রায়বাবু সাধাসিধে লোক, বিশেষ কোনো শখ আহ্লাদ কিংবা বিলাসিতার শখ তার কোনো কালেই ছিলো না, সস্তার একটা বিড়ি টানা ছাড়া। লেখক মানুষ কিনা! মধ্য পঞ্চাশের শরীর টাকে একটা পাতলা ফিন ফিনে পাঞ্জাবী ঢেকে রাখতো, আর চোখে কালো চৌকো ফ্রেমের চশমা আর পায়ে সস্তার একজোড়া চপ্পল। অবশ্য খাওয়া দাওয়াতেও যে তার অরুচি সেটা তার সুন্দর মাধবীলতাসুলভ শরীর দেখলে বোঝা যেত। তবে হ্যাঁ আর পাঁচটা মানুষের মতো তারও কিন্তু স্বপ্ন ছিলো কিন্তু স্বপ্নটা কোনো জাতীয় পুরস্কার পাওয়া কিংবা উর্বশীর মতো সুন্দরী কোনো অতিমানবীর সঙ্গে রমণ সুখ নয়, তার স্বপ্ন ছিলো এক বাধাহীন সমাজের, এক সীমাবিহীন “গ্লোব” এর, যেখানে AK47 এর টাকা দিয়ে গৃহহীন মানুষদের যত্ন নেওয়া হবে, যেখানে পরমানু বোমের পরিবর্তে আবিষ্কার করা হবে মানুষে মানুষে ভাতৃত্ববোধ স্থাপনের ফর্মূলা, “ধর্ম” পড়ানো হবে শুধু মাত্র ভৌতবিজ্ঞানের বইয়ে, যৌনাঙ্গের উপর মানুষের অধিকার নির্ভর করবে না৷ তার এই “স্বপ্ন” চায়ের ঠেকে, পাড়ার রকে বেশ রসিয়ে রগড় করার বিষয় ছিলো। সেই সুবাদে আমার কানের অভ্যন্তরীণ নালি দিয়ে আমার মাথার ভিতর এই স্বপ্নের প্রবেশ ঘটেছিলো। আমার কাছে ব্যাপারটা হাসির বিষয় মনে না হলেও জীবনের গোধূলি লগ্নে দাঁড়িয়ে তার পক্ষে এই স্বপ্নের কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব তা নিয়ে আমার বেশ সন্দেহ ছিলো, তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটু হাসি বেরিয়ে আসতো।
মাঝে মাঝে রাস্তায় দেখা হত একটু আধটু কথাও হত। মাঝে মাঝে মাঝে লেখালিখির খোঁজ খবর নিতাম হেসে বলতেন, ‘চলছে!’, একদিন সামনা সামনি দেখা হলে জিজ্ঞেস করেছিলাম
“বড় পাবলিকেশন হাউস থেকে লেখা কবে বেরোবে?”
উনি মুখটা বানরের মতো খিঁচিয়ে বলেছিলেন “সমাজের জন্য কিছু করতে চাইলে বরাহনন্দনরা পাবলিশ করবে না, ওদের চাই সস্তার ফুর্তি, কচি কচি মেয়েদের দেহের বর্ণনা আর কয়েকটা চুমুর সাহিত্যিক বর্ণনা দেওয়া প্রেমের উপাখ্যান।”
“তা মশাই আপনার স্বপ্নও তো ‘ভালোবাসা’!”
“আমার ভালোবাসাটা সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতি, কপোত কপতির ভালোবাসা তার ফলস্বরূপ উপরি পাওনা। আমার লেখা প্রত্যেক মুহূর্তে সমাজকে তার বিবস্ত্র দিক গুলোর কথা চিৎকার করে করে বলে, আর ধর্ম রক্ষকদের সমস্যা এই জায়গাতেই, একটু কলম এদিক থেকে ওদিক হলেই আমি দ্বিতীয় সালমান রুশদি কিংবা তাসলিমা নাসরিন, কিংবা গৌরী লংকেশ হয়ে যাবো, তার উপর বাড়ি এসে ‘কল্যাণ’ দিয়ে যাবে।”
” লেখক হয়ে controversy ভয় পান ?” কথাটা শুনে উনি সদ্য যুদ্ধ জয় করে আসা এক সৈনিকের মতো আমার দিকে তাকিয়ে বললেন “এবার লিখছি একটা গল্প যা একান্তই সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা আর নিজের প্রানপায়রার কথা মাথায় রেখে ।”
মনে মনে হাসলেও সামনে বললাম ” তালে এবার বোধ হয় আপনার একাডেমী পুরস্কার প্রাপ্ত কোনো লেখাই পড়বো।”
কথার মাঝের sarcasm বুঝতে পেরে চোখ গুলো ক্ষুদে করে বিড় বিড় করে কয়েকটা উচ্চ স্তরের সাহিত্যিক শব্দ আমার পূর্ব পুরুষদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করলেন।
এর পর মাস খানেক কেটে গেলো, খোঁজ পেলাম ভদ্রলোকের কোনো এক লেখা নাকি publish হয়েছে। প্রথম লেখা বলে কথা, কিনে নিয়ে পড়ে ফেললাম, মূল বিষয়বস্তু ছোটো করে বললে দাঁড়ায় শীতের এক মধ্যরাতে নামহীন কোনো দেশের কোনো নাম হীন রাস্তায় এক রেডিও থেকে ভেসে আসা কোনো দেশাত্মবোধক গান শোনা রিষ্কা চালকের হাতে এক তরুণীর ধর্ষণ। পরবর্তীতে আসামীকে সাংবাদিক ও পুলিশরা জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারে আসামি নাকি তার কাজের জন্য একটুও অনুতপ্ত নয়। আসামির যুক্তি অনুযায়ী “মেয়েরা রাত করে বেরোলে ধর্ষণ তো হবেই, উপরন্তু মেয়ে মানুষ হলো হীরের মতো তুমি যদি রাস্তায় ফেলে রাখো লোকে তো তা নেবেই” যাহোক লেখাটা moralising ছিলো না, উচিত অনুচিতের বাইরে গিয়ে লেখা । মোটের উপর ভালোই । ওনার উপন্যাস বেশ নামডাক পেলো কয়েক মাসে ।
সমস্যাটা গিয়ে বাধলো তখন যখন ওনার লেখা টা ইংরেজিতে প্রকাশ করার প্রস্তাব এলো । উনি বেশ খুশিই ছিলেন কারণ প্রথমবার তার কোনো লেখা এত সম্মান পাচ্ছে, উপরন্তু শুধু রাজ্যে নয় বরঞ্চ দেশ ব্যাপী। কয়েক দিন বাদে দেশ ব্যাপী লেখা প্রকাশ পেলো, controversy শুরু হলো, চরমপন্থী ধর্ম রক্ষকদের মতে ওনার লেখা নাকি আন্তর্জাতিক স্তরে দেশের ছবির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছিলো। তাদের রোষ ওনার উপর বাড়তে থাকে। লিখিত হুমকিও আসতে থাকে । অভিনন্দন জানাতে গিয়ে ওনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ” আপনার ভয় লাগে না? “
উনি বলেছিলেন ” আমি পারিবারিক দায় দায়িত্ব থেকে মুক্ত, মারা গেলে বিশেষ কোনো ক্ষতি হবে না আর এই বয়সে এসে মরার ভয় পাওয়াটা বেশ হাসির ব্যাপারও বটে।”
অফিস বদলির চক্করে পরিবার সহ আমায় সে পাড়া ছেড়ে অন্য শহরে অন্য পাড়ায় আসতে হয়। তারপর আর ওনার সাথে যোগাযোগ হয় নি। একদিন সকালে গিন্নির কড়া চায়ের অপেক্ষা করতে করতে খবরের কাগজে চোখ গেলো একটা ছবির দিকে, উল্টো হয়ে পড়ে থাকা একটা লাশের নীচ থেকে রক্ত বেরিয়ে আসছে। ঠিক যেন মনে হচ্ছে কোনো কিশোরীর হাত থেকে আলতার শিশি মেঝেতে পড়ে ছড়িয়ে গেছে। খবরটির হেড লাইনেই দিকে চোখ গেলো তাতে লেখা “ধর্মরক্ষকদের হাতে নিহত লেখক অধিরথ রায়”।

কলমে সৌপত বিশ্বাস, চাকদহ , নদীয়া

বর্তমানে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করছি, ফাঁকা সময়ে বই পড়তে বেশ ভালো লাগে, টুক টাক লেখা লিখিও করি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here