বাবা ব্যবসায় বিরাট লস খেয়েছিলেন। সবসময় চিন্তা মগ্ন থাকতেন। মা‘র সাথে তেমন কথা বলতেন না। মাঝে মধ্যে আমাকে কাছে বসিয়ে কি যেনো বিড় বিড় করে বলতেন আর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন পাওনাদার আমাদের বাড়ি আসতো। আমাদের সামনেই বাবাকে খুব অপমান করা হতো। বাবা একটা কথাও বলতেন না। আমার চাচা মামা‘রা একটা সময় আমাদের বাড়িতে খুব যাতায়াত করতেন। কিন্তু আমাদের এই পরিস্থিতি হবার পর কেউ কোন দিন আমাদের একটা নজর দেখতে পর্যন্ত আসেন নি । একদিন আমি আমার বন্ধুদের সাথে খেলছিলাম। হঠাৎ মা‘র তীব্র চিৎকারে হকচকিয়ে উঠলাম। দৌড়ে গেলাম বাড়িতে। দেখি বাবা সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে আছেন আর মা বাবার পা ধরে কাঁদছিলেন। রাতে পুলিশ আসলো বাড়িতে। চেয়ারম্যান সাহেবের পা ধরে আমার মা অনেক কাঁদলেন যাতে বাবা‘র লাশটা পোস্টমর্টেম এর জন্য পুলিশ না নিয়ে যান। চেয়ারম্যান সাহেব বললেন ২০ হাজার টাকা লাগবে। না হলে লাশ আটকানো যাবে না। শেষ পর্যন্ত টাকার কাছে মা হার মানলেন এবং পুলিশ বাবার লাশ নিয়ে গেলেন। পুরো দুই দিন পর পুলিশ আমার বাবা‘র ক্ষত–বিক্ষত লাশ আমাদের বাড়ি পৌঁছিয়ে দিলো। বাবা‘র লাশ দাফন করা হলো। দাফন শেষেই পরিচিত আত্মীয় স্বজনরা যে যার মতো খুব দ্রুতই কেটে পড়লো। পড়ে রইলাম মা আর আমি। মা আমাকে বুকে নিয়ে এক নাগাড়ে কেঁদেই চলছিলেন। বাবা মারা যাবার পর আমাকে নিয়ে আমার মা জীবন যুদ্ধে নামলেন। এর ওর কাজে মা সাহায্য করে যা আনতেন তা দিয়ে আমাদের জীবন কোন রকমে চলতো । কষ্টের মাঝে আমি একটু একটু বড় হতে থাকলাম। আমিও আস্তে আস্তে কাজে ঢুকে পরতে শুরু করলাম। এরই মাঝে গ্রামে এক এনজিও আসলো। যারা অসহায় দরিদ্র পরিবারের ছেলেদের সহজে লোন দিয়ে বিদেশে পাঠাতেন। শতো কষ্টের মাঝে যেনো আশার কিন্ঞ্চত আলো দেখতে পারলাম। কিন্তু মাকে একা কি ভাবে রেখে যাবো সেটা ভেবে বড় ধাক্কা ক্ষেতে লাগলাম। মা আমাকে বললেন বাবা আমি একা থাকতে পারবো। আমার বিশ্বাস তুই আমার দুঃখ দূর করতে পারবি তোর বাবার দেনা শোধ করতে পারবি।আমি কারো দয়ায় বাঁচতে চাই না রে বাজান। আমি মাকে বললাম মা আমিও চাই না তুমি অন্যের বাড়িতে কাজ করো বা কারো দয়ায় আমরা বাঁচি। তোমাকে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে দেখলে আমার কলিজা টা ফেঁটে যায়। কথাটা বলে মাকে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম। অল্প কিছুদিন পর আমার মা সেই এনজিও এর গ্রাহক হলেন এবং সেই সুবাদে আমার বিদেশ যাবার বন্দোবস্ত হয়ে গেলো। আমি বিদেশ চলে এলাম। এখানে এসে প্রতিমাসে আমি মাকে টাকা পাঠাতাম এনিজওর কিস্তি, বাবা‘র দেনা এবং মা‘র খরচ বাবদ। প্রায় তিন বছর পর এনজিওর লোন এবং আমার বাবা‘র করে যাওয়া দেনা পুরোপুরি শোধ করতে সক্ষম হলাম। এরপর মা বার বার বলছিলো একবার হলেও দেশে আসবার জন্য। আমি বললাম মা পাকা বাড়ি করবো তারপর আসবো বাড়িতে। এরপর আরো দুইবছর কেটে গেলে। আমাদের পাকা বাড়ি নির্মানের কাজ শেষ হয়েছিলো। আমি মনে মনে বাড়ি আসবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। একদিন কাজ করছিলাম হুট করে আমার অফিস থেকে জানানো হলো আমার মা আর নেই। এনজিও থেকে নাকি অফিসে ফোন করে জানানো হয়েছে। খবর টা শুনে পাথর হয়ে গেলাম। সে দিনই প্ল্যানে উঠলাম দেশে আসবার জন্য। পরদিন দেশে এসে দেখলাম আমার মাকে বাবা‘র কবরের পাশেই কবর দেয়া হয়েছে। শেষ দেখাটা দেখতে পাড়লাম না আমার মাকে। কি কষ্ট টাই না করেছেন আমার মা। যে অর্থের অভাবে আমার বাবা‘কে হারিয়েছিলাম আজ আমার কষ্ট উপার্জিত লক্ষ টাকা পরিপূর্ণ ভোগ না করেই মা চলে গেলেন। এটা ভেবে অন্তরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলো। আমার মা‘র কপালে সুখ টিকলো না। এখন বাড়ি ভরা হাজারো মানুষ আমাকে দেখতে এসেছে। যে আত্মীয় স্বজনরা কখনো একটা বার খোঁজও নিত না তারা আজকে আমার মা‘র জন্য আমার সামনে বিলাপ করে কাঁদছে । কারণ এখন আমার অর্থ হয়েছে বাড়ি হয়েছে আরো কতো কি। অথচ আমার বাবা যেদিন মারা গিয়েছিলেন সেদিন আমি আর আমার মা ছাড়া চোখের পানি ফেলবার মতো কেউ ছিলো না। মা–বাবার কবরের সামনে গিয়ে অঝড়ে কাঁদছিলাম। কি হলো এতো অর্থ রোজগার করে? তোমাদের কাউকে সুখী করতে পারলাম না।চোখের পানি মুছে পিছে ফিরলাম বিদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হবার জন্য । যে বাড়িতে আমার মা থাকবেনা, যে বাড়িতে আমার বাবা থাকেননি সেই বাড়িতে আমিও থাকবো না। মা – বাবা‘র কবর অন্তরে গেথে নতুন সংগ্রামে পরবাসে পাড়ি জমালাম। এখন প্রতিদিনিই চোখের কোন বেয়ে পড়া অজস্র পানি দিয়ে আমার বুকে লুকানো মা–বাবাকে ভালোবাসায় সিক্ত করে দিই। মনে করি এইতো বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর শত কষ্ট জয় করবার অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন আমার মা…।
লেখক পরিচিতি : মিসবা তুহিন ; জামালপুর,দেওয়াগন্ঞ্জ, বাংলাদেশ
গল্প লিখি। অব্যক্ত যন্ত্রণা, হাসি–কান্না,প্রেম–বিরহ,বাস্তবতার আলোকে কথামালা গাঁথি। ভালো লিখি কিনা মোটেও ভাবি না। সাহিত্যিক হবো কিনা জানি না। তবে লিখে যাবো আমৃত্যু…।
বিঃ দ্রঃ লেখাটি মন_ও_মৌসুমী র #ত্রিমাসিক_লেখা_প্রতিযোগিতার (জানুয়ারি ,২০১৯) এর একটি Entry .
ফলপ্রকাশ জানুয়ারি ,২০১৯ এর দ্বিতীয় সপ্তাহ , পড়তে থাকুন -যোগাযোগ বজায় রাখুন #মন_ও_মৌসুমী র ওয়েবসাইট এর সাথে।
আপনার গল্পটা পড়ে আপনার মত আমারও হৃদয়টা দুমড়ে মুচড়ে গেলো।লোনা জলের ধারা আর ধরে রাখতে পারলাম না।বাবাকে হারিয়েছেন অভাবে,মা’কে হারালেন স্বচ্ছলতার কালে।মা’কে শেষ পর্যন্ত শান্তি দিলেই মায়ের কপালে সয় নি সুখ।দুঃসময়ে স্বজনরা বিমুখ হয়েছে।তবুও সুসন্তান হিসাবে লড়াকু সৈনিকের মত লড়ে হার মানিয়েছেন দুঃখকে।বাবা মার বিয়োগে বেছে নিয়েছেন প্রবাস জীবন।
সত্যিই অসাধারণ একটা অনুপ্রেরণা মূলক গল্প উপস্থাপন করেছেন সুপ্রিয় গল্পকার মিসবা তুহিন ভাই।
Very nice
অসাধারণ