রাজশেখর বাবু ক্লাবে ঢুকেই বললেন, “উঃ! কি ঠাণ্ডাটাই না পড়েছে ! হাড়গোড়গুলো সব জমে গেল গা !”

গলাটা খাটো করে দ্বিজেন রায় বললেন, “আজ বৌমার হাতের গরম চা জোটেনি বোধহয়!”

আর কেউ কিছু বলার আগেই লোডশেডিং হয়ে গেল। গরমকাল নয় সুতরাং ভয় নেই।

রাজশেখর বাবু ক্লাবটা যখন প্রতিষ্ঠা করেন তখন তিনি মাত্র বারো বছরের বালক। ক্লাবের নাম বালক সঙ্ঘ হলেও, রাজশেখর বাবু অথবা ক্লাবের কোন সদস্যই আর বালক নেই সকলেরই বয়স প্রায় আশি ছুঁইছুঁই!

ৎক্ষনাৎ মোমবাতি জোগাড় হয়ে গেল। চারিদিক কুয়াশার নিস্তব্ধতায় মোড়া। মাঝেমাঝে দুটোএকটা গাড়ির শব্দ আর দুর্ভেদ্য অন্ধকারকে ভেদ করে আসা ঝিঁঝিঁর ডাক শোনা যাচ্ছে।

স্তব্ধতা কাটিয়ে বিপিন বাবু বললে, “আজও নির্মল আসেনি তাইনা ?”

এসেছি তো !” দরজার কাছ থেকে নির্মল বাবুর কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

তা এত দিন ছিলি কোথায় ? কতবার ফোন করেছি জানিস!একবারও ফোন তুলিসনি!” বেশ একটু রেগে গিয়েই রাজশেখর বাবু বললেন।

একটু থেমে রাজশেখর বাবু আবার বলে চললেন, “ আমাদের সবারই ইহকাল গিয়ে পরকালে ঠেকেছে। দেখতে দেখতে তো দুটো বন্ধুকে হারালাম, তাই তোদের জন্য চিন্তা হয়, এই আরকি। বলতে বলতে রাজশেখর বাবুর দুই চোখের কোলে দুফোঁটা গরম জল এসে পরে।

নির্মল বাবু কিছুই বললেন না। সামনে রাখা চেয়ারে বসে পড়লেন।

সতীশ বাবু পরিস্থিতি হালকা করতে বললেন, “ঠিক আছে, এবার সবাই যখন এসেই পরেছি তখন আর কোন চিন্তা নেই। এবার বল তো আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় কি হবে?”

রাজশেখর বাবু , সতীশ বাবুর কানেকানে বললেন, “আজ বিপিনটাকে জব্দ করা যাবে !”

হাসি চেপে এবার সকলকে শুনিয়েই রাজশেখর বাবু বললেন, “ আজ যখন লোডশেডিং, পরলোক চর্চাটাই হো! কি বলিস রে বিপিন !”

বিপিন বাবু কাঁপাকাঁপা গলায় বললে, “ বুড়ো বয়সে তোর ভীমরতি ধরেছে! তুই তো জানিস ছেলেবেলা থেকেই ভুভুভুতের নাম শুনলেই আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া য়ে যায় ! তবে কেন এই বুড়ো বয়সে শাস্তি দিতে চাস ল্ তো !”

বিপিন বাবুর কথা শেষ হতে না হতেই অন্ধকার ক্লাবঘর প্রচণ্ড হাসিতে কেঁপে উঠল। সতীশ বাবু হাসি থামিয়ে গম্ভীরভাবে বললেন, “ঘর অন্ধকার, গোল টেবিল তার মাঝখানে মোমবাতি, এটাই কিন্তু প্ল্যানচেটের আইডিয়াল অ্যাটমোস্ফিয়া!  বিদেহী আত্মারা কি আমাদের ডাকে সাড়া দেবে? তা এই বিষয় আমাদের নির্মল বাবুর কি বক্তব্য ?”

নির্মল বাবু সংক্ষেপে উত্তর দিলেন, “তারা মানুষের ডাকে সাড়া দেয়।

শুনেই রাজশেখর বাবু বল্লেন, “বাবা তুই আবার কবে থেকে ভুতে বিশ্বাসী হলিরে?”

সঙ্গেসঙ্গেই আর এক প্রস্থ হাসির ঠেলায় মেতে উঠল ক্লাবঘর। আবার কর্পূরের মতো উবেও গেল।

সতীশ বাবু বললেন, “আচ্ছা তোদের নিখিলেশ কে মনে আছে?”

বিনয় বাবু উত্তরে বললেন,  সেই নিখিলেশ তো, যে পুকুরে ডুবে মরেছিল?”

সতীশ বাবু বলতে শুরু করলেন, “হ্যাঁ, সেই নিখিলেশ। সে আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল। তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। হঠাৎ একদিন শুনলাম নিখিলেশ কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রায় তিন দিন পর রায়দের পুকুরে তার ফুলেফেঁপে ওঠা পচাগলা দেহটা ভেসে উঠল। প্রিয় বন্ধুকে হারানোর শোকে খুব কেঁদেছিলাম সেদিন।

তারপরে বছর পাঁচেক কেটে গেছে। নিখিলেশকেও প্রায় ভুলেই গেলাম। তখন আমি সবে কলেজে ভর্তি হয়ছি। এমনি একদিন কি একটা কারণে রায়দের সেই পুকুরটার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি একটা ছোট্ট ছেলে, ঠিক সেই ক্লাস সেভেনে পড়া নিখিলেশের মতো দেখতে, পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে আমায় হাত নেড়ে ডাকছে। তারপর শুধু কানে ভেসে এল একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর,” কিরে! প্রিয় বন্ধুকে ভুলে যাসনি তো?”

তারপর যখন জ্ঞান ফিরল তখন মা মাথায় জল পট্টি দিচ্ছেন, ধুম জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, আর গা,হাত, পায়ে অসহ্য ব্যথা।

পুকুর ধারে কেন অজ্ঞান হয় পড়েছিলাম সেটা বাড়ির কাউকে আর বলিনি। শুধু বলেছিলাম মাথা ঘুরে সাইকেল থেকে পড়ে গেছিলাম। তারপর থেকে আর অবশ্য এরম কোন দিন হয়নি।

এতক্ষণ সকলে চুপ করে সতীশবাবুর কথা মন দিয়ে শুনছিলেন। এবার বিনয়বাবু বললেন, “ঘটনাটার জন্য কি সত্যিই নিখিলেশের আত্মা দায়ি ? তোর সাবকনশাসও তো হতে পারে!”

সতীশবাবু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, “হ্যাঁ, হতেই পারে।

বিপিনবাবু বললেন, “ঠিক আছে আজকের মতো এখানেই খান্ত দাও। কাল বার হবে, আজ অনেক রাত হল। আর ঠাণ্ডাটাও বেশ বাড়ছে।

সকলে সম্মতি জানিয়ে একে একে যেযার বাড়ি চলে গেলেন।

রাতের খাওয়া শেষ করে এবার রাজশেখর বাবু শুতে যাবেন। এমন সময় তাঁর ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রীনে ভেসে উঠেছে নিখিল বাবুর ছেলের নাম।

ফোনটা ধরতেই ধার থেকে নিখিল বাবুর ছেলের গলা ভেসে এল, “কাকু, বাবা আর নেই ! আজ দুপুরে হাসপাতালে নিয়ে যেতেযেতেই…”

সদ্য পিতৃহারা ছেলেটা কান্নায় ভেঙে পড়ল। আতঙ্কে রাজশেখর বাবুর গলা দিয়ে কথা সরলো না! এত ঠাণ্ডাতেও রাজশেখার বাবুর কপালে ঘামের ফোঁটা দেখা দিল

রাজশেখর বাবুর কানের কাছে ফিসফিস করে কে যেন বললে, “সাবকনশাস!”

 

কলমে ঈশিতা চট্টোপাধ্যায়

Jooble Presents Quarterly Creative Writing Competition

8 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here