অঙ্কন : অহিজিৎ সরকার

|১|

ড্রয়ার খুলে হাতড়ে হাতড়ে মোমবাতি আর দেশলাই বার করে কাঠি ঠুকে ঠুকে কোনরকমে মোমবাতিটা জ্বালিয়েছিল। কিন্তু তুলে ধরে সামনে আনতেই নিঃশ্বাস লেগে সেটা নিভে গিয়ে আবার চারিদিক সেই ঘুটঘুটে হয়ে গেল। আর সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে পা বাড়াতেই দরজার এক কোণে রাখা মাটির কলসিতে পা লেগে হুমড়ি খেয়ে পড়ল এবং কলসি ভেঙে জল গড়িয়ে তার সমস্ত শরীর ভিজে সপ সপে হয়ে গেল। আসলে আলোয় অভ্যস্ত চোখ অন্ধকারে কেমন যেন দিশাহারা হয়ে যায়। তাই চোখে আলো পড়তেই স্বস্তির নিঃশ্বাসটা এতো জোরে পড়েছিল যে তাতেই মোমবাতিটা নিভে গেল। অন্ধকারেই দরজা ধরে ধরে কোনরকমে সে উঠে দাঁড়াল। দরজাটা খুলে দিতে পারলেও খানিকটা আলো চোখে দেখতে পাবে । দরজার গায়ে হাত বুলিয়ে ছিটকিনিটা খোঁজার চেষ্টা করল। কিন্তু বাঁ বা ডান কোনদিকেই ছিটকিনিটা খুঁজে পেল না। একটু অবাক হল সে। যতদূর মনে পড়ছে দরজার একটু বাঁ দিক ঘেঁষেই ছিটকিনিটা ছিল। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে চিন্তা করল । তার কোন ভুল হচ্ছে না ? এটা দরজা তো? দরজার গায়ে হাত বুলিয়ে কড়াটা খুঁজল । হ্যাঁ, এই তো কড়াটা। তাহলে ছিটকিনিটা গেল কোথায়? অদ্ভুত ব্যাপার তো! নিরুপায় হয়ে পেছন ফিরে টেবিলের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য এক পা দু পা করে পা বাড়ালো। এবার অবশ্য খুব সাবধানে। যা জোরে পড়ে গিয়েছিল তখন! তার টেবিলের উল্টোদিকে একটা জানলা আছে। কোনভাবে জানলার পাল্লা দুটো খুলতে পারলে খানিকটা চাঁদের আলো ঘরে ঢুকবে। একটু আলো না পেলে এই ভয়ংকর অন্ধকারে দম আটকে যাবে তার। হাতড়ে হাতড়ে কোনরকমে টেবিলের কাছে পৌঁছে পা দুটো উঁচু করে হাত দুটো টেবিলের ওধারে নিয়ে গেল। কিন্তু তার হাত জানলা পেল না, দেওয়ালে গিয়ে ঠেকল।। বুঝতে পারল যে সে টেবিলের এক কোণে সরে এসেছে। পা নামিয়ে টেবিলের কোণাটা ধরে ধরে টেবিলের মাঝ বরাবর এসে আবার পা উঁচু করে হাত বাড়িয়ে জানলাটা খুঁজল। কই নাতো। এখানেও তো জানলা নেই। পুরোটাই তো কংক্রিট! পা নামিয়ে টেবিলের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ চোখ বুজে ভাববার চেষ্টা করল। কি হচ্ছে এটা তার সঙ্গে? অনুভব করল তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, শরীরের ভেতরে রক্ত চলাচল বেড়ে গেছে। এত থিকথিকে অন্ধকার সে আগে কোনদিন দেখেনি। গলা যেন টিপে ধরছে । মোবাইলটা কোথায় তার? পাগলের মতো সে টেবিলের ওপর হাতড়ে মোবাইলটা খুঁজতে শুরু করল। হাতের ধাক্কায় তার লেখার কাগজ, বই পত্র সব ছত্রাখান হয়ে ছড়িয়ে পড়ল মাটিতে। মেঝের ওপর হামাগুড়ি দিয়ে বইখাতা সরিয়ে সরিয়ে মোবাইলটা খুঁজতে লাগল। কিন্তু যেদিকেই যাচ্ছে সেইদিকেই দেওয়ালে মতো শক্ত কিছুতে ধাক্কা খাচ্ছে। নয় ফুট বাই দশ ফুট ঘরটা কি করে এতো ছোট হয়ে গেল তার মাথায় ঢুকছেনা কিছুতেই! এই তো পেয়েছে সে। টেবিলের পায়ার কাছে পড়েছিল ওটা। মোবাইলটা বুকে চেপে ধরে টেবিলের পায়ায় ঠেসান দিয়ে বসে পড়ল। নাক, চোখ, মুখ দিয়ে গড়িয়ে জলটা জিভে এসে কিরকম যেন নোনতা ঠেকল । হাতের চেটো দিয়ে মুখ মুছে প্রাণপনে মোবাইলের সুইচটা অন করার চেষ্টা করল।যদিও সে জানে সেটা আর সম্ভব নয়।মোবাইলটা কিছুদিন ধরে বন্ধই থাকত। মোবাইলে ভরার মতো টাকা নেই তার কাছে আর। জমানো টাকাকড়ি যা ছিল সব একে একে ফুরিয়ে গিয়েছে।কান্নার বদলে কিছু দুর্বোধ্য শব্দ মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসল তার। ঘরের ছাদটা ধীরে ধীরে মাথার ওপর নেমে আসছে । হাঁপরের মতো হাঁ করেও আর নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। অন্ধকারটা কালো, ঘন হয়ে সিমেন্টের মতো জমাট বেঁধে ধরছে তাকে। ঘরটা ছোট হতে হতে বাক্সর মতো হয়ে আস্তে আস্তে যেন তাকে কুঁকড়ে মুকড়ে ভেতর ঢুকিয়ে নিতে চাইছে। ভয়ে চিৎকার করে উঠতে চাইল সে। কিন্তু খানিকটা গোঙানি আর লালা ছাড়া আর কিছু বেরল না তার মুখ থেকে। ঘরের ভেতর অক্সিজেন ফুরিয়ে যাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি। ফুসফুসটা মনে হচ্ছে ফেটে যাবে এবার তার। সে পাগলের মতো শেষবার উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। কিন্তু ততক্ষণে তার শরীরের নীচটা বরফের মতো ঠান্ডা মাটির সঙ্গে গেঁথে গেছে।

|২|

“আজ বেলা দশটার সময় সোদপুর পানিহাটি এলাকার বাসিন্দা দীপ্ত মজুমদার নামে বছর পঁয়ত্রিশের এক যুবককে অর্ধমৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় তার ঘরের দরজা ভেঙে। দীপ্তর বাড়ির লোক এবং পাড়া প্রতিবেশীরা যখন তাকে জলে ভেজা অবস্থায় উদ্ধার করে তখনও তার শরীরে প্রাণ ছিল, এবং হাতের মধ্যে মোবাইল শক্ত করে ধরা ছিল। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে দীপ্তর মৃত্যু হয়। মুখ থেকে গ্যাঁজলা ওঠা দেখে যদিও পুলিশের প্রাথমিক অনুমান দীপ্ত আত্মহত্যা করেছে তবুও অন্যান্য সম্ভবনাগুলোও তারা খতিয়ে দেখছেন। তার মৃতদেহকে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়। দীপ্তর মা এবং বোনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে যে লোকডাউনের জন্য চাকরি চলে যাওয়াতে দীপ্ত খুব আর্থিক এবং মানসিক চাপে ছিল। জমানো টাকাকড়ি প্রায় সবই শেষ হয়ে গেছিল। পুলিশের অনুমান সেটাই দীপ্তর আত্মহত্যা করার কারন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত আমাদের প্রতিনিধি সুকান্ত মালাকারের কাছে বিস্তারিত জানতে চাওয়ার আগে আমরা বিখ্যাত সাইকায়াট্রিস্ট ডক্টর সৌম্যকান্তি বোসের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে নেব।

আচ্ছা ডক্টর বোস দীপ্তর মানসিক স্থিতির…….

কলমে অদিতি দে

 



LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here