সকালে জিম থেকে ফিরে এসেই আজ কনক চ্যাটার্জীর মুড বেশ অফ হয়ে আছে । অন্যদিন হলে জিম থেকে ফিরে এসেই লেবু ছাতুর শরবতের গ্লাসটা হাতে নিয়ে মিনিট দশেক খবরের কাগজটা নিয়ে বসেন । তারপর স্নান খাওয়া সেরে থানায় চলে যান । আজ তিনি টেবিলে বসে আছেন ঠিকই , পাশে খবরের কাগজটাও পড়ে আছে  সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই , একমনে হাতের মোবাইলটা শনাক্ত করে চলেছেন । আজ ওয়ার্কআউট সেরে যখন তোয়ালেতে ঘাম মুছে জিমের সেফটি লকার থেকে মোবাইল আর পার্সটা বের করছিলেন তখন এক অদ্ভুত গন্ধ তাঁর নাকে আসে । গন্ধটা আবছা হলেও কেমন যেন চেনা চেনা । মোবাইলের স্ক্রিনটাও একটু কেমন যেন তেলতেলে ।  মানেটা  খুবই স্পষ্ট যে কনক চ্যাটার্জীর লকারটিতে  কোন আগন্তুকের হাত পড়েছিল । তারই হাতের গন্ধ মোবাইলের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে । কিন্তু আগন্তুককের স্পর্ধা দেখে হতবাক কনক চ্যাটার্জী  । তিনি বারাসাত থানার ইনচার্জ সেটা এই জিমের প্রায় সবারই জানা । তবে কার স্পর্ধা হলো কনক চ্যাটার্জীর সেফটি লকারে হস্তক্ষেপ করবে ? যেই করুক না কেন তিনিও ঐ রকম আর একটি লকার  হোল্ডার । কেন না জিমের ঐ চার ফুট বাই ছয় ফুটের প্যাসেজ কর্ণারে একমাএ লকার হোল্ডাররাই যেতে পারে । অন্য কোন মেম্বারদের যাবার অনুমতি নেই সেখানে । চিন্তার কারণ একটাই ,  মোবাইলে   পাস ওয়ার্ড থাকলেও হ্যাক করতে কতক্ষণ  ।  মোবাইলের অভ্যন্তরীণ নথি খুবই কনফিডেন্সিয়াল । প্রচুর গুরুত্ব পূর্ণ কন্ট্যাক্ট রয়েছে । সেগুলো কারোর হাতে পড়লে প্রচুর ক্ষতির সম্ভবনা থেকে যায় । এমনকি তাঁর চাকরী জীবনের সুনাম নষ্ট হতে পারে । কাল জিমে গিয়ে একবার সিসিটিভি ফুটেজ দেখার কথা মনস্ত করলেন  । কনক চ্যাটার্জী  খুব সন্তর্পণে একটি প্লাস্টিক পাউচে মোবাইলটা ঢুকিয়ে রেখে ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের তন্ময় বোসকে ফোন করেন । স্পিকার অন করেই কথা বললেন – ‘ তন্ময় তুমি ডিপার্মেন্টে কখন যাবে ? ‘
— ‘ স্যার , দশটার আগেই ঢুকে যাই । কি দরকার বলুন না স্যার ? আমি যাবার আগে তাহলে থানা থেকে ঘুরে আসবো । ‘
— ‘ না সে দরকার হবে না , আমিই তোমার ল্যাবে গিয়ে একটু ফিঙ্গারপ্রিন্ট টেষ্ট করিয়ে নেব একটা জিনিসের । তাহলে আমি সাড়ে নটার ভিতর পৌঁছে যাচ্ছি তোমার ল্যাবে । ‘


#####
কনক চ্যাটার্জী লালবাজার গোয়েন্দা দপ্তরের বিশেষ প্রশিক্ষণ  প্রাপ্ত  গোয়েন্দা  পুলিশ অধিকারী ।  কর্মক্ষেত্রে  শুধু না  ব্রুকেট  লেভেলেও  তাঁর কর্ম তৎপরতার জন্য অনেক সুনাম আছে ।  এহেন  গোয়েন্দা পুলিশকে বারাসাত  থানার ইনচার্জ করে পাঠানো  হয়েছে । উনি কারোর আন্ডারে কিংবা সাহায্যকারী  সহকারী  হিসাবে কাজ করতে নারাজ ছিলেন  ।  তাই  পজিশনের  ঘাটতি হলেও বারাসাত থানার ইনচার্জের পদটি তিনি শ্রেয় বলে মনে করেছিলেন । পাঁচ ছয় বছর ধরে বারাসাত ও তার  আশেপাশের  অঞ্চলে দুর্নীতি ও অসামাজিক কার্যকলাপ  মাত্রাতিরিক্ত মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে ।  স্থানীয় মানুষের জীবন অসহনীয় হয়ে উঠেছে  ।  মানুষজন প্রতিনিয়ত  আতঙ্কে  থাকে কি জানি কি বিপদের মুখে পড়তে হয় তাদের । স্থানীয়  পুলিশ থানা অসামাজিক কার্যকলাপ  দমনে ব্যর্থ  হয় ।  ফলস্বরূপ প্রসাশনকে বাধ্য হয়েই নড়েচড়ে  বসতে হয় । রাজ্য প্রতিরক্ষা  মন্ত্রালয়ের থেকেই গোয়েন্দা পুলিশ অধিকারী   কনক চ্যাটার্জীকে   বারাসাত থানার ইনচার্জ করে পাঠান  ।  বছর চল্লিশের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন গোয়েন্দা  পুলিশ অফিসার  কনক চ্যাটার্জী  শুধুমাত্র মনের দিক দিয়ে   দৃঢ়চেতা মানুষ নন ।  শারীরিক দিক দিয়েও বলিষ্ঠ দীর্ঘকায়  সুপুরুষ  ।  অতীতে ছাত্রাবস্থায়  জাতীয় স্তরে ক্যারাটেতে  ব্ল্যাক বেল্ট হাসিল করেছিলেন ।  বর্তমানে প্র্যাকটিসে খামতি দেননি কখনোই  । এই  পুলিশ অফিসারের উপস্থিতিতে বারাসাত থানার এবং থানার অন্তর্গত অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ  অবস্থার উন্নতি বেশ চোখে  পড়ার মতো ।  তবুও অপরাধ থেমে থাকার নয় ,  ঘটে চলেছে  ।


#####

ফরেনসিক ল্যাবে যেতেই কনক চ্যাটার্জী  ফরেনসিক এক্সপার্ট তন্ময় বোসকে পেয়ে যান । নিজের মোবাইলটা তন্ময়ের হাতে তুলে দিলেন পরীক্ষার জন্য । তন্ময় তৎক্ষণাৎ ‘ নিনহাইড্রিন ‘ স্প্রে আর ম্যাগনিফাইং গ্লাস নিয়ে বসে পড়লেন । মিনিট দশেকের পরেই কনক চ্যাটার্জী  জিজ্ঞাসা করলেন — ‘ কি বুঝলে তন্ময় ? আমি ছাড়াও অন্য কেউ এই ফোন ধরেছিল বলো ?
— ‘ হ্যাঁ স্যার , আপনার ফিঙ্গারপ্রিন্ট ছাড়াও । অন্য একজনের ফিঙ্গারপ্রিন্ট আছে । তাঁকে কিন্তু আপনি সহজেই আইডেন্টিফাই করতে পারবেন স্যার , কেন না তাঁর মিডিল ফিঙ্গারের মাথায়  লিউকোপ্লাস্ট লাগানো আছে আর তিনি মেডিকেটেড প্রোটিন সাপ্লিমেন্টারি সেবন করেন । ফিঙ্গারপ্রিন্টের সাথে সেই প্রোটিন সাপ্লিমেন্টারির ন্যানো মলিকিউল ধরা পড়েছে আপনার মোবাইল স্ক্রিনে । ‘


— ‘ ইয়েস , এটারই গন্ধ পেয়ে ছিলাম আমি । এই গন্ধটা আমার খুব চেনা লেগেছিল । আমার মাকে দেওয়া হতো । মা তখন ক্যান্সারে মৃত্যুশয্যায় । এই গন্ধটা আমি ভুলিনি তাই । ‘
— ‘ এগজ্যাক্টলি স্যার , এই হার্বল প্রোডাক্ট  প্রোটিন সাপ্লিমেন্টারি ক্যান্সার পেসেণ্টকে দেওয়া হয় , তাহলে আপনার কাজ আরো সহজ হয়ে গেল । ‘
–‘ ঠিক আছে তন্ময় আজ আমি উঠছি । ‘
ল্যাব থেকে বেরিয়ে কনক চ্যাটার্জী  থানার রাস্তা ধরলেন । রাস্তায় একটি ট্রাকের যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে রাস্তার মধ্যেখানে বিকল হয়ে পড়েছে । সেই কারণে তুমুল যানজট সৃষ্টি হয়েছে । এর মধ্যে ট্রাফিক পুলিশের কোন পাত্তা নেই দুজন ট্রাফিক মার্শাল রাস্তা সামলাতে নাজেহাল হয়ে পড়েছে । কনক চ্যাটার্জী  ট্রাফিকের বেহাল অবস্থা দেখে নিজের বাইকটা রাস্তার ধারে সাইড করে নেমে এলেন । ট্রাফিক মার্শালদের সাথে কথা বলে একটা ক্রেনের ব্যবস্থা করেদিলেন । ট্রাফিক সামলে থানায় পৌঁছাতে প্রায় এগারোটা বেজে গেল । কনক চ্যাটার্জী  খুব চিন্তিত হয়েই আজ থানায় ঢুকলেন । থানায় প্রবেশ করতেই সুবিমল এগিয়ে এলেন — ‘ স্যার , আমাদের এখুনি একটা ইনভেস্টিগেশন বেরোতে হবে । প্রমিলা খাস্তগীর নামে একজন পঞ্চাশোর্দ্ধ নৃত্য শিল্পীর ফ্ল্যাটে মার্ডার হয়েছে বলে অনুমান করা হয়েছে । এই মিনিট পাঁচেক আগে বলাকা অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ফোন এসেছিল । বলছে রক্তের স্রোত ফ্ল্যাটের দরজার তলা দিয়ে গড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে । দরজায় অনেক ধাক্কাধাক্কি করেছে , তা স্বত্ত্বেও ফ্ল্যাট মালিকের কোন সাড়াশব্দ পায় নি । আমরা না গেলে  দরজা ভাঙতে পারছে না । ফরেনসিক ডিপার্মেন্টে খবর দিয়ে দিয়েছি , ওরা অকুস্থলে পৌঁছে যাবে । ‘
— ‘ চলো তাহলে আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই । ‘


#####


সাড়ে এগারোটার আগেই পুলিশের গাড়ি বলাকা অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে যায় । অ্যাপার্টমেন্টের গ্রাউন্ড ফ্লোরে আবাসিকদের জটলা । আবাসনের বড় গেটের কাছে বাইরের কৌতুহলী জনতার ভীড় । পুলিশের গাড়ি আসতেই সবাই নিরাপদে পাশ কাটায় । আবাসনের গেটকিপার গেট খুলে দিতেই পুলিশের গাড়ি ভিতরে ঢুকে যায় । অফিসার্স ইনচার্জ কনক চ্যাটার্জী  অ্যাসিস্টেন্ট ইন্সপেক্টর সুবিমল নন্দী অ্যাসিস্টেন্ট ইন্সপেক্টর সন্ধ্যা মিত্র ও কন্সটেবল রতন বোস গাড়ি থেকে নেমেই সটান বলাকা অ্যাপার্টমেন্টের দুতলায় চলে যায় । দুতলায় পাশপাশি দুটো আঠারোশ স্কোয়ারফিট ফ্ল্যাটের মালকিন প্রমিলা খাস্তগী । একটি ফ্যাটে নিজে থাকতেন , আর পাশের ফ্ল্যাটটি তিনি তাঁর মায়ের নামে বসুন্ধরা নৃত্য অ্যাকাডেমি খুলেছেন । সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত ছয় শিফটের নৃত্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় সেখানে । প্রমিলা খাস্তগীর দুপুরে লাঞ্চের আগের ক্লাসটা নিতেন আর সন্ধ্যের শেষ ক্লাসটা নিতেন । বাকি ক্লাস তাঁর শিষ্যা অপরাজিতা নন্দী নিতেন । এতক্ষণ ধরে এত তথ্য দীপেন চৌধুরী নামে বছর কুড়ির একটি ছেলে সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কনক চ্যাটার্জীকে বলছিলেন । দীপেন বসুন্ধরা নৃত্য অ্যাকাডেমির কেয়ার টেকার কাম রিসেপ্শণিস্ট এর কাজ করে এবং  নাইটে সিটি কলেজে বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে । দীপেন আরো জানায় যে — দুটো ফ্ল্যাটের অভ্যন্তরের সংযোগ স্থলে একটি দরজা আছে । সেই দরজা দিয়েই প্রমিলা খাস্তগীর নৃত্য অ্যাকাডেমিতে যাতায়াত করতেন । আজ সকালে দীপেন এসেই অ্যাকাডেমির দরজা খুলে দেয় , এবং সঙ্গে সঙ্গে কাজের মাসি চলে এসে ঘর পরিস্কার করতে শুরু করে দেয় । তিনিই প্রথম লক্ষ্য করেন পাশের প্রমিলা খাস্তগীরের ফ্ল্যাটের সংযোগস্থলের দরজার তলা দিয়ে জল ধোয়া রক্ত অনেকটা গড়িয়ে নৃত্য অ্যাকাডেমিতে চলে এসেছে । কাজের মাসি মানে জবা মাসি দেখতে পেয়েই চিৎকার শুরু করে দেন দীপেন ছুটে আসে দেখে রক্তের স্রোত বেরিয়ে এসেছে অনেকটা । এরপর তাদের চিৎকারে উপরে ফ্ল্যাটের লোকজন নেমে আসে , অনেকবার দরজা ধাক্কাধাক্কি হয় কোন সাড়া শব্দ না পেয়েই বাধ্য হয়ে থানায় খবর দেওয়া হয় ।
কনক চ্যাটার্জী  সিঁড়িতে দীপেনকে পাশ কাটিয়ে নৃত্য অ্যাকাডেমিতে ভিতরে প্রবেশ করেন , অকুস্থলে গিয়ে দেখেন রক্ত জলের স্রোত গড়িয়ে অনেকটা এই ফ্ল্যাটে চলে এসেছে । কনক চ্যাটার্জী  পকেট থেকে গ্লাভস বের করে হাতে পরে নেন । রক্ত স্রোতের কাছে উপুড় হয়ে বসে দু আঙ্গুলে রক্তের নমুনা তুলে নিয়ে তারল্যের সত্যতা ও ঘনত্ব যাচাই করলেন । তারপর বাথরুমে গিয়ে আঙ্গুল ধুয়ে পুনরায় অকুস্থলে এসে দরজা পরীক্ষা করলেন । তিনফুট বাই ছয়ফুটের দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ । দীপেন বুদ্ধি করেই এই দরজাটা ধাক্কানোর চেষ্টা করেনি সম্ভবত রক্ত স্রোতের কারণে । কনক চ্যাটার্জী  এরপর ফ্ল্যাটটি ঘুরে দেখলেন ।  আঠারোশ  স্কোয়ারফিটের ফ্ল্যাটটিকে দুটি হলরুমে ভাগ করা হয়েছে । বাঁ ডান পাশাপাশি দুটো হলঘর । বাঁদিকের হল ঘরটার সাথে পাশের ফ্ল্যাটটি একটি দরজা দিয়ে যুক্ত । বাঁদিকের হলঘরের ডান দিকে আর্চের ডিজাইন করা দরজার পরিসর করা কিন্তু দরজা নেই । ডানদিকের হল ঘরের সাথে বাইরের বেরোনোর দরজা রয়েছে । বাইরের দরজা দিয়ে ঢুকতেই ডান দিকের এককোনায় ছোট রিসেপ্সন ডেস্ক । তার বিপরীতে দিকে কাঠের কারুকার্য করা তিন আসন যুক্ত সোফা । লম্বা হল ঘরের শেষ প্রান্তে আগের কাঠের কারুকার্য করা সোফা সেট এর বাকি দুটো সোফা হল ঘরের শেষ প্রান্তে রাখা । হল ঘরের দুদিকের দেয়ালে বিরাট বড় করে একজন ভারতনাট্যম নৃত্যশিল্পীর পোট্রেট টাঙ্গানো আছে । ইনিই মনেহয় প্রমিলা খাস্তগীর । চোখ দুটো আর চিবুকটা কেমন যেন চেনা …..কনক চ্যাটার্জী  কয়েক সেকেন্ড পোট্রেটের দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বাইরের বেরিয়ে এলেন । প্রমিলা খাস্তগীর ফ্ল্যাটের দরজায় ক্যাচ লক করা । ভিতর থেকে কেউ না খুললে দরজা খোলা যাবে না । বাধ্য হয়েই কনক চ্যাটার্জী  দরজা ভাঙতে বললেন । সুবিমলের  দ্বারায় হলো না বলে কনক চ্যাটার্জী  নিজে হাত লাগালেন । বহু ধাক্কাধাক্কির পর দরজা ভেঙ্গে ফ্ল্যাটের ভিতরে ঢুকলেন । ড্রয়িং রুম আর ডাইনিং রুমটা কমন হলেও রুমের দুটি পার্ট । মধ্যখানে দামী টাইলসের সেটিং করা আর্চ । সেই আর্চে সাদা সিফণের উপর গোল্ডেন সুঁতোর কাজ করা শৌখিন পর্দা ঝুলছে । আর তাতে রক্তমাখা হাতের হাত মোছার দাগ । পর্দা সরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখা গেল রক্তে ভেসে যাচ্ছে শ্বেতপাথরের মেঝে । দরজার ভিতরে কি আছে পূর্বে খানিকটা অনুমান করা থাকলেও এতটা ভয়ংকর নারকীয় বীভৎসতা তাদের জন্য অপেক্ষা করছে কেউই ভাবতে পারেনি কখনও । প্রমিলা খাস্তগীর মেঝেতে কাত হয়ে পড়ে আছেন । তাঁর গলার উপর চুরি দিয়ে এমনভাবে পোচ দেওয়া হয়েছে যে শ্বাসনালী খাদ্যনালীর দ্বিখণ্ডিত হয়ে সারভাইক্যাল ভাটিব্রার খুব অল্প অংশ জোড়া আছে বাকি টা হাঁ করে আছে । শরীরের সমস্ত রক্ত যেন সারারাত ধরে মাটিতে গড়িয়ে দেহ রক্তশূন্য করে তুলেছে । রক্ত প্রবাহের মধ্যে একটা কাঁচের জলের বোতল ভেঙ্গে পড়ে আছে । খুব সম্ভবত এই বোতলের জলের সাথে রক্ত মিশে পাশের ফ্ল্যাটের দরজার তলা দিয়ে গড়িয়ে ঢুকেছে । কনক চ্যাটার্জী  খুব সন্তর্পণে মৃতদেহ পাশ কাটিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের দরজার কাছে এগিয়ে গেলেন । মৃতদেহের অবস্থান থেকে পাশের ফ্ল্যাটের সংলগ্ন দরজা বড় জোর দশ গজ দূরত্ব । অনুমান সঠিক ভাঙ্গা বোতলের জল ও তার সাথে রক্ত মিশে সেই মিশ্রণ পাশের ফ্ল্যাটে গড়িয়ে ঢুকেছে । কনক চ্যাটার্জী  আবার মৃতদেহের কাছে ফিরে এলেন । মৃতদেহের ত্বক সাদা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে । কনক চ্যাটার্জী  মৃতদেহের পায়ের পাতাটা টার্চ করে দেখলেন বডি রিগার মর্টিস  হয়ে গেছে । কনক চ্যাটার্জী  পিছন থেকে ফরেনসিকের তন্ময় বোসকে ডেকে নিলেন — ‘ দেখো তন্ময় , আমার তো মনে হচ্ছে প্রায় নয় দশঘন্টা আগে মার্ডার হয়েছে । তোমার কি মনে হয় ?
–‘ ঠিকই বলেছেন স্যার , গতকাল রাত্রে সাড়ে আট থেকে নটার মধ্যে হয়েছে । গলায় যেভাবে ধারালো অস্ত্রের পোচ দেখছি তাতে মনে হয় আততায়ী পুরুষ হবার কথা । শুধু পুরুষ বললে ভুল হবে শক্তিশালী পুরুষ । আগে বাঁ হাতটা পিছুমোড়া ধরেছিল তারপর ধারালো বড় চুরি দিয়ে গলায় পোচ দিয়েছে । আমার মনে হচ্ছে পোস্টমর্টেম করলে দেখতে পাবো ভিক্টিমের সোল্ডার ডিসলকেট হয়েছে । ‘
— ‘ ডান হাতে মুঠোতে কি রয়েছে দেখোতো ? ‘
–‘ স্যার এ তো বোতলের ছিপি । মনে হয় ভিক্টিম জলের বোতল হাতে নিয়ে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করেছিল । ধাক্কাধাক্কিতে ছিপি আলগা হয়ে জল ভর্তি বোতলটা মাটিতে পড়ে ভেঙ্গে যায় । হাতে ছিপি রয়ে যায় । ‘
— ‘ হবে হয়তো । তবে এই জায়গা থেকে ডাইনিং আর ড্রয়িংরুমে দুরত্ব খুব বেশি না হলেও আছে । সেই কারণে ধাক্কাধাক্কির চিহ্ন স্পষ্ট নয় অথবা আততায়ী যাবার আগে সব ঠিক করে গেছে । আর একটা ব্যাপার সুস্পষ্ট যে আততায়ী ভিক্টিমের খুবই পরিচিত । না হলে বিনা বাঁধায় বাড়িতে ঢুকে মার্ডার করে তারপর ক্যাচ লক টেনে বেরিয়ে যেতে পারতো না । তন্ময় সারাবাড়িতে যত ফিঙ্গারপ্রিন্ট আছে কলেক্ট করো । ‘

#####


মৃতদেহ পোস্টমর্টেমে পাঠিয়ে দিয়ে । কনক চ্যাটার্জী  এবার তন্ময়দের সাথেই সারা ফ্ল্যাট সরজমিনে তদন্তে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন । ফ্ল্যাটের সামনের দরজা দিয়ে ঢুকতেই মাঝারি মাপের ড্রয়িংরুম । সেগুন কাঠের সাবেকি আসবাবপত্রে খুবই সুন্দর ভাবে সাজানো দেয়ালে সুদৃশ্য কাঠের শোকেস তাতে বিভিন্ন ধরনের শোপিস সাজানো আছে । সিলিং থেকে দামী ঝাড়বাতি ঝুলছে । দুপাশের দুটো দেয়ালেই প্রমিলাদেবীর পোর্ট্রেট , একটা নৃত্যরতা আরেক সাধারণ বেশে । কনক চ্যাটার্জী  খুঁটিয়ে পোর্ট্রেটটি ভাল করে দেখলেন । বেশ মনমোহনী সুন্দরী ছিলেন প্রমিলাদেবী । পোর্ট্রেট ছবিতে কিছু একটা আছে যেটা আগে কোথাও দেখেছেন মনে হলো কনক চ্যাটার্জীর । কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছেন না । কনক চ্যাটার্জী  ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে গেলেন । সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো পরিষ্কার রান্নাঘর । গ্যাসের উপর একটা ছোট সসপ্যানে অল্প জল বসানো । পাশেই চাপাতার ছোট কাঁচের জার । মনে হচ্ছে যেন চা বানানোর উদ্যোগ নিচ্ছিল । রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে কনক চ্যাটার্জী  বাথরুমে ঢুকে দেখলেন । দেখে মনে হচ্ছে সব কিছু ঠিক আছে অথচ কিছু একটা ঠিক নেই । বেসিন থেকে খুব বেশি ডেটল ডেটল গন্ধ বের হচ্ছে । বেসিনের পাশেই রাখা ডেটলের লিকুইডসোপের ঢাকনাযুক্ত পুসকভারটা  পাশেই খুলে রাখা আছে । সাদা বেসিনটা ঝকঝক করছে । মনে হচ্ছে এই ঝকঝকে ব্যাপারটাতে খটকা লেগেছে কনক চ্যাটার্জীর । কনক চ্যাটার্জী  তন্ময়কে ডেকে নিলেন ,– ‘ দেখো তো তন্ময় , আমার বেসিনটাতে কিছু গন্ডগোল লাগছে । ‘
তন্ময় একটা কেমিক্যাল স্প্রে করতেই বেসিনের ভোল বদলে গেল । — ‘ ঠিকই ধরেছেন স্যার , এই বেসিনে রক্ত ধোয়া হয়েছিল । এই দেখুন ট্যাপের পিছনে রক্ত এখনও আছে । এত ধোয়ার পরও রক্তের দাগটা যায়নি , আততায়ীর চোখ এড়িয়ে গেছে । ‘
— ‘ তুমি ব্লাড স্যাম্পেলটা তুলে নাও । ফিঙ্গারপ্রিন্ট কিছু পেলে ? ‘
–‘ না স্যার , আততায়ী খুব ক্লেভার , সব ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়েছে । এমনকি ঘটনাস্থলেও কিছু পেলাম না । তবে পর্দার রক্তের দাগ থেকে কিছু হেল্প পেতে পারি । ‘
এরপর কনক চ্যাটার্জী  বেডরুমে ঢুকলেন । পাশাপাশি দুটো বেডরুমে একটি ছোট আর একটি বেশ বড় । পরিপাটি করে সাজানো । দেয়াল জুড়ে কাঠের বিশাল শৌখিন ওয়ারড্রোব । ঘরের মধ্যখানে কুইন সাইজের সেগুনকাঠের কারুকার্য করা বিশাল খাট । ডানদিকের দেয়ালে পরপর দুটি স্টিল আলমারি ও একটি ছোট দরজা । কনক চ্যাটার্জী  দরজা খুলে দেখলেন সেটি একটি এ্যাটাচ বাথরুম । কাঠের ওয়ারড্রোব ও স্টিল আলমারির চাবির জন্য বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হলনা । চাবি বিছানার পাশে কর্ণার টেবিলের ড্রয়ারে রাখাছিল । কনক চ্যাটার্জী  খুব সাবধানেই আলমারির খুলে দেখে নিলেন , লকারে টাকা অলংকার সবই ঠিক আছে । তারমানে চুরির চেষ্টায় খুন হয়নি ! এই বীভৎস খুনের কারণ কি তবে প্রতিহিংসা ! কনক চ্যাটার্জীর মাথায় আরো প্রশ্ন ভীড় করতে থাকে , এতবড় পাশপাশি দুটি ফ্ল্যাট নিয়ে একজন মহিলা একা থাকতেন ? বাড়ির কোন লোকজন দেখছি না , কি ব্যাপার আগে সেটাই দীপেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে । দীপেনের কথা মাথায় আসতেই কনক চ্যাটার্জী  বেডরুম থেকে বেরোতে যাবেন বলে তৎপর হতেই শুনতে পেলেন এক পুরুষ কণ্ঠের কান্না । কি হলো ? তবে কি বাড়ির কেউ এসে পড়লো ? কনক চ্যাটার্জী  ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলেন একজন বয়স্ক লোক , বয়স আন্দাজে ষাট  হবে , পরনে সাদা পাজামা ও ধূসর রংএর পাঞ্জাবী । মাথা ভর্তি উস্কোখুস্কো চুল , অনেকদিন দাঁড়ি কাটেনি , মনেহয় দাঁড়ি রাখেন , চোখে স্টিল ফ্রেমের চশমা । লোকটি ছোট সোফায় বসে কেঁদেই চলেছে । কনক চ্যাটার্জী  তাঁর সামনে এসে দাঁড়াতেই লোকটি কান্না ভেজানো কণ্ঠে বলেন — ‘ আমি একটিবার প্রমিলা দেখতে চাই প্লীজ আমায় পারমিশন দিন । ‘
— ‘ আপনার পরিচয় ? কোথায় থাকেন ? ‘
— ‘ আমি সুকান্ত পাত্র , প্রমিলা আমার বিশেষ পরিচিত । আমি বসুন্ধরা নৃত্য অ্যাকাডেমির ইভেন্ট ম্যানেজার । দীপেনের কাছ থেকে ফোনে খবর পাওয়া মাত্রই আমি চলে এসেছি । আমি দমদম ডায়মন্ডপ্লাজার কাছে থাকি । ‘
— ‘ বডি আমরা পোস্টমর্টেমে পাঠিয়ে দিচ্ছি , অ্যাম্বুলেন্সে ঢোকানো হয়ে গেছে । পোস্টমর্টেম এর পর আমরা বডি দিয়ে দেব , তখন দেখবেন । খুব নির্মম ভাবে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে প্রমিলাদেবীকে । আপনি থানায় চলুন আপনাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার আছে । এইখানে আমরা তদন্তের স্বার্থে দুটো ফ্ল্যাটই শীল করে দেব । অনেক রকম ফরেনসিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হবে । ‘কনক চ্যাটার্জী  এরপরই ডাক দিলেন — ‘ সুবিমল , তুমি সুকান্ত পাত্র , দীপেন আর কাজের মেয়েটিকে থানায় পাঠানোর ব্যবস্থা করো । ডান দিকের ঘরটা কার সুকান্তবাবু আপনি বলতে পারেন ? ‘
— ‘ ঐ ঘরটা সাত্যকীর , সাত্যকী প্রমিলার ভাইপো , প্রমিলার সাথেই থাকে । এখন কর্মসূত্রে বাঙ্গালোরে থাকে । ‘
কনক চ্যাটার্জী  সুকান্ত পাত্রের কথা শুনে দরজা ঠেলে ডান দিকের ঘরে ঢুকলেন । ঘরে ঢুকতেই কনক চ্যাটার্জী  হতবাক । যে লোকটি কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন তাঁর ঘরটি লন্ডভন্ড করা হয়েছে । বিছানা পত্র ওলটপালট করা । ওয়াল ক্যাবিনেট থেকে বইপত্র মাটিতে পড়ে আছে স্টিল আলমারীর দুপাল্লা খোলা , তার ভিতরে জামা কাপড় ওলটপালট করা । কনক চ্যাটার্জী  ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা হাতে নিয়ে তদন্ত শুরু করে দিলেন । আলমারি খাট ক্যাবিনেটে সর্বত্র হাতের ছাপ পেলেন কিছু তাতে কোন ফিঙ্গারপ্রিন্ট পেলেন না । খুব সহজেই বোঝা গেল আততায়ী হাতে রবারের গ্লাভস পরে ছিল । আততায়ী কিসের উদ্দ্যেশে এই ঘরে ঢুকেছিল ? কী খোঁজার চেষ্টা করেছিল । সেটা কি খুঁজে পেয়েছে ? এই চুরির কারণেই কি প্রমিলাদেবীকে খুন করা হয়েছিল ? কনক চ্যাটার্জী  সারা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখলেন । কিন্তু সেরকম চোখে পড়ার মতো কিছু্ই পেলেন না । আলমারী বন্ধ করতে যাবেন তখনই তাঁর চোখে পড়ে চাবির গোছাটা আলমারির লকে ঝুলছে তাতে একটা চুল জড়ানো আছে । কনক চ্যাটার্জী  চুলটি ভাল করে লক্ষ্য করলেন — চুলের সাইজ দেখে মনে হচ্ছে মহিলার চুল , প্রায় একফুটের বেশি লম্বা । একজন ব্যচেলর ছেলের ঘরে তাঁর পার্সোনাল আলমারির চাবি মহিলার চুল জড়ানো ব্যাপারটা অবাক করার মতো । এচুল প্রমিলাদেবীর হতে পারেনা । কারণ প্রমিলার দেবীর চুল বেশ কোঁকড়ানো এবং কাঁধ অবধি লম্বা হবে হয়তো । কনক চ্যাটার্জী  খুব সন্তর্পণে চুলটি টেনে বের করে নিয়ে পকেট থেকে পাউচ বের করে তাতে ভরে রাখলেন । এরপরও তিনি ঘরের মেঝেটা ভাল করে দেখে নিয়ে মিনিট পাঁচেকের পর ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন । তন্ময়ের যাকিছু অনুসন্ধান করার ছিল করেছেন , তিনি কনক চ্যাটার্জীর সাথে প্রয়োজনীয় কথা সেরে ফ্ল্যাট থেকে চলে যান । কনক চ্যাটার্জী  ফ্ল্যাট সিল করে স্বদলবলে থানায় ফিরে আসেন ।
#####
থানায় ফিরে এক মুহুর্ত অপেক্ষা করেননি । নিজের টেবিলের ড্রয়ার থেকে লাল ডায়েরীটা বের করে নিলেন । মনের মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্ন গুলি এক এক করে নামাতে থাকেন  ডায়েরীর পাতায় । লেখা শেষ করবার পরই কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন । বন্ধ চোখের কাল্পনিক বাতাবরণে মার্ডারের সম্ভাব্য দৃশ্যপট গুলি ভাবনার অন্তর্জালে এক এক করে ভেসে উঠতে থাকে । মিনিট পাঁচেক চুপ থাকার পর কনক চ্যাটার্জীর ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হয়ে ওঠে , চোয়াল শক্ত হয়ে রগের শিরা গুলি প্রকট হয়ে ওঠে । বিরক্তি আর শ্লেষাত্মক শব্দ অস্ফুটে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে — ‘ ইস্ মানুষ কত পাষন্ড হয়ে উঠছে দিনকে দিন । হত্যা করার ও রকম ফের আছে , পৈশাচিকতা এতটা দুর্বিনীত হতে পারে ধারণা ছিল না । একজন মহিলাকে হত্যা করার থাকলে কত সহজেই ছুরি মেরে বা গলা টিপে কিংবা গুলি করে হত্যা করতে পারতো । এই রকম বিভৎস্য ভাবে গলায় পোচ দিয়ে হত্যা করা …. ভাবাই যায় না । তারউপর বাঁ হাতটা যে ভাবে মুচড়ে পিছুমোড়া করে ধরেছিল তাতে তন্ময় বলছে সোল্ডার ডিসলোকেট হতে পারে । এই রকম বর্বর অত্যাচার একমাত্র সাংঘাতিক প্রতিহিংসা থেকেই সম্ভব । তবে কি কারণে এমন প্রতিহিংসা ! ..ছিঃ ! ….কনক চ্যাটার্জী  চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন । থানায় দীপেন চৌধুরী সুকান্ত পাত্র ও জবামাসিকে আনা হয়েছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ।  তাঁরা বাইরের বেঞ্চে অপেক্ষারত । কনক চ্যাটার্জী  নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে সুবিমলের টেবিলের দিকে যান , — ‘ চলো সুবিমল শুরু করা যাক , প্রথমেই কাজের মাসিকে ডেকে নাও । ‘কাজের মাসি টেবিলে আসা মাত্রই কাঁদতে শুরু করে — ‘ বাবু গো আমি তো কিছুই করিনি আমাকে এখানে আনলেন কেন ? আমি তো ঘর মুছতে গিয়ে ছিলাম । ‘– ‘ মাসি বাজে কান্না থামাও তো ‘ , ধমকে ওঠেন সুবিমল , — ‘ যা জিজ্ঞাসা করছি উত্তর দাও । ও বাড়িতে কতদিন ধরে কাজ করছো তুমি ? ‘
— ‘ তিন বছর ধরে নাচের ফ্ল্যাটে কাজ করি ‘
— ‘ মাইনে কত দেয় ? ‘
— ‘ মাইনে খুব অল্প বাবু , দুবেলা গোটা ফ্ল্যাটটা ঝাঁটপোচ করি পাঁচশ টাকা দেয় । ‘
— ‘ প্রমিলাদেবী তোমাকে কাজে রেখেছিল ? কেমন মানুষ ছিলেন তিনি ? ‘
— ‘ কাজে রেখেছিল কিন্তু মাইনে তো দীপেনদার কাছ থেকে পেয়ে যাই । আমি ঘর মুছে চলে আসি দিদিমণির সাথে দেখা হয় না , কথাও হয় না আমার সাথে ।বাবু সেই সকাল থেকে নাচের স্কুলে আটকে আছি । দেড়টা বেজে গেল , দুটোর সময় আমার মেয়ের স্কুল ছুটি হবে আনতে যেতে হবে আমায় । বাবু আমায় ছেড়ে দিন এবার । ‘
— ‘ ঠিক আছে যাবে । আচ্ছা বলোতো আজকের ঘটনার দু তিন দিন আগে তুমি অস্বাভাবিক কোন কিছু দেখেছো ? ঠিক মনে করে দেখোতো ? ‘
— ‘ না বাবু আমি সেরকম কিছু দেখি নি । ‘
— ‘ আচ্ছা যাও , পরে তোমায় ডাকা হতে পারে , এলাকা ছেড়ে কোথাও যাবে না । ‘

#####


প্রমিলাদেবীর বিশেষ বন্ধু সুকান্ত পাত্র টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াতেই কনক চ্যাটার্জী  তাঁকে চেয়ারে বসতে বললেন । ভদ্রলোকও যেন দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না , চেয়ার পেয়ে ধপ করে বসে পড়লেন । ফ্ল্যাটে তাঁকে যতটা বিধস্ত দেখাচ্ছিল এখন আরো বেশি বিমর্ষ বিধস্ত লাগছে । হয়তো থানার আভ্যন্তরীণ আবহে একটু বেশি রকমের ভয় পেয়ে গেছেন । এক গ্লাস জল সুবিমল এগিয়ে দিলে সুকান্ত পাত্র নিমেষে গ্লাস শেষ করে দিয়ে থিতু হয়ে বসলেন । তারপর নিজেই শুরু করলেন আমি দমদম ডায়মন্ড প্লাজার কাছে থাকি । আমি বসুন্ধরা নৃত্য অ্যাকাডেমির ইভেন্ট ম্যানেজার । নৃত্য অ্যাকাডেমির ট্রুপ বিদেশে বা রাজ্যের বাইরে গেলে ইভেন্ট গুলি আমি দেখাশোনা করি । আমার সাথে প্রমিলার পরিচয় কলেজ লাইফ থেকে । বহুদিনের আলাপ বলেই বন্ধু হলেও আমি প্রমিলার পরিবারের সাথে বিশেষ ঘনিষ্ঠ ।
— ‘ আপনি বিবাহিত ? কনক চ্যাটার্জী  প্রশ্ন করলেন
— ‘ না আমি ব্যাচেলার , প্রমিলাকে ভালবেসেছিলাম কলেজ লাইফ থেকে । প্রমিলা সংসার করতে রাজী হয়নি । নাচের জগৎ নিয়ে এত ব্যস্ত থাকতো সবসময় যে প্রমিলার বিয়ে করে সংসার করার ইচ্ছে কোনদিনও ছিল না । আমার বাবা মা অনেকবছর আগেই মারা গেছেন তাই আমিও এইভাবেই রয়েগেছি । ‘
— ‘ প্রমিলাদেবীর পরিবার সমন্ধে কিছু বলুন ? ‘
— ‘ বর্তমানে যেখানে প্রমিলার ফ্ল্যাট সেখানে আগে প্রমিলার পৈত্রিক বাড়ি ছিল । দুহাজার আটে বাড়িটি প্রমোটারের হাতে তুলে দেয় । মোটা অঙ্কের নগত অর্থ আর দুটি আঠেরোশ  স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট পায় প্রমিলা । প্রমিলার বাবা লেট বিষ্ণুচরণ খাস্তগীর ফুড কর্পোরেশনে চাকরী করতেন । প্রমিলারা দুই ভাই বোন । প্রমিলা ছোট । প্রমিলার দাদা বৌদি রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান । ওনাদের একমাএ সন্তান সাত্যকী তখন ক্লাস সিক্সে পড়ে । প্রমিলা সাত্যকীর দেখাশোনার ভার গ্রহণ করে । বলতে গেলে সেই কারণেই প্রমিলা আর নিজের বিয়ের কথা ভাবেনি । তাছাড়া মেসোমশাই মানে বিষ্ণুচরণ খাস্তগীর বয়সকালে প্রমিলাই সেবা করেছে । একটা ছেলের যা করণীয় সবই প্রমিলা নিষ্ঠা ভরে সকল দায়িত্ব কর্তব্য পালন করেছে । মেসোমশাই ওনার যা কিছু সম্পত্তি সবই প্রমিলার নামে লিখিয়ে দিয়ে গেছেন । প্রমিলার অবর্তমানে সব সম্পত্তি সাত্যকীর পাওয়ার কথা । মানে সেইরকমই উইল করা আছে । ‘
— ‘ ও তাহলে খুনের মোটিভ সম্পত্তি হতে পারে । প্রমিলারদেবীর খুনের ঘটনা আপনি সাত্যকী খাস্তগীরকে ফোন করে জানিয়েছেন ? ব্যাঙ্গালোরে কোথায় থাকেন উনি ? ‘
কনক চ্যাটার্জীর প্রশ্ন শুনে সুকান্ত পাত্র চুপ , মনে হলো যেন প্রশ্নটা ঠিক মতো বুঝতে পারেননি । কনক চ্যাটার্জী  আবারও প্রশ্ন করলেন । তারপরও চুপ দেখে কনক চ্যাটার্জী  অবাক হয়ে বললেন — ‘ কি ব্যাপার উত্তর দিচ্ছেন না কেন ? ‘
— ‘ ইয়ে মানে … সুকান্ত পাত্র একটু যেন  দ্বিধাগ্রস্ত   হয়ে পড়লেন ।
— ‘ কি হলো বলুন ? ‘ ধমকে ওঠেন কনক চ্যাটার্জী 
— ‘ স্যার আমি তখন আপনাকে মিথ্যা বলে ছিলাম । আসলে ফ্ল্যাটের দরজায় তখন কৌতুহলীদের ভীড় ছিল । ঘরের মধ্যে দীপেন ছিল । তখন যদি সত্যিটা বলতাম প্রমিলার পরিবারের বদনাম আবাসনে ছড়িয়ে যেত । আসল সত্যটা হলো প্রমিলার ভাইপো সাত্যকী খাস্তগীর এখন দমদম সেন্ট্রাল জেলে । ‘
— ‘ মানে !
— ‘ সাত্যকী সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার । কিন্তু চাকরী করতো বেসরকারী ব্যাঙ্কে , সেখানে কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসাবে জয়েন করলেও পরে লোন সেকশানের চলে যায় । সেখানে কয়েকজন লোনগ্রহীতাদের প্রতারণা করে বহু টাকার তছরূপ করে । এতে ব্যাঙ্কের  নাম নষ্ট হয় । সাত্যকীর কারসাজি ধরা পড়ে যায় । ব্যাঙ্ক কাস্টমারদের প্রতারণা ও টাকা লেনদেনের জালিয়াতির জন্য সাত্যকীর পাঁচবছরের জন্য জেল হয় । ‘
— ‘ সাত্যকী তো পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলে টাকা তছরূপ করার দরকার পড়েছিল কেন জানেন ? ‘
— ‘ সাত্যকী নিজেই একটা সফটওয়ার কোম্পানী খুলতে চেয়েছিল । কিন্তু প্রমিলার বিসনেসের জন্য টাকা দেবে না পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল । প্রমিলার বক্তব্য ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরী করুক বিসনেসে করার কি দরকার ? সাত্যকী তখন বাধ্য হয়েই ভুল পথে পা বাড়ায় । জেল থেকে বেরোতে সাত্যকীর এখনও দেড় বছর বাকি । ‘
— ‘ আচ্ছা প্রমিলাদেবীর উপর আক্রোশ আছে এই রকম কাউকে আপনি চেনেন ? ‘
— ‘ আক্রোশ কেন থাকবে ? প্রমিলা তো কারোর কোন ক্ষতি করেনি কখনও । সবারই সাথে সদ্ভাব ভালই ছিল । তাছাড়া প্রমিলা নিজের নাচের জগৎ নিয়ে থাকতো । সেরকম  কোন বন্ধুবান্ধব ছিল না । আমার সাথেই একমাএ যোগাযোগ আছে । আমি প্রায় দিনই এখানে নিয়ম করে বিকালের দিকে আসি । ‘
— ‘ সকালের দিকে কি করেন আপনি ? ‘
— ‘ আমার ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরিই হয় , প্রায় বারোটা সাড়ে বারোটা বেজে যায় । খবরের কাগজ পড়ে স্নান খাওয়া দাওয়া করে বিকালের দিকে এখানে চলে আসি । ‘
— ‘ আজ সকালে উঠলেন কেন ? ‘
— ‘ উঠিনি তো , সাড়ে আটটায় ল্যান্ডলাইনে দীপেনের ফোন এসেছিল , আমার বাড়িতে থাকে শম্ভুদা আমাকে ঘুম থেকে তুলে দেয় । দীপেনের মুখেই শুনি , প্রমিলার ফ্ল্যাটে কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে , প্রমিলার সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না । আবাসনে এসে জানতে পারি প্রমিলা মার্ডার হয়েছে । ‘
— ‘ ঠিক আছে আজ এই অবদি থাক , এলাকা ছেড়ে যাবার চেষ্টা করবেন না । আপনি আসুন । ‘

#####


সুকান্ত পাত্র চলে যাবার পর দীপেনকে ডেকে নেওয়া হয় । বছর কুড়ির দোহরা গড়নের চুপচাপ ছেলেটি বেশ মিতভাষী । ঘটনার প্রবাহ আর থানার অভ্যন্তরীণ পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পেরে একটু যেন ভয়ে কুঁকড়ে আছে । ওসির চোখে চোখ রেখে চেয়ারে বসলেও মুখটি যেন শুকনো । কনক চ্যাটার্জী  জিজ্ঞাসা করলেন — ‘ আপনি ঠিক আছেন তো ? ‘ দীপেন ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানায় ।
— ‘ কতদিন কাজ করছেন প্রমিলা দেবীর ওখানে ? আপনার সমন্ধে কিছু বলুন ? ‘
— ‘ দিদিমণির কাছে আমি চার বছর ধরে কাজ করছি । আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন থেকে আমি দিদিমনির বাড়িতে পেপার দিতাম , এছাড়াও আবাসনের অনেকের বাড়িতে পেপার দিতাম । ক্লাস টেন পাশ করার পর আমি নিজেই দিদিমণির সাথে দেখা করি ভাল কিছু কাজ পাবার আশায় । দিদিমণি এক কথায় আমাকে রেখে দিলেন । তখন স্কুল সেরে বিকালে আসতাম , চার হাজার টাকা দিতেন তারসাথে একটা ভাল টিফিন দিতেন । আমার পড়ার খরচ ভালভাবে চালিয়ে নিতে পারতাম । কলেজে ওঠার পর ভর্তির খরচ দিদিমণি পুরোটাই দিয়ে ছিলেন । মাইনে পাঁচ হাজার করে দিয়েছিলেন । এছাড়াও পূজোতে পয়লা বৈশাখে আমার জন্য নতুন জামা কিনে দিতেন । আমার মায়ের পর যদি কেউ স্নেহ করে থাকেন আমায় তিনি হলেন দিদিমণি । কথা গুলো বলেই দীপেন কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন । সুবিমল এক গ্লাস জল এগিয়ে দিয়ে দীপেনকে শান্ত হতে বললেন । জলের গ্লাসটা হাতে পাওয়া মাত্রই এক নিমেষে শেষ করে ফেলে দীপেন ।
— ‘ প্রমিলাদেবীর পরিবারে কে আছেন ? মানে স্বামী সন্তান ? ‘
— ‘ দিদিমণি মনে হয় অবিবাহিতা ছিলেন  , কারণ বহুবার আমি দিদিমণিকে ফোনে কথা বলতে শুনে ছিলাম যে — ” আমি মিস প্রমিলা খাস্তগীর বলছি । ” … এই কথা অনুযায়ী আমার ধারণা হয়েছিল উনি অবিবাহিতা ।অ্যাকাডেমির পাশের ফ্ল্যাটে ওনার সাথে মনে হয় ওনার ভাইপো থাকতেন । বর্তমানে অফিসের কাজে  ব্যাঙ্গালোরে থাকেন বলে শুনেছি , আমি যবে থেকে কাজে জয়েন করেছি একবারও কিন্তু ওই ভাইপোকে দেখিনি । ওনাকে সুকান্ত স্যার বোধ হয় খবর দেবেন । ‘
— ‘ আচ্ছা দীপেন , কখনও কি আপনি দিদিমনির সাথে কারোর কোন ঝগড়া বা দ্বন্ধ হতে দেখেছিলেন ? একটু ভেবে বলুন …কেউ কি আপনার দিদিমণির ক্ষতি করতে পারে আপনার মনে হয়েছে ? ‘
দীপেন কিছুক্ষণ ভেবে বললেন — ‘ না সেরকম কিছু মনে পড়ছে না আমার । দিদিমণিকে নাচ আর ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতেই দেখি । তাদের মধ্যে কেউ কখনও খারাপ ব্যবহার করেনি । ‘
— ‘ নতুন কোন লোকজন কি নৃত্য অ্যাকাডেমিতে যাতায়াত শুরু করেছিল ? ‘
— ‘ না স্যার , সেরকম কেউ আসেনি , এমনকি নতুন ছাত্রছাত্রী কেউ ভর্তি হয়নি । তবে সামনের মাস থেকে সকালের শিফটের জন্য একজন নাচের দিদিমণির খোঁজ চলছে । সকালে অপরাজিতা দিদি যিনি আসেন তাঁর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে । তাঁর বদলে নতুন একজনের খোঁজ চলছে , একজনের দু একদিনের মধ্যে দেখা করার কথা ছিল দিদিমণির সাথে । দেখা হয়েছে কিনা আমি জানি না । ‘
— ‘ আচ্ছা আপনি আসুন আজ , এলাকা ছেড়ে যাবার চেষ্টা করবেন না । ‘
#####
সবার বয়ান নেওয়া শেষ হলে কনক চ্যাটার্জী  নিজের ঘরে ফিরে যান । কিছুক্ষণ পরই সুবিমল ঘরে ঢোকে । — ‘ স্যার কেসটা কিছু বুঝলেন ?
— ‘ হুম , জটিল তো মনে হচ্ছে । ঘরের মধ্যে ক্লু সেরকম পাওয়া যায়নি । তবে ভিক্টিমের ঘরে কোন চুরি যায়নি । তবে ভাইপোর ঘর থেকে সামথিং মিসিং । কি হতে পারে সেটা বুঝতে পারছি না , অথচ ঐ ঘরে সাড়ে তিন বছর ধরে ভাইপো থাকে না । তাহলে কি জিনিস ছিল যেটা আততায়ীর খুব দরকার ? সুবিমল , ভাবো ভাবো , কিছু না কিছু ক্লু বেরোবেই । আর ঐ সুকান্ত পাত্র লোকটি বেশ সন্দেহজনক । ‘
— ‘ ভাবছি স্যার , …স্যার , সন্ধ্যা বললো অবনী আপনার জন্য লাঞ্চবক্স দিয়ে গেছে , সাড়ে তিনটে বাজে খেয়ে নিন । আমিও যাই লাঞ্চ সেরে নিই ।সুবিমল চলে যাবার পরই কনক চ্যাটার্জী  জিমের ইন্সট্রাক্টরকে ফোন করলেন । তিনিই ওই জিমের মালিক। — ‘ আমি বারাসাত থানার ইনচার্জ কনক চ্যাটার্জী  বলছি , মহাদেববাবু , আমার আপনার সাথে একটু জরুরী আলোচনা আছে । আপনি কি একবার থানায় আসতে পারবেন ? ‘
— ‘ হ্যাঁ স্যার , কোন অসুবিধা নেই আমি এখুনি আসছি । ‘

#####


কনক চ্যাটার্জীকে লাঞ্চ করে মহাদেববাবুর জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি । চারটের ভিতরই মহাদেববাবু থানায় হাজিরা দেন । মহাদেববাবু আসতেই কনক চ্যাটার্জী  নিজের ঘরে ডেকে নেন । — ‘ বসুন মহাদেববাবু , আমি ভনিতা না করেই আমি সরাসরি আমার বক্তব্য রাখছি । মহাদেববাবু আপনি রিটায়ার্ড আর্মিম্যান , সেই কারণে কাজের প্রতি দায়িত্ব ও নিষ্ঠা প্রতিপালন করেন আপনি , এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত । আশা রাখছি আপনি আমার কথায় সহমত । ‘
— ‘ অবশ্যই স্যার , কি হয়েছে একটু যদি খুলে বলেন ? ‘
— ‘ মহাদেববাবু , জিমের লকারে আমার ব্যক্তিগত জিনিসের উপর কারোর হাত পড়েছে । যার ফল স্বরূপ ভবিষৎ – এ আমার সুনাম নষ্ট হতে পারে । এটা যখন আমি আগাম জানতে পেরেছি তখন আর চুপ করে বসে থাকা সম্ভব নয় । ‘
— ‘ তাই নাকি ! কিন্তু স্যার এটা কি করে সম্ভব ? একমাএ লকার হোল্ডার ছাড়া লকার প্যাসেজে অন্য কারোর যাবার পারমিশন নেই । তাহলে কি করে সম্ভব ? ‘
— ‘ ভুল করছেন , লকার হোল্ডারা যেতে পারে তো ? আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে — আপনি জিম মেম্বারদের প্রত্যেকেই মোবাইলে ম্যাসেজ পাঠান যে জাপান থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত যোগাগুরু এসেছেন যিনি কিনা বিশেষ যোগা প্রদর্শন করবে যা কিনা রেগুলার করলে বিশেষ বিশেষ রোগমুক্তির পথ দেখাবে । এমনকি ক্যান্সার পেশেন্টদের মারণ যন্ত্রণা উপশমে সাহায্য করবে । তাই উক্ত দিনে প্রত্যেক মেম্বারদের উপস্থিতি কাম্য ।সম্পূর্ণ প্রোগাম সিসিটিভি  ক্যামেরার সামনে হবে । আমিও উপস্থিত থাকবো তবে ক্যামেরার পিছনে । আপনি এইটুকু ব্যবস্থা করুন বাকিটা আমি দেখে নিচ্ছি । আর দিনটা আগামী শনিবার করুন । ‘
— ‘ ঠিক আছে স্যার তাই হবে । স্যার , আমি খুব লজ্জিত । এরকম একটা বাজে ঘটনা ঘটে গেছে জেনে আমার খুব খারাপ লাগছে । ‘
— ‘ ইটস্ ওকে ! ঘটনাটা আপনার মধ্যে গোপন থাকে যেন । আজ আসুন তাহলে । ‘

#####


পরের দিন কনক চ্যাটার্জী  থানায় এসে পৌঁছানোর ঘন্টা খানেকের ভিতর পোস্টমর্টেম ও ফরেনসিক রিপোর্ট চলে আসে । রিপোর্ট হাতে পেয়েই কনক চ্যাটার্জী  নিজ ঘরে লাল ডায়েরী খুলে বসলেন । খুবই ভাল করে খুঁটিয়ে রিপোর্ট গুলো পড়ে নিজের মনেই বিড়বিড় করলেন –‘ এর থেকে বোঝা যাচ্ছে প্রমিলাদেবীকে যে হত্যা করেছে সে তাহলে কোন উঁচু কাঁধযুক্ত কোন পুরুষ হবে । প্রমিলাদেবীর বাঁ হাতের কব্জিতে পুরুষের হাতের শক্ত মুষ্টিবদ্ধ আঙ্গুলের ছাপ আছে । যেভাবে পিছন মোড়া করে ধরা হয়েছে তাতে কাঁধের ক্ল্যভিকেল বোন থেকে হিউমারাস বোন ডিসলকেট হয়েছে । গলায় একবারই ছুরির পোচ দিয়েছে । একবারের পোচে যেভাবে ট্রাকিয়া এবং এসোফেগাস দ্বিখণ্ডিত হয়েছে । তাতে খুবই সহজেই বোঝা যায় আততায়ী বলিষ্ঠ শক্তিধর পুরুষ। আরেকদিকও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আততায়ী নারীর বেশ ধরে এসেছিল কারণ প্রমিলাদেবীর পিঠে পরচুলার লম্বা চুল পাওয়া গেছে , তারসাথে রক্তমাখা পর্দা আর চাবির গোছায় যে চুল পাওয়া গেছে তা একই ধরনের চুল । এবং তিনটে  চুলই পরচুলার চুল । কে হতে পারে এই আততায়ী ? নারীর যদি বেশ ধরে থাকে  তবুও কি আততায়ীকে পুরুষ বলে চিহ্নিত করতে পারেননি প্রমিলাদেবী ? এই কাজ সুকান্ত পাত্র কিংবা দীপেনের নয় কারণ আততায়ীর হাতের ছাপ ওদের সাথে মিল নেই উপরন্তু সাইজে বেশ বড় ছাপ ছিল । প্রমিলাদেবীর আলমারিতে দামী অলংকার ও টাকা সবই যথা স্থানে ছিল । তারমানে চুরির উদ্দ্যেশে খুনটা হয়নি স্পষ্ট । চার বছর ধরে সাত্যকীর ঘর বন্ধ ছিল মানে কারোর প্রবেশ ছিল না , সেই ঘর থেকে কি জিনিস চুরি গেল যা খোঁজার জন্য সাত্যকীর ঘর লন্ডভন্ড হয়েছিল ? প্রমিলা দেবীকে মারার উদ্দ্যেশে এসেছিল আততায়ী তারপর সাত্যকীর ঘর লন্ডভন্ড করেছে গ্লাভসের ছাপে রক্ত ধোয়া জলের চিহ্ন পাওয়া গেছে । ভাবতে অবাক লাগছে পঞ্চাশোর্দ্ধ একজন নৃত্যশিল্পীর প্রতি কার এত প্রচন্ড প্রতিহিংসা জন্মেছে ? কারণ কি হতে পারে ? …ওফ ! মাথাটা কি ভার ভার লাগছে । যবে থেকে এই চাকরীতে ঢুকেছি তবে থেকে এই সবই দেখে যাচ্ছি । মাথার আর কি দোষ দেবো ! …. চোখ বন্ধ করে চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিলেন কনক চ্যাটার্জী  ।মিনিট চারেক বাদেই সুবিমলকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠালেন । — ‘ কি বুঝলে সুবিমল এই প্রমিলা মার্ডার কেসটার ব্যাপারে ?
— ‘ সেটাই তো স্যার ! একজন নৃত্য শিল্পীর উপর কার এত রাগ থাকতে পারে ? তাও আবার এত বয়ষ্ক মহিলা । খুনি পুরুষ না মহিলা সেটাও তো বোঝা যাচ্ছে না । ফ্ল্যাটে কোন সিসি টিভি ক্যামেরাও নেই । ফ্ল্যাটে কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম বলছে সিসি টিভি ক্যামেরা লাগানোর প্রস্তুতি চলছে । এই হয়েছে এক অশান্তি , চারিদিকে ব্যাঙ -এর ছাতার মতো খালি ফ্ল্যাট গজিয়ে উঠছে অথচ পৌরসভার কোন রুলস মানে না । ‘
— ‘ সুবিমল , মহিলা হবে না কারণ মহিলার ছদ্দবেশে এসেছিল মাথায় পরচুলা পরে । গায়ে তার প্রচন্ড শক্তি । ‘ কে হতে পারে ভাবো ।
— ‘ নৃত্য শিল্পীর প্রেমিক হতে পারে ? ‘ — ‘ ওনাকে হাল্কা ভাবে নেওয়া উচিৎ হবে না । তবে ওনার হাতের ছাপ ছোট । কিন্তু লোকটা সাসপীসিয়াস । লোকটার বয়ানে গন্ডগোল আছে । তাছাড়া প্রমিলাদেবীর কাছের সেরকম বন্ধু বা আত্মীয় নেই সেই সুযোগটা সুকান্ত পাত্র নিতেই পারে । তবে মোটিভ কি হতে পারে ? প্রমিলাদেবীর প্রচুর ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স আছে সেটাতো সাত্যকী পাবে । ‘
— ‘ স্যার কাউকে দিয়ে খুনটা করায়নি তো ? ‘
— ‘ আরিব্বাস ! তোমার তো দেখছি আইকিউ দারুন ডেভলপ করছে । ব্যাপার কি ? হুম .. এটা হতে পারে …
সুবিমল গদগদ হয়ে বললেন — ‘ ইয়ে স্যার সঙ্গদোষ যেমন হয় সঙ্গগুণও হতে পারে , আপনার সংস্পর্শে থেকে কিছু্টা তো ইমপ্রুভ হবেই , সেটাই হয়েছে আর কি । আপনি এই থানায় এসে যা যা একটা কেস সলভ করছেন যে দেখে আন্দাজ হয়ে গেছে । ‘
কনক চ্যাটার্জী  হেসে বললেন — ‘ হুম … সুকান্ত পাত্র লোকটার সম্পর্কে খুব ভাল করে খোঁজ খবর নাও । লোকটার প্রতিটা খবর আমি জানতে চাই , তুমি কাজে লেগে পড়ো , সুকান্ত পাত্রকে থানায় না ডেকে ওনার বাড়ি যাও । ‘

#####


দমদম ডায়মন্ড প্লাজার উল্টোদিকে মেন রোডের উপর ছোট পরিসরের তিনতলা বাড়ি । একতলায় দুটো দোকান ঘর ভাড়া রয়েছে দুতলায় দুটি অফিস ঘর ভাড়া । তিনতলায় সুকান্ত পাত্রর বাস । সাব ইন্সপেক্টর সুবিমল নন্দী বাড়িটিকে ভাল করে খুঁটিয়ে দেখে সঙ্গে থাকা সন্ধ্যা ও রতনকে বললেন — ‘ পৈত্রিক সম্পত্তির ষোলোআনা মাখনই সুকান্ত পাত্র গলধঃকরন করে থাকেন । এমতো অবস্থায় সুখী মানুষটির চাকরী কিংবা ব্যবসায় মন না থেকে নৃত্য অ্যাকাডেমির পরিচর্যায় সময় কাটবে এতো সাধারণ ব্যপার । দেখে বোঝাই যায় লাখের উপর আমদানী হয় ভাড়া মারফত । ‘
— ‘ হ্যাঁ স্যার , সেতো বোঝাই যাচ্ছে । চলুন এবার প্রমিলাদেবীর বিশেষ বন্ধুর সাথে দেখা করে আসি । ‘
তিনতলায় কলিং বেল বাজাতেই একজন বয়স্কলোক দরজা খুলে দেন । ঘরের দরজায় পুলিশ দেখে একেবারে হতভম্ব হয়ে যান । সুকান্ত পাত্র কোথায় জানতে চাইলে দরজা ছেড়ে দাঁড়ায় । সাব ইন্সপেক্টর সুবিমল নন্দী ঘরে প্রবেশ করেন , ওনার পিছু পিছু সন্ধ্যা ও কনস্টেবল রতন বোস ঘরে ঢুকলেন । ঘরে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলেন বেলা দেড়টা নাগাত সোফায় চা সহযোগে পেপারে মগ্ন সুকান্ত পাত্র । গতকালের বিমর্ষতা আজ চায়ের পেয়ালায় সম্পূর্ণ রূপে ভ্যানিশ । কেউ দেখে বলবে না যে ভদ্রলোক তাঁর সবচেয়ে প্রিয় একজনকে হারিয়েছেন । পায়ের আওয়াজে পেপার থেকে চোখ সরিয়ে বললেন –‘ আপনারা এখানে ? কি ব্যাপার ? আমাকে ডাকলেই পারতেন আমি থানায় চলে যেতাম ।’
— ‘থাক বারে বারে আপনাকে কষ্ট করতে হবে না মাঝে মাঝে আমরাও আসবো আপনার খবর নিতে । ‘
–‘ বলুন কি করতে পারি আমি ? ‘
— ‘ না না , আপনাকে কিছু করতে হবে না , আপনি যেখানে বসে আছেন সেখানে চুপ করে বসুন । আমরা প্রমিলা মার্ডার কেসের সাসপেক্ট সবার বাড়িতেই সার্চ করছি , আপনিও এর মধ্যে পড়েন । ‘
— ‘ কিন্তু আমার বাড়ি সার্চ করবেন কেন ? এটা আপনারা করতে পারেন না । এলাকায় আমার একটা সুনাম আছে । ‘
— ‘ আমরা করতে পারি , লোকাল থানার পারমিশন নিয়েই আমরা সার্চ ওয়ারেন্ট সঙ্গে এনেছি । ইচ্ছে করলে দেখতে পারেন ।
এর পরই অ্যাসিস্টেন্ট ইন্সপেক্টর সুবিমল নন্দী সন্ধ্যা সরকার ও কন্সটেবল রতন বোস চুরুণী তল্লাশীতে লেগে পড়েন । অনেক খোঁজাখুঁজির পর তেমন কিছু হাতে পড়লো না যা তদন্তে সাহায্য করবে । কিছু পুরনো ফটোগ্রাফ ও ব্যাঙ্কের কিছু নথিপত্র যাকিছু পাওয়া গেল তার কিছু ছবি তোলা হলো আর কিছু ফটোগ্রাফ সঙ্গে নিয়ে ওনারা বেরিয়ে গেলেন ।
সুকান্ত পাত্রর বাড়ি থেকে বেরোনোর পরই সন্ধ্যা ফোন করে কনক চ্যাটার্জীকে সবিস্তারে জানালে কনক চ্যাটার্জী  ওদের সুকান্ত পাত্রের ব্যাঙ্ক থেকে বিস্তারিত নথি নিয়ে আসতে বললেন ।

#####


ব্যাঙ্ক থেকে প্রয়োজনীয় নথি নিয়ে আসার পর কনক চ্যাটার্জী  সুবিমল ও সন্ধ্যাকে নিয়ে আলোচনায় বসলেন । একটি সরকারী ব্যাঙ্কের পাসবুকের আপ টু ডেট দেখতে দেখতে সন্ধ্যা বলে উঠলেন –‘ ঠিকই বলেছেন স্যার , লোকটা সাস্পীসিয়াস । গত দশ বছর ধরে প্রতিমাসে ব্যাঙ্ক থেকে সুকান্ত পাত্র মাসের এক কি দু তারিখ তিরিশ হাজার করে টাকা তুলেছে । আমরা গত দশবছরের স্টেটমেন্ট এনেছি না হলে তারও আগেকার খবর জানা যেত । তবে গত পাঁচ বছর যাবৎ তিরিশ হাজার করে তুলেছে । তার আগে পঁচিশ করে তুলেছিল । আর মাঝে মাঝেই আশি হাজার কখনও দেড়লক্ষ করে টাকা তুলেছেন । একা মানুষ এত্ত টাকা কি করে ? ‘
— ‘ সন্ধ্যা এতে কিছু প্রমাণ হয়না ! দোকান ভাড়া ও অফিস ভাড়ার টাকা ডাইরেক্ট ব্যাঙ্কে ঢোকে যখন তখন সংসার খরচের জন্য টাকা তুলতে পারে । তবুও তোমার মনে যখন খটকা লেগেছে তখন খবরি লাগাও । আগামী মাসের এক তারিখ আসতে এখনও আট দিন বাকি । ব্যাঙ্ক ম্যনেজারের সাথে কথা বলো ‘ চেক ড্র ‘ সেকশনে যিনি কাজ করেন তিনি কিছু যদি মনে করে বলতে পারেন কিনা দেখো । ‘

#####


সেদিনের মতো তদন্তে সেরকম কিছুই সুরাহা হলো না । ডিউটি শেষ করে কোয়ার্টারে ফিরে গেলেন কনক চ্যাটার্জী  । অবনী দরজা খুলে দিতেই কনক চ্যাটার্জী  ঘরে প্রবেশ করেই দেখতে পেলেন টেবিলের উপর একটা খাম রাখা আছে । খামের উপরে কনক চ্যাটার্জীর নাম লেখা , সাদা কাগজের উপর নামটি প্রিন্টিং করা এবং কাগজ কাটিং করে ব্রাউন পেপারের খামের উপর গাম দিয়ে লাগানো আছে । কোন ঠিকানা লেখা নেই প্রেরকের নাম নেই । খামটি উল্টেপাল্টে দেখে কনক চ্যাটার্জী  বললেন — ‘ কে এই খাম দিয়ে গেল অবনী ? ‘
–‘ তা জানি না দাদাবাবু । ‘ বাইরের দরজার তলা দিয়ে খামটা ঢুকিয়ে দিয়েছে । আমি দরজা খুলে কাউকে দেখতে পাইনি । ‘
কনক চ্যাটার্জী  খামটা তৎক্ষণাৎ খুলে ফেলে চিঠি বের করলেন । চিঠি বলতে ছোট রুলটানা খাতার পাতায় পেন্সিল দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা — ‘ তদন্ত বন্ধ হোক না হলে মোবাইলের সিক্রেট বাইরে চালান হয়ে যাবে । ‘ চিঠি পড়া মাত্রই কনক চ্যাটার্জীর চোয়াল শক্ত হয়ে আসে চোখ দুটো জ্বলে ওঠে । কনক চ্যাটার্জী  বিড়বিড় করে বলে ওঠেন — ‘ একবার তোকে হাতের নাগালে পাই । ‘
রাত্রের খাওয়াদাওয়া করে বিছানায় শুলেও ঘুম আসে না । কনক চ্যাটার্জীর মনের মধ্যে অনেক কিছু ভীড় করতে থাকে — ‘ তদন্ত বন্ধ করতে বলেছে কেন ? কোন তদন্তের কথা বলেছে …প্রমিলা মার্ডারকেস ? উনিশ তারিখ সন্ধ্যেবেলায় প্রমিলা খাস্তগীর মার্ডার হন । ঠিক তার পরের দিনই সকালে জিমে আমার ফোন ধরেছিলে কেউ । তারমানে কি আততায়ী আমাকে আগেই টার্গেট করে খুনের ছক কষেছিল । আততায়ী কি ভেবেছে আমাকে ভয় দেখিয়ে তদন্ত বন্ধ করবে ? আততায়ীর এত বুদ্ধি যখন তখন আমাকে এত তাড়াতাড়ি কেন জানিয়ে দিল যে সে আমার সাথে নিয়মিত একই জিমে জিম করে । এতোটা বোকামি কেন করলো ? আমিতো খুব সহজেই জেনে গেলাম আততায়ী রোজ জিমে যায় । এতবড় একটা খুনের ঘটনা যেখানে মিডিয়া পেপারে টিভিতে খুনের খবর বারে বারে প্রচার করার করছে সেখানে খুনের তদন্ত এত সহজে বন্ধ করা যায় নাকি ? এই ভাবে চিঠি পাঠানোটা আততায়ী বোকামী করলো না চালাকি করলো বুঝে উঠতে পারছি না । আচ্ছা , যতই চালাকি করুক না কেন আমি শেষ দেখেই তবে ছাড়বো । কাল হ্যান্ডরাইটিং এক্সপার্টকে দেখাতে হবে চিঠিটা । ‘ …. অবশেষে ক্লান্তির ঘুম দুচোখে নেমেই আসে ।

#####


— ‘ স্যার এই চিঠি দেখে আমি অনেক কিছুই বলতে পারি । যেমন ধরুন হাতের লেখা তিন থেকে চার বছর বাচ্চার । শুধু বাচ্চা নয় চঞ্চল বাচ্চাটি এই দু লাইন লিখতে দুবার লেখা ছেড়ে উঠেছে , এই দেখুন ‘ হলে ‘ লেখার পর ছেড়েছে তারপর আবার লেখা শুরু করেছে । তবে স্যার যুক্ত অক্ষরটুকু বয়ষ্ক ব্যক্তির লেখা । তবে এই দু লাইন লিখতে দুজনে হাত লাগিয়েছে এটা স্পষ্ট । কাগজ দেখে সে রকম কিছু বলতে পারছি না । এই রকম কাগজের খাতা সব দোকানেই পাওয়া যায় । ‘
— আচ্ছা যতটা বললেন তাতেই কাজ হবে । কনক চ্যাটার্জী  হ্যান্ডরাইটিং এক্সপার্ট রাজদীপ সামন্তর ঘর থেকে বেরিয়ে থানার রাস্তা ধরেন ।
এরপরও তিনদিন পার হয়ে গেছে প্রমিলা মার্ডার কেসে কোন সুরাহা হয়ে ওঠেনি । কনক চ্যাটার্জী  যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই রয়ে গেলেন । এদিকে মিডিয়া ঘটনাটাকে  বারে বারে টেলিকাস্ট করায় উপর মহল থেকে চাপ আসতে থাকে । কনক চ্যাটার্জী  ঠান্ডা মাথার মানুষ , ধৈর্য রাখতে জানেন , নিজের প্রতি আস্থাকে ঠুনকো মনে করেন না । আজ রবিবার সকাল থেকে ব্যস্ত আছেন জিমের লাগোয়া মুক্তাঙ্গনে । সেখানে আজ বিশেষ যোগা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে । সবার মধ্যে ম্যাট বিছিয়ে বসলেও কনক চ্যাটার্জীর দৃষ্টি সজাগ । সঙ্গে আছে সন্ধ্যা , তিনি জিমের অফিস রুমে কম্পিটারের সামনে বসে । জিমের উনষাট জন মেম্বারের মধ্যে বাহান্ন জন এসেছে । এক ঘণ্টার ক্লাসে যোগাগুরু বিভিন্ন যোগা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তার উপকারীতা বুঝিয়ে দিচ্ছেন যোগা মেম্বারদের । তবে এই মিটিং কিন্তু কনক চ্যাটার্জীর কোন উপকারে লাগেনি । এতজন লোকের মধ্যে সন্দেহভাজন পত্রপ্রেরকে খুঁজে বের করা কাজটা সহজ ছিল না । তারউপর যোগাগুরুর জিজ্ঞাসাতে ক্যান্সার পেশেন্ট কারোর বাড়িতেই নেই জানা গেছে । কারণ কেউ হাত তুলেনি । সন্ধ্যা জিম মেম্বার প্রত্যেককে কম্পিটার মনিটরে নিরীক্ষণ করেছেন । পরে সব তথ্যই কনক চ্যাটার্জীর সাথে আলোচনা করেছেন । কনক চ্যাটার্জীর সব ভিডিও ফুটেজ দেখে সন্ধ্যাকে বলেন — ‘ খরচা পাতি সবই তো দেখছি বিফলে গেল । কারোর বাড়িতেই ক্যান্সার পেশেন্ট নেই বলছে । ‘
— ‘ স্যার নিরাশ হবেন না , এখনও সাতজনকে আমরা দেখিনি । হতে পারে তারমধ্যে কেউ । ‘
— ‘ তাহলে জিমের ইন্সট্রাক্টর মহাদেবকে ফোন করি । — ‘ হ্যালো , মহাদেববাবু যে সাতজন আসেনি তাদের নাম ঠিকানা ফটো আপনি এই হোয়াটস অ্যাপ নম্বরে পাঠিয়ে দিন । তাদের আপনি চেনেন ? ‘
— ‘ স্যার আমি সব কিছু হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়ে দিচ্ছি । কিছু সেরকম লাভ হবে না । সাতজনের মধ্যে ছয়জনই মহিলা , বয়স আনুমানিক পঁয়তাল্লিশ থেকে ষাটের মধ্যে হবে , ওনারা আর্থ্রাইটিসের পেশেন্ট । ওনারা বিকালে আসেন , সকালে আসা অসুবিধা আছে বলে আসেননি । আর একজন ছেলে আছে সে আসেনি । তাকে ছেলে বলা ভুল হবে স্যার , অদ্ভুত সাজগোজ । কানে মেয়েদের মতো বড় বড় দুল পরে , নেলপলিশ লাগায় । মেয়েলী আচরণ । নাম তন্ময় খাঁড়া । ছেলেটি হেবি ওয়ার্ক আউট করে । কাল কেন আসেনি কিছু জানায়নি ‘ ।
— ‘ আচ্ছা আপনি ইনফরমেশন গুলো পাঠিয়ে দিন আমি দেখে নিচ্ছি । ‘

#####


আজ জিমের মহাদেববাবু ছেলেটির নাম তন্ময় বলাতে কনক চ্যাটার্জীর খটকা লাগে । নামটা কোথায় যেন শুনেছেন । হটাৎই মনে পড়ে যায় গত শুক্রবারে জনার্দনের মুখে শুনেছিলেন ।
গত শুক্রবারে কনক চ্যাটার্জীর নির্দেশে জনার্দন ও সুবিমল দমদম সেন্ট্রাল জেলে গিয়েছিলেন সাত্যকী খাস্তগীরের সাথে দেখা করার জন্য । পিসির মার্ডার হয়েছে জেনে সাত্যকী হতবাক , কিন্তু শোকের ছায়া মুখমন্ডলে পঠিত হয়নি । তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল পিসির উত্তরাধিকার হওয়াতে সমস্ত সম্পত্তি তাঁর হবে কিনা না অন্য কোন ব্যবস্থা করা হয়েছে ?উত্তরে জানিয়েছিল সেই সব সম্পত্তি পাবে । আরো বলেছিল — ‘ এখন সম্পত্তি পেয়ে আর কি হবে ? জেলে খাটা আসামীর দুর্নাম আরতো মুছে ফেলতে পারব না । তখন যদি টাকা পেতাম পিসির কাছ থেকে তাহলে আমাকে আর চুরি করতে হতো না । আমার জীবনটা বরবাদ হয়ে গেল পিসির জেদের জন্য । আমি একটা সফটওয়ার কোম্পানী খুলতে চেয়ে ছিলাম , নিজে স্বাধীন ভাবে রোজগার করতে চেয়েছিলাম । পিসি ব্যবসাতে টাকা ঢালতে অস্বীকার করেছিলেন । পিসি আমাকে বলেছিলেন, ‘ আমার বাবার টাকা আমি নয়ছয় করতে দেবো না। ‘
জনার্দন সেদিন জেলের রেজিস্ট্রার চেক করে দেখে ছিলেন সাড়ে তিন বছরে বাড়ি থেকে প্রমিলা খাস্তগীর একবারও ভাইপোর সাথে জেলে এসে দেখা করেননি । কিন্তু বছরে দুবার করে একজন আসে । নাম তন্ময় খাঁড়া । রিলেশনশিপে কাজিন লেখা ছিল জনার্দন এসে বলেছিলেন ।
কিছুক্ষণ নিজের ভাবনার মধ্যে থেকে বিড়বিড় করে উঠলেন কনক চ্যাটার্জী  — ‘ মহাদেববাবুর তন্ময় খাঁড়া আর সাত্যকী খাস্তগীর কাজিন একই ব্যক্তি নয় তো ! কনক চ্যাটার্জী  হোয়াটস অ্যাপ অন করে ছবি দেখলেন — মুখ ভর্তি দাঁড়ি ওয়ালা আটাশ বছরের একজন যুবকের ছবি । ছবিটা জুম করে দেখে নিলেন । এ রকম কাউকে তো দেখিনি জিমে ! তবে যে মহাদেববাবু বলে ছিলেন ছেলেটির মধ্যে মেয়েলী ব্যাপার আছে , কিন্তু সেটাতো ছবিতে স্পষ্ট নয় । কনক চ্যাটার্জী  এবার ফোন করে সুকান্ত পাত্রকে থানায় আসতে বললেন ।


#####

–‘ এই যে সুকান্তবাবু সেদিন আপনি – ই তো বললেন প্রমিলা খাস্তগীর ঠিকুজি কুষ্টি সব জানেন , তবে সেদিন তন্ময় খাঁড়ার নাম তো একবারও বলেননি । কে এই তন্ময় খাঁড়া , সাত্যকী খাস্তগীরের কাজিন ?
— ‘ সাত্যকীর কাজিন ! আমি তো চিনি না ! সাত্যকীর মামার বাড়ির কেউ হবে হয়তো , প্রমিলার বাড়ির কোন আত্মীয় নয় স্যার ।
— ‘ প্রতিবছর নিয়ম করে বারোই ফেব্রুয়ারী সাত্যকী খাস্তগীরের সাথে দেখা করতে যায় । বলতে পারেন , বারোই ফেব্রুয়ারী কোন বিশেষ দিন কি ? ‘
— ‘ সাত্যকীর জন্মদিন ‘
— ‘ এটাই আন্দাজ করেছিলাম আমি , তাহলে ইনি কাজিন নন , বিশেষ কেউ । ‘
— ‘ সাত্যকীর কোন বান্ধবী ছিল ? ‘
— ‘ আমি জানি না সেই ব্যাপারে । ‘
— ‘ আচ্ছা যেদিন প্রমিলাদেবী খুন হন সেদিন রাত্রে প্রমিলাদেবীর সাথে কেউ দেখা করতে এসেছিলেন ?  কে আসতে পারে আপনি জানেন ? ‘
— ‘ সেদিনের সকাল বেলায় আমি ফোন করেছিলাম প্রমিলাকে কিন্তু সেরকম খবর আমি ওর কাছে পাইনি । আমি তো আগেই আপনাকে বলেছিলাম ভাইরাল ফিভার হওয়ায় মার্ডারের আগের দুদিন ও মার্ডারের দিন নৃত্য এ্যকাডেমিতে যাচ্ছিলাম না । মার্ডারের পরেরদিন দীপেনের ফোন পেয়ে আসি । ‘
— ‘ সুকান্তবাবু খুনিকে আমি আন্দাজ করতে পেরেছি । সে মহিলার রূপ ধরে মার্ডার করতে এসেছিল । সাত্যকীর বিশেষ পরিচিত । ‘
কনক চ্যাটার্জী  সুকান্ত পাত্রর দিকে কথাটা ছুঁড়ে দিয়ে চুপ মেরে গেলেন । কথাটা শোনার পর সুকান্ত পাত্রর মুখমন্ডল কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেল । কয়েক সেকেন্ডে নিজেকে ধাতস্থ করে জিজ্ঞাসা করলেন — ‘ আপনি জানেন খুনি কে ! কে করেছে খুন ? ‘
–‘ দু তিনদিনের মধ্যেই নাম জানতে পেরে যাবেন । আজ আসুন আপনি ।
বেশ চিন্তিত মনেই সুকান্ত পাত্র থানা ছেড়ে বেরিয়ে যাবার পর কনক চ্যাটার্জী  জনার্দনকে ইশারা করলে জনার্দনও থানা থেকে বেরিয়ে যান । জনার্দন না ফেরা অবধি কনক চ্যাটার্জী  থানায় ছিলেন । জনার্দনের সারাদিনের কর্ম পরিক্রমার ফিরিস্তি শুনে অবশেষে কোয়ার্টারে গেলেন ।


#####

কোয়ার্টারে ফিরে এসে আজ ঘরে ঢুকতেই আবারও চোখে পড়লো টেবিলে রাখা একটা ছোট প্যাকিং বাক্স । বাক্সটি বড় জোর ছয় ইঞ্চি বাই তিন ইঞ্চি খানেক হবে । অবনীকে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই অবনী বললেন — ‘ দাদাবাবু , এটি একটি ছেলে দিয়ে গেছে বললেন কুরিয়ার ডেলিভারী করতে এসেছে । আপনি নাকি অর্ডার দিয়েছেন । বক্সের কি আছে দাদাবাবু ? খালি ভিতরে খড়খড় করছে যেন । ‘
কনক চ্যাটার্জী  এবার কাছে গিয়ে বাক্সটাকে ভাল করে দেখলেন । বক্সের দু ধারে পেরেক দিয়ে বা ঐ জাতীয় কিছু দিয়ে ছোট ছোট ফুটো করা আছে । তখনই বাক্সটা আবারও দুলে উঠলো । — ‘ আরে সর্বনাশ করেছে । ‘ বাক্স হাতে নিয়ে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান কনক চ্যাটার্জী  । কোয়ার্টারের বাইরে রাস্তায় নিক্ষেপ করলেন বাক্সটিকে । রাস্তায় দু একজন দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে । — ‘ কি হয়েছে বড়বাবু ? ‘
— ‘ মনে হয় সাপ আছে ‘ … কনক চ্যাটার্জী  পকেট থেকে ছোট ফোল্ডিং ছুরিটা বের করে খুব সাবধানে বাক্সটির একধার লম্বা করে চিরে দিলেন । তারপর একটা লম্বা লাঠি দিয়ে বার কতক ঠোকা মারতেই দুফুটের  একটা ছোট গোখরো হিসহিস করে বেরিয়ে এলো । বেরিয়ে কোথায় যাবে বুঝতে না পেরে ফণা তুলে কুণ্ডুলি পাকিয়ে রইল । — ‘ বড় বাবু মেরে ফেলুন । ‘
— ‘ না না নিরীহ প্রাণী , থাক । ‘ সাপটা কিলবিল করে রাস্তা থেকে নেমে শুকনো ড্রেনে নেমে গেল । কনক চ্যাটার্জী  চোয়াল শক্ত করে সাপটির চলে যাওয়া লক্ষ্য করলেন । মিনিট দুয়েক থম মেরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার পর বাক্সটার কাছে এগিয়ে এসে বাক্সটাকে তুলে ধরে ভিতরটা দেখলেন । ভিতরে ভাঁজ করা একটা কাগজ রয়েছে । কাগজটা বের করে স্ট্রিট লাইটের তলায় মেলে ধরলেন — ‘ সাপের ছোবলে বেঁচে গেলেও আমার হাত থেকে বাঁচবেন না । তদন্ত বন্ধ করুন । ‘ ….. সেই একই ভাবেরুলটানা কাগজে পেন্সিল দিয়ে গোটা গোটা করে লেখা ।
— ‘ দাদাবাবু , তোমাকে মারতে মৃত্যুবান পাঠিয়ে ছিল ! আমি ভাবতেই পারছিনা ! …. ভয়ার্ত অবনী কনক চ্যাটার্জীর পাশে এসে দাঁড়ায় ।
কনক চ্যাটার্জী  বিড়বিড় করে বলে উঠলেন — ‘ বাস্টার্ড , একবার হাতে পাই তোকে , তারপর দেখবি কে কাকে বাঁচায় । ” অবনী শীগগির খেতে দাও আমি এখুনি বেরোবো । ‘ … কনক চ্যাটার্জী  পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ফোন করেন — ‘ রেডী হয়ে নাও , কেউটের ডেরায় বিন বাজাতে হবে । ‘


######

রাত পৌনে একটা বাজে । গলির মোড়ে তিনটে লেড়ি কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে । গাড়ির আওয়াজ পেয়ে কান খাঁড়া করে সজাগ হয়ে ওঠে । তবে মুখে শব্দ নেই । যেন ভাব খানা এমন বিরক্ত না করলে ঘেউঘেউ করতে যাবে কেন ?  ঘিঞ্জি গলির ভিতর আর গাড়ি ঢোকানো উচিৎ হবে না মনে করে বড় রাস্তার ধারে গাড়ি পার্ক করে রেখে হাঁটা শুরু করে ওরা , সুনসান এঁদো গলি, দুপাশ মিলিয়ে পুরনো আমলের লড়ঝরে বারোটা বাড়ি হবে । ওরা চারজন একটা দেড় তলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় ।– ‘ জনার্দন বাড়ির পিছনের পজিশন কেমন একটু সাবধানে দেখে এসো । সুবিমল তুমি আমার কাঁধে চড়ে কার্নিশে উঠে গিয়ে দেখো গ্রিলের দরজা খুলতে পারো কিনা ? ‘
— ‘ স্যার , পিছনে বাড়ির ছাদের সাথে এ বাড়ির ছাদ ঘেঁসাঘেঁসি । পালানোর পক্ষে আইডিয়াল । ‘
— ‘ আসতে কথা বলো , সুবিমল ভিতরে গেছে , তুমি বরং কার্নিশে উঠে ছাদে উঠে ছাদের দরজা তাক করে পজিশন নাও । ‘
মিনিট সাতেকের ভিতর সুবিমল গ্রিলের দরজা খুলতে সমর্থ হলে কনক চ্যাটার্জী  ও সন্ধ্যা বাড়িতে ঢুকে পড়েন । হাতে উদ্ধত রিভলভার । অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘর গুলির প্রথমটায় টর্চ ফেলতে দেখে পাওয়া যায় একজন মহিলা একটা ছোট ছেলে নিয়ে শুয়ে আছে । চোখে আলো পড়তেই ভয়ে ‘ কে ‘ করে ওঠে । — ‘চুপ একটাও কথা নয় , টুঁ শব্দ করলে বুলেট মাথার এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাবে । তন্ময় কোন ঘরে ? ‘
ভয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দেয় — ‘ উপরের ঘরে । ‘
— ‘ সারা বাড়ি পুলিশ ঘিরে রেখেছে চালাকি করার চেষ্টা করবেন না । রতন তুমি তলায় থাকো । পাশের ঘরটা দেখো সন্ধ্যা । আমি উপরে যাচ্ছি । ‘ …কনক চ্যাটার্জী  সিঁড়ির দিকে গেলে সন্ধ্যা পাশের ঘরে টর্চ ফেলে দেখেন একজন বিছানায় শয্যাশায়ী , গায়ে চাদর ঢাকা , মহিলা না পুরুষ বোঝা যাচ্ছে না , মাথা নেড়া । বিছানার তলায় একটা টুলের উপর একটা ছোট গামলা রাখা , টুলের পাশে বেড প্যান রাখা । ঘরটায় কেমন যেন ওষুধ ওষুধ গন্ধ । সন্ধ্যা দেখেই বুঝতে পারলেন এটা কোন পেশেন্টের ঘর । ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দরজা টেনে উপরে শিকল লাগিয়ে দিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোতেই উপর থেকে ধাক্কা ধাক্কির শব্দ শোনা গেল , জিনিস পড়ার শব্দ কানে আসতেই সন্ধ্যা সিঁড়ির প্যসেজের লাইটটা জ্বালায় । খুব সন্তর্পণে উপরে উঠে যায় । ঘরেতে উঁকি মারতেই দেখে কনক চ্যাটার্জী  কালপ্রিটকে মেঝেতে ধরাশায়ী করে ফেলেছে কিন্তু শক্ত মুষ্টিবদ্ধ হাত কনক চ্যাটার্জীর গলায় — ‘ সন্ধ্যা ছাদের দরজা ….সন্ধ্যা দৌড়ে গিয়ে ছাদের দরজা খুলে দিতেই হুড়মুড়িয়ে জনার্দন ভিতরে ঢুকে আসেন । জনার্দন মাথায় রিভলভারটা ঠেকাতেই কালপিট মুষ্টি শিথিল করে । কনক চ্যাটার্জী  পিছুমোড়া করে হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিয়ে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ান । — ‘ এটার মুখ বন্ধ করো জনার্দন , গোখরো সাপ পাঠিয়েছে ! আমাকে ব্ল্যাকমেইল করা ! থানায় চল বাস্টার্ড , তারপর তোকে দেখছি । ‘– ‘ এই বাস্টার্ড বলবেন না …. হুঙ্কার দিয়ে ওঠে কালপিট


#####

সকাল সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে । কন্সটেবল রতন সুকান্ত পাত্রকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন ।
— ‘ আরে সুকান্তবাবু সাত সকালে আপনাকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম ।’
— ‘ স্যার সকাল নয় , ভোররাতে ডেকে আনলেন , কি ব্যাপার স্যার ?
— ‘ হুম ভোর রাত ঠিকই বলেছেন । আপনাকে বলেছিলাম না দু একদিনের ভিতর খুনিকে খুঁজে বের করবোই । সেটা আর অপেক্ষা করলাম না । তা সুকান্তবাবু একটা শিক্ষিত ছেলে এতটা মানসিক বিকৃত হলো কি ভাবে ? ‘
— ‘ কে ছেলে ? কি বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না । ‘
— ‘ সুকান্তবাবু আর ভণিতা করতে হবে না । তন্ময় সব স্বীকার করেছে । আমাকে ব্ল্যাকমেইল করবে , গোখরো সাপ পাঠাবে আমি কি এত সহজে ছেড়ে দেব ? যান একবার লকাপটা দেখে আসুন । যান ! ‘
কনক চ্যাটার্জীর কথা শুনে সুকান্ত পাত্র হতভম্ব , উদভ্রান্তের মতো দৌড়ে যায় লকাপের দিকে । প্রহারে অচৈতন্য তন্ময়কে দেখে পাগলের মতো ছুটে আসে কনক চ্যাটার্জীর কাছে — ‘ স্যার ছেলেটাকে এত্ত মেরেছেন আপনারা ? কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সুকান্তবাবু …
— ‘ আপনি জানতেন যখন আপনার প্রেমিকার খুনি তন্ময় , তখন লুকিয়ে গেলেন কেন ? ‘
— ‘ আমি জানতাম না স্যার সত্যিই বলছি , প্রমিলার মার্ডারের দুদিন পর আমি জানতে পারি । কি করবো বলুন স্যার ? অপত্য স্নেহ ….
— ‘ এরকমটা আমি আন্দাজ করতে পেরেছিলাম , যতবার আপনাকে জেরা করেছি ততবারই তন্ময় আমাকে ধমকি দেওয়া খাম পাঠিয়েছে । দ্বিতীয় বার তো সাংঘাতিক ভাবে ! গোখরো সাপ ছিল পার্সেলের ভিতর । এই খুনের পর ওর ধারণা ছিল সব দোষ হয়তো আপনার উপরে পড়বে , যেহেতু আপনি প্রমিলাদেবীর অনেক কাছের একজন ছিলেন । তাই খুনের পরেরদিনই জিমে গিয়ে আমার মোবাইলে হাত দেয় , আমার সব কন্ট্যাক্ট ওর হাতে চলে যায় । আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে তদন্ত বন্ধ করতে বলে । খুনি এত বোকা হবে আমি ভাবতে পারিনি । আরে এটা গলা কেটে মার্ডার করা হয়েছে , এই ঘটনা আমরা সুইসাইড বলে চালিয়ে দিয়ে তদন্ত বন্ধ করতে পারি না । আমি তদন্ত থেকে সরে গেলেও অন্য অফিসার এসে তদন্তের ভার নেবে । সেক্ষেত্রে তদন্ত বন্ধ হবেনা কখনও । এটাই খুনির প্রথম ভুল । যখনই আপনাকে জেরা করা হচ্ছে তারপরই খুনি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছে এটা খুনির দ্বিতীয় ভুল । আর তৃতীয় ভুল ছিল কনক চ্যাটার্জীর পরিচয় সঠিক ভাবে না জেনেই কনক চ্যাটার্জীর মোবাইলে হাত দিয়েছিল । এবার আপনি বলুন এত আক্রোশ কেন জন্মেছিল তন্ময়ের ? আপনার সাথে তন্ময়ের সম্পর্ক কি ? চুপ করে থাকবেন না , কথা বের করতে আমি কিন্তু খুব ভালই জানি । ‘
সুকান্ত পাত্র চোখের জল মুছে মৌনতা ভাঙ্গলেন — ‘ তন্ময়ের সাথে সাত্যকীর  একটা সম্পর্ক আছে । আজকাল সমাজে সমকামীতা সম্মতি লাভ করেছে । কিন্তু প্রমিলা সম্মতি দেয়নি । সাত্যকীর সাথে তন্ময়ের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে আলাপ , তারপর দুজনের ঘনিষ্ঠতা আট বছরে আরো সুদৃঢ় হয় । দুজনেই খুব মেধাবী ছাত্র ছিল , ওরা একই অফিসে কাজ করতো । সেখানে ওদের এই সম্পর্কের কারণে অনেক ব্যঙ্গ বিদ্রুপের সম্মুখীন হতে হয় । ওরা ঠিক করে চাকরী ছেড়ে দিয়ে নিজেরা স্বাধীন ব্যবসা করবে । সাত্যকী ব্যবসা করার জন্য ওর পিসি মানে প্রমিলার কাছে টাকা চেয়ে ব্যর্থ হয় । তন্ময় জানতো আমি ওর পালক পিতা । ছোটবেলা থেকে ওর সমস্ত দায়িত্ব আমি নিয়ে ছিলাম সেই কারণে ভদ্রতার খাতিরে আমার কাছ থেকে কোন দিন অতিরিক্ত কিছুই চায়নি তন্ময় । ওরা যে কোম্পানীতে চাকরী করতো সেই কোম্পানীতে জালিয়াতি করে , তবে সেটা সাত্যকী করেনি,  করেছিল তন্ময় । তন্ময়ের ভুল সাত্যকী নিজের ঘাড়ে নেয় । এর এক অদ্ভুত কারণ ছিল , সাত্যকীকে  ভালবেসে তন্ময় নিজেকে ততদিনে পুরোপুরি মেয়েলী সত্ত্বায় আবিষ্ট করে ফেলেছিল । এই কারণে জালিয়াতি প্রকাশ্যে এলে সাত্যকী ভয় পেয়ে যায় । সাত্যকীর ধারণা হয়েছিল তন্ময় জেলে গেলে জেলের কয়েদীদের  দ্বারা অত্যাচারীত হতে পারে । সেই জন্য জালিয়াতির সব ডকুমেন্ট নিজের নামে চালিয়ে দেয় এবং সাত্যকী ধরা পড়ে , জেল হয় । ওদের পরস্পরের প্রতি ভালবাসা ভীষণই প্রগাঢ় ছিল । ওরা শুধুমাত্র এক সাথে থাকতে চেয়েছিল । সাত্যকী জেলে যাবার পর তন্ময় ভীষণই ভেঙ্গে পড়ে চাকরী ছেড়ে ঘরে বসে থাকতো । ওর পালিতা মাতৃসম মাসি দুবছর ধরে ক্যান্সারে আক্রান্ত । একসময় জমানো টাকা পয়সা শেষ হতে শুরু করে , দারিদ্রতার সম্মুখীন হতে লাগলো ওরা । তন্ময়ের রাগ ক্ষোভ বাড়তে থাকে । প্রমিলার সাত্যকীর প্রতি বিরূপ মনোভাব তন্ময়ের আক্রোশ আরো বাড়িয়ে দেয় । সাত্যকী জেলে যাবার পর তন্ময় নিজে গিয়েছিল প্রমিলার কাছে প্রমিলাকে বোঝাতে , যদি প্রমিলা বিপুল অর্থ দিয়ে মুচলেকা করিয়ে সাত্যকীকে  ছাড়িয়ে আনে । কিন্তু প্রমিলা অত্যন্ত অপমান করে তন্ময়কে তাড়িয়ে দেয় । ‘
— ‘ সমকামী প্রেমের গল্প ! কিন্তু এটা এখনও বললেন না আপনার সাথে তন্ময়ের কি সম্পর্ক ? কি কারণে এত বছর ধরে আপনি তন্ময়কে টাকা দিয়ে আসছেন ? এমনকি গত দু বছর ধরে কখনও আশি হাজার কখনও দেড় লাখ করে টাকা দিয়ে এসেছেন , সম্ভবত কিণ্ণর মাসির চিকিৎসার জন্য । ঠিক বলছি তো আমি ? ‘
— ‘ তন্ময়ের সাথে সাত্যকীর  সম্পর্ক থাকুক সেটা আমিও চাইনি । বারবার তন্ময়কে ডেকে এনে বুঝিয়েছি কোন লাভ হয়নি । তারপর বাধ্য হয়েই তন্ময়কে সত্যটা বলে ফেলেছি । ফলস্বরূপ প্রমিলাকে মার্ডার হতে হলো । ….কথা গুলো বলেই সুকান্ত পাত্র আবারও কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন । সুবিমল এগিয়ে এসে সুকান্তবাবুর হাতে এক গ্লাস জল তুলে দেন । মিনিট খানেক পরে ধাতস্ত হয়ে বললেন — ‘ অফিসার্স আর যাই বলুন না কেন তন্ময়কে বাস্টার্ড বলে গালি দেবেন না । তাতে আমিও তন্ময়ের মতন  আহত হই । তন্ময় আমার আর প্রমিলার সন্তান । প্রমিলার সাথে আমার বিয়েটুকুই যা হয়নি । সব ঠিক থাকলে আমাদের প্রেমেও পরিণতি পেত, বিয়ের শীলমোহর পড়তো । যৌবনে আমাদের মেলামেশায় প্রমিলা গর্ভবতী হয়ে পড়ে । প্রমিলার বাবা আমাদের বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন । কিন্তু বেঁকে বসে প্রমিলা , সে কিছুতেই গর্ভাবস্থায় বিয়ে করতে রাজি হয়নি । কারণ ছিল এই বিবাহ সনাতন ধর্মের বিরোধী। আমরা সবাই অপেক্ষা করি ডেলিভারী দিনটার জন্য । সেইদিনে ঘনিয়ে এলো আমার আর প্রমিলার জীবনের বিপর্যয় । প্রমিলা একটি সুস্থ সন্তান জন্মদিয়েছিল । কিন্তু আমাদের দূর্ভাগ্য , জন্ম নিল কিন্নর । এতদিনের অপেক্ষা আমাদের নষ্ট হয়ে গেল । প্রমিলা শিশুটিকে দেখে ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে নেয় , শিশুটিকে কোলে তুলে মাতৃদুগ্ধ দিতে অস্বীকার করে , ছুঁয়েও পর্যন্ত দেখেনি । নার্সিংহোমে বাচ্চা ছেড়ে বাড়ি চলে আসে । নার্সিংহোম থেকে আমি শিশুটিকে বাড়ি নিয়ে আসি , মাস খানেক নিজের কাছেই রাখি । বাড়িতে আমার বাবা মাও তীব্র বিরোধীতা করে । তারপর যা হয় বাধ্য হয়েই শিশুটিকে কিন্নর সমাজে দিয়ে আসি । কিন্তু আমি দিপালীদি মানে তন্ময়ের পালিতা কিন্নরমাসিকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলাম । আমার সন্তান রেল স্টেশানে কিংবা ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে তালি বাজাবে না । ও পড়াশোনা করবে বড় হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবে । আমি সমস্ত খরচ দেবো এবং এখনও দিচ্ছি । তন্ময় ছোটবেলা থেকে জানতো আমি মানবতার খাতিরে ওর সকল ব্যয়ভার গ্রহণ করেছি । সাত্যকী আর তন্ময় দেখতে গেলে একই রক্তের ভাই । তাই আমিও ওদের সম্পর্কের বিরোধীতা করি , প্রমিলার পক্ষ নিই । প্রমিলা কিন্তু জানতো না সাত্যকীর  সাথে যার সম্পর্ক সে আসলে পুরুষ নয় তাঁরই কিন্নর সন্তান । প্রমিলা মার্ডারের দিন পনেরো আগে আমিই বাধ্য হয়েই তন্ময়কে ওর জন্ম বৃতান্ত জানাই যে কেন আমি এই সম্পর্কে সম্মতি দিতে অপারগ ।তন্ময় ওর জন্ম বৃতান্ত শোনার পর প্রমিলার প্রতি আক্রোশে ফেটে পড়ে । তখন আমি একবারও বুঝতে পারিনি তন্ময় তাঁর নিজের মাকে হত্যা করবে । ওর জন্ম বৃতান্ত যদি আমি না জানাতাম তাহলে প্রমিলাকে মার্ডার হতে হতো না । শেষ ভুলটা আমিই করলাম । আমার জন্যই তন্ময় আজ মাতৃহন্তা হলো । সবকিছু তছনছ হয়ে গেল , তন্ময়কে আমি সুরক্ষা দিতে পারলাম না ।
— ‘ এবার বুঝলাম জিমের ছেলেটির সাথে প্রমিলাদেবীর নাক চিবুক ঠোঁটের এত কি করে মিল হতে পারে । ‘ ….. কনক চ্যাটার্জী  ধীর পায়ে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে লকাপের গারোদের সামনে এসে দাঁড়ালেন । লকাপের দরজা খুলে এক গ্লাস জল নিয়ে ঢোকেন । প্রচুর মার খেয়ে রক্তাক্ত তন্ময় এখন লকাপের মেঝেতে উঠে বসেছে , সারা গায়ে রুলের বাড়িতে কালসিটে পড়ে গেছে । কনক চ্যাটার্জী  জলের গ্লাসটা তন্ময়ের মুখের কাছে এগিয়ে ধরেন — ‘ ক্ষমা চাইছি , তোমাকে বাস্টার্ড বলা আমার উচিৎ হয়নি । ‘ …. তন্ময় জলের গ্লাসটা হাতে নেবার পর কনক চ্যাটার্জী  পকেট থেকে রুমালটা বের করে সস্নেহে তন্ময়ের ঠোঁটের কষ থেকে চুয়ে পড়া রক্তের ফোঁটাটা মুছে দিলেন , — ‘ সত্যি তো জন্মের উপর কোন মানুষেরই তার নিজের হাত থাকে না , যা থাকে তা হলো অদৃষ্ট । তোমার মতো একজন মেধাবী কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারের হাতে আমার মোবাইল চলে যাওয়াতে আমি ক্ষেপে উঠি , আমার চাকরী জীবনে কেউ আমার সততা নিয়ে ছেলে খেলা করবে এটা আমি মেনে নিতে পারিনি , তাই বড্ড বেশি মেরে ফেলেছি তোমাকে । কিন্তু তুমি এত নির্মম ভাবে হত্যা করলে কেন তন্ময় ?
— ‘ অফিসার , প্রশ্ন করা খুবই সহজ । জীবন যন্ত্রণা আমি ভোগ করেছি । মা বাবা থেকেও আমি সমাজের চোখে জারজ । আমি কিন্নর হয়ে জন্মেছি তাতে আমার দোষ কোথায় ? প্রমিলা সুকান্ত , দুজনেই দুজনের হয়ে থাকলো শুধু আমাকে ওরা ছুঁড়ে ফেলে দিল । আর ওই প্রমিলা খাস্তগীর শুধু আমাকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দেয়নি আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুকেও আমার কাছ থেকে সরিয়ে রাখলো । সাত্যকী , প্রমিলা খাস্তগীর কাছে নিজের ন্যায্য টাকা চেয়েছিল , ওর দাদুর সম্পত্তির উপর সাত্যকীরও অধিকার ছিল । প্রমিলা খাস্তগীর সাত্যকীকে তাঁর পৈত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল । একটা ভদ্র শিক্ষিত ছেলেকে জেলের ঘানি টানতে হলো । আমাদের দুজনের জীবন তছনছ করে দিয়েছে প্রমীলা খাস্তগীর । এই নির্মম পীড়া আপনারা দেখতে পেলেন না ! আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন আমি এত নির্মম ভাবে হত্যা করেছি ? আমার কি তখন মাথার ঠিক ছিল ? ‘
— ‘ তন্ময় সাত্যকীর ঘরে কি খুঁজে ছিলে তুমি  ? কি ছিল সেখানে ? ‘
— ‘ আমার আর সাত্যকীর ছবি । ‘
— ‘ ও আচ্ছা । তন্ময় , আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো যাতে তোমার ফাঁসি না হয়ে যাবজ্জীবন হয় যেন । তোমার পক্ষ থেকে যে সরকারী উকিল থাকবে তাঁকে আমি সম্পূর্ণ রূপে সহযোগিতা করবো , কথা দিলাম । ‘
লকাপ থেকে বের হতেই সুবিমল এগিয়ে এসে কনক চ্যাটার্জী কে জিজ্ঞাসা করলেন –‘ স্যার এই কিন্নর পূরাণে কাল রাতেই যবনিকাপাত ঘটবে কি করে জানলেন ? ‘
— ‘ ভাল বলেছো ‘ কিন্নর পূরাণ ‘ । সবই অদৃষ্টের খেলা । আমার খবরি , কাল রাতে আমায় খবর দিল দুদিন তন্ময় পাত্র ওরফে তন্ময় খাঁড়া সুকান্তবাবুর সাথে দেখা করেছিল । ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলার সাথে সাথেই তন্ময় সুকান্তবাবুর সাথে দেখা করে । জিম থেকে আগেই ঠিকানা পেয়েছিলাম , আর খবরি তন্ময়ের পিছু নিয়ে দেখে এসেছিল তন্ময়ের বাড়ি কোথায় । দুটো ঠিকানা যে একই ঠিকানা জানতে পারলাম । ওই বাড়িতে হেল্থ সেন্টারের কর্মী সেজে খবরি যায় এবং জানতে পারে ওই বাড়িতে একজন ক্যানসার পেসেণ্ট আছে । শুধু তাই নয় , ওই বাড়িতে বছর চারেকের  একটি বাচ্চা ছেলেকে ঘরেই খেলা করতে দেখেছিল খবরি । আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওই বাচ্চাটিকে দিয়ে তন্ময় হুমকির চিঠি লিখিয়ে ছিল । পার্সেলে গোখরো সাপ আসার পর মাথায় রোখ চেপে গিয়েছিল আমার। ঠিক করলাম তন্ময়ের বাড়ি সার্চ করতেই হবে । কালপ্রিট ওখানেই আছে । তাছাড়া মার্ডার উইপেন ঐ ধারালো ছোরা আর পরচুলা তো ওখান থেকেই পাওয়া গেল । সেক্ষেত্রে আমার আন্দাজ ঠিকই ছিল । আর বৃহন্নলাদের পাড়ায় ঢোকা মাঝ রাত্রিতেই নিরাপদ । জানোতো ওরা হচ্ছে ভীমরুলের চাক , একবার ঢিল পড়লেই সর্বনাশ । তন্ময় প্রফেশনাল কিলার নয় , চরম স্পর্শকাতর পরিস্থিতি তন্ময়কে হত্যাকারী বানিয়েছে । ছেলেটা ইচ্ছে করলে পালিয়ে যেতে পারতো কিন্তু যায়নি কারণ বাড়িতে তার মৃত্যুপথযাত্রী পালিতা মাসি রয়েছে তাঁকে ফেলে যায় কি ভাবে ? অথচ আমাদের ভদ্র সমাজের অনেক মা নিজের সন্তানকে ছুঁড়ে ফেলতে দ্বিধা বোধ করে না । মা বাবা থাকা সত্ত্বেও জারজ হয়ে কিন্নর সমাজে প্রতিপালিত হয়ে কতই না অপমান সহ্য করতে হয়েছে তন্ময়কে । তাছাড়া প্রাণ প্রিয় বন্ধুকে হাজতবাস করতে দেখেও ভেঙ্গে পড়ে তন্ময় । প্রমিলাদেবীর বিরূপতাকে শেষ অবধি আর মেনে নিতে না পেরে হত্যা করে বসলো তন্ময় । এই হলো তোমার ‘ কিন্নর পূরাণ ‘ এর সারাংশ ।

সমাপ্ত ॥

কলমে : শুভ্রা রায়

Write and Win: Participate in Creative writing Contest and win fabulous prizes

8 COMMENTS

  1. দুর্দান্ত একটি রহস্য গল্প পড়লাম … এধরণের গল্প / উপন্যাস নিয়ে ভালো web series হলে ভালো হয় .

  2. পড়ে মুগ্ধ হলাম। রহস‍্যের জাল বিস্তারে পাঠক হিসাবে বেশ আনন্দ পেয়েছি।

    একটা ব‍্যপার আমার খুব ভাল লেগেছে, লেখক কনক চ‍্যটার্জী চরিত্রটিতে সরকারী অফিসারের আইনী দায়বদ্ধতা ও দুঁদে গোয়েন্দার প্রখর বিশ্লেষনী ক্ষমতা, দুটোই একাধারে আরোপ করতে সমর্থ হয়েছেন।

    আগামীর অপেক্ষায় রইলাম, অনেক সাধুবাদ।।

  3. পড়ে মুগ্ধ হলাম। রহস‍্যের জাল বিস্তারে পাঠক হিসাবে বেশ আনন্দ পেয়েছি।

    একটা ব‍্যপার আমার খুব ভাল লেগেছে, লেখক কনক চ‍্যটার্জী চরিত্রটিতে সরকারী অফিসারের আইনী দায়বদ্ধতা ও দুঁদে গোয়েন্দার প্রখর বিশ্লেষনী ক্ষমতা, দুটোই একাধারে আরোপ করতে সমর্থ হয়েছেন।

    আগামীর অপেক্ষায় রইলাম, অনেক সাধুবাদ |

  4. দুরন্ত রহস্য গল্প। লেখিকা কে অভিনন্দন জানাই। আরো লিখো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here