গোপালকৃষ্ণ_বাবুর_পেন

0
1370
www.deviantart.com
গোপালকৃষ্ণ বাবু এমনিতে বড়ই সাদাসিধা লোক, স্ত্রী ছাড়া অন্য কারো সাথে ঝগড়া করা বা কটু কথা বলার বদনাম তার নেই। সরকারি দশটা পাঁচটার চাকরি করেন, কলকাতার কাছেই মফস্বলের একটি শহর থেকে হাওড়ার ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে তার চাকরির চার ভাগের তিন ভাগ পার করে দিলেন। এমনিতে সাতে পাঁচে না থাকলেও তার একটাই দুর্বলতা, উনি ঠকে যাওয়া একদম পছন্দ করেন না। সে ঠকতে আর কেই বা পছন্দ করে, আর সবাই প্রতিশোধ ও নিতে চায়, তবে সম্ভব না হলে একটা সময় হাল ছেড়ে দেয়। কিন্তু গোপালকৃষ্ণ বাবুর ব্যাপারটা তার চেয়েও একটু বেশি। উনি কিছুতেই ভুলতে পারেননা। আর যতক্ষন না তার কোনো বিহিত হচ্ছে ততক্ষন তার মেজাজ তুঙ্গে থাকে, এবং এটা তার এক দু দিন নয় মাসের পর মাস চলতে থাকে। এমনও হয়েছে কখনো তিনি এরকম ঘটনার জন্য দুবছর পরেও বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। তার স্ত্রী এটাকে তার মাথার ব্যমো বলেই মেনে নিয়েছেন। ছেলে মেয়েও খুব একটা পাত্তা দেয়না, কিন্তু গোপালকৃষ্ণবাবুর ভবি ভুলবার নয়। এই কারনে তার উচ্চরক্তচাপের সমস্যাও দেখা দিয়েছে।
 এমনিতে তিনি যে অঞ্চলে থাকেন সেখানে তিনি যেহেতু জন্ম থেকেই আছেন তাই তার পুরো অঞ্চলটাই প্রায় পরিচিত, এবং তাকেও বহু লোকই চেনে, তাই ওই অঞ্চলের বাজার হাটে তাকে বিশেষ ঠকাবার কারন নেই। যদিও বা কোনো নতুন লোক একটু আধটু চেষ্টা করার কথা ভাবে, তাহলেও তার কিছু কান্ড যা লোকের মুখে মুখে ফেরে তা জানার পর সে চেষ্টা থেকে তারা বিরতই থাকে।
 এ “জাগো গ্রাহক জাগো” র বেশ কয়েক বছর আগেকার ঘটনা। পেঁয়াজের তখন খুব দাম, আলু বেশ সস্তা, একই সময় হঠাৎ খুচরোর আকাল দেখা গেল। এক আলু পেঁয়াজের দোকানদার তাকে প্রায়ই খুচরোর বদলে দুটি আলু দেওয়া শুরু করলো। দিনক’য়েক তা বোঝার পর গোপাল কৃষ্ণ বাবু একদিন দৃঢ় স্বরে তাকে বাধা দিলেন এবং দুটি আলুর বদলে দুটি পেঁয়াজ তুলে নিলেন। দোকানদার তো হাঁ হাঁ করে উঠলো। গোপালকৃষ্ণবাবু কিন্তু তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে গত ক’দিনে তার খুচরোর বদলে আলু পেয়ে যা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, এইটা তার কিছুটা পরিপূরক হবে। ব্যাস, এরপর থেকে বাজারে আর কেউ তাকে কোনোদিন খুচরোর বদলে অন্য কিছু দেয়নি।
 আর একবার, তখন সবে মিষ্টির দোকানে আবার মাটির হাঁড়ি ফিরে আসছে, কিন্তু তিনি তখনো পলিথিনের প্যাকেটেই সাবলীল, এক পরিচিত দোকানে রসগোল্লা কিনতে গিয়ে তিনি লক্ষ্য করলেন যারা হাঁড়িতে নিচ্ছে তাদেরকে রসের পরিমান বেশি দেওয়া হচ্ছে। তিনি সাথে সাথে প্রতিবাদ করতে, উত্তর এলো, ‘পলিথিন এ অত রস দেওয়ার মত জায়গা নেই’। তিনি সাথে সাথে বললেন তাকে একটি ফাউ রসগোল্লা দিতে ওই অতিরিক্ত রসের বদলে, তা দোকানের কর্মচারী তো থতমত খেয়ে গেল, তিনিও ছাড়বার পাত্র নন। যাক, অবশেষে দোকানের  মালিকের হস্তক্ষেপে তাকে একটি ফাউ রসগোল্লা দিয়ে বিদায় জানানো হলো, এবং তারপর থেকে ওই দোকানে পলিথিনের ব্যবহারই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
 মাছের বাজারে এক নতুন আসা মাছ ওয়ালা তাকে প্রথম দর্শনে আধ পচা মাছ গছিয়ে ছিল, নেহাৎ সেদিন তার একটু তাড়া ছিল, নয়তো তিনি সাধারনতঃ মাছ টিপে শুঁকেই নেন। আর কপালটা কার খারাপ ছিল সেটাও বিচার্য্য, কারন পরদিন তিনি হাসিমুখে সেই দোকানে এসে সেই মাছভাজা ওই মাছওয়ালাকে খুব খাতির করে খাইয়েছিলেন এবং সে বেচারির মুখের যে অসাধারন অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছিল তা মাছের বাজারে এখনো কিংবদন্তী হয়ে আছে।
 একবার স্টেশনে এক ফলবিক্রেতা তাকে চরম মিষ্টি বলে যে কমলালেবু বিক্রি করেছিল, তা যারপরনাই টক, তা তিনি ওই কমলালেবুগুলির আর একটি পরিষ্কার করে ছাড়িয়ে, সেই দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে যত খদ্দের আসছে তাদের সবাইকে স্বাদ পরীক্ষা করতে অনুরোধ করতে লাগলেন। দু একজন তো চেখেই পালালো। দোকানদার তো রেগে অগ্নিশর্মা। অন্য দোকানদারদের জুটিয়ে আনল। কিন্তু গোপালকৃষ্ণবাবু তো আর ছাড়ার পাত্র নন। তিনি তাদেরকেও নিজের থেকে একটি করে কোয়া খাওয়ালেন এবং তাদের মত জানতে চাইলেন। সে বেচারারা ওই টক ফল খেয়ে উল্টে সেই দোকানিকেই এমন তিরস্কার করলো যে সে গোপালকৃষ্ণবাবুকে টাকা তো ফেরত দিলই, বিক্রিত কমলালেবুগুলো ও ফিরিয়ে নিচ্ছিলনা। কিন্তু গোপালকৃষ্ণবাবু তো অন্য ধাতুতে তৈরি, তিনি সেই সব কমলালেবু তাকে ফেরত দিয়ে শুধু যে দুটি তিনি খেয়েছিলেন ও খাইয়েছিলেন সে দুটির দাম তাকে দিয়েই এলেন।
 এক কামারশালায় উনি একটি হাতুড়ি ও একটি খুরপির বাঁট লাগাতে দিয়েছিলেন। তা কর্মকার মহাশয় পরেরদিনে দেবে বলে রোজই তাকে ফেরায়, দু তিন দিন এমন হবার পর একদিন তিনি একটু রাগ দেখানোয় সে তাকে এক বিশেষ দিনে বিকেলে বাজার খোলার সময় আসতে বলে, ও এও বলে যে তাঁর জন্যই সে দোকান খুলে আগে তার কাজটা করবে ও সেগুলো তাকে তখনই দিয়ে দেবে। ওই বিশেষ দিনে অফিস থেকে ঘরে না ফিরে গোপালকৃষ্ণ বাবু সোজা কামারশালায় গেলেন এবং দেখলেন দোকানটি বন্ধ হচ্ছে। তিনি তাড়াতাড়ি কর্মকার মহাশয় কে ধরলেন, কিন্তু সে খুবই বিরক্ত হয়ে তাকে দেরি করে আসার জন্য তিরস্কার করলো এবং তার অন্য জায়গায় কাজ আছে বলে, আজ আর হবে না, তিন-চার দিন পর আসুন বলে জানিয়ে দিল। গোপালকৃষ্ণবাবু তখন তাকে বিশেষ কিছুই বললেন না, শুধু সারা বাজারে তার যত বন্ধুস্থানীয় আছেন এমন অন্তত পনেরো কুড়িজনকে আলাদা আলাদা করে অনুরোধ করলেন তার হয়ে ওই কর্মকার মহাশয় কে যেখানে দেখতে পাবে সেখানেই যেন ওই হাতুড়ি ও খুরপির বাঁটের কথা জিজ্ঞেস করে ও মনে করিয়ে দেয়। তারা প্রত্যেকেই তাকে আশ্বস্ত করলো। উনি কিন্তু কাউকেই অন্যদের কথা বললেন না, এদের মধ্যে সবজি বিক্রেতা, মাছ বিক্রেতা, আলু পেঁয়াজ বিক্রেতা, ওষুধের দোকানি, মুদি দোকানি, মিষ্টির দোকানদার ইত্যাদি এমন অনেকেই ছিল যারা গোপালকৃষ্ণ বাবুকে ব্যক্তিগত ভাবে পছন্দ করতো।
 চার দিন পর তিনি যখন কামারশালায় আবার যান, তখন দেখেন তার ওই হাতুড়ি ও খুরপি বাঁট লাগানো অবস্থায় দোকানের আধখোলা দরজার সামনেই রাখা রয়েছে। তাকে দেখে কর্মকার মহাশয়ের সে কি রাগ। ভালো করে কথাই বললো না, শুধু দামটা বলে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইল। তিনিও তার জিনিষ নিয়ে দাম দিয়ে ওখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব বিদায় নিলেন। এবং তার বাজারের বন্ধুদের সাথে একে একে দেখা করে যা বুঝলেন তা হলো, গত তিন দিনে অন্তত পনেরো ষোল জন বিভিন্ন সময় বাজারের বিভিন্ন জায়গায় ওই কর্মকার মহাশয়কে ধরে গোপালকৃষ্ণ বাবুর হাতুড়ি ও খুরপির খবর জানতে চেয়েছে। শেষের দিকে ওই কর্মকার মহাশয় গোপালকৃষ্ণ বাবু বা হাতুড়ি খুরপির কথা শুনলেই ক্ষেপে যাচ্ছিল, এবং তার ফলস্বরূপ অন্য লোকেরাও তাকে এই কথা জিজ্ঞেস করে করে খেপিয়ে মজা পাচ্ছিল। শেষের দিন নাকি এমন অবস্থা হয় যে, ওই কর্মকার মহাশয় সারাদিন দোকান থেকে বেরই হন নি এই জ্বালাতনে আর তার দোকানের ঝাঁপ ও অর্ধেক বন্ধ রাখা শুরু করেছিলেন। গোপালকৃষ্ণ বাবু অবশ্য নিজেও আর কোনোদিন ওই কামারশালায় যাননি।
কেন, কে জানে!?
 এ হেন গোপালকৃষ্ণ বাবু একবার অফিস থেকে একটু দেরি করে ফেরার পথে হাওড়ার সাবওয়ে দিয়ে  উঠে এসে যখন ভেতরে ঢুকছেন তখন কেউ তার কাছে টিকিট চাইলো, অভ্যেস বসতঃ তিনি “মান্থলি” বলে ঢুকে গেলেন এবং ট্রেন তখন প্রায় ছেড়ে দেয় দেয় এই অবস্থায় দৌড়ে উঠে পড়লেন এবং তার ডেলি প্যাসেঞ্জার সাথীদের সাথে বসে পড়লেন। বসেই বুকপকেটে হাত দিয়ে খেয়াল করলেন তার সাধের পার্কার পেনটি নেই।
 এমনিতে গোপালকৃষ্ণ বাবু পকেটমারীর ব্যাপারে খুবই সাবধানী। টাকা পয়সা তিনি জামা বা প্যান্টের ভেতর পকেটেই রাখেন। তার জন্য দর্জির কাছে অর্ডার দিয়ে বিশেষ পকেট বানিয়ে নেন। আজ পর্যন্ত তার কোনোদিন পকেটমারি হয়নি। এব্যাপারে তিনি একটু গর্ববোধই করেন। এদিকে যে পেনটি খোয়া গেছে সেটি তার স্কুল পাস করার পর ঠাকুরদার দেওয়া শেষ উপহার। পেনটি সোনালী রঙের গানমেটালের এবং তৎকালীন বাজারে নতুন আসা অত্যন্ত দামি বল পয়েন্ট পেনের প্ৰথম দিকের সংস্করণ, এখন এটি যথেষ্ট দুর্মূল্য, দ্বিতীয় একটি পাওয়াও অসম্ভব, প্রায় অ্যান্টিক পর্যায়ের, তার বড়ই সখের জিনিষ। একে তো ঠাকুরদার শেষ স্মৃতি তার ওপর পেনটি মহার্ঘ এবং তার জীবনের বহু উত্থানের সাক্ষী। গোপালকৃষ্ণবাবু বেশ মুষড়ে পড়লেন। ট্রেনে তিনি সেদিন কারো সাথে কথাবার্তা তেমন বললেন না আর খালি ওই পেন হারানোর ব্যাপারেই ভাবতে থাকলেন। হঠাৎ তার খেয়াল হলো, “আরে! ঢোকার সময় কেন টিকিট চাইলো!?” এইবার তিনি বুঝলেন যে ওই হঠাৎ টিকিট চেয়েই তাকে অন্যমনস্ক করা হয় ও সে সুযোগেই তার পেনটি তুলে নেওয়া হয়। গোপালকৃষ্ণবাবু উপলব্ধি করলেন যে তিনি ঠকেছেন। ব্যাস, তার তো মাথা গেল গরম হয়ে, মেজাজটিও গেল বিগড়ে। বাড়ি ফিরে ভালো করে খেলেনও না, কারো সাথে কথাও বললেন না, তাড়াতাড়ি শুয়েও পড়লেন। শুয়ে কি আর ঘুম আসে? স্ত্রীও বুঝলেন যে কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, কিন্তু কি জিজ্ঞেস করায় কোনো উত্তর পেলেননা।
 পরদিন গোপালকৃষ্ণ বাবুর মন এতই খারাপ থাকলো যে তিনি অফিস গেলেন না, খালি তার মাথায় এই পকেটমারির বিহিতের বিভিন্ন উপায় ঘুরতে লাগলো। প্রথমেই মাথায় এলো পুলিশে যাবার কথা, কিন্তু সামান্য একটা পেন যে পুলিশের কাছে বিশেষ গুরুত্ব পাবে না তা তিনি ভালোই জানেন। ভাবলেন ডেলিপ্যাসেঞ্জার সাথীদের বলবেন, কিন্তু তারাও ব্যাপারটার গুরুত্ব দেবে না, এবং হাসাহাসি করবে এটাও তার জানা। তাহলে উপায়?
 বিকেলের দিকে স্ত্রীর গঞ্জনার জ্বালায় বাধ্য হয়ে তাকে ঘটনাটা খুলে বললেন। সব শুনে স্ত্রী তো প্রথমে গুরত্ব ই দিলো না, কিন্তু গোপাল কৃষ্ণ বাবুর বিগড়ানো মেজাজের জন্য বিরক্ত হয়ে তিনি বললেন, “যাও গিয়ে ঐখানে দাঁড়িয়ে থাকো, তোমার দুঃখ দেখে ওরা তোমাকে ওই সামান্য জিনিষ ফেরত দিয়ে দেবে।” গোপালকৃষ্ণ বাবু তখনকার মত কোন বিতর্কে গেলেন না। কিন্তু তার খুব খারাপ লাগলো। রাতে শুয়ে শুয়ে স্ত্রীর বলা কথাটা তার মাথায় ঘুরছিল। এমন সময় বিদ্যুতের মত একটা উপায় তার মাথায় খেলে গেল।
 পরদিন সকালে গোপালকৃষ্ণবাবু যথারীতি অফিস গেলেন। কাজের ফাঁকে সুযোগ বুঝে সাহেবকে ধরে একটি অনুরোধ করলেন যে আগামী কিছুদিন তিনি এক ঘন্টা দেরিতে আসবেন ও একঘন্টা আগে চলে যাবেন। তা এমনিতে তাঁর কাজের সুনাম আছে, আগে যাওয়া বা দেরিতে আসা তার ধাতে নেই , আর এটা সরকারি অফিস, কে কখন ঢুকছে কে বেরোচ্ছে, কেউ বিশেষ খোঁজ রাখেনা। তাই সাহেব নির্দ্বিধায় তাকে অনুমতি দিলেন।
 সেদিন বিকেলে, গোপালকৃষ্ণবাবু অফিস থেকে ঘন্টাখানেক আগে বেরিয়ে হাওড়া স্টেশনের ওই সাবওয়ের ভেতরের প্রান্তে আন্দাজে যেই জায়গায় তাকে অন্যমনস্ক করতে টিকিট চাওয়া হয়েছিল সেই জায়গায় এলেন।
 জায়গাটা ভিড়ে ভিড়াক্কার, কিন্তু প্রায় সবাই ছুটছে। লোকাল ট্রেনের ছাড়ার সময় ভিড়টা বাড়ে, বাকি সময় তা মোটা মুটি থাকে। কেউ কারো দিকে তাকায় না, শুধু নিজের জিনিষ আর সঙ্গীর দিকে লক্ষ্য রাখে।
 গোপাল কৃষ্ণবাবু একটি ফলওয়ালার কাছ থেকে বড়সড় আর শক্তপোক্ত একটা কাঠের পেটি জোগাড় করলেন। ভিড়ের ধাক্কায় যাতে পড়ে না যান তাই একটি পিলারকে ঠেস দিয়ে পেটিটা উল্টো করে রেখে তাতে উঠে দাঁড়ালেন।
এইবার তার আসল কাজ।
 গোপালকৃষ্ণবাবু বহু ইউনিয়ান ও রাজনৈতিক পার্টির বক্তৃতা দেখেছেন, সেই বক্তাদের ঢঙেই তিনি চেঁচিয়ে বলতে শুরু করলেন। প্রথম প্ৰথম কিছুটা আড়ষ্ঠ লাগছিলো, কিন্তু ধীরে ধীরে তা কাটতে শুরু করলো।
 ভিড় বাড়ার সাথে সাথে, গোপালকৃষ্ণবাবু শুধু এই কথা গুলোই বলে চলছিলেন যে, “সাবধান, সাবধান, সবাই সাবধান, এখানে পকেটমার আছে, অন্য কোনো দিকে মন দেবেন না, আপনার অন্যমনস্কতার সুযোগে আপনার পকেট মারা হতে পারে, তাই সাবধান, সাবধান, সাবধান।”
এইরকম প্রায় ঘন্টাখানেক চেঁচাবার পর ভিড়টা একটু পাতলা হতেই তিনি পেটিটা ফলওয়ালার কাছে ফেরত দিয়ে তার ভাড়া চুকিয়ে পরেরদিনের জন্য তা বুক করে রেখে, সাধারনতঃ তিনি যে লোকালে যান তার পরেরটি ধরলেন। তার শহরের স্টেশনে প্রায় সব লোকাল ট্রেনই দাঁড়ায়, তাই তার দু একটি ট্রেন ছাড়লে ক্ষতি নেই।
 পরদিন তিনি সাধারনতঃ যে ট্রেনে আসেন তার আগের ট্রেনে এসে আবার ঐখানে ওই ফলওয়ালার পেটির ওপর দাঁড়িয়ে আবার একই রকম চেঁচিয়ে বক্তব্য রাখতে শুরু করলেন এবং ঘন্টাখানেক পর চেঁচানো বন্ধ করে পেটি জমা রেখে অফিস চলে গেলেন। বিকেলেও যথারীতি তাই করলেন।
 দিন তিনেক রোজ দুবার করে এমন করার পর শনি ও রবিবার গলাকে বিশ্রাম দেবার জন্য তিনি আর হাওড়া গেলেন না। পরের সপ্তাহে সোমবার আবার যথারীতি তিনি সকালে রুটিনমাফিক চেঁচিয়ে বক্তব্য রাখতে থাকলেন।
ইতিমধ্যে দু একজন পরিচিত তাকে ভিড়ের মধ্যে থেকে লক্ষ্য করে, “দাদা, কি ব্যাপার?” বা “কি হলো দাদা,কি করছেন?” জিজ্ঞেস কবলে, তিনি তাদের হাত তুলে অভয় দেখিয়ে এগিয়ে যেতে বলেছেন। এদিকে বাড়িতে স্ত্রীকে আগে বেরোন বা দেরিতে ফেরা নিয়ে অফিসের কাজের অজুহাত তো আগেই দিয়ে রেখেছেন তাই সেদিকে চিন্তার কিছু নেই। তাকে শুধু এখন নিজের তৈরি রুটিন মেনে চলতে হচ্ছে।
 সোমবার বিকেলে তিনি যখন সবে বলা শুরু করেছেন, হঠাৎ তার পেছন থেকে একজন তাকে টেনে পেটির ওপর থেকে নামিয়ে আনলো। লোকটি দেখতে বেশ ভদ্র এবং সপ্রতিভ, শিক্ষিতও মনে হলো। সে প্রথমেই তাকে টেনে একটু আড়ালে নিয়ে গেল। তারপর জিজ্ঞেস করলো, “কি ব্যাপার বলুনতো? রোজ এরকম আনখাই চেঁচাচ্ছেন কেন। কি অসুবিধে আপনার? কি হয়েছে আমাকে বলবেন?” গোপালকৃষ্ণ বাবু অকপটে তার সমস্যার কথা বললেন। ওই পেনটি তার কাছে কত দামি তা বোঝাবার ও চেষ্টা করলেন। লোকটি কি বুঝলো কে জানে। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ” চলুন আমার সাথে।” এবার গোপালকৃষ্ণবাবু একটু ভয় পেলেন। তাঁর দ্বিধা দেখে লোকটি বলল, “ভয় নেই আমি আপনার কোনো ক্ষতি করবোনা, আমরা অতটা খারাপ নই।” ভয় ভয় গোপালকৃষ্ণবাবু রাজি হলেন এবং লোকটির পিছু নিলেন। স্টেশন চত্বর থেকে বেরিয়ে হাওড়ার বাসস্ট্যান্ড অঞ্চল পার হয়ে তাকে লোকটি নিয়ে চললো, এমন করে মিনিট দশেক এগলি ওগলি পার হয়ে তাকে সে একটি বহু পুরোনো বাড়ির ছোট্ট একটা ফাঁকা ঘরে নিয়ে এলো। গোপাল কৃষ্ণ বাবুকে সেই ঘরে একটি চেয়ারে বসিয়ে, লোকটি আবার কোথায় যেন চলে গেল। মিনিট পাঁচেক বাদে সে একটি মাঝারি মাপের বস্তা নিয়ে এসে গোপালকৃষ্ণবাবুর সামনে তা খুলে ভেতরের সব জিনিস মেঝেতে ছড়িয়ে দিয়ে বললো, ” এই দেখুন গত সপ্তাহে যত পেন পাওয়া গেছে সব এখানে আছে, আপনারটা বেছে নিন।” গোপালকৃষ্ণবাবু দেখলেন তার সামনে অসংখ্য বিভিন্ন ডিজাইনের পেন ছড়িয়ে আছে। তিনি তো চোখে সর্ষেফুল দেখলেন। যাই হোক, একটু ধাতস্থ হবার পর, তিনি খুঁজতে শুরু করলেন। প্রায় মিনিট পনেরো ঘাঁটাঘাঁটি করে অবশেষে তিনি তার কাঙ্খিত বস্তুটি পেলেন, এবং প্রায় সোনার কেল্লা ছায়াছবির লালমোহন বাবুর কুঁকরি পাবার মত করে লাফিয়ে উঠে “পেয়ে গেছি” বলে চেঁচিয়ে উঠলেন।
 লোকটি জিজ্ঞেস করলো, ” খুশি তো?” গোপালকৃষ্ণবাবু “হ্যাঁ” বলায়  সে জানতে চাইলো ” আর অমন করে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে চেঁচাবেন না তো?” গোপালকৃষ্ণ বাবু এক কথায় জানালেন, ” আর জীবনেও না! আমার কি ঠ্যাকা পড়েছে?” লোকটি বলল, ” ব্যাস, কথা দিচ্ছেন তো? নইলে কিন্তু…” গোপালকৃষ্ণবাবু অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে দৃঢ়ভাবে জানালেন যে তিনি আর কোনদিনও এ কাজ করবেননা, যদিনা অবশ্য আবার তার পকেটমার হয়। একথা শুনে লোকটি একটু দমে গেল যেন, তারপর বলল, “বোঝেন ই তো পেটের দায়ে এসব করতে হয়। ঠিক আছে, আমি বলে দেব, হাওড়া স্টেশনে অন্তত কোনোদিন কেউ আপনার পকেট মারবেনা। তবে, আপনি কিন্তু এই নিয়ে পুলিশ-টুলিশের কাছে যাবেননা, তবে আমরা কথা রাখতে পারবোনা।” গোপালকৃষ্ণ বাবু এই কোথায় সম্মতি জানালে সে আবার বললো, “জানেন? আপনি ওই রকম চেঁচালে লোকজন সাবধান হয়ে যায় আর আমাদের লোকদেরও কনসেন্ট্রেশান নষ্ট হয়, তারাও নার্ভাস হয়ে যায়, তাই ব্যবসার বেশ ক্ষতি হচ্ছে। আচ্ছা লোক তো আপনি! সামান্য একটা পেনের জন্য আপনি আমাদের কত ক্ষতি করেছেন আপনি জানেন? আর, আমাকে খোঁজার চেষ্টা করবেননা, আমি এই অঞ্চলে কাজ করিনা, এ অঞ্চলের লোকেদের যাতে আপনি না চিনে রাখেন তাই তাদের বদলে আমি এসেছি।” এই বলে লোকটি আবার তাকে অনুসরণ করতে বললো এবং অন্য একটি গলি এবং তস্য গলি দিয়ে নিয়ে গিয়ে একটি দেওয়ালের ফাঁক গলে, কয়েকটি রেললাইন পেরিয়ে হাওড়ার কোনো একটি প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তে তাকে তুলে দিল এবং কোনো কথা না বলে সোজা উল্টো মুখে হাঁটা দিয়ে দেওয়ালের পিছনে হারিয়ে গেল।
 গোপালকৃষ্ণবাবু পেনটি বার করে ভালো করে দেখলেন এবং আবার ভেতরের বুকপকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন, এবং একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। তারপর স্টেশনের প্রধান অঞ্চলে এসে যথারীতি পরের ট্রেনটি ধরে বাড়ি ফিরে, হৈ হৈ করে ঘরে ঢুকে স্ত্রীকে বললেন, “তোমার কথাতেই পেনটা খুঁজে পেলাম, তুমি যদি আমাকে সেদিন- ‘যাও গিয়ে ঐখানে দাঁড়িয়ে থাকো, তোমার দুঃখ দেখে ওরা তোমাকে ওই সামান্য জিনিষ ফেরত দিয়ে দেবে’- এই কথা না বলতে তাহলে আমার মাথায় এমন বুদ্ধি খেলতোই না, আর পেনটাও পেতামনা।” এই বলে তিনি একটি বড় মিষ্টির হাঁড়ি স্ত্রীর হাতে ধরিয়ে দিলেন।
Writer Amitava Banerjee

— লেখক অমিতাভ ব্যানার্জী Durgapur Steel Plant এর SAIL এ কর্মরত একজন অফিসার। ছোটবেলায় দুর্গাপুরের কল্লোল থিয়েটার গ্রূপের সাথে যুক্ত ছিলেন ।
একজন Voracious reader।সিনেমা পাগল মানুষ। জন্ম 1971এর 28 February মানে 47টা শীত পার হয়ে গেছে ।লেখালেখির বয়স খুব বেশি হলে এক বছর।

SOURCEAmitava Banerjee
Previous articleশবযাত্রা…..
Next articleবুকের ভেতর নদী
Avatar
Disclaimer: Monomousumi is not responsible for any wrong facts presented in the articles by the authors. The opinion, facts, grammatical issues or issues related sentence framing etc. are personal to the respective authors. We have not edited the article. All attempts were taken to prohibit copyright infringement, plagiarism and wrong information. We are strongly against copyright violation. In case of any copyright infringement issues, please write to us. লেখার মন্তব্য এবং ভাবনা, লেখকের নিজস্ব - কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত..................

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here