুদ্রপ্রসাদ। নিথর, নির্বাক প্রতিমার মত ভাবলেশহীন ভাবে বসে থাকেন একই জায়গায় ঘন্টার পর ঘন্টা। ডাকলেও কোন সাড়া পাওয়া যায় না। তাঁর দীর্ঘদিনের অন্তরঙ্গ সঙ্গীর এই নিদারুণ শোকাল্পুত চেহারা দেখে তিনিও ক্রমশ ভেঙ্গে পড়ছিলেন।
ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিলে ভোরবেলায়। অভ্যাসমত প্রাতঃকালীন পদভ্রমন সেরে সদ্য কেনা খবরের কাগজটা নিয়ে বাইরের বারান্দায় এসে বসলেন রুদ্রপ্রসাদ। পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল, ঠোঁটের কোনায় একটা শুকনো হাসির রেশ লেগে রইল কিছুক্ষণ। নমিতা ঠিক এই সময়ে ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতেন, হাতে ধরা থাকত ট্রেতে সাজানো চায়ের টিপট্ আর ব্রেকফাস্টের সরঞ্জাম। দেশী ও বিদেশী সবরকমের রান্নাতেই নমিতার দক্ষতা ছিল অসাধারণ। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে রুদ্রপ্রসাদ খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে মনোনিবেশ করলেন প্রথম পৃষ্ঠায়।
খুটখাট আওয়াজে রুদ্রপ্রসাদের মনঃসংযোগ বিঘ্নিত হল। খবরের কাগজটা সরিয়ে তাকালেন সামনের দিকে, অবাক হয়ে গেলেন। কোট প্যান্ট আর টাই পরা তীঘ্নধী চেহেরার মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছেন। দুর থেকে পরিচিত কেউ বলে মনে হল না। হাত নেড়ে ভিতরে আসার জন্য আহ্বান জানালেন রুদ্রপ্রসাদ। ভদ্রলোক এগিয়ে এসে তাঁর পরিচয় জানালেন। লোকেশ নাগ এক প্রখ্যাত জীবনবিমা কোম্পানির প্রতিনিধি। সংক্ষেপে তিনি জানালেন তাঁর আসার কারণ। নিহত হওয়ার কয়েকমাস আগে ৠষি একটি জীবনবিমা করেছিলেন এবং নীতি অনুসারে অনুমোদন করেছিলেন আপাত উত্তরাধিকারী হিসেবে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তর নাম। তিনি দুঃখের সঙ্গে জানালেন –আপনজনের মৃত্যুর যে কোন মুল্য হয় না একথা তিনি ভালো করেই জানেন তবুও বিমার পত্রের লিখিত চুক্তির সর্ত অনুসারে তিনি এসেছেন সত্যতা যাচাই করে রুদ্রপ্রসাদকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাঁর পাওনা টাকার চেক্টা দেওয়ার জন্য।
‘‘আপনি যে চেকটা এনেছেন সেটা কত টাকার?’’
অতর্কিত প্রশ্নটা শুনে উভয়ই বিস্ময়ে তাকালেন। নমিতা যে এসে দাঁড়িয়ে তাঁদের কথোপকথন শুনছেন রুদ্রপ্রসাদ ঘুনাক্ষরেও টের পাননি।
‘‘দশ লাখ টাকা।’’
‘‘দশ লাখ! দশ লাখ! আশ্চর্য্য! কি আশ্চর্য্য! আমি জানতাম! আমি জানতাম! অভিশাপ! সব ছারকার করে দিল, সব ছারকার হয়ে যাবে।’’
চিৎকার করতে করতে নমিতা বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলেন।
কিংকর্তব্যবিমুড় হয়ে বসে রইলেন রুদ্রপ্রসাদ ও লোকেশ নাগ।
রুদ্রপ্রসাদের ঘুমটা ভেঙ্গে গেল মাঝরাত্রে একটা চাপাকান্নার আওয়াজে। পাশ ফিরে দেখলেন নমিতা কাঁদছেন। অনেক দিন পরে নমিতাকে কাঁদতে শুনে রুদ্রপ্রসাদ অবাক হলেন। দুটো হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলেন তাঁর জীবনসঙ্গিনীকে। নমিতা অঝোরে কাঁদলেন রুদ্রপ্রসাদের বুকে মাথা রেখে।
‘‘আমার একটা কথা রাখবে? বলো রাখবে?’’
‘‘তুমি যা বলবে আমি কথা দিলাম রাখব। তুমি স্বাভাবিক হও আমি চাই। ৠষিকে হারিয়েছি তোমাকে হারাতে চাই না, বেঁচে থাকার একটা কারণ আমার চাই নমিতা, আমি বাঁচতে চাই।’’
‘‘তোমার ওই বাঘের নখটাকে তাহলে বলো আমার ৠষিকে ফিরিয়ে দিতে।’’
‘‘এটা হয় না নমিতা। এটা কখন সম্ভব নয়। মরা মানুষ কখন ফিরে আসে না নমিতা, আমি নিজে দাঁড়িয়ে তার উত্তরক্রিয়া করেছি। ৠষি আর ফিরে আসবে না। এটাকে মেনে নাও, এটাই ধ্রুব সত্য।’’
‘‘বেশ, তাহলে ওই দশ লাখ টাকাটা?’’
‘‘ওটা স্রেফ কো–ইনসিডেনস্, ওটার জন্য বাঘের নখের কোন অবদান নেই।’’
‘‘ঠিক আছে তুমি যদি বাঘের নখের কথা বিশ্বাস নাই কর তাহলে আমি যা চাইছি তা দিতে তোমার আপত্তি কেন?’’
‘‘না আমার কোন আপত্তি হবে কেন, যদি তুমি তাই চাও তাহলে তাই করব। ’’
রুদ্রপ্রসাদ বিছানা থেকে নেমে শেলেফ্ এর ওপর দুটি বইয়ের মাঝখানে রাখা বাঘের নখটি বাঁ হাতের তালুতে নিয়ে, মুঠো করে, হাতটি ওপরে তুলে চোখ বন্ধ করে বলে উঠলেন ‘‘যেভাবে পারো আমার ৠষিকে আমাদের কাছ ফিরিয়ে দাও।’’
অল্পক্ষণের মধ্যেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ঘুমিয়ে পড়লেন নমিতা। আজ অনেকদিন বাদে নমিতাকে তৃপ্ত দেখে খুশি হলেন রুদ্রপ্রসাদ।
নমিতার ডাকে ঘুমটা আবার ভেঙ্গে গেল রুদ্রপ্রসাদের।
‘‘শুনতে পেয়েছো আওয়াজটা?’’
‘‘কি? কিসের আওয়াজ?’’ চোখটা রগড়ে জবাব দিলেন রুদ্রপ্রসাদ।
‘‘এক বার দেখবে না?’’
‘‘দাঁড়াও দেখে আসি।’’
টর্চটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলেন রুদ্রপ্রসাদ। শোয়ার ঘরের বাইরে এসে প্রস্তুত হলেন আওয়াজটার গতিপথ নিরূপণ করার জন্য। খুট করে একটা শব্দ শুনতে পেলেন, মনে হল সদর দরজার ওপারে। অনেকটা দরজায় মৃদু টোকা দেওয়ার মত । এত রাত্রে কে এল? অবাক হয়ে এগিয়ে এলেন কয়েক পা সদর দরজার দিকে। টর্চের আলোটা এই সময়ে নিবু নিবু হয়ে এলো। দরজার গায়ে কান পাতলেন রুদ্রপ্রসাদ। বাইরে স্পষ্ট মনে হল কেউ একজন দাঁড়িয়ে, একটা হালকা পায়ের ধীর মন্থর চলাফেরা। একটা ভ্যাপসা চেনা চামড়া পোড়া গন্ধও নাকে এসে আঘাত করল রুদ্রপ্রসাদের। গন্ধটা তাঁর নাকে লেগে আছে এখনও। একাই গিয়েছিলেন ৠষির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য। নমিতা আসতে রাজি হননি। পুলিশের কাছে আগেই খবর পেয়েছিলেন রুদ্রপ্রসাদ যে অ্যাক্সিড্যানটের পরে ৠষির গাড়িটায় আগুন লেগে যায়। হূষির অর্ধদগ্ধ দেহটা বহুচেষ্টা করে ও সমবেত প্রচেষ্টায় বাইরে আনা সম্ভব হয়েছিল। কিন্ত পুড়ে যাওয়া ৠষির সেই চেহেরাটা এত বিভৎস যে দেখে উপস্থিত সবাই ভয়ে শিউরে উঠেছিল। সেই কথা শুনে বাঁধ ভাঙ্গা চোখের জলকে থামাতে পারছিলেন না নমিতা, বলেছিলেন মা হয়ে আমি কিছুতেই ওই দৃশ্য দেখতে পারব না।
টর্চের আলোটা নিভে গেল, কুপকুপে অন্ধকারে একা দাঁড়িয়ে আছেন রুদ্রপ্রসাদ। অনেক সাহস জোগাড় করে দরজায় আবার কান পাতলেন। মনে হল খুব ক্ষীন স্বরে কেউ ‘‘মা– মাগো’’ বলে কাৎরাচ্ছে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। ভীষণ ভয় পেলেন রুদ্রপ্রসাদ। এক ছুটে পালিয়ে এলেন শোবার ঘরে।
‘‘কি হল গো? কিসের আওয়াজ? বলো না?’’
‘‘না না ও কিছু নয়। বোধহয় কোন বেড়াল বা কোন জন্তু হবে। তুমি শুয়ে পড়ো।’’ রুদ্রপ্রসাদ কোনরকমে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। তাঁর বুকটা ভিতরটা এখনও ধক্ধক্ করছে।
পাঁচ মিনিটও হয়নি, দরজায় একটা জোরে আঘাত পড়ল শান্ত রাত্রির সমস্ত নীরবতাকে ভেঙ্গে খানখান করে দিয়ে। আচমকা সেই আওয়াজে দুজনেই চমকে উঠলেন। সেই আওয়াজের শব্দ থামতে না থামতেই সদর দরজার বাইরে থেকে এল আর্তনাদ ‘‘মা–মাগো, আমি এসেছি।’’
‘‘শুনছো আমাদের খোকা এসেছে। দ্যাখো সে তোমার কথা শুনেছে, খোকা দাঁড়িয়ে আছে বাইরে, এই ঠান্ডায়, যাও তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজাটা খুলে দাও, ভিতরে নিয়ে এসো তাকে। যাও যাও।’’
‘‘নমিতা এটা হতে পারে না, কিছুতেই হতে পারে না। এটা আমাদের কল্পনা, আমাদের কল্পনাকে আমরা সত্যি বলে ভাবছি। ’’
‘‘তুমি যদি না যাও আমি একাই যাব। আমাকে যেতে দাও, আমাকে ছেড়ে দাও, মাকে ছেলের কাছ থেকে কেউ আটকাতে পারে না।’’
রুদ্রপ্রসাদ প্রাণপ্রণ চেষ্টা করলেন নমিতাকে আটকানোর, কিন্ত ছিলা ছেঁড়া ধনুকের মত নমিতা চলে গেলেন।’’
‘‘আমি আসছি খোকা, আমি এখুনি আসছি।’’
দরজার বাইরে তখন চলেছে তান্ডব, আঘাতের পর আঘাত, ভিতরে নমিতা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন দরজার সবথেকে উঁচু ছিটকিনিটা খোলার, কিন্ত কিছুতেই তাঁর হাত পৌঁচচ্ছে না। নমিতা আর উপায় না দেখে দূরের একটা ভারী চেয়ারের হাতল ধরে সেটাকে টেনে নিয়ে এলেন ধীরে ধীরে। চেয়ারটা টেনে দরজার কাছে এনে তার ওপর উঠে দাঁড়ালেন।
রুদ্রপ্রসাদ হতবাক হয়ে নমিতার কার্যকলাপ লক্ষ্য করছিলেন।
‘‘এইতো বাবা আমি এসে গেছি, এইবার দরজাটা খুলে দিচ্ছি ,তুই আর একটু —।’’ নমিতা হাতটা বাড়ালেন ছিটকিনির দিকে।
রুদ্রপ্রসাদ আর এক মুহুর্ত সময় নষ্ট করলেন না। ছুটলেন শোবার ঘরের দিকে উর্দ্ধশ্বাসে। কোথায় গেল সেই নোখটা? এই তো একটু আগেই তো এখানে ছিলো। অন্ধকারে হাতড়াতে লাগলেন এদিক থেকে সেদিক। অবশেষে তাঁর হাতে উঠে এল সেই বাঘের নোখ। রুদ্রপ্রসাদ বাঘের নোখটি বাঁ হাতের তালুতে নিয়ে, মুঠো করে, হাতটি ওপরে তুলে চোখ বন্ধ করে তাঁর সর্বশেষ ইচ্ছেটি কামনা করলেন—-|
বাইরের তান্ডব, কোলাহল সব হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। ছুটে এলেন রুদ্রপ্রসাদ সদর দরজার দিকে, নমিতা পা পিছলে পড়ে আছেন মার্বেলের মেঝেতে বেহুঁস হয়ে। সতর্কতার সাথে পরীক্ষা করে দেখলেন, সব ঠিক আছে, তাঁর উদ্বেগ লাঘব হল। আপনা থেকেই তাঁর চোখ গিয়ে পড়ল ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু সেই দরজাটির দিকে। অবাক হয়ে রুদ্রপ্রসাদ দেখলেন, যে দরজাটি আপ্রাণ চেষ্টা করেও খুলতে পারেনি নমিতা সেটা আপনা থেকে ক্যাঁচ্ ক্যাঁচ্ আওয়াজ করে খুব আস্তে আস্তে খুলতে শুরু করল। আপ্রাণ চেষ্টা করলেন রুদ্রপ্রসাদ চোখদুটো বন্ধ করে রাখার, কিন্ত কিছুতেই পারলেন না। এক অদৃশ্য শক্তি তাঁকে বাধা দিল। পলকহীন চোখে তিনি তাকিয়ে রইলেন দরজার দিকে। জীবনে এইরকম দৃশ্য দেখতে হবে কখন আশা করেননি। বিষ্ময়বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
পরিপূর্ণ জ্যোৎস্না–রাত্রির রূপ এই প্রথম দেখলেন রুদ্রপ্রসাদ। কেউ কোথাও নেই, ধু ধূ করছে চারিদিক, শব্দহীন, জনহীন নিশীত রাত্রি। এইরকম ছায়াবিহীন জ্যোৎস্না রাত্রি যে সম্ভব না দেখলে বিশ্বাস করতেন না। অদুরে বালি মেশানো জমিতে জন্মানো আর শীতের রৌদ্রে দগ্ধ অর্ধশুষ্ক কাশবনের ডগায় আটকে থাকা শিশিরবিন্দুগুলি জ্যোৎস্নার আলোয় প্রতিফলিত হয়ে চিক্চিক্ করছে মুত্তোর মালার মত আর এমন এক অপার্থীব সৌন্দর্য্যের সৃষ্টি করেছে যে দেখলে কেমন ভয় হয়। একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি ইউক্যালিপটাস্ গাছের ডালপালাগুলো বেসামাল হাওয়ায় দুলছে এদিক থেকে ওদিক আর সেই সঙ্গে বাতাসে ভেসে আসছে তাদের শরীরের মাতাল করা মিষ্টি গন্ধ। গাছগুলোর দিকে আবার তাকালেন রুদ্রপ্রসাদ। মনে হল ডালপালাগুলো হাত নেড়ে নেড়ে তাঁকে ডাকছে কাছে এগিয়ে আসার জন্য। মোহগ্রস্ত হয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে খোলা আকাশের নিচে এসে দাঁড়ালেন রুদ্রপ্রসাদ। চারিদিকে কেমন একটা থমথমে ভয়মিশ্রিত উদাস বাঁধনহীন মুক্ত ভাব, বুকটা হু হু করে উঠল। এই নিরব নিশীতরাত্রে জ্যোৎস্না ভরা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে রুদ্রপ্রসাদের মনে হল সম্পুর্ণ অজানা অজ্ঞাত একটা জায়গায় তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। সামাজিক কাঠামোয় গড়া জনগণের আচার–আচরণ নিয়ন্ত্রিত কোন নিয়মকানুন এখানে খাটে না। এই সব জনহীন জায়গা গভীর রাত্রে ভুত প্রেত ও অপদেবতাদের ক্রীড়াভুমিতে পরিনত হয়, তিনি এখানে বিনা অনুমতিতে অনধিকার প্রবেশ করেছেন। কথাটা মনে আসাতেই রোমকুপ খাড়া করে দেওয়া একরাশ ভয় আবার এসে তাঁর শরীরে বাসা বাঁধল।
কোনরকমে ছুটে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন রুদ্রপ্রসাদ। দরজার বাইরে বিকট জোরে একটা অট্টহাসির শব্দ শোনা গেল। পরক্ষনেই অট্টহাসির শব্দকে ছাপিয়ে বুকফাটা কান্নায় শরীরের সব রক্তকে হীম করে দেওয়া কণ্ঠস্বরে ঋষির নাম ধরে কেউ চিৎকার করে উঠল। ভীত, সন্ত্রস্ত ও কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন রুদ্রপ্রসাদ। প্রচন্ড ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন, কিন্তু গলা দিয়ে কোন স্বর বেরল না। তাঁর মনের ভুল, না সত্যি সত্যি দরজার বাইরে কেউ বা কারা দাঁড়িয়ে আছে? যাচাই করার কোনরকম ইচ্ছা হল না। নিজেকে কোনরকমে সামলে নিয়ে শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে যেদিকে নমিতা বেঁহুস হয়ে পড়ে আছেন সেইদিকে মন্থরগতিতে এগিয়ে চললেন রুদ্রপ্রসাদ।
বিঃ দ্রঃ বিদেশী গল্প মঙ্কিস্ পওস্ এর ছায়ায় রচিত
লেখক পরিচিতি : সুব্রত মজুমদার