একে শ্রাবণ মাস, তারমধ্যে আবার বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের জেরে কদিন ধরেই অবিরাম বৃষ্টিতে যেন থমকে গিয়েছে মানবজীবন। বর্ষা কোনদিনই পছন্দের নয় সুদীপার, তবে এখানে বর্ষার যেন অন্যরূপ। নাগরিক বর্ষাতেও যেন কৃত্রিমতা আছে। এখানে বর্ষাও যেন সহজ-সরল, অনেকটা এখানকার মানুষগুলোর মতো। হাতের ফাইলটা মাথায় দিয়ে, শাড়ির কুঁচিটা সামলে একটু ছুটেই এগিয়ে যায় গাড়ির কাছে। টানা একুশ ঘন্টা ডিউটি করা ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দেয় গাড়ির ব্যাকসীটে। চশমাটা খুলে পাশে রেখে, চোখদুটো বন্ধ করে। কুণালের সাথে সম্পর্কটা বড়ো বেশি একঘেয়ে হয়ে আসছিল। সজীবতা হারিয়ে পুরোটাই যেন সাড়ে আটবছরের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। বড্ড হাঁফিয়ে উঠেছিল সুদীপা, হয়তো কণাদও। যেকোন সম্পর্কে একটা দূরত্বের প্রয়োজন হয়। হয়তো ভালোবাসার সম্পর্কটাকে বাঁচাতেই কিছুটা ইচ্ছা করেই এই প্রত্যন্ত এলাকায় বদলি নিয়ে চলে এসেছিল সুদীপা। মহকুমা হাসপাতাল, ভেবেছিল কলকাতার থেকে কাজের চাপ হয়তো কম হবে। কিন্তু এখানে রুগীর চাপ অনেক বেশি, প্রয়োজনে ডাক্তার-নার্স-পরিসেবার ব্যবস্থা কম। স্বভাবতই চাপ পড়ে যায় অল্প কয়েকজন স্টাফের ওপরেই।
ডাক্তারি পাশ করার পর কেটে গেছে প্রায় বারোটা বছর। মৃত্যুকে এতো কাছ থেকে দেখেছে, মৃত্যু আর মনকে ছোঁয়না। তবু কালকের ঘটনাটা মন থেকে মুছে ফেলতে পারছে না সুদীপা। এগারোটা বাচ্চার দগ্ধ মৃতদেহ চোখের সামনে ভাসছে। গ্যাস সিলিণ্ডারে চলছিল পুলকারটা। হঠাৎ সিলিণ্ডার বাস্ট করে। উফ্ জীবন্ত দগ্ধ অতগুলো ছোট ছোট বাচ্চা। হাসপাতালে আনা হয় তখনও ড্রাইভার আর তিনজন বাচ্চা বেঁচে ছিল। সবাই আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল ওদের বাঁচানোর, কেউই বাঁচেনি। যেভাবে দগ্ধ হয়েছিল, সুদীপার মনে হয় না বাঁচাটাই ঈশ্বরের আশীর্বাদ। বেঁচে থাকার লড়াইটা মৃত্যুর থেকেও কষ্টকর হতো শিশুগুলোর কাছে।
ঘটনার পর থেকেই স্থানীয় লোকজন, মৃতদের পরিবার, পলিটিক্যাল মানুষজন থেকে মিডিয়া, হাসপাতাল একেবারে সরগরম। সেই কাল সন্ধ্যে আটটাতে ডিউটি এসেছিল, আর এখন বিকাল পাঁচটা বেজে গেছে অনেকক্ষণ আগে। এতক্ষণকার টানা ধকলে শরীরটা অবসন্ন লাগছে।
ব্যাগের মধ্যে মোবাইলটা বাজছে। সেটা বের করে আর কথা বলার মতো ইচ্ছাও নেই সুদীপার। দরকারি ফোনের সাথে কত অদরকারি ফোনও তো আসে, তেমনই কেউ হবে ভেবে চোখ বুজে শুয়েই থাকে সুদীপা। হাসপাতালের কোয়াটার্সটা মনোমত লাগেনি সুদীপার, তাই মাসখানেকের মধ্যেই শহর ছাড়িয়ে একটু নিরিবিলিতে নিজের একটা পছন্দসই আস্তানা খুঁজে নিয়ে কোয়াটার্স ছেড়ে দিয়েছিল সুদীপা। ডাক্তারিটুকুর বাইরেও সুদীপা একটা নতুন জীবনের সন্ধান পেয়েছে এখানে এসে। ছোটবেলায় খুব ইচ্ছা ছিল স্কুলের দিদিমণি হবে, বেশ বকুনি দিয়ে দিয়ে পড়াবে ছাত্রীদের। সেই না মেটা শখটাই এখানে এসে যেন হঠাৎ করে পূরণ হয়ে গেছে সুদীপার। বছর দশেক আগেও এখানে নিম্নশ্রেণির মানুষজনের মধ্যে মেয়েদের লেখাপড়ার কোনো চল ছিল না। এইযুগে দাঁড়িয়েও বিমলাদি নাম সই করতে জানে না জেনে প্রথমদিন তো আকাশ থেকে পড়েছিল সুদীপা। প্রথম শুরুটা করেছিল রান্নার লোক বিমলাদিকে দিয়েই। আস্তে আস্তে বিমলাদির সাথে আসতে শুরু করে ওর চেনাজানা দু-চারজন। এখন তো প্রায় জনা কুড়ি মহিলা আসে। যেদিন সন্ধ্যেবেলাগুলো ফাঁকা থাকে, ওদের পড়াশুনো শিখিয়েই বেশ কেটে যায় সুদীপার। আজ শরীর বড্ড ক্লান্ত লাগছে, আজ আর পড়াবে না। কিন্তু পরশুদিন তো ওদের আজকে আসার কথা বলা আছে। সারাদিন খাটাখাটনির পরেও ওরা যখন আগ্রহ ভরে পড়াশুনো শিখতে আসে, ফিরিয়ে দিতে কেমন যেন খারাপ লাগে সুদীপার। “প্রত্যন্ত এলাকায় আলোর জ্যোতি” শিরোনামে গতমাসেই একটা চলতি খবরের কাগজে সুদীপার এই ছোট্ট প্রচেষ্টার নিউজটাও বেরিয়েছিল। ঠিক অহং নয়, এই কাজটাতে একটা আত্মতৃপ্তির ছোঁয়া পেয়েছে সুদীপা। খবরটা খবরের কাগজে পড়ে কুণাল অবশ্য মন্তব্য করেছিল, এসব প্রচারে আসার সুপ্ত প্রচেষ্টা। দিন দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে কুণাল। কুণালের মানসিক সমস্যাটা জেনেই কুণালকে ভালোবেসেছিল….
আবার মোবাইলটা বাজছে….
বাধ্য হয়ে ব্যাগ থেকে বের করে মোবাইলটা। যাহ্ কেটে গেল। শঙ্করের ফোন….
শঙ্কর মাহাতো, হাসপাতালের একমাত্র ডোম। বাবার হাত ধরে হাসপাতালে আসা-যাওয়া শুরু সেই বারো-চোদ্দ বছর বয়স থেকে। বাবা অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়ার পর, বাবার চাকরিটাই পেয়েছে। কতই বা বয়স হবে, ত্রিশ-বত্রিশ। এত নিখুঁত পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, ডাক্তাররাও মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যান। আজ সারাদিন সবথেকে বেশি ধকল গেছে শঙ্করের, একা হাতে এতগুলো বাচ্চার পোস্টপার্টম করেছে। দোষ একটাই, বেশিরভাগ সময়টাই নেশা করে থাকে। কিছু বললেই বলে, আমি মদ খাই, মদ আমাকে খায় না। কথাটা অবশ্য ভুল নয়, নেশা করে থাকলেও নিজের কাজটুকু করে যায় সুন্দরভাবে। খুব দরকার ছাড়া শঙ্কর তো ফোন করেনা, আবার কি হলো কে জানে! সুদীপাই রিং ব্যাক করে।
দিদি আপনি আসছেন তো, শঙ্করের প্রথম কথা। যদি ভুলে যান, তাই একবার মনে করালাম। কাল থেকে যা যাচ্ছে, জানি হেভি টায়ার্ড আছেন। তবু একবার আসুন না দিদি….
ইস্ একদম ভুলেই গিয়েছিল সুদীপা। আজ তো শঙ্করের বিয়ে। কোন উৎসব-অনুষ্ঠান করবে না, কোন্ এক মন্দিরে বিয়ে হবে। সন্ধ্যেবেলা হাসপাতালের সবাইকেই যেতে বলেছিল, ছোট করে আপ্যায়নের ব্যবস্থা হয়তো। আজকের ঘটনায় সে সব তো পুরো মাথা থেকে বেরিয়েই গিয়েছিল। ও নিজেও তো সারাদিন হাসপাতালেই ছিল, বিয়েটা হলো কখন? নাকি সন্ধ্যেবেলাই হবে! শরীর ভীষণ ক্লান্ত লাগছে একথা ঠিক, কিন্তু না গেলে শঙ্কর কষ্ট পাবে। ভাববে হয়তো, নীচু জাত বলে হয়তো এড়িয়ে যাচ্ছে।
কি হলো দিদি কিছু বলছেন না যে, আসবেন না আপনি ?
এতখানি আন্তরিকতার পরে কিভাবে শঙ্করকে না বলবে বুঝতে পারেনা সুদীপা।
না না যাব না কেন? হালকা হেসেই জবাব দেয় সুদীপা। আমি ঠিক পৌঁছে যাব, তুমি ভেবো না।
বাড়ি গিয়ে একটু ফ্রেশ নাহলে শরীর আর চলছে না। কিন্তু আকাশের অবস্থা ভালো নয়, যদি আরও জোর বৃষ্টি আসে তখন হয়তো আর বেরোতেই ইচ্ছা করবে না। তারচেয়ে বরং একবারে এই পথেই শঙ্করের বাড়ি ঘুরে এলে বোধহয় ভালো হতো। কিন্তু ওর বৌয়ের জন্য কিছু তো নিয়ে যেতে হবে। ব্যাগটা খুলে দেখে হাজার দেড়েক মতো টাকা আছে, কিছু একটা কিনে নেওয়াই যায়। নাহ্ তারথেকে বরঞ্চ টাকাই দেবে, ওরা নিজের পছন্দমতো কিছু কিনে নেবে। গাড়ি ঘোরাতে বলে গোবিন্দকে। গোবিন্দ হাসপাতালেরই ড্রাইভার, শঙ্করের বাড়ি সুদীপা না চিনলেও ও নিশ্চয়ই চেনে।
বৃষ্টির জন্য পথঘাট ফাঁকা ফাঁকা। বড়ো রাস্তা থেকে গাড়ি চলেছে লাল মোরামের রাস্তা ধরে। বাপরে, কি প্রচণ্ড ঝাঁকুনি। গাড়ির মধ্যেই নিজেকে সামলে বসে সুদীপা। এমন বৃষ্টিদিন বলেই বোধহয় সন্ধ্যে নেমেছে তাড়াতাড়ি। একটা গলির মুখে এসে গাড়ি থামায় গোবিন্দ। আর তো গাড়ি যাবেনা ম্যাডাম, এবার হেঁটে যেতে হবে।
গোবিন্দ সামনে, সুদীপা পিছন পিছন চলেছে পা টিপেটিপে। বৃষ্টির জন্য রাস্তা পিছল। রাস্তার পোলে টিমটিম করে জ্বলছে হলদে বাল্ব।
শঙ্কর….একটা একতলা বাড়ির সামনে এসে হাঁক দেয় গোবিন্দ।
ভেতর থেকে কেউ সাড়া না দিলেও সুদীপার বুঝতে অসুবিধা হয়না যে এটাই শঙ্করের বাড়ি। বিয়েবাড়ি বলে মনেই হচ্ছেনা। বাড়ির সামনের উঠোনে একটা আলো অবধি নেই। লোকজনও সেরকম উপস্থিতিও বোঝা যাচ্ছেনা।
গোবিন্দ আবার হয়তো ডাকতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই পিছন থেকে শঙ্করের গলা। দিদি আপনি এসেছেন!!!!!
শঙ্কর বাড়িতে ছিলনা। হাতে একটা মিষ্টির হাঁড়ি দেখেই বোঝা যাচ্ছে মিষ্টি আনতে গিয়েছিল।
একমুখ হেসে সুদীপা আর গোবিন্দকে নিয়ে যায় বাড়ির ভিতরে। পাশাপাশি দুটো ঘর, সামনে একটা সরু বারান্দা। রান্না কোথায় হয় বোঝার চেষ্টা করেও বুঝতে পারেনা সুদীপা। বারান্দায় কতগুলো চেয়ার পাতা, ওখানেই দুজনকে বসতে দিয়ে ঘরে ঢুকে যায় শঙ্কর।
হয়তো অল্পসময়, তবু অধৈর্য্য লাগছে সুদীপার। শরীরটা সত্যিই আজ আর সঙ্গ দিতে পারছে না। এইভাবে বসে থাকাটা বিরক্তিকর লাগছে। হাসপাতালের আর কেউ আসবে কিনা তাও জানা হয়নি। কারও সাথে আলোচনা না করে এইভাবে হুট করে চলে আসার সিদ্ধান্তটা ভুল হলো কিনা কে জানে!!!!
চলো তোমার বউকে একবার দেখেই ফিরতে হবে আমাকে। শরীরটা আর যেন চলছে না। শঙ্কর ঘর থেকে বেরতেই কথাগুলো বলে ফেলে সুদীপা।
হ্যাঁ দিদি আসুন আসুন। এইভাবে বসিয়ে রাখার জন্য না হলেও সুদীপার কথাতে বেশ অপ্রস্তুতে পড়ে যায় শঙ্কর। গোবিন্দদা তুমি একটু বসো, আমি আসছি।
গোবিন্দকে নতুন বৌ দেখতে আশ্চর্য লাগে সুদীপার, ডাকলো না দেখে আশ্চর্য লাগে সুদীপার।
ছোট মাপের ঘর। সাজানো গোছানো তো দূরে থাক, বেশ অগোছালো। একটা আলনায় জামাকাপড় ঝুলছে এলোমেলো ভাবে। ছোট কাঠের টেবিলে জলের জগ, বাচ্চার দুধের কৌটো, ওষুধপত্র আর চৌকিতে একজন বৌ মাথা নিচু করে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে একমনে। একজন বাইরের মানুষ যে ঘরে ঢুকেছে সেদিকে কোন খেয়ালই নেই। নিজের লজ্জাটুকু ঢাকার প্রচেষ্টাও নেই কোন। এইজন্যই বোধহয় গোবিন্দকে ঘরে ডাকলো না, নিজের মনেই কথাটা বাবে সুদীপা।
কিন্তু শঙ্করের বৌ কোথায়!
বাসন্তী দেখ্ তো কে এসেছে, চিনতে পারিস কিনা।
শঙ্করের কথায় মুখ তুলে তাকায় বৌটা। এবার চমকানোর পালা সুদীপার। আরে এ তো বাসন্তী। মাসখানেক আগে ভোররাতে হাসপাতালের কাছে একটা মাঠে বাচ্চাটার জন্ম দিয়ে পড়েছিল। রাস্তার কিছু লোক হাসপাতালে খবর দিয়েছিল। মা আর বাচ্চাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল হাসপাতাল কর্মীরাই। নিজের নাম ছাড়া কিছুই বলতে পারেনি বাসন্তী। ওর বাড়ির লোকের খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করেও কিছু জানা যায়নি। এমনিতেই হাসপাতালে পেশেন্টের চাপ, কোথাও ওর যাওয়ার জায়গা নেই জেনেও হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিতে হয়েছিল বাসন্তীকে। কিন্তু বাসন্তী এখানে!
বাসন্তী মুখ তুলে হাসছে। অদ্ভুত এক সরলতা ওর মুখের এই হাসিতে। কে জানে চিনতে পেরেছে কিনা সুদীপাকে।
অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়ে শঙ্করের দিকে তাকায় সুদীপা।
বাসন্তীকেই বিয়েটা করে ফেললাম দিদি। ওর তো কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিলনা। হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়ার পরেই ওকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু পাগল হোক আর যাই হোক, সোমত্ত মেয়েমানুষ তো। পাঁচজনে পাঁচকথা বলছিল। আর ছেলেটারও তো একটা বাপের পরিচয় লাগবে। তাই ভাবলাম বিয়েটা করেই ফেলি।
অ্যাই বাসন্তী নেমে আয়, প্রণাম কর দিদিকে। সুদীপা দুজনকেই থামানোর চেষ্টা করে কিন্তু পারেনা। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে বাসন্তীর। ব্যাগ থেকে দুটো পাঁচশো টাকার নোট বের করে দেয় বাসন্তীর হাতে। মন দিয়ে সংসার করবি। বরের-ছেলের যত্ন করবি। কি জানি কি বোঝে বাসন্তী। একবার শঙ্করের মুখের দিকে তাকিয়েই লজ্জায় মুখ ঢাকে শাড়ির আঁচল দিয়ে।
শঙ্কর একটু মিষ্টি খাওয়ার জন্য খুব জোরাজুরি করছিল। আবার একদিন আসবে বলে কোনরকমে শান্ত করে শঙ্করকে। একটু ফ্রেশ না হয়ে আজ আর কোন খাবার খাওয়ার মতো অবস্থা নেই সুদীপার। গাড়ি অবধি এগিয়ে দিতে সাথে আসে শঙ্কর।
ভালোবাসা পেলে বাসন্তী মনে হয় ঠিক হয়ে যাবে, তাই না দিদি? গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিল সুদীপা, শঙ্করের কথায় থমকে দাঁড়ায়। অদ্ভুর এক ভালোবাসার দৃঢ়তায় আলোআঁধারিতেও উজ্জ্বল শঙ্করের চোখদুটো।
নিশ্চয় সুস্থ হয়ে উঠবে বাসন্তী, শঙ্করের হাতদুটো ধরে অভয় দেয় সুদীপা।
গাড়ি চলছে সুদীপার বাড়ির পথে। বৃষ্টিটা থেমেছিল কিছুক্ষণ, আবার শুরু হয়েছে। মনের মধ্যে তোলপাড় চলছে সুদীপার। কুণালের সাথে পরিচয় মাসতুতো দিদির বাড়িতে। জামাইবাবুর বন্ধু ছিল। ভালোবেসে কেউ একজন ছেড়ে গেছে কুণালকে, মানসিক আঘাতটা কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছিল না সেইসময়। ব্যাঙ্কের চাকরিটাও হয়তো চলে যাবে এমন অবস্থা। সুদীপাই জোর করে নিয়ে গিয়েছিল সাইক্রিয়াটিষ্টের কাছে। অনেকটা ভালোবাসাই পারে কুণালকে সুস্থ করতে। ডাক্তারবাবুর কথাটাকে যেন চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়ে ফেলেছিল সুদীপা। কুণালকে মনে মনে তার অনেক আগেই ভালোবেসে ফেলেছিল যে। বাড়ির সবার অমতে বিয়ে করেছিল কুণালকে। ধীরে ধীরে প্রায় সুস্থও হয়ে গিয়েছিল। আজ হঠাৎ করে নিজেকে যেন দোষী মনে হচ্ছে সুদীপার। শঙ্করের চোখে নিজের ভালোবাসার প্রতি যে বিশ্বাস দেখেছে, তার কাছে নিজেকে ভীষণ ছোট মনে হচ্ছে। কুণালের সমস্যাটুকু জেনেই তো বিয়ে করেছিল সুদীপা। সে অধৈর্য্য হয়ে কুণালকে একা রেখে স্বার্থপরের মতো এতদূরে পালিয়ে এলো কি করে! এমনটাতো করার কথা ছিল না। তবে কি তখন কুণালের বাড়ির লোকের কাছে, সমাজের চোখে মহান হতে কুণালকে বিয়েটা করেছিল! নিজের প্রতিই একটা ধিক্কার আসছে সুদীপার। তার ভালোবাসাতেই ঘাটতি ছিল। আর তাইজন্যই কুণালের আবার এই মানসিক পরিবর্তন! নাহলে মাঝে অনেকদিন তো সম্পূর্ণ সুস্থই হয়ে গিয়েছিল কুণাল।
নাহ্ আর ভাবতে পারছে না সুদীপা। মাথার দুপাশের রগদুটো যন্ত্রণায় দিপদিপ করছে। অনেকদিন পর কুণালের জন্য ভীষণ মন কেমন করছে। সম্পর্কের উষ্ণতাটা মনে হচ্ছে নিজের অবহেলাতেই নষ্ট করে ফেলেছে সুদীপা। শঙ্করের বাড়িতে না গেলে ভালোবাসার এই নতুন উপলব্ধিটুকু করতে পারত না সুদীপা।
কাজের যা চাপ এখনি চাইলেও কলকাতা যেতে পারবে না সুদীপা। আজ রাতেই ফোন করবে কুণালকে। যদি কুণাল কটাদিনের জন্য ছুটি নিয়ে এখানে আসতে পারত….
লেখিকা পরিচিতি : বনবীথি পাত্র, পাটুলি স্টেশন বাজার, পূর্ব বর্ধমান.
বিঃ দ্রঃ লেখাটি জানুয়ারি,২০২০, “মাসিক জনপ্রিয় লেখনী” প্রতিযোগিতার অন্তর্ভুক্ত।