সেই কন্ঠস্বর

--শ্রয়ণা মুখার্জী

0
335

২৯শে এপ্রিল, ২০২০। দিনটা আমার এখনও মনে আছে। অন্যদিনের মতো সেদিনও সকালে বই খাতা খুলে বসেছিলাম। পড়ায় মন বসছিলো না একদম। আমার বাঁধনছেঁড়া মনটা বারবার সকল নিয়ন্ত্রণ অতিক্রম করে ফিরে যেতে চাইছিল কিছু পুরনো স্মৃতিতে- তিক্ত, অমধুর কিছু স্মৃতি যেগুলো আমার মনের মণিকোঠার অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে গিয়েও বারবার ফিরে আসে, নাড়িয়ে দেয় আমার মনটাকে। হঠাৎই শুনলাম, “মাছ নেবে গো দিদি, মাছ? ভালো রুই আছে, কাতলা আছে, চিংড়ি আছে, …..।” বিশ্বব্যাপী মহামারীর জন্য সমগ্র দেশ জুড়ে লকডাউন চলছিল গত এক মাস ধরে; বাজার দোকান, যান চলাচল সবই বন্ধ ছিল তখন। করোনা ভাইরাসের করাল গ্রাস কেড়ে নিয়েছে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ, পথে বসিয়েছে শত শত মানুষকে। জীবিকা নির্বাহের জন্য কত মানুষ রাস্তায় নেমেছে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও, তাদের দুটো টাকা রোজগারের আশায় বসে আছে কত পরিবার। তারা বাড়ি না ফিরলে তাদের সংসারে হাঁড়ি চড়েনা, ক্ষুধার্ত অবস্থায় অপেক্ষা করতে করতেই মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়ে‌ কত নিষ্পাপ প্রাণ। এদের সকলের দুঃখ দুর্দশার কাছে আমার মনের কষ্টটা যে কিছুই নয়…..
          ২৯শে এপ্রিল, ২০২০। দিনটা আমার আজও মনে পড়ে। ওইদিন সকালে একটি মাছ বিক্রেতার করুণ আর্তি আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল আমার জীবনের প্রথম সাহিত্য সৃষ্টিতে। হঠাৎ করেই লিখে ফেলেছিলাম একটা কবিতা, নাম দিয়েছিলাম ‘নতুন পৃথিবীর খোঁজে’ । না, আমার সেই নতুন পৃথিবীটার খোঁজ এখনও পাইনি আমি। আমি লিখেছিলাম-
“পৃথিবীর এই দুঃসময়ে
মুঠোফোনে করাল গ্রাসে
আমরা সবাই নিমজ্জিত…..”
সত্যিই তো তাই। আজ এই কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলায় লড়াই করছে হাজার হাজার চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী। কর্মসংস্থান হারিয়েছে বহু মানুষ। অথচ আমরা কি ভেবে দেখেছি কখনো তাদের কথা? একবারও চিন্তা করেছি তাদের জন্য? আরাম করে বাড়িতে বসে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে মিম সেয়ার করে গেছি প্রতিনিয়ত। আমি সেইদিন এই কবিতাটার চতুর্থ স্তবকে লিখেছিলাম-
“আমরা সবাই ব্যস্ত আজও
নিজ গুণ‌ জাহির করায়,…..”
লকডাউন হওয়ার সুবাদেই আমারা আমাদের প্রতিভাগুলোকে উন্মোচিত করেছি, কখনো এঁকেছি ছবি, আবার কখনো রীতি অনুসরণ করেই বানিয়ে ফেলেছি ডালগোনা কফি, সট্যটাসের নীচে ক্যাপসানে লিখেছি ‘#following_trend’। আমিও এর ব্যাতিক্রমী নই।
          আমার প্রথম কবিতাটা ছিল সামাজিক প্রেক্ষাপটের উপর রচিত। আমি কবিতাটা একটা বহু জনপ্রিয় পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার আশায় পাঠালেও সেটা প্রত্যাখ্যান করা হয়। তার একদিন পরেই আমি আমার দ্বিতীয় কবিতা ‘শুভলগ্নের প্রতীক্ষা’ লিখেছিলাম আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে। কবিতাটার বিষয়বস্তু ছিল একটা অবাঞ্ছিত কন্যা সন্তানের বড় হয়ে ওঠা এবং লালসার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করা। কবিতাটার মাধ্যমে আমি নিপিড়িত, নির্যাতিত নারীদের জীবনকাহিনী তুলে ধরার একটি সামান্য প্রচেষ্টা করেছিলাম। কবিতাটা একটি ক্রিয়েটিভ রাইটিং প্রতিযোগিতায় প্রথম নির্বাচিত হয়েছিল। আমার তৃতীয় কবিতা আন্তর্জাতিক মাতৃ দিবসে আমার তরফ থেকে আমার মায়ের জন্য একটা ছোট্ট উপহার- ‘মা’। আমার জীবনের প্রথম ভালবাসা আমার মা। আমার পরম প্রিয় মানুষটার সাথে আমার কাটানো টুকরো টুকরো স্মৃতি, ছোট্ট ছোট্ট অনুভূতি তুলে ধরেছিলাম কবিতাটায়। এরপর আমি রচনা করেছি একটি ভালোবাসার কবিতা ‘ভালোবাসার চিঠি’, বিধ্বংসী সাইক্লোন আমপানে কার্যত অচল হয়ে পড়া পশ্চিমবাংলা এবং শত শত গৃহহীন হয়ে পড়া মানুষকে নিয়ে লেখা কবিতা ‘বঙ্গদেশের আঁধাররাত্রি’, রাখিবন্ধনের উপলক্ষে লেখা ‘অঙ্গীকার’ ইত্যাদি। না, আমি কোনো নামকরা কবি বা লেখক হয়ে উঠিনি, আমার লেখা নিয়মিত কোথাও প্রকাশিত হয়না, কিন্তু আমার এক একটা সৃষ্টি আমাকে পরিতৃপ্তি এনে দেয়, আমার হৃদয়ের প্রত্যেকটি কোষ যেন আমাকে বলে দেয় যে আমিও কিছু পারি।
          আমি যখন আমার জীবনের প্রথম কবিতাটা লিখি, তখন আমি স্কুলের গণ্ডি পেরোইনি। উচ্চমাধ্যমিকের তিনটে পরীক্ষা পিছিয়ে গেছিল অনির্দিষ্টকালের জন্য। একটা মাছ বিক্রেতার করুণ স্বর উদ্বুদ্ধ করেছিল আমাকে ওইদিন। ওই কণ্ঠস্বরটা আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল গত বছরের দুর্ঘটনার কথা যার জন্য আমি বহুদিন স্কুলে যেতে পারিনি, যার জন্য আমাকে বিষন্নতা গ্রাস করেছিল প্রচন্ড পরিমানে। পড়াশোনা করতে পারিনি বহুদিন। কিন্তু ওই একটি কন্ঠস্বর আমাকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল আমার প্রথম কবিতা লেখায়, ওই কণ্ঠস্বরটা যে আমাকে আজও  বলে দেয় যে আমিও লিখতে পারি। আমার সাথে ঘটে যাওয়া গত বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলোকে ভুলিয়ে দিয়ে এক নতুন আমিকে খুঁজে দিয়েছে ওই কণ্ঠস্বরটা। আড়ালে থেকেও প্রতিনিয়ত সে ই আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে নতুন কিছু লেখার জন্য, এই সমাজের সবথেকে অবাঞ্ছিত বলে গণ্য হওয়া মানুষগুলোর জন্য ভাবার জন্য। সেই মানুষটাকে আমি আর কোনদিনও দেখিনি, তার কন্ঠস্বরও শুনিনি কখনও আর, কিন্তু সে ই যে আমার লেখনীশক্তির উদ্ভাবক, আমার প্রকৃত সাহিত্যের অনুপ্রেরণা।

–শ্রয়ণা মুখার্জী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here