“বৃষ্টি” কথাটির মধ্যে ভেসে আসে স্বস্তির ছোঁয়া। বন্ধ কাঁচের জানালার পারে চোখ রেখে এই রিমঝিম স্রোত আর আকাশের কালো মেঘের ধীর গতি, সাথে করে নিয়ে যায় দূরে কোথাও। বিয়ের পর পাঁচটি বছর কিভাবে কেটে গেলো টের পেলাম না।
একজন অচেনা মানুষের হাত ধরে সারাজীবন কাটানো যায় কি?…. একসময় ভাবতাম সত্যি, কিন্তু অনির্বানের সাথে আলাপ হতে এমন অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আর কোনো প্রয়োজন পরেনি।
সল্টলেকের একটা মাল্টি-ন্যাশানাল আইটি কোম্পানি তে চাকরি ওর, আর বাগুইহাটির একটা কনভেন্ট স্কুলে পড়াই আমি। বেহালায় শ্বশুর বাড়ি থেকে রোজ আসা যাওয়া খুব হেক্টিক হওয়ায় দুজন মিলে চিনার পার্কে একটা ২ বি-এচ-কে ফ্ল্যাট নিয়ে শুরু করি আমাদের ছোট্ট সংসার। শুরুতে অবশ্য আনির্বান খুব একটা রাজি ছিল না ফ্ল্যাটে আসার বিষয়ে, কিন্তু একটু বুঝিয়ে বলাতে বাড়ির বাকি সবার সাথে ও নিজেও রাজি হয়ে যায়।
সম্মন্ধ দেখা চলাকালীন আমাদের ফোনেই কথা হত বেশি, আর গুনে গুনে তিনবার মাত্র দেখা হয় আমাদের। দুজনের পছন্দ অপছন্দ, সিনেমা চর্চা কিংবা বই পড়ার ধরণের মধ্যে একটি অস্বাভাবিক মিল খুঁজে পাই। আনির্বানের যে গুন আমায় আজও খুব প্রভাবিত করে, তা হল ওর সেন্স অফ হিউমার আর যেভাবে ও আমাকে যে কোনো পরিস্থিতিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করায়। কেবল যে মজার কথাটুকু তা নয় আরো একটা বিষয় যেটা সবথেকে বেশি আমার মন ছুঁয়ে যায় হল, ওর লেখা। মাঝে মাঝে হয়ত আমার অনুরোধেই নিজের লেখা কিছু কবিতা বা গল্প পড়ে শোনাতে হতো ওকে, আর আজও সেই অভ্যাস অব্যাহত রয়েছে।
মাইক্রোওয়েভের বিপ্ শব্দ কানে আসা মাত্র, চোখের ফোকাস জানালার বাইরে থেকে সরে কাঁচের গায়ে নিজের আবছা প্রতিবিম্বের উপর এসে পরলো। কালো মেঘের মত চুলের ঢেউ নেমে এসেছে কাঁধের একপাশ ছুঁয়ে, এই জড়ানো লাল-হলুদ শাড়ি, চোখের ধূসর কাজল ও কপালের ছোট্ট কালো টিপ আজ আমার শোভনতার অন্যতম কারণ। জানালার ধার থেকে উঠে রান্নাঘরে রাখা মাইক্রোওয়েভের সামনে এসে দেখতে পেলাম কেক্ টা রেডি হয়ে গেছে।
আজ অনির্বানের জন্মদিন।
অফিসের কাজে বিগত আট মাস জার্মানিতে কাটাবার পর আজ কলকাতায় ফিরছে ও। এতদিনের দূরত্ব মোবাইল, হোয়াটস্অ্যাপ, স্কাইপের সুবাদে কিছুটা দূর হলেও দুটি মানুষের শারীরিক উপস্থিতি সর্বদা অপূরণীয়। ঘড়ির কাঁটার দিকে চেয়ে এখন আর কিছু ঘন্টার অপেক্ষা।
সকাল ১০:৪৫ মিনিট….. মিউনিখ-আবু ধাবি হয়ে আসা এতিয়াদ এয়ারলাইনস নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রানওয়েতে অবতরণ করল। কলকাতার মাটিতে পা পরতে বেরিয়ে এলো স্বস্তির নিঃশ্বাস। ২-নং লাগেজ কাউন্টার থেকে ট্রলি ব্যাগটা সাথে করে বিমানবন্দরের এক্সিট গেটের বাইরে পা রাখতেই, চেনাপরিচিত সেই শহর। চেনা জানা মুখের আদলের এই সমস্ত মানুষের ভিড়ের মাঝে আমি আর অনাকাঙ্ক্ষিত নই। মোবাইল বার করে ওলাতে ক্যাব্ বুক করলাম। কিছুক্ষণ আপেক্ষা মাত্র একটা সাদা সিডান গাড়ি নিয়ে একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক হাজির হলেন। একটু হাসি মুখে শুভেচ্ছা জানিয়ে, পিছনের ডিগিতে ট্রলি ব্যাগটা তুলে ড্রাইভার সিটে ফিরে গেলেন তিনি। ট্রিপ শুরু করতে গিয়ে বলে উঠলেন,
“হ্যাপি বার্থডে অনির্বান স্যার”….
আমি কিছুটা অবাক হয়ে, ড্রাইভারের সাইডে, গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনের সাথে আটকানো মোবাইল স্ক্রিনে চোখ পরতে বুঝলাম ওলা অ্যাপে দেখাচ্ছে আমার জন্মদিন বার্তা ।
একটু হেসে উত্তর দিলাম… ” থ্যাঙ্কিউ!”
“ট্রিপ টা চালু করছি তাহলে… কোথায় যাবেন স্যার?”
বাইরে মেঘলা আকাশের দিকে চেয়ে বললাম…
“বেহালা! অনেকদিন মার সাথে দেখা হয়নি….”
2. ঠিকানা
প্রত্যেক দেশবাসীর দৃষ্টি সামনের মিনিটেরর দিকে স্থির। মানবজাতির কাছে এ এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। মনিটরের স্ক্রিনে ফুটে ওঠা বিভিন্ন সংখ্যা, নানারকম আলোর ঝিকমিক প্রতিফলন সাথে গ্রাফিকাল লাইনের এলোমেলো উপস্থাপনা বুঝিয়ে দিচ্ছে ইঞ্জিন যথেষ্ট স্টেবল্।
কাউন্টডাউন শুরু ….১০….৯….৮…..
দুটো কাঁপা হাত চেপে ধরলো সিটের আর্ম-রেস্ট। এমন উত্তেজনা তার কাছে এই প্রথম নয়…..
ভেসে আসে….টুর্নামেন্টের শেষ বলে প্রয়োজন ছয় রানের অনুভূতি, প্রথম প্রেমের গোপন প্রস্তাব, প্রথম চাকরির কল, প্রথম ভালোবাসার রাত, হাসপাতালে কোলে নিয়ে দেখা পুত্রের প্রথম হাসি, তার আঙুলের প্রথম স্পর্শ, তার প্রথম হাঁটার আনন্দ, তাকে বড় হতে দেখার প্রতি মুহূর্ত….নিমেষে এই প্রতীয়মান দৃশ্যগুলি কোথাও মিলিয়ে যায়।
হুইলচেয়ারে বসা বার্ধক্যগ্রস্ত,জীর্ণ, ক্ষতবিক্ষত মানুষটির একমাত্র সঙ্গী, নিঃসঙ্গতা। অবহেলিত মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠা এই বৃদ্ধাশ্রম এখন তার ঠিকানা বেশ কিছু বছর ধরে।
৩…২….১….০…. লিফট অফ……..
উজ্জ্বল টিভি স্ক্রিনের লাইভ ব্রডকাস্টে দেখা যাচ্ছে মহাকাশ-যানের ঊর্ধ্বগামী গতিযাত্রা। ধীরে ধীরে মাটি থেকে উঠে মেঘের চাদর ভেদ করে মিলিয়ে গেলো আকাশে…... শুধু রয়েগেল পিছনে ফেলে যাওয়া ধোঁয়ার আবছা স্মৃতিচিহ্ন ..….