ত্রাণের আলো

কলমে স্বাগতা কোনার

0
321

“মা ভুটভুটি কখন আসবে গো ?” – বুধো মায়ের আঁচল ধরে আর একবার টানলো। ফুলমণি একটু ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো “আহ! জ্বালাতন করিসনা বাপ।” কাকভোর থেকে হাঁটুডোবা জলে লাইন দিয়ে হাপিত্যেশ করে দাঁড়িয়ে আছে ফুলমণি। ছোটো ছেলে বুধোকে নদীর পাড়ে বসিয়ে রেখেছে। আর বড় মেয়ে চাঁপাকে অন্য এক জায়গায় পাঠিয়েছে ত্রাণের লাইন দিতে। যেটুকু পাওয়া যায় তার জন্য এই প্রাণপণ চেষ্টা। অন্ততঃ দুটো দিন টেনেটুনে চলে যাবে। সময় খুব তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যায়। বছর তিন আগেও অবস্থা এতটা খারাপ ছিলনা। বুধোর বাপ মাছ বেচে আর ফুলমণির জাল বুনে যা আয় হতো সংসারটা চলে যেত। চাঁপাকে সরকারী ইস্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল।সেসব যেন এখন স্বপ্নের মত লাগে।বুধোর বাপটা আজ দুই বছর হলো জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে আর ফেরেনি।একটা মাটির ঘর, দুই ছেলেমেয়ে ও কিছু বাসনকোসন রেখে মায়া কাটিয়েছে। বাবা দখিনরায়ের কোপ পড়েছিল।জঙ্গলে শরীরের অবশেষ কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি।তারপর থেকে কোনোরকমে মাছ ধরার জাল বুনে, সব্জি বেচে দুবেলা খাবার জোটে। ফুলমণি কষ্ট করে,মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ছেলেমেয়ের মুখে একটু হাসি ফোটাতে চায়। তাও যেন কপালে সহ্য হয়না। দেবতা ও প্রকৃতির রোষ বছর বছর আছড়ে পরে এই সোঁদরবনে। সেবার আয়লাতে ঘরের চাল উড়ে গেল, খানিক মাটি ধসে গেল। শহরের দাদাবাবু দিদিমনিরা সব এসেছিলেন, কত ত্রাণ দিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন তোদের সব পাকা ঘর হবে,বাঁধ হবে। তাদের কথায় এই আধমরা মানুষগুলো মনে বল পায়। ত্রাণ ও সাহায্যে কিছুদিন চলে যায়। তারপর আবার সব অন্ধকার। বুধো ছেলেমানুষ ,এই সবে ছয় বছর বয়স।অবুঝ মনে এটা ওটা বায়না করে। ফুলমণির বুকের ভেতরটা হু হু করে, একটা কষ্ট গলার কাছে দলা বাঁধে। আর চাঁপা বারো বছর বয়সেই যেনো অনেকটা বড় হয়ে গেছে।মায়ের কষ্ট সে বুঝতে পারে। যতটা পারে ফুলমনিকে হাতে হাতে সাহায্য করে। ধীরে ধীরে একটু গুছিয়ে নিতে না নিতেই আবার এলো আম্ফান ঝড়। সামান্য মেরামত করা ঘরটাও জলে পড়ে গেল। আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, শুধু একবুক হাহাকার ছাড়া। একটা ত্রিপল খাটিয়ে তাতেই রোদ,জল আটকানোর বৃথা চেষ্টা। বাবুরা বলেছিল পাকা বাঁধ হবে; মোদের ও পাকা ঘর হবে। সেই আশাতেই আজও বুক বাঁধা। বুধো আর চাঁপা আবার ইস্কুল যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে আগের মত। হঠাৎ ভুটভুটির আওয়াজে ভাবনার ঘোর কাটলো। বুধো আঁচল ধরে টেনে বললো ” মা!ও মা! ওরা এসে গেছে “। লাইনে দাঁড়ানো সবার মধ্যে হুড়োহুড়ি শুরু হল।কে আগে যাবে, কতটুকু বেশি জিনিস পাবে তার জন্য শুরু হল ঠেলাঠেলি। সেই ভিড়ে ও কোলাহলে ফুলমণির মত আরও কতজনের দীর্ঘশ্বাস চাপা পড়ে গেল।

কলমে স্বাগতা কোনার, বর্ধমান

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজী সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা।শিক্ষকতা হল পেশা।ভ্রমণ হল নেশা।অবসর যাপনে প্রিয় বন্ধু হলো বই। মায়ের উৎসাহে ও কিছু শ্রদ্ধেয় মানুষের অনুপ্রেরণায় লেখার জগতে আসা।ভালোলাগার জন্য লিখি।ভালোবেসে লিখি।আপনাদের সবার স্নেহ ও আর্শীবাদ কে পাথেয় করে ও লেখনী কে সঙ্গী করে আরও এগিয়ে যেতে চাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here