ট্রামলাইন

0
536

মধ্য কলকাতার রাস্তায় ঘড়ঘড় শব্দ তুলে লাইনের উপর দিয়ে আস্তে আস্তে ট্রামটা চলেছে| লেনিন সরণী টা পেরোতেই আচমকা আদৃতের ঘুম টা ভেঙে গেল| ট্রামটা দাঁড়িয়ে আছে কেন? কিছু গোলযোগ দেখা দিল নাকি? বেশ তো চলছিল| আচমকা ঘুমটা ভেঙে গিয়েও হল বিপদ| চুপচাপ অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায়ও নেই| কটা বাজে?? ঘড়িতে রেডিয়াম ডায়াল লাগানো, সেটার দরকার নেই| বাইরেই ঝলমলে আলো| বাজে রাত .৫০| রাতের কলকাতার একটা আলাদা মাধুর্য্য আছে| আশেপাশে নতুন দোকানের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রখ্যাত পুরোনো দোকানগুলোও তাদের ঐতিহ্য বজায় রেখেছে| তা সে মিষ্টির দোকান হোক, কি জুতোর দোকান| রাস্তার ধারে হলুদ মিটার ট্যাক্সির সাথে ওলা বা উবেরের জমজমাট বন্ধুত্ব জমেছে যেন| হাতে টানা রিক্সা আর প্রাইভেট গাড়ির স্টেটাসের পার্থক্যটা অবশ্য চোখে পড়ে| তবুও এই ট্রামের বিকল্প পাওয়া মুশকিল| আরে বাবা!! ভিক্টোরিয়া আর হাওড়া ব্রিজ, কফি হাউসের তিনতলার বৈঠক আর গোলবাড়ির কষা মাংস তো পৃথিবীতে একটাই আছে নাকি| তার তো আর কোন বিকল্প নেই| সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ট্রামটা আবার চলতে শুরু করল| ঘড়াং ঘড়াং আওয়াজটা বেশ লাগছে|

আবার ঘুম এসে গিয়েছিল বোধহয় আদৃতের| কারণ এইবার যখন তার চোখ খুলল, তখন ট্রামে বসা গুটিকয়েক যাত্রীগুলোর আর কাউকেই চোখে পড়লো না তার| সবাই এর মধ্যেই নেমে পড়লো নাকি? নাহ্! কেউ তো নেই আশেপাশে| তবে? সবাই বোধহয় নেমে পড়েছে| এবারের তারই নামার পালা| ট্রামটা একজায়গায় এসে থামল| আদৃত একবার চোখ ঘুরিয়েই বুঝল জায়গাটা শোভাবাজার| নামল সে ট্রাম থেকে| জায়গাটা ঘুরঘুট্টি অন্ধকার| রাত বেড়েছেকিছু দেখা যাচ্ছে না অবশ্য চোখে| রাত বোধহয় প্রায় ১০ টা হবে| এখনই পাড়াটা নিঝুম| সেদিনও তেমনই ছিল| আসলে এই পাড়াটা এমনই থাকে| সন্ধ্যে থেকে কতগুলো শরীরের ভিড় হয়, আর চলে বিক্রেতা শরীরের সাথে খদ্দের শরীরের কেনাবেচা| তারপর কাজ মিটে গেলে আবার বিক্রেতা শরীর একটা নতুন খদ্দের থুড়ি শরীর খোঁজে

দুদিন আগেও আদৃতের দেখা হয়েছিল মায়ার সঙ্গে| এই প্রথম মনের টান কি তা বুঝেছিল দুজন| আদৃত একটা ডকুমেন্টারি বানাবে বলে শোভাবাজারের এই বেশ্যাপাড়ার অলিগলি দেখছিল| তখনই মায়ার সাথে তার পরিচয়| মায়া এই লাইনে আছে প্রায় দু বছর| কিন্তু সেদিন প্রথম দুজন বুঝেছিল, শরীরটা একটা নিমিত্ত মাত্র| মন যখন কাউকে বেছে নেয়, তখন সে আর কোন বাধা মানে না| ধীরে ধীরে প্রেমে পড়ে দুজন| মায়া ঠিক করে সে এই কাজ ছেড়ে দেবে| ছেড়েও দিয়েছিল| বিয়েও করেছিল দুজন এরপর দুবছর শান্তিতে কেটেছিল| কিন্তু সমাজের নরপিশাচগুলো যারা শরীরের খোঁজে ব্যাকুল ছিল, তারা চুপ থাকবে কেন| নানাভাবে ফিরে আসতে বলে জ্বালিয়েছে তারা মায়াকে| কিন্তু সে অনড়| সে এই পাপ করতে পারবে না আর|

তা বলে সব প্রেমের পরিণতি তো পূর্ণতায় হয় না|

আজ আদৃত এসে দাঁড়িয়েছে শোভাবাজারের গলিটায়

যে দূরে কাকে একটা দেখা যাচ্ছে| মায়া কি??

হ্যাঁ| সেইই তো| আস্তে আস্তে অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি এগিয়ে এলো| দুজনে দুজনকে দেখল| দুটো শরীর, থুড়ি দুটো মনেই একটা হাসির ঝলক খেলে উঠল

মায়া শেষ কথা বলে ফিরিয়ে দেওয়ার দুদিন পরেই দুটো আলাদা আলাদা ট্রামলাইনে কাটা অবস্থায় দুটো লাশ পাওয়া যায়| একটা আদৃতের, আর একটা তার স্ত্রী মায়ার|

আদৃত আর মায়ার দেহ দুটো মিলিয়ে গেল রাতের কলকাতার নিস্তব্ধতায়| হাত ধরাধরি করে|

কে বিশ্বাস করবে যে মধ্যরাতের কলকাতার ট্রামলাইনের উপর দিয়ে একটা যাত্রীবাহী ট্রাম চলে যার সওয়ারীরা সবাই মৃত| আর সেই ট্রাম প্রত্যেক যাত্রীকে পৌঁছে দেয় তাদের অন্তিম ঠিকানায়| তাদের প্রিয়জনের কাছে| যারাও মৃত| মৃত্যুক্ষণে আলাদা হয়েও যারা এক হয়ে যায় মরণের পরে|

পুরোনো কলকাতায় ভিক্টোরিয়া, হাওড়া ব্রিজের মতই একটা জিনিসই একমেবাদ্বিতীয়| সেটা হল আদি অকৃত্রিম প্রেম| যাদের পূর্ণতা পেতেই হয়| মরণের পরেও|

 

লেখক পরিচিতি :দেবাঞ্জন সাহা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here