আজ ছোট্ট রাজু খুব ব্যস্ত দম ফেলার সময় নেই হাতে।আজ যে ছোটো রাজুর স্কুলের প্রথম দিন। রাজু আজ প্রথম বারের জন্য স্কুল যাবে। সেই আনন্দে সারারাত রাজুর ঘুম আসেনি।ভোর ৬ টার সময় ঘুম থেকে উঠে পড়েছে রাজু , বিছানায় বসে বসে ভাবছে স্কুলের কথা, কী রকম কাটবে আজকের দিনটা সেই কথা । রাজু যেন আজ আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছে । বাবার এনে দেওয়া স্কুলের ড্রেসটা বারবার পড়ছে আর নিজেকে আয়নায় দেখছে বারবার । ছোটো রাজু মা- কে ডেকে জিজ্ঞেস করল মা আমাকে নতুন স্কুল ড্রেসটায় কেমন লাগছে , বলোনা মা কেমন লাগছে?
মা হেসে বলল নতুন স্কুল ড্রেসটায় বেশ মানিয়েছে আমার সোনাকে , খুব মিষ্টি দেখতে লাগছে।
রাজু – সত্যি বলছ তো মা ? আমাকে স্কুল ড্রেসটা পড়ে এত ভালো লাগছে ।
মা – হ্যাঁ , ভালো তো লাগতেই হবে আমার সোনা যে আজ প্রথম স্কুলে যাবে , ভালো না লাগলে চলবে কী করে । কিন্তু তুই আমাকে একটা কথা বলত , তুই এত সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে পড়েছিস কেন ?
রাজু – মা , আমার না ঘুমোতে ইচ্ছে করছিল না।কখন যে স্কুলে যাব , আমার যে আর দেরী করতে ইচ্ছে করছে না মা ।
মা – যাবি তো , স্কুলে তো যাবিই , কিন্তু এখন তো সবে সকাল ৭ টা বাজছে । স্কুল শুরু হবে বেলা ১১ টাই এখন তো অনেক দেরী আছে রে সোনা । তার আগে তোকে স্কুলের জন্য রেডি হতে হবে ,আর হ্যাঁ শোন স্কুলে গিয়ে যেন কোনোরকম বদমাইশ করবি না কিন্তু ।কী রে মনে থাকবে তো কী বললাম ?
রাজু – হ্যাঁ , মা মনে থাকবে । তুমি দেখো আমি স্কুলে গিয়ে কোনো বদমাইশ করব না , শুধু মন‌ দিয়ে পড়াশোনা করব ।
মা – এইত আমার সোনা ছেলের মত কথা ।যে কথাটা বললি সেই কথাটা মনে রাখিস ।
রাজু – হ্যাঁ মা , মা- কে জড়িয়ে ধরে ।
মা – চল এবার ওঠ অনেক আদর হয়েছে , এবার স্কুলের জন্য রেডি হতে হবে তো ,‌না‌ হলে স্কুলে যেতে আবার দেরী হয়ে যাবে আর সবাই বলবে রাজু প্রথম দিন- এ স্কুলে লেট করে এসেছে ।চল রেডি হবি চল , তোকে স্নান করিয়ে দিই ।
রাজু – হ্যাঁ , চলো মা আমাকে স্নান করিয়ে দাও ।
মা – নেই স্নান হয়ে গেল এবার বাবার এনে দেওয়া নতুন স্কুলের ড্রেসটা নিয়ে যা বাবাকে বলে পড়িয়ে দিতে ।
রাজু – আচ্ছা মা । বাবাই ও বাবাই , আমাকে স্কুল ড্রেসটা পড়িয়ে দাও তো ।
বাবাই – আরে আমার ছোটো রাজু আজ প্রথম স্কুলে যাবে, নেই হাতে তোল এইত এবার বোতাম গুলো এঁটে দিই ।এই নে প্যান্ট টা পড়েনে ।এইত বেশ মানিয়েছে আমার রাজুকে স্কুল ড্রেসটায় ।
মা – রাজু খেতে আয় ।
রাজু – যাচ্ছি মা ।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে রাজু বাবার সাইকেল করে স্কুলের জন্য বেরিয়ে পরল । স্কুলের ভিতরে গিয়ে রাজু দেখে কত ছেলে সেখানে এসেছে পড়াশোনা করতে । সবাই একরকম স্কুল ড্রেস পরে , রাজু আলতো ভাবে এগিয়ে গেল তাদের দিকে । সবার সাথে আলাপ পরিচয় হল রাজুর , অনেক নতুন বন্ধু বান্ধব হলো রাজুর । হঠাৎ কারো একটা শব্দে যেন রাজুর ঘুম ভাঙ্গলো । রাজু চোখ মেলে দেখলো সামনে কয়েকজন লোক চেঁচামেচি করছে । রাজু বুঝতে পারল সে পুরোটাই একটা স্বপ্ন দেখছে যা সত্যি না । রাজু দেখলো সে যে হোটেলে কাজ করে সেই হোটেলে অনেক লোক খেতে এসেছে , আর হোটেলের মালিক প্রদীপদা তার দিকে এগিয়ে আসছে । রাজু একটু ভয় পেল, প্রদীপদা রাজুর সামনে এসে বলল। কীরে রাজু কখন থেকে ডাকছি তোকে কথা কানে যায় না নাকি এত ঘুম কিসের , কটা বাজে তার হুঁশ আছে । দেখ কত লোক খেতে এসেছে নে তাড়াতাড়ি ওঠে পর উঠে হাতে হাতে কাজ করতে শুরু কর তো দেখি ,কী রে কী ভাবছিস ?
রাজু – জানোতো প্রদীপদা আমি না স্বপ্ন দেখছিলাম যে , আমি আমার বাবাই- র সাথে স্কুলে গেছি। মা – বাবাই কত আনন্দে আছে । বাবাই আমাকে সাইকেলে করে স্কুলে দিতে এসেছে। সেখানে আমার মত কত ছেলে – মেয়ে পড়তে এসেছে , আমার কত নতুন বন্ধু বান্ধব হয়েছে । আমি ওদের সাথে কত আনন্দ করছি , আমি খুব খুশি ।
প্রদীপদা – বা , এদিকে হোটেলে – এ লোকজন খাবার জন্য এসে কখন থেকে বসে আছে ,আর তুই কিনা স্বপ্ন দেখছিস যে তুই স্কুলে গেছিস ,বলি তোকে স্কুলে পাঠাবে কে ? এলোরে আমার স্বপ্নের রাজপুত্র,ওনি এখন স্কুলে যাবেন যতসব । যা যা দেরী করিসনা তারাতারি উঠে পড় । অনেক বেলা হয়েছে যা গিয়ে আটাটা মাখতে শুরু কর , তারপর জল বয়ে নিয়ে আসবি আরও অনেক কাজ বাকি আছে আজ ,যা নাইলে এবার মার খাবি কিন্তু আমার হাতে ।
রাজু – যাচ্ছি যাচ্ছি ,মেরো না প্রদীপদা বড্ড লাগে যে ।
প্রদীপদা – তাহলে যা যা বলছি করো ,যা ।
ছোটো রাজুর স্বপ্নটা যেন নিমেষেই ভেঙ্গে গেল। রাজুর চারপাশে যেন কালো অন্ধকার ঘনিয়ে এলো । কোনো অজানা একাকীত্ব যেন আবার নতুন করে ছোট্ট রাজুকে গ্ৰ্যাস করতে এগিয়ে এলো । রাজু এক অনাথ শিশু , পিতৃমাতৃহীন ।এ পৃথিবীতে রাজুর আপন বলতে সে ছাড়া তার আর কেউ নেই ।এত বড় পৃথিবীতে ছোট্ট রাজু বড় একা । একদিন রাজুর সব ছিল, বাবাই ছিল ,মা ছিল। একটা সুন্দর পরিবার ছিল রাজুর । রাজুর বাবাই আর মা- একে অপরকে ভালবাসে বিয়ে করেছিলেন । রাজুর বাবাই তখন একটা বেসরকারি কোম্পানীতে কাজ করতেন আর রাজুর মা ছিলেন গৃহবধূ । বিয়ের কয়েক বছর পর ছোট্ট রাজুর জন্ম হয় । রাজুর মা পিয়ালী দেবী সারাদিন ছোট্ট রাজুকে নিয়েই ব্যাস্ত থাকতেন । তখন রাজু খব ছোটো ,সবে মাত্র বছর দুয়েকের ‌‌‌। ছোটো রাজুকে নিয়ে রাজুর বাবাই আর মা – র দিন কাটছিল খুব আনন্দের সঙ্গে। কিন্তু সেই আনন্দের রেশ বেশি দিন স্থায়ী হল না । কিছুদিনের মধ্যেই যেন সেই আনন্দে দুঃখের রেশ টেনে নিয়ে এলাম । কোনো এক অজানা ঝড়ে।
ছোট্ট রাজুকে নিয়ে রাজুর বাবাই আর মা একদিন এক আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছিলেন ,এমন সময় হঠাৎ- ই এক অ্যাক্সিডেন্টে রাজুর বাবাই ঘটনাস্থলে মারা যান , রাজুর মা পিয়ালী দেবীও কিছুক্ষন পর মারা যান । রাজু তখন বছর তিনেকের , ছোট্ট রাজু তখন অনাথ চালচুলোহীন ,পিতৃমাতৃহীন একটা বাচ্চা । এরপর ছোট্ট রাজু রাস্তায় ভিক্ষা করে নিজের পেটে ভরিয়েছে । কোনো কোনো দিন শুধু জল খেয়ে পেটের খিদে মিটিয়েছে ।
কেউ তখন কাছে এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেইনি , কোলে তুলে নেইনি রাজুকে । কোনো দিন সকাল থেকে না খেয়ে সারাদিন কেটেছে রাজুর । এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ একদিন রাজু এসে হাজির হয় প্রদীপদার হোটেলে , প্রদীপদাই রাজুকে তার হোটেলে একটা কাজ দেয়। সেই থেকে ছোট্ট রাজু প্রদীপদার হোটেলে কাজ করে । রাজু এখন প্রদীপদার হোটেলে কাজ করে খাই । ছোট্ট রাজুর দু – চোখ জুড়ে অনেক স্বপ্ন ,সে স্কুলে যাবে , লেখাপড়া করবে । মানুষের মত মানুষ হবে । কিন্তু সে স্বপ্ন এখনো সত্যি হল না । রাজুর সকাল শুরু হয় প্রদীপদার বকুনি খেয়ে ,তারপর পাশের কল থেকে হোটেলের কাজের জল বয়ে নিয়ে আসা । খাবার কাপ ,প্লেট ধোয়াধুয়ি করা, খাবার পরিবেশন করা । এসবের মধ্যে দিয়েই রাজুর দিন শেষ হয়ে কখন যেন রাত হয়ে আসে । সারাদিন হোটেলে হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর মেলে দু – বেলার খাবার টুকু , ছোটো রাজু রাতে হোটেলের এক পাশে শুয়ে থাকে খোলা আকাশের নীচে । রাতের আকাশে তারা দেখে রাজুর তার বাবাই আর মা -র কথা মনে পড়ে ।আজ যদি মা আর বাবাই থাকত তাহলে হয়ত রাজুর জীবনটা অন্য হত। রাজু স্কুলে যেত , পড়াশোনা করে মানুষের মত মানুষ হতে পারত । রাজুর মায়ের স্বপ্ন ছিল রাজু পড়াশোনা করে ডাক্তার হবে ,গরীব – অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবে । রাজু প্রতি রাতে আকাশের তারার দিকে চেয়ে থাকে আর রাজুর দু – চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে জলের ফোঁটা । এভাবেই ছোটো রাজুর কত কষ্টে দিন যায় । চোখে হাজার ও স্বপ্ন নিয়ে দিনরাত রাজু হোটেলে কাজ করে চলেছে । ছোটো রাজু হোটেলে কাজ করতে করতে দেখতে পায় তার সমবয়সী অনেক ছেলেমেয়ে স্কুলে যাচ্ছে । কেউ কেউ আবার তাদের বাবা – মা-র সাথে স্কুলে যাচ্ছে । রাজু প্রায়দিনই এই দৃশ্য দেখতে পায় । ছোটো রাজু মনে মনে ভাবে তার এই ভাবনাটা যদি স্বপ্ন না হয়ে সত্যি হয় , তাহলে কত না ভালো হতো । যদি সে তার মায়ের স্বপ্ন সত্যি করতে পারত , যদি সে স্কুলে যেতে পারত , পড়াশোনা করতে পারত তাহলে কত না ভালো হতো ।কত না খুশি হত রাজুর মা। ছোটো রাজু মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে পরেরবার যেন এই ইচ্ছাটা তার সত্যি হয়ে ওঠে আর যেন স্বপ্ন হয়ে না থাকে ।

কলমে শুভম চ্যাটার্জী, রায়না, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here