<<জাপান পর্ব ১২ ১০ই মে থেকে ১৮ই মে ,২০১৮
আমাদের বিবাহ বার্ষিকী মানেই , সাজগোজ করে ভুরিভোজ।কিছু বুঝলেন ! মানে ফিট ফাট হয়ে কোনো রেস্টুরেন্ট এ খাওয়া। ওই দিন আমার রান্নার ছুটি। এতো বছর এরকম এ হয়ে এসেছে , এবছর একটু আলাদা। আলাদা যে হবেই বাপু , জাপান এ এসেছো , তা মন মতো খাওয়া বলতে তো ওই নান -কারি -টিক্কা আর বিরিয়ানি। খেয়ে খেয়ে দু আড়াই মাসে , সব কিছুর প্রতি বিতৃষনা এসে গেছে , বিশেষ করে চিকেন খেয়ে খেয়ে একদম সত্যিকারের মুরগি হয়ে গেছি বললে চলে। ভাস্কর অনেক বার আমাকে বলেছিলো , আর ওই দিন রান্না করতে হবে না , চলো বাইরে খায়। এখানে বাইরে খেতে যাওয়ার কথা শুনলে আমার খুব একটা ভালো লাগে না, কারণ প্রতি শনিবার , এসেছি অবধি , বাইরের সেই একই মেনু , বড়জোর পাল্টে ম্যাক-ডি /পিজ্জা । তাই নিজেই প্রায় জোর করে ঠিক করলাম না ঘরেই রান্না করবো। আর ওই দিনে মেয়ের স্কুল আছে , মেয়ে গার্ডেন এ যাবে , সেখানে লাঞ্চ করবে। তাই সব ভেবে সক্কাল সক্কাল শুরু হলো , চিকেন বিরিয়ানির আয়োজন। সকালে উঠে ৯ তার মধ্যে চিকেন বিরিয়ানি -চিকেন কারি আর মেয়ের গ্রীলড চিকেন। আগের দিনে কেক ছিল মিষ্টি মুখের জন্য। কেক কাটা ব্যাপারটা আমার বেশ লাগে , যদিও আমার বর এসব এ উদাসীন। বৌ র ভালো লাগে বলে সে ফুল কেক এনে অভ্যস্ত শেষ ৮ বছরে , এবছর ও অনিয়ম হয়নি। মজার ব্যাপার ছিল এই , আমি এনেছিলাম হালকা বেগুনি রঙের কার্নেশন ফুল , আমার পাড়ার ফুলের দোকান থেকে আর রাতে বেলা ভাস্কর নিয়ে এলো একই ফুল একটু হালকা গোলাপি রঙের। যখন দু ডালি ফুল এক সাথে সাজালাম , মনে হলো না আলাদা। এরকম ও হয়। অন্য দোকান- অন্য সময়ে -দুই আলাদা মানুষের কেনা ফুল -তবে একই উদ্যেশে -কখনো কখনো মিলে যায়। যেমন টি আমি আর ভাস্কর। একদম অন্য ধরণের মানুষ , একজন উত্তর তো অন্য জন দক্ষিণ , কেমন করে মিলে গেছি। খুব ভালো লেগেছিলো , ফুল গুলো দেখে।
ভাস্কর ভেবেছিলো অফিস দুপুরের খাবার পর যাবে। কথামতো দুজনে , মেয়েকে সাইকেল এ বসিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কিয়োটো বোটানিক্যাল গার্ডেনের উদ্যেশে। ৯:৪০ সকাল , বোটানিক্যাল গার্ডেনের গেটের সামনে ফোয়ারার কাছে সবার সাথে দেখা করার কথা। গেটেই দেখা হয়ে গেলো আইক এর সাথে। আস্তে আস্তে সবাই এলো। স্কুল এর দিদিমনি হেড মাস্টার। সবার মা এসেছে -বাবা আসেনি কারোর , সেই দেখে ভাস্কর বাবা বেঁকে বসলেন , বললেন উনি ফেরত যাচ্ছেন , ঘরে অপেক্ষা করবে -কিসব অফিস এর কাজ বাকি ইত্যাদি। অগত্যা , আমি মেয়েকে সামলালাম।
আজ এখানে ২০০ স্কুলের বাচ্চা তাদের স্কুলের দিদিমনির সাথে এসেছে। এখানে প্রায় ৪০০০ বাঁচা আজ যোগদান করেছে। আসবেন শহরের মেয়র।
কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে সাথে মেয়রের বক্তৃতা। অনেক রকম খেলা শুরু হলো। চারিদিক যেন রঙে ভোরে উঠেছে , কি করে? আসলে বাচ্চারা তো এমনিই ফুলের মতো সুন্দর , আর তার সাথে তাদের মাথায় ছিল এক এক রঙের টুপি , এক এক স্কুল , এক এক রং। হাতে ঝুন ঝুন করা চুরির মতো ব্রেসলেট। যা মাঝে মাঝেই সবাই মিলে এক সাথে নাড়িয়ে আওয়াজ করছিলো। বিশাল মাঠ ভর্তি।
মেয়র এলেন,বাচ্ছাদের সাথে খেললেন। অনুষ্ঠান হলো -বক্তৃতা হলো। এসব শেষ হতে হতে প্রায় ১১:৩০। সেদিন খুব ঠান্ডা ছিল। ১৫ ডিগ্রী হবে। বিয়ে করেছিলাম ৪৩ ডিগ্রী অসহ্য গরমে। তারপর এই ন-বছর এ এই প্রথম বিবাহ-বার্ষিকী তে ঠান্ডা। ১০ই মে , আমি সোয়াটের পরে। একটা জায়গায় সবাই সবার ব্যাগ রেখেছিলো , ফিরে গেলাম সেখানে। বাচ্চারা খাবার খাবে। খাবারের আগে হলো প্রার্থনা।
খাবার খেয়ে মেয়েকে নিয়ে ফিরে আসার পালা। সবাই তখন ওখানে বাচ্চাদের খেলাচ্ছে , আমি অনুমতি নিয়ে চলে এলাম , কারণ বাড়িতে একজন অপেক্ষারত। আসার সময় জীবন বেরোনোর জোগাড়। ২০ মিনিটের সাইকেল চালিয়ে আসার রাস্তা এতটাই চড়াই যে এক জায়গায় পা শিথিল হয়ে গেলো। কিছুটা হেঁটে -কিছুটা চালিয়ে ৩০ মিনিটে বাড়ি পৌছালাম। তারপর গোগ্রাসে বিরিয়ানি। রাতে ছিল এগ চিকেন রোল বানানোর উদ্যোগ। প্রায় রান্না শুরু করবো , প্রিয়াঙ্ক দা এসে এক বাটি চিকেন পাস্তা দিয়ে গেলো। তাই আর রোল বানানো হয়নি -পাস্তা আর গ্রীলড চিকেন ছিল নৈশ্যভোগ। এই গেলো ৯ বছরের বিবাহ বার্ষিকী পালন। অনেকদিন মনে থাকবে। অনেকটা অন্যরকম যে।
এই সপ্তাহে আমাদের প্ল্যান এ ছিল ওসাকা। কিন্তু আবহাওয়ার পূর্ভাবাস একদম ঠিক দিচ্ছে না। শনিবার উজ্জ্বল আকাশ থাকলেও , রবিবার মেঘাছন্ন আর বৃষ্টির সম্ভাবনা। ভেবেছিলাম ওসাকা তে একদিন বা দুদিন থেকে ইউনিভার্সাল ষ্টুডিও ছাড়াও একোরিয়াম আর সমুদ্র দেখেই ফিরবো। কিন্তু হোটেল ব্যবস্থা আর আবহাওয়া দুটোই সাথ না দেওয়াই শেষ মেশ প্ল্যান হলো , আমরা একদিনেই সকালে ইউনিভার্সাল স্টুডিও দেখে রাতে ফিরে আসবো কিয়োটো। সঙ্গী ছিল ঘোষ পরিবার। রোজ অফিস থেকে ফিরে বৈঠক বস্তু পরিকল্পনার। কোন কোন ride চড়বে , কোনটা বেশি জনপ্রিয় , priority টিকিট নেবো কি নেবো না , এসব হাজারো প্রসঙ্গ আর তার কথা।
কথা মতো সক্কাল সক্কাল উঠে সকালের দুপুরের খাবার জোগাড় করে যত তাড়াতাড়ি পারলাম , মানে ৮ টাই বেরিয়ে পড়লাম। আগে থেকে জেনে রেখেছিলাম , যাওয়ার পথ। আমার সামনের স্টেশন সুগাকুইন থেকে Eizen Main Line এর ট্রেন ধরে , চারটে স্টেশন পরে Demachiyanagi Station .সেখান থেকে ট্রেন বদলে Kehian Main Line এর ট্রেন ধরে , ৮ টি স্টেশন পরে Kyobashi স্টেশন। আবার সেখান থেকে Osaka Loop Line এর ট্রেন ধরে Nishikujo Station, আরো ৫টি স্টেশন স্টপ। এখানেই ক্ষান্ত হয়নি , এর পরেও আরো একবার ট্রেন বদল। এখানে Sakurajima line এর ট্রেন ধরে শেষমেশ গন্তব্য স্টেশন Universal City Station(২ স্টেশন ) এ পোঁছালাম। স্টেশনের বাইরে আসতেই পথ যেন এমনি এমনি চিনিয়ে দিচ্ছে কোথায় কোনদিকে যাবো। সব ভিড় জনসমুদ্র সব একই দিকে। আমরাও সেই পাঠে এগিয়ে আরো চার মিনিট হেঁটে পৌছালাম Universal Studio Japan এ।
লাইন এ দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ। টিকিট কাটা হলো আমাদের তিন জনের। প্রাপ্তবয়স্কের 7,315 yen আর বাচ্ছাদের ৫০০০ yen .একদিনের টিকিট কাটতে প্রায় ২০০০০ চলে গেলো। আর কি। প্রবেশ দ্বার পেরিয়ে , ঢুকলাম স্বপ্নর দুনিয়ায়। ঢোকার আগেই বাইরে থেকে দেখলাম বীভৎস্য সব roller coaster . অনেক বায়না করেছি , ভাস্করের কাছে , যেন সে আমাকে এই সব রাইড গুলো চড়তে দেয়। কারণ ভাস্কর একটু ভীতু প্রকৃতির। ও নিজে তো যাবেই না , আর আমাকেও অনুমতি দেবে না। সাথে ঘোষ পরিবারের দুজন এ বেজায় ভীতু। ঠিক বুঝলাম না কেন এরা সবাই এখানে , যেখানে এতো ভাবলো ভালো রাইড , সেখানে এরা কি করতে। যদি নাই বা চড়বে , তো রাইড গুলো কি দেখতেই এসেছে। যাক সে কথা। এদিক ওদিক দেখে , ছবি তুলতে তুলতে এগিয়ে গেলাম জুরাসিক পার্কের রাইড এর দিকে। এটাই ছিল আমাদের তালিকার এক নম্বরে। দেখে তো ভাস্কর আর ঘোষ পরিবার অনেকক্ষণ ভাবতেই থাকলো , যাবে কি যাবে না। ধুর বাবা। মনে মনে রাগ হচ্ছিলো। সময় এগোচ্ছে আর একটাও রাইড চড়িনি এখনো। ওপর দিয়ে flying dinosaur রাইড একবার এদিক একবার ওদিক আর সাথে সাথে তাতে চড়তে থাকা বাচ্চা বুড়োর উল্লাসের চিৎকার। ভাস্কর আগেই বলেছে , ওটাতে আমার ওঠা হবে না। কিছু যদি হয়ে যায়। আছে বাবা , কি হবে শুনি?কিছু হলে কি লোকে চড়তো ?কে তাকে বোঝাবে। যাক। এবার আমরা লাইন এ দাঁড়ালাম জুরাসিক রাইড এর জন্য। সে প্রায় দেড় ঘন্টা। লাইন এর পর শেষমেশ এলো আমাদের পালা। সত্যি বলতে আমার তেমন আহামরি লাগেনি , এরকম রাইড আগেও আমি নিকো পার্ক এ চড়েছি। শুধু শেষের ৫ সেকেন্ড এ একটু ওপর থেকে নিচে ঝপ করে জলের মধ্যে। এই যা। তাতেও কস্তুরী দি সেকি ভয়।
এর পর খাওয়া দাওয়া হলো। প্রিয়াঙ্ক দা কিনেছিলো একটা মুরগির ঠ্যাং। কি বিচ্ছিরি গন্ধ তার। সম্মুখে বলতে পারিনি ঠিক এ। তবে না খেয়ে থাকলেও আমি ওই খাদ্য কোনো দিন আমার মুখে দিতে পারবো না। ওটা ঠিক কোন ধরণের চিকেন তা আমার জানা নেই। আমরা কিনেছিলাম Frozen Fruit .আম. আঃ অাহ্। কি দারুন খেতে। যেটুকু বুঝলাম ,একটা আমের খোসা ছাড়িয়ে , তার তিন ভাগ করে , পাশের দুটো ভাগের (মানে আঁটি র ভাগ টা ছেড়ে দিয়ে ) এক একটিতে একটা আইস ক্রিম এর কাঠি ঢুকিয়ে , বরফে রেখে দিয়েছে মনে হলো। কিন্তু সে যাই হোক , খেতে কিন্তু দারুন ছিল। ওই এক চিট আমের দাম ৫০০ ইয়েন।
এর পর আমরা গেলাম মিনিওন শো দেখতে। ও বাবা এতো লাইন শেষ এ হয়না। প্রায় আড়াই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে শেষমেশ দেখলাম। এটা আমার পছন্দ হলো। ৫D শো। বেরিয়ে হটাৎ চোখ পড়লো , একটা display তে , সেখানে লেখা ওয়েটিং টাইম এতো। ও বাবা। এই ছিল। এতক্ষনে বুঝলাম , প্রতিটা শো দেখতে কতক্ষন তোমাকে লাইনে দাঁড়াতে হবে তা তুমি লাইন এ ঢোকার আগেই জানতে পারবে। এই শো দেখতে ঘোষ পরিবার আমাদের সাথে আসেনি , তারা minion চেনেনা। তারা গেছে স্পেস শো দেখতে। যদিও সেখানে অগ্রিম সতর্কতা বাণী দেখে তারা লাইন ছেড়ে পালিয়েছে ইতিমধ্যে। হ্যাঁ সতর্কতা , minion শো দেখার আগেও আমরা সেটা পেয়েছিলাম , যেমন যার হার্ট এর সমস্যা , যার উচ্চতাতে সমস্যা , যার উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি ইত্যাদি , তারা এসব শো না দেখলে ভালো। ভাস্কর আর বাবি এক চোখ বন্ধ করে শো টা দেখেছিলো। idea তা আমার ই। কারণ এক চোখে দেখলে , আমাদের একটা সেন্স চলে যায় , ভয় কম লাগে।
এরপর ওখান থেকে বেরিয়ে মেয়ের জন্য একটা জলের বোতল কিনবো ভাবলাম। এখানে প্রতিটা শো বা রাইড এর পাশাপাশি ছিল , সেই চরিত্র সম্পর্কিত দোকান।যেমন minion এর পাশেই ছিল minion shop , সেখানে minion আকারের বোতল , টুপি , খেলনা ,পেন্সিলবক্স থেকে শুরু করে সব পাওয়া যাচ্ছে। ভাস্করের বা মেয়ের কারোর ই তেমনা আগ্রহ ছিল না। তবুও আমি কিনলাম , মেয়ের জন্য , হয়তো নিজের ছেলেবেলার ইচ্ছে ইশারায় , নিজের জন্য একটা minion জলের বোতল , দাম ২০০০ ইয়েন। ভাবা যায়। আমার সাথে বেরোলে আমার বর আর কিছু ভাবেনা। জানে আমি একটু খামখেয়ালি ধরণের। কিনবল বলেছি তো কিনবো। এর পর গেলাম scooby ওয়ার্ল্ড আর wonder world এর দিকে। এই জায়গাটাতে তেমন কোনো ভয়ঙ্কর রাইড নেই , আছে ছোট ছোট বাচ্চাদের ভালো লাগার খেলনা , আর রাইড। মেয়ের খুব ভালো লেগেছিল।
সময় এগোতে থাকলো , আমাদের শেষ রাইড ছিল Harry Potter .সেখানে গিয়ে ঘোষ বাবু দের সাথে আবার সাক্ষাৎ। হ্যারি পটার দেখে দেখে থাকলে , মনে হবে আমরা যেন সত্যিই সিনেমায় দেখা হ্যারি পটার এর দুনিয়াতে প্রবেশ করলাম। অনেক ছোট বড় শো চলছিল। গেটের সামনেই সেই বিখ্যাত ট্রেন , ধোঁয়া উড়িয়ে অপেক্ষায় তার যাত্রীর। একটা ছোট ম্যাজিক শো দেখে , পৌছালাম আসল হ্যারি পটার শো দেখতে। আমার মেয়েকে ওরা ভেতরে যেতে দিলো না , কারণ ওর উচ্চতা ওই রাইড চড়ার জন্য যথোপযুক্ত নয়। তাই ভাস্কর ও গেলো না। মেয়ে কে নিয়ে বাইরে থাকলো। বাইরেও ম্যাজিক শো চলছিল। মেয়ে কে ওটা দেখাতেই বাবা ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এক কথায় ভাস্কর বাঁচলো। কারণ এসব রাইড এ ও খুব ভয় পায়। কস্তুরী দি জুরাসিক পার্কার রাইড এ তো ভয় পাওয়া সত্ত্বেও কেন যে এই ভয়ঙ্কর রাইড এ যেতে ইচ্ছুক হলো , সেটা আজ রহস্যময়। যাক সে কথা ৯০ মিনিট লাইন এ দাঁড়িয়ে শেষমেশ পোঁছলাম রাইড এর কাছাকাছি। আমাদের লাইন টা কাসল এর মধ্যে দিয়ে ছিল। হুবহু সিনেমাতে দেখা হ্যারি পটার কাসল। তাতে ফটোফ্রেমে থেকে সব চরিত্ররা দর্শকদের উদ্যেশে কথা বলছে। ভেতর তা একটা রোমহর্ষক পরিবেশ। কস্তুরী দি ১০ বার জিগেস করছে এটা শো না রাইড। তা আমি কি করে জন্য বলুন তো। এতো ভয় লাগছে তও যাওয়া চাই। কিছুক্ষন এ বুঝলাম এটা রাইড সহ ৫D শো.
রাইড এর সিট্ গুলো ওপর থেকে নিচ অবধি একটা অটোমেটিক লক সিস্টেম এ যাত্রীদের বেঁধে রাখে। ভেতরে ভেতরে যে ভয় হচ্ছিলো তা নয়। একবার ও মনে হলো ,না আসলেও হতো। কিন্তু জীবন তো একটাই। সব অভিজ্ঞতা না করলে কি চলে। শুরু হলো রাইড। জীবনে এতো ভয় আমি পাইনি। প্রথম যেটা মাথায় এলো , বেশ হয়েছে ভাস্কর বা মেয়ে আসেনি। ভাস্কর বোধয় মরেই যেত। রাইড টা যে কি অস্বাভাবিক ভয়ঙ্কর ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। একটু ড্রাগন , আরো কত কিছু মুখের কাছে চলে আসছে , একবার হ্যারি পটার এর সাথে আকাশে উড়ে আবার ভো করে নিচে অন্ধকার গুহায় নেমে যাচ্ছি ,কখনো মনে হচ্ছে ভাগ্যিস জুতো পরে এসেছিলাম , কোনো চটি পড়লে তা বোধয় উড়ে যেত। কখনো ডান -কখনো বাম , আবার কখনো বা মাথা উঁচু , পা শুন্যে। শেষ এক মিনিট মনে হয়েছিল , এবার বোধহয় আর বাঁচবো না। ভাস্করের কথা শোনা উচিত ,আর roller coster চড়ে কাজ নেই। শেষ হলো রাইড। আমার যদি এরকম হয় , তাহলে বুঝতে পারছেন ঘোষ বাবুদের কি হাল। তারা দুজনেই খুব অসুস্থ বোধ করছিলেন। এরপর রো একটু এদিক সেদিক দেখে উল্টোপথে বাড়ি ফেরার পালা। ঘোষ বাবুরা যে বেশ হিলে গেছিলেন সেটা বুঝলাম , রাতের খাবার তারা না খেয়েই বাড়ি গেলেন। আমরা রোজকার মতো শনিবারের খাওয়া ‘সলমন ‘রেস্টুরেন্ট এ খেয়ে ফিরলাম। রাতে শুতে শুতে ওই হ্যারি পটার এর রাইড ভাবছিলাম। বেশ লাগছিলো। যেন মরতে মরতেও না মরা। যখন যেন ঘুমিয়েই পড়েছি।
এসপ্তাহে ছিল Aoi Masturi .যেটা সামিগমো থেকে কামিগামো অবধি একটা ট্রাডিশনাল প্যারেড। শরীর টা তেমন ভালো ছিল না। কিন্তু এই টার জন্য অনেকদিন অপেক্ষায় ছিলাম। তাই মিস করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। সকালে মেয়ে কে স্কুলে পাঠালাম না। কারণ ঠিক হলো , আমরা ওই রাস্তার ঠিক মাঝে একটা জায়গায় দ্রাব , যেখান দিয়ে ওই প্যারেড যাবে। কথা মতো মেয়েকে খাইয়ে ১ তা নাগাদ সাইকেল নিয়ে বেরোলাম। ভাস্কর আর আসিফ ও একই সময় সাইকেল নিয়ে অফিস থেকে বেরোলো। এখন এখন কার অনেক রাস্তায় আমার নখদর্পনে। তাই kitaoji dori তে যে জায়গায় দেখা করার কথা হয়েছিল। সেখানে দেখা হলো। যখন পৌছালাম , তখন ধীরে ধীরে লোক জমায়েত হচ্ছে। পুলিশ রাস্তা ঠিক করছে। কিছুক্ষনের জন্য ওই রাস্তায় ট্রাফিক বন্ধ হবে। সময় জ্ঞান জাপানের সর্বোত্তম , তাই সময় মতো মানে ২:১৫ নাগাদ প্যারেড ঠিক এসে পৌছালো। সে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। বিভিন্ন ট্রাডিশনাল।/আনুষ্ঠানিক পোশাকে সব নারী পুরুষ। কারোর হাতে কিছু, কারোর হাতে অন্য কিছু। মেয়েরা এক অন্যরকম সাজে। কখন হেঁটে বা কখনো ঘোড়ায় চড়ে।
Aoi Masturi কে Aoi Festival ও বলে। এটা কিয়োটো র তিনটি (গিয়ন GION মাতসুরি ও জিডাই JIDAI মাতসুরি সহ) বিখ্যাত উৎসবের একটি। অনেক সৌভাগ্য যে আমি এই উৎসব দেখতে পেলাম। অনেক ধ্যবাদ সেই জাপানীস স্কুলের দিদিমনির যে আমাদের এই উৎসবের সম্পর্কে জানিয়েছিলন।
দু-চার লাইন বলি এই উৎসব সম্পর্কে —
Aoi Masturi অাই মাতসুরি (葵 祭) কিয়োটো তে প্রতিবছর 15 ই মে অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণটি কিয়োটোতে একটি বিশাল প্যারেড, যার মধ্যে 500 জন লোক হেইয়ান পিরিয়ড এর পোশাক পরে (খ্রিস্টীয় 794-1185) কিয়োটো ইমপেরিয়াল প্যালেস (রাজ বাড়ি )থেকে কামো শেরিন (কামিগামো ) পর্যন্ত পদযাত্রা করে । Aoi হল জাপানী নানাবর্ণ পুষ্পপ্রসু উচু গাছবিশেষ এবং এই উৎসবের এই নামকরণ করা হয় কারণ মিছিলের সদস্যদের ওই পাতার তৈরি পোশাক পরে পদযাত্রা করেন।
7২4 খ্রিস্টাব্দে কিয়োটো জাতীয় রাজধানী হিসেবে ঘোষিত হবার সময় Aoi Masturi শুরু হয়। তাই মনে করা হয় Aoi Masturi 7 ম শতকে শুরু হয় , যদিও এর সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব হয়নি। কামরূপ শেরিনের দেবতাদের দ্বারা সৃষ্ট হওয়া সম্ভবতঃ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছিল। সম্রাট দেবতাদের কাছে উত্সর্গীকৃত হওয়ার পরে, বিপর্যয় হ্রাস পায় এবং এই ঐতিহ্য শুরু হয়। তাই এই উৎসবের সরকারী নাম কামো মাতসুরি, কারণ মন্দিরগুলির সাথে এটি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।Heian সময় থেকে এটি Aoi Masturi বলেই পরিচিত। পুরুষেরা ঘোড়ার পিঠে বসে, বিশাল পুস্পস্তবক বুকে নিয়ে , মেয়েরা Kimono পরে , পদযাত্রায় সামিল হন।
ঐতিহ্যগতভাবে, সায়ো সাম্রাজ্যবাদী পরিবারে একজন অল্পবয়সী মহিলা সদস্য ছিলেন, যিনি কামো শেরিনের উচ্চ আধিকারিক হিসেবে সেবা করেছিলেন। উৎসবের সময়, সায়ো তীর্থযাত্রীদের পূজা করতেন। আধুনিক যুগে, কিয়োটো থেকে একজন অবিবাহিত নারী প্রতি বছর সায়ো হিসাবে সেবা করার জন্য নির্বাচিত হয়। উৎসবের আগে তাকে শুদ্ধকরণের অনুষ্ঠানগুলির মধ্য দিয়ে যেতে হয় , এবং তাকে একটি পালকি তে নিয়ে মিছিল সামিল করা হয়।
প্রতিবছর প্যারেড শুরু হয় সকাল 10:15 ইম্পেরিয়াল প্রাসাদের দক্ষিণ গেট থেকে , এবং 11:15 এ সামিগমো শ্রাইন এর সামনে নদী পার করা হয় । মিছিলের প্রায় দুই ঘন্টা আগে মন্দিরের মধ্যে সঞ্চালন অনুষ্ঠানগুলি কামিজোরা শেরনের জন্য প্রস্থান করে, যেখানে প্যারেডের প্রধানত দুপুর 15:30 এর কাছাকাছি আসে। পুরো মিছিলের প্রেক্ষাপটে প্রারম্ভিক থেকে শেষ পর্যন্ত , প্রায় এক ঘন্টা সময় লাগে।
কেউ চাইলে এই অনুষ্ঠান রাজবাড়িতে এবং কামো শ্রাইন এ বসে দেখতে পারেন । টাকা দিয়ে বসার জায়গা সংরক্ষিত করতে হয়। সংরক্ষিতআসন ব্যতীত, যদি আপনি ইমপেরিয়াল প্রাসাদ বা কামো শেরিনে প্যারেডটি দেখতে চান তবে আমাদের মতো , রজে রাস্তা দিয়ে এই প্যারেড যায় , সেখানে দাঁড়িয়ে ইটা আপনি পর্যবেক্ষণ করতে পারেন । উৎসবের আগের দিনগুলি, ঘোড়দৌড় এবং সায়ো এবং তার সহকর্মীদের শুদ্ধকরণের মতো সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠান মন্দিরগুলিতে সংঘটিত হয়।
আরেকটা জিনিস চোখে পরার মতো , সেটা ছিল এদের পরিহিত চটি। যা ছিল চোটের দড়ি দিয়ে তৈরি। সবাই ওই একইরকম চটি পরে মিছিলে সামিল হয়েছিল।
কি ভাবেন পৌঁছাবেন :
মিছিল ইম্পেরিয়াল প্রাসাদ থেকে প্রস্থান করে, সামিগমো শেরাইনের মধ্য দিয়ে যায় এবং কামগামো শ্রাইন এ শেষ হয়। তাই এই তিনটি জায়গা ছাড়াও , যে পথে এই মিছিল যায় , সে পথে দাঁড়ালে যে কেউ এই মিছিল দেখতে পারেন।
সময় ও মূল্য :
কিয়োটো ইমপেরিয়াল প্রাসাদে এবং সামিগম শেরাইনটি সংরক্ষিত আসন রয়েছে। ইম্পেরিয়াল প্যালেসে নিয়মিত আসন এবং সামিগমো শ্রাইনের এই আসনের মূল্য ২700 ইয়েন, ইংরেজ অডিও গাইডগুলিতে শুনতে চাইলে মূল্য বেরে 3700 ইয়েন। টিকিট কানসাই পর্যটন তথ্য কেন্দ্র কিয়োটোসহ ট্রাভেল এজেন্টের মাধ্যমে, অথবা তাবি জাপান থেকে অনলাইন কিনতে পারেন। Kamigamo শ্রাইন এ আসন এর মূল্য 1000 ইয়েন খরচ যা উৎসবের দিনে মন্দির এ বিক্রি হয়।
আজ প্রথম মনে হলো এখানে গরম পড়েছে। সাইকেল নিয়ে পোপো করে এই বয়েসে বোধহয় আমরাই ঘুরে বেড়াই। aoi masturi দেখে গেলাম ইউনিভার্সিটি পাড়ায়। ওখানে একটা মন্দিরে আজ মেলা বসেছে। ভাস্কর নিয়ে গেলো। বাড়ি ফিরলাম ৩:৩০ ঘড়িতে। হাতকাটা জামা ঘেমে একাকার।
কাল বুধবার। আবার শুরু হলো রোজকার জীবন। মেয়ের স্কুল-ভাস্করের অফিস আর আমার সংসার। দিন কেটে যায়। সে যে ভাবেই হোক.সময় থামে না , থমকায় না। ভাবছি এই শান্তিবার কাছে কোথাও যাবো। শেষের সপ্তাহের কয়েকটা দিন এতো ঘোরাঘুরিতে খুব ক্লান্ত আমরা। দেখা যাক কি হয়। এর মধ্যে , মেয়েকে স্কুলে দিয়ে প্রায় বেরিয়ে পরি সাইকেল নিয়ে , কাছে পিঠে , বাজার করতে ,গিফট কিনতে বা নিজের পোশাক।
<< জাপান পর্ব ১২ জাপান পর্ব ১৪ >>
*-* পর্ব ১৩ :CopyRight @ M K Paul, June,2018 *-*
[…] <<জাপান পর্ব ১১ জাপান পর্ব ১৩ >> […]
[…] << জাপান পর্ব ১৩ ১৯শে মে থেকে ২৭শে মে ,২০১৮ […]