চন্ডরাজার বলি – উপন্যাস : সংখ্যা ২

1
1242

<<প্রথম সংখ্যা           

( ৪ )

তপন টেবিলের ওপর রাখা সিগারেটের প্যাকেটটা আমার দিকে এগিয়ে ধরল, বললাম –তোকে তো বলেইছি আমি এসব ছেড়ে দেবার চেষ্টা করছি। তপন সামান্য হেসে বলল – তা চেষ্টাটা একদিনের জন্য স্থগিত রাখলে হয়না, একা একা সিগ্রেট খেতে একদম ভালো লাগে না, আমার জন্য নাহয় একটা! কি আর করি? লোকে অনুরোধে ঢেঁকি গেলে আমি নাহয় একটা সিগারেট খেলাম, অগত্যা একটা তুলেই নিলাম, তপন লাইটার জ্বেলে মুখের সামনে তুলে ধরল, অনেকদিন পরে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললাম –কিন্তু পঁয়ষট্টি বছরের বুড়োর বাইশের তরুণী জুটল কি করে? তপন মুচকি হেসে বলল –টাকার জোরে কি না হয়! পরে শুনেছিলাম ওটা মোড়লের তৃতীয় পক্ষ, আগের দুটো বউও কিন্তু বহাল তবিয়তেই বেঁচে আছে, এই মেয়েটির বাবা সম্ভবত মোড়লের কাছে কিছু টাকা ধার করেছিল, তারপর বুঝে নিতে হবে। -হুম! বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বললাম –কিন্তু এদিকে যে রাত প্রায় সাড়ে নটা। এবার আমার যাওয়া উচিৎ, নাহলে বাস মেট্রো কিছুই পাব না, তবে তোর গল্পটা নেহাত মন্দ লাগছে না, আর কতটা বাকি আছে? তপন আমন্ত্রণের সুরে বলল -তার থেকে থেকেই যা না ভাই, একটা রাতের তো ব্যাপার, তোর জন্য কাচা পায়জামা-পাঞ্জাবি রাখা আছে, তেমন অসুবিধে কিছু হবে না। আর সামান্য অসুবিধে হলেই বা কি! অনেক দিন পর পুরনো বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা মারতে মন্দ লাগছিল না, ভেবে দেখলাম রাতটা থেকে যাওয়াই যুক্তিসঙ্গত। তপন খুশি হয়ে বলল তাহলে তুই জামা কাপড়টা পালটে আয়, আর আমি বৃন্দাবনকে বলি আর এক রাউন্ড চায়ের ব্যাবস্থা করতে। তপন হাঁক পাড়তে বৃন্দাবনই আলো দেখিয়ে পাশের ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে দেখলাম মোটামুটি ব্যাবস্থা করাই আছে। ঝাড়পোঁছ করা পরিছন্ন ঘরটা জুড়ে খাটের ওপর বালিশ, চাদর পরিপাটি করে মেলা, আলমাড়ী থেকে পায়জামা পাঞ্জাবি বের করে খাটের ওপর রেখে বৃন্দাবন চলে গেল। আমি ঘরের লাগোয়া বাথরুমে গিয়ে কল খুলে দিলাম, যা আশঙ্কা করেছিলাম তাই হল, কলে জল নেই, তবে বাথরুমের কোনে দেখলাম দু-বালতি জল ধরে রাখা, ভালো করে হাত মুখ ধুয়ে, গায়ে পোশাকটা চড়িয়ে তপনের ঘরে ফেরত এলাম। তপন চায়ের সরঞ্জামগুলো ঘাটাঘাটি করছিল, আমাকে দেখে বলল –বৃন্দাবন চা একটু বেশী করে ফেলেছে, মনে হয় দুকাপ করেই হবে। বললাম –মন্দ কি! চা অধিকান্ত না দোষায়! তপন বিস্কুটের প্লেটটা এগিয়ে দিতে একটা গোটা ক্রীম ক্রেকার মুখে চালান করে চিবুতে চিবুতে বললাম –তবে যাই হোক না কেন, শীতের সন্ধ্যায় তোর ভুতুড়ে গপ্পোটা কিন্তু জমে উঠেছে এবার আর ব্রেক না কষে বাকিটুকু চালিয়ে যা। তপন আমার কথায় চটে গেল না, উল্টে অদ্ভুত একটা হাঁসি ওর ঠোঁটের কোনে খেলে গেল। রহস্যভরা কণ্ঠে বলল –জয়ন্ত আজকের এই রাত্তিরটা কেটে ভোঁর হবার আগেই আমার প্রতিটা কথাই যে ধ্রুব সত্য সে বিশ্বাস যে তোর হবে সেটা নিশ্চিত। তপনের কথায় উত্তরে হাই তুলে বললাম –বেশ চ্যালেঞ্জটা নেওয়া গেল, তারপর শিকারের অভিজ্ঞতাটা শুনি!

তপন বলতে শুরু করল –ত্রিলোচনের কথামতো রাত আটটা নাগাদ মন্দিরের কাছে পোড়া বটতলার থানে গিয়ে হাজির হলাম। যদিও ওদের এই অভিযানে আমি সামিল নই, তাহলেও ভাবলাম একবার গিয়েই দেখি যদি ত্রিলোচনের মত পাল্টায় তাহলে বেশ একটা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হবে। পোড়া বটতলায় দিনের বেলা আগেও কয়েকবার গেছি কিন্তু রাতে গিয়ে যা দেখলাম তাতে বুকের ভিতরে ছ্যাঁত করে উঠল। জঙ্গলের মধ্যে গ্রামটা দিনের বেলাতেই নিস্তব্দ নির্জন থাকে, আর রাতে তো কথাই নেই, সূর্যাস্ত হতেই ঘরে ঢুকে কুলুপ আটাই এখানকার রেওয়াজ। এখানকার মানুষ ভুত প্রেত জিন পরী সমেত সবকিছুতেই বেজায় বিশ্বাসী, আর রাতের অন্ধকারে এই পোড়া বটতলায় একা দাঁড়িয়ে, আমিও নির্দ্বিধায় হলপ খেয়ে বসলাম যে ওসব ঘোর বাস্তব। চারধারে তাকিয়ে দেখে মানুষ তো দুরের কথা কোথাও একটা জন্তু কিম্বা পাখিও চোখে পড়ল না। এদিকে একটানা ঝিঁঝিঁর ডাকে কানে তালা লাগার যোগার। গ্রামের বস্তি এখান থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে, ফেরত যাব নাকি ভাবছি এমন সময় ওখান থেকে একটা চলমান আলোর ফালি চোখে পড়ল, আলোর রেখাটা দুলতে দুলতে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে এগিয়ে আসতে লাগল।

কয়েক মিনিট পরে ত্রিলোচন আর মোড়ল এসে হাজির হল। ত্রিলোচন আমাকে দেখে হাসল –তু বাবু বড় ঢীট আছিস দেখছি, এই জঙ্গলে কীসের শিকার করবি, শেষে নিজেই না শিকার হয়ে যাস। উত্তর দেওয়া নিষ্প্রয়োজন, চুপ করেই রইলাম। ত্রিলোচনই বলে চলল –উই হারামজাদা বাঁকেবিহারী দানোর ভয়ে ভেগেছে, উর হিসাব আমি পরে লিবো, আজ রাতে তিনজনের দরকার লাগবে, ভাবলাম তবে তরেই লি সেইজন্য তোর আস্তানায় গেছিলাম, গিয়ে দেখি তু শালা সেখানে লাই, তখুনি বুঝেছি তুই হারামী এখানেই থাকবি। মোড়ল কাধের ঝোলাটা নামিয়ে তার থেকে একটা শিশি বের করে সামান্য ঝাকিয়ে ত্রিলোচনের হাতে তুলে দিল, ‘তুলসী আর নিশিগন্ধার রস্‌’, সম্পুর্ন ভেষজ, প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি মস্কিউটো রেপেলেন্ট। ত্রিলোচন প্রথমেই হাতের চেটোয় খানিকটা তেল ঢেলে নিল তারপর সেই তেল বেশ করে শরিরে ঘসতে লাগল। এরকম বারদুয়েক করে শিশিটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমার অবশ্য এসবের প্রয়োজন নেই, জঙ্গলে দরকার লাগতে পারে ভেবে ওডোমস্‌ সঙ্গেই রেখেছিলাম, সেটা কাজে লেগে গেছে। মোড়ল এবার শিশির বাকি রসটা উপুর করে নিজের গায়ে ঢেলে দিল। তারপর দুহাত দিয়ে ভুঁড়ি আর বুকে কচলাতে শুরু করল। ত্রিলোচন ততক্ষণে আলখাল্লার পকেট থেকে গাঁজার কল্কে বের করে টান দিতে শুরু করেছে, পরপর দুটো টান দিয়ে সে খানিক ধাতস্থ হল, কল্কেটা আমার হাতে আসতে আমিও বেশ যুত করে একটা দম্‌ দিলাম, মনের মধ্যে একটা অকারন উদ্বেগের ভাব তৈরি হয়েছিল, দ্রব্যগুণে সেটা তৎক্ষণাৎ মিলিয়ে গেল। ত্রিলোচন আকাশের দিকে চেয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস টেনে বলল –উই আকাশে ম্যাঘ জমছে, বৃষ্টি হব মনি হয়, ঝড়পালার রাতে আবার ভুত পিশাচের শক্তি ব্যাড়ে যায়, তোরা কিন্তু সাবধানে থাকবি, বলে দিলাম। মোড়ল ইতিমধ্যে ঝোলা থেকে অস্ত্রশস্ত্র সব বের করতে শুরু করেছে। পরপর বেরোল দুটো ধনুক, গুচ্ছখানেক তীর, টাঙ্গি আর একটা বড় ছুরি। ত্রিলোচন বলল –দ্যাখ বাবু তোর যেটা পছন্দ হয় তুলে নে, তীর ধনুক দেখে লোভ হয়েছিল, কিন্তু ও জিনিস যে আমার হাতে বাগ মানবে না সেটা বুঝতে অসুবিধে হল না। ছুরিটা হাতে তুলে নিলাম। যা হবার এতেই হবে। আলখাল্লার পকেট থেকে ত্রিলোচন একটা লাল ফুলের মালা বের করল, এই মালাটাই আজ সে মোড়লের মেয়ের গলায় পরিয়েছিল। মালাটা জমির ওপর রেখে ত্রিলোচন বলল –এখন এটাই আমাদের পথ দেখাবে। ত্রিলোচন হাঁটু গেড়ে মালাটার সামনে বসে কড়ে আঙুল ঠেকিয়ে অস্পষ্ট স্বরে মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কেটে যাবার পর সে কোন দুর্বোধ্য ইঙ্গিতে যেন কাউকে আহবান করে সজোরে হাত তালি মারল। অদ্ভুত কাণ্ড! কোথাও একফোঁটা হাওয়া নেই, যাকে বলে একেবারে নিথর অবস্থা অথচ মালাটা ছিটকে গিয়ে একহাত দূরে পড়ল। ত্রিলোচন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হুকুমের সুরে বলল –তোর ঘাটিতে চল্‌, চণ্ডবাবার কিড়ে! মালাটা কোন অদৃশ্য শক্তির বলে এবার রুক্ষ মেঠো রাস্তার ওপর দিয়ে ঘষটাতে ঘষটাতে চলতে শুরু করল। ত্রিলোচন চাঁপা স্বরে বলল –সবাই ওটার পিছে চলো আর সাবধান কেউ টুঁ শব্দটি অবধি করবে না। নির্জন নিস্তব্ধ রাতে গভীর বনের মধ্যে দিয়ে রহস্যময় মালাটার পিছনে ত্রিলোচন ছুটে চলল, তার পিছনে হাতে রাম-দা হাতে মোড়ল, সবার শেষে আমি। মনের কোনে যেটুকু সংশয় ছিল,কর্পূরের মতো উবে গেছে। দুপুর বেলা ত্রিলোচনের কাণ্ডকারখানা দেখে খটকা লেগেছিল, মনে হয়েছিল সবই বুঝি ধাপ্পাবাজি, কিন্তু এখন নিজেকেই যেন ছেলেমানুষ মনে হচ্ছে, নিশুতি এই রাতে একমাত্র ভরসা ত্রিলোচন। জ্যোৎস্না আলোকিত থমথমে রাতে, দুধারে ঘন গাছপালার মাঝখানে দিয়ে মেঠো পথ ঘসে ঘসে মালা এগিয়ে চলেছে, পিছনে আমাদের দলটা। প্রায় আধ কিলোমিটার রাস্তা হবে এভাবে চলার পর পথের একপাশে একটা মোরগঝুটির নুইয়ে পরা ডালের ডগায় মালাটা জড়িয়ে থেমে গেল। সাথে সাথে আমাদেরও চলার গতি স্তব্ধ হল। ত্রিলোচন নাক টেনে যেন কীসের গন্ধ শুঁকল তারপর দারুন রোষে গর্জন করে উঠল –তোর মতলব আমি বুঝেছি! দেখি তুই না যাস ক্যামনে! ত্রিলোচন উচ্চস্বরে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করল, তারপর ফের একবার হাততালি, মালা টুপ করে ডাল থেকে খসে ফের পথ চলা শুরু করল। আমরা আবার ওটাকে অনুসরণ করা শুরু করলাম। অকস্মাৎ মালাটা মেঠো পথ ছেড়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পরল। এবার পথ চলাটা সত্যি কষ্টকর হয়ে পরল। পথ বলতে এখানে অবশ্য আর কিছু নেই, যেখানে সেখানে গজিয়ে ওঠা বুনো ঝোপঝাড় আর পায়ের নিচে লম্বা লম্বা ধারালো ঘাস। একটা কাঁটা গাছে ঘষা খেয়ে হাতের নুনছাল উঠে রক্তারক্তির উপক্রম হল, কিন্তু এখন ওসব ধর্তব্যের মধ্যে আনলে চলবে না। সঙ্গীদের থেকে পিছিয়ে না পরি, জোরকদমে হাটা লাগালাম। বেশ কিছুক্ষণ ধরে কখনও ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে কখনও দেয়ালের মতো পথ আটকে থাকা গাছের শক্ত শক্ত ডাল কেটে চলার মতো পথ বানিয়ে শেষে একটা ন্যাড়া জায়গায় এসে পৌঁছলাম। মালাটা জমির এক কোনে গিয়ে স্থির হয়ে পরল। ত্রিলোচন মন্ত্র পড়তে পড়তে মালাটা হাতে তুলে নিয়ে সুতো ধরে টান দিতেই ফুলগুলো সব ছড়িয়ে পরল। দ্রুত হাতে ফুল গুলোকে একজায়গায় জড়ো করে ত্রিলোচন বলল –শালাকে এখানেই খুন করে পুতে রেখেছে, এই জায়গার মাটি না পেলে উ আত্মাকে ঢীট করা যাবে না। মোড়ল উদ্বিগ্ন স্বরে বলল –দাদাঠাকুর তুমি সবই জানো। ত্রিলোচন আমাদের উদ্দেশ্যে বলল –তোরা দুজনে মন দিয়ে শোন, এবার আমরা ভেন্ন হব, তিনটে করে ফুল আর একমুঠো কবরের মাটি, আমাদের সবার হাতে থাকবে, এখান থেকে তিনকোশ দূরে গেলে জঙ্গলের মাঝে বাবুলালের টিলা পড়বে। সেখানে গিয়ে এই ফুল গুলা জ্বালায়ে দিয়ে আর এই কবরের মাটি টিলার মাটির মধ্যে মিলিয়ে দিলে বিপদ কাটবে। আমি শঙ্কিত হয়ে বললাম –কিন্তু আমরা তো সবাই একসঙ্গে যেতে পারি! ত্রিলোচন নেতিবাচক ভঙ্গীতে মাথা নেড়ে বলল –না তা হয় না, তেমন ধারা নিয়ম নেই। আমি যাব সূতা নদীর ধার ঘেসে, মোড়ল তু উত্তর-পুব দিক ধরে জঙ্গলের রাস্তা ধরবি, আর বাবু তুই পুব দিকে যা, জঙ্গলের মধ্যে এটাই সব থেকে সোজা রাস্তা, সোজাসুজি হাটবি তো সাড়ে তিন কোশ পরে বাবুলালের টিলা পড়বে। তিনটে করে লাল ফুল আর একমুঠো মাটি ত্রিলোচন আমাদের দুজনের হাতে তুলে দিল। আমি রুমাল বের করে তার মধ্যিখানে ফুল আর মাটি রেখে শক্ত করে গিট পাকিয়ে প্যান্টের পকেটে পুরে নিলাম। ত্রিলোচন গম্ভির স্বরে বলল –ওই প্রেতাত্মা কিন্তু আমাদের পেছু নেবে, ভয় দেখাবে, যে ভয় পাবে তাকে মেরে পাঁকে ফেলে দেবে, তুরা কিন্তু ভয় পাবি না, সাহস করে এগিয়ে যাবি, মোড়ল ত্রিলোচনের পা ছুয়ে প্রনাম করে বলল –আজ্ঞা হোক দাদাঠাকুর! তারপর ধীর পায়ে চলতে চলতে জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল। এবার আমার পালা, আমি মনে প্রচুর সংশয় নিয়ে ত্রিলোচনের থেকে বিদায় নিয়ে বললাম –আসছি ত্রিলোচন। ত্রিলোচন আঙুল উচিয়ে দিক নির্দেশ করল –ওই যে বাবু ওই হোল পুব দিক, ওখান দিয়েই সোজা হাটা দিবি। আমার উৎসাহ এরমধ্যে থিতিয়ে এসেছে, কিন্তু সেসব প্রকাশ করে আর কাজ নেই!এগিয়ে যাচ্ছিলাম, ত্রিলোচন পিছন দিয়ে বলে উঠল –একটা কথা বাবু, ভয় খারাপ কিন্তু লোভ আরও বেশি খারাপ, কোন ফাঁদে পা দিবি না, দিলে কিন্তু মরবি। মনে রাখবি এই জঙ্গলে আজকের রাতে সব কিন্তু মিথ্যে, আর হ্যা খরগোসটাকে দেখতে পেলে ছুরি বসিয়ে দিবি, যা বাবু, বেঁচে ফেরত আয়! জয় চণ্ড বাবার জয়।

কি ভয়ংকর নির্জন আর নিস্তব্ধ সাতকোশিয়ার এই জঙ্গল, অরণ্য প্রেমী, যারা অ্যালার্ম ধরে উঠে প্রাতরাশের প্যাকেট আর সফট ড্রিঙ্কের বোতল হাতে নিয়ে হাতির পিঠে চড়ে বা জীপে সওয়ার হয়ে অরণ্য ভ্রমণে অভ্যস্ত তারা গহন গভীর বনাঞ্চলের এমন বীভৎস রুপ কল্পনাও করতে পারবেন না। রক্ষে রাতটা পূর্ণিমা, মাঝ আকাশে একটা গোল থালার মতো চাঁদ উঠেছে। সেটাকে দেখে মনে জোর আনার চেষ্টা করলাম। হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে চোখ ধাধিয়ে গেল সেইসঙ্গে বাজ পড়ার করকড়াত শব্দ। মনে হোল বৃষ্টি হবে। দুপাশে ঘন শাল, শিমূল আর পাইনের সমারোহ, মাঝখানে এক চিলতে সরু মেঠো জঙ্গুলে পথ যার ওপর শুকনো গাছের পাতা ঝরে ঝরে কার্পেটের মতো সৃষ্টি করেছে। প্রতি পদক্ষেপে নিজের পায়ের খস্‌খসে শব্দে নিজেই চমকে উঠছিলাম। কিছুটা পথ এভাবে চলার পর যেখানে পৌঁছলাম সেখানে জঙ্গল আরও গভীর আরও ঘন আকার ধারন করেছে এখানে আর শুধু পায়ের তলায় কার্পেট নয় মাথার ওপর চাঁদোয়ার ব্যাবস্থাও রয়েছে দেখলাম। দুধারের বড় বড় গাছের শাখা প্রশাখা গুলো জড়াজড়ি করে ছাতা মতো তৈরি করেছে। এখান থেকে পথ কেমন যেন স্যাঁতস্যাঁতে আর আবছা অন্ধকারাচ্ছন্ন, মাঝে মধ্যে অবশ্য ডালপালার ফাঁকফোকর দিয়ে জ্যোৎস্নার আলো ঠিকরে পড়ছিল, নাহলে হয়ত এগিয়ে চলাটাই দায় হয়ে পরত। হঠাৎ যেন ঘাড়ের পাশটাতে কার গরম নিঃশ্বাস এসে পড়ল। ভয়ংকর চমকে পিছন ফিরে চাইলাম। যতদূর চোখ যায় দেখলাম, কেউ কোথাও নজরে পড়ল না। হয়ত মনের ভুল! ফের চলা শুরু করলাম। মনে একটা অসন্তোষ ক্রমশ দানা বাঁধছিল। আমার ধারণা হয়েছিল ত্রিলোচনের সঙ্গে অভিযানে গিয়ে নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা হবে। কোথায় তির-ধনুক বল্লম হাতে খরগোসের শিকার করব, সেখানে একাকী এই মহারণ্যে উন্মাদের মতো অনির্দিষ্টের যাত্রা করছি। সব কথা খোলাখুলি না জানিয়ে ত্রিলোচন আমাকে ঠকিয়েছে! হঠাৎ আবার ঘাড়ের ওপর সেই নিঃশ্বাসটা পড়ল আর তখুনি দারুন রাগে হাতের ছুরিটা আড়াআড়ি ভাবে চালিয়ে দিলাম, অদ্ভুত কাণ্ড! ছুরিটা যেন হাওয়া কেটে কোন দেহধারীর শরিরে গেঁথে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে বিশ্রী স্বরে আর্তনাদ করে কে যেন ছুটে পালাল। আমি হতভম্বের মতো দাড়িয়ে রইলাম, এসব যে কি ঘটছে? চোখে দেখা যাচ্ছে না অথচ জিনিসটার অস্তিত্ব বেশ টের পাচ্ছি। সম্বিৎ ফিরতে ফের জোরকদমে হাটা দিলাম।এই জঙ্গলটাকে আমার হঠাৎ অতি ভয়ানক জায়গা বলে মনে হতে শুরু করেছে। হঠাৎ টের পেলাম একটা অস্পষ্ট আওয়াজ আমার পেছু নিয়েছে, সেটা কারও পায়ে চলার, সাবধানে পেছু তাকিয়ে অবশ্য কাউকে দেখতে পেলাম না, আমি চললে সেটা চলে, আমি থমকে দাড়িয়ে গেলে সেটাও দাড়িয়ে যাচ্ছে। দু-একবার খুব কায়দা করে চলার মাঝে হঠাৎ নিথর হয়ে থেমে যেতেই আমার অনুসরণকারী ফাঁদে পরল। অসতর্ক পদক্ষেপ ফেলে সে বুঝিয়ে দিল, এসব আর যাই হোক আমার মনের কষ্টকল্পনা নয়। আমি চলার গতি আরও বাড়িয়ে দিলাম, কিছুটা পথ এভাবে যাবার পর তিরবেগে ঘুরে ছুরিটা দিয়ে আঘাত হানলাম। এবারে ছুরি আর কিছুতে ঠেকল না শুধু বনবন করে খানিক হাওয়া কেটে ফেরত চলে এলো। আমি প্রাণপণ অস্ত্রটা এদিক ওদিক শুন্যে আছড়াতে লাগলাম তবে আমার অদৃশ্য শত্রু ততোক্ষণে সতর্ক হয়ে গেছে। ভয়ে আতংকে আমার প্রায় কালঘাম ছুটে গেল।

দারুন ত্রাসে দিগ্বিদিক জ্ঞ্যানশুন্য হয়ে ছুটতে শুরু করলাম, গাছের ওপর থেকে ঝুলে থাকা ডালগুলো চাবুকের মতো গায়ে, মুখে আছড়ে পড়তে লাগল। গালের একপাশটা ফেটে ঝরঝর করে রক্ত পড়তে লাগল। তবে সেইমুহুর্তে সেসব নিয়ে ভাবার অবকাশ ছিল না। কতক্ষণ এভাবে ছুটেছি জানি না হয়ত ভীষণ ক্লান্ত হয়ে দাড়িয়েছি একটু জিরিয়ে নেবার জন্য, এলোপাথাড়ি পায়ের শব্দটা একেবারে কাছে এসে গেলো, আওয়াজটা এবারে আরও স্পষ্ট, আরও নির্ভুলভাবে শোনা যাচ্ছে, অশরীরী অনুসরণকারী আর নিজেকে লুকিয়ে রাখার তোয়াক্কা করছে না। প্রাণের ভয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌর লাগালাম। কতোটা পথ এভাবে ছুটে পার হলাম কে জানে, একসময় বুকে প্রচণ্ড হাঁপ ধরে গেল, মুখ দিয়ে অঝোরে ফেনা ঝড়ছিল, শরিরের ভিতরে যে ব্যাটারিটা আছে তার চার্জ বোধহয় সেসময় পুরোপুরি ফুরিয়ে গেছিল, বোঁ করে মাথা ঘুরে ঘাসবনের ওপর হুমড়ি খেয়ে পরলাম।

ছোটার ক্ষমতা আর একদমই ছিল না তাই একটা ঝাঁকড়া গাছের গোঁড়ায় বসে হাপাতে লাগলাম। কিছুক্ষণের বিশ্রামের পর টের পেলাম, পিছনের অদৃশ্য জীবটা এইমুহুর্তে অন্তত আমার ধারেকাছে নেই। লক্ষ্য করলাম, জঙ্গল এখানে খানিকটা হালকা হয়ে এসেছে। যদি কোথাও একটু জল পাওয়া যেত! সামনে কোথাও যদি একটা পুকুর ডোবা কিছু পাওয়া যায়, কিছুক্ষণ বসার পর তেষ্টার বেগটা খানিক কমল। পথ চলা শুরু করব ভাবছি, অকস্মাৎ মিষ্টি সুরেলা একটা স্বর কানে এলো। মেয়েলী কণ্ঠে কেউ গুনগুন করে গানের কলি ভাঁজছে। ভয়ে ভয়ে দুর্বল স্বরে –কে? বলতেই গানটা থেমে গেল। এরপর কিছুক্ষণ কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম কিন্তু অরণ্যের নিজস্ব কিছু আওয়াজ ছাড়া অন্য কিছুই কানে এলো না। কাছাকাছির মধ্যে একটা পেঁচার তীক্ষ্ণ কর্কশ ডাক আর কোন একটা বিবস প্রাণীর মরণপণ আর্তনাদে আঁতকে উঠলাম! প্যাচাটা বোধহয় শিকার ধরেছে। পরের কিছু মুহুর্ত অসহায় জন্তুটার ছটফটানি আর আর্ত চিৎকারের বেগ ক্রমশ কমতে কমতে শেষে একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। না দেখা জন্তুটার জন্য মন খারাপ হয়ে গেল। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম একটা কালো লম্বা ছায়া মাথার ওপর বনবন করে ঘুরতে শুরু করেছে, উপর দিকে চাইতে দেখলাম ডানা ওয়ালা একটা রোমশ বাদুড় মাথার ওপর পাঁক খেয়ে ক্রমশ নিচে, বোধহয় আমার দিকেই এগিয়ে আসছে, ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে এবার একটা ঘৃণার অনুভুতিও আমাকে গ্রাস করল,

মাটির ওপর থেকে একটা পাথর তুলে বাদুড়টাকে তাক করে সজোরে ছুড়ে মারলাম, পাথরটা জানোয়ারটার ডানা ঘেসে চলে গেল, এক চুলের জন্য লাগল না, খ্যানখ্যানে বিশ্রী শব্দ করে জন্তুটা অন্যদিকে উড়ে গেল, আর আমিও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। হঠাৎ নারীণ্ঠের অপ্রত্যাশিত আহবান কানে এলো –বাবু! আওয়াজটা কয়েক হাত দুরের বুনো ঝোপটার দিক থেকে এসেছে। ভয়ে বিস্ময়ে সেদিকে তাকালাম। মুহুর্ত খানেক বিরতির পর আবার স্বরটা ভেসে এলো –বাবু আমি শাওনি, তোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। কে শাওনি? হাতের ছুরিটা শক্ত করে ধরে উঠে দাঁড়ালাম। নারীকণ্ঠ তাড়াতাড়ি বলে উঠল –এদিক পানে আসিস না বাবু, আমার গায়ে কাপড় নেই। চমকের ওপর চমক! বলে কি? নারীকণ্ঠ বলল –আমি মোড়লের বউ শাওনি, আজ তুই আমাদের ঘরে এলি যে। একরাশ অবিশ্বাস নিয়ে বললাম –তুমি এখানে কিভাবে এলে? তোমার তো এখন ঘরে থাকার কথা? নারীকণ্ঠ বলল –তুই এখনো বুঝিস নি বাবু, এসব ওই ওঝা আর আমার মরদের চালাকি! গেরামের লোকগুলোকে না ঠকালে কি ওদের চলে? আমার সংশয় প্রবল আকার ধারন করল, বললাম –তোমার কোন কথা বিশ্বাস করিনা। তুমি এখনি বাইরে এসে দাড়াও। লাস্যময়ী কণ্ঠস্বরটা প্রলুব্ধ করা সুরে বলল –বাবু তুই দেখি বড় লুচ্চা, আমাকে ন্যাংটো দেখতে তোর মনে সাধ জেগেছে, তাই না রে? তবে দ্যাখ। ঝোপের আড়াল থেকে এবার একটি পুর্নাবায়ব নারী শরির প্রকাশিত হল। যুবতীটি পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত অবিশ্বাস্য ভাবে নগ্ন। মেয়েটির সুঠাম গড়ন নিটোল স্বাস্থ্য। মুখশ্রী সুশ্রী, ভারী নিতম্ব, বুকের ওপর পুরুষ্টু স্তনগুলো যেন ভরা বেলুনের মতো ফুলে উঠেছে। এক মাথা ঢেউ খেলানো অবিন্যস্ত চুল কাধে পিঠে সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। সুন্দরীর মোটা ঠোঁট দুটি যেন পুরুষের কামনা জাগিয়ে তলার জন্যই তৈরি হয়েছে। বুভুক্ষু দুচোখ দিয়ে যুবতী শরিরের গোপন ভাঁজগুলো গিলে খাচ্ছিলাম। মেয়েটি রহস্যময় হাঁসি হেসে বলল –আমাকে দেখতে সুন্দর না রে বাবু! অস্ফুট স্বরে বললাম –হ্যা। যুবতীটি হাত বাড়িয়ে ইঙ্গিত করল –তবে আয় বাবু আমোদ করি! কিছুক্ষণের জন্য যেন শরিরের ভিতর হরমোনের গতিবেগ প্রচণ্ড বৃদ্ধি পেয়ে মস্তিষ্কের দখল নিয়ে ফেলেছিল, মেয়েটিকে ভোগ করার বাসনা এতো প্রবল হয়ে উঠেছিল যে হিতাহিত জ্ঞ্যানশুন্য হয়ে দ্রুত ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। একসময় রহস্যময়ী নারীমুর্তির একেবারে কাছে চলে এলাম, এতটাই যে ওকে এবার হাত দিয়ে ছুয়ে দেখতে পারব। এতোটা বলে তপন যেন শিউরে উঠল তারপর চোখ বন্ধ করে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলল। আমি রুদ্ধশ্বাসে শুনছিলাম অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম –তারপর কি হল। তপন সামান্য চুপ করে শান্ত স্বরে বলল –আমি বেঁচে গেলাম।

-সে তো দেখছি, কিন্তু কিভাবে? তপন ধীরে ধীরে বলল –সেদিনের পরও আমার বেঁচে থাকা ছিল হয়ত বৃহৎ কোন প্রাপ্তির জন্য তাছাড়া আর কোন যুক্তি নেই, যাইহোক ততক্ষণে মেয়েটার একদম কাছে এসে পড়েছি, আর তর সইছিল না, ওর ওপর ঝাপিয়ে পরতেই যাচ্ছিলাম এমন সময় তীব্র আলোর ঝলকানি আর কান ফাটানো বাজ পরার শব্দ, বাজটা খুব কাছেই পড়েছে একটা বুনো ঝোপের ওপর, ঝোপটা দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করল আর প্রচণ্ড কম্পনে আমিও হাতখানেক দূরে ছিটকে পড়লাম। নিজেকে সামলে উঠে যে দৃশ্য দেখলাম তা এখনো মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন হয়ে আমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। দেখলাম সুশ্রী যুবতীটি একটা কুৎসিত ডাইনির রূপ নিয়েছে, জীবটা যেন আপ্রাণ চেষ্টা করছে নিজের দেহের সবকটা অংশকে একজায়গায় ধরে রাখতে কিন্তু পারছে না। একটু একটু করে তার দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সব গলে ধোঁয়া হয়ে গেল। এবার দেখা গেল খরগোসটাকে, আমার হাতের নাগালের মধ্যে, ঘাসের ওপর বসে, আর তার লাল চোখের স্থির দৃষ্টি সোজাসুজি আমার উপর নিবদ্ধ। কাঁপা হাতে ছুরিটা মাটি থেকে তুলে নিলাম। কিন্তু দুপা এগোতেই ওটা ছুটে পালিয়ে গেল। এবার আকাশ ভেঙে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামল। ততোক্ষণে আমার শিরায় শিরায় ভয়ের কাঁপন শুরু হয়েছে, আমি ঝড় বৃষ্টির পরোয়া না করে জঙ্গলের কাদামাখা পথ দিয়ে ছুটে চললাম।

অনেকটা পথ এভাবে ছোটার পর জলকাদায় পা পিছলে মুখ থুবড়ে পড়লাম। চোয়ালে দারুন আঘাত লাগল, মনে হচ্ছিল মুখটা যেন ফেটে গেছে। হাত ঠেকিয়ে বুঝলাম থুতনি চিড়ে রক্ত ঝরছে। একরাশ কাঁদা মেখে যখন উঠে দাঁড়ালাম দেখলাম একটা ন্যাড়া জায়গায় এসে হাজির হয়েছি। মনে হল আদিবাসীরা এইখানে গবাদি পশুগুলোকে চড়াতে নিয়ে আসে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো কাটার মতো গায়ে ফুটছিল, আমার সর্বাঙ্গ ততোক্ষণে ভিজে একেবারে সপসপ করছিল। কয়েক মিটার এগিয়ে গেলে আবার জঙ্গলের ঘনত্ব বাড়ছে সেদিকে গেলে হয়ত কোন গাছের তলায় আশ্রয় পেতে পারি ভেবে হাঁটা থামালাম না। আচমকা বৃষ্টিটা যেভাবে শুরু হয়েছিল সেভাবেই বন্ধ হয়ে গেল। জলে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধের সঙ্গে নাম না জানা বুনো ফুলের সুগন্ধ মিশে আশেপাশের পরিবেশটাকে যেন মাতিয়ে দিচ্ছে। অন্যরকম পরিস্থিতি হলে হয়ত জঙ্গলের এমন রুপ দেখে এই আমিই হয়ত ধন্য হয়ে যেতাম। কিন্তু সেরাত্রে সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো মনের অবস্থা সত্যিই ছিল না।

একটা ঢালু জমির ওপর বৃষ্টির জল জমে তাতে চাঁদের প্রতিকৃতিটা বেশ দৃশ্যমান হয়ে পরেছিল। সেদিকে নজর পরতেই চমকে উঠলাম! একজন বলিষ্ঠদেহী আদিবাসী যুবকের প্রতিবিম্ব ওই জমা জলে দেখা যাচ্ছে, ছেলেটি রোষকষায়িত দৃষ্টে সোজা আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। চকিতে পিছন ঘুরে কাউকে দেখতে না পেয়ে ফের ওই জলের দিকে তাকাতেই দেখলাম মুর্তিটি অদৃশ্য হয়েছে। আজ রাতে বোধহয় নতুন করে কিছুতেই আর অবাক হবার মতো নেই তাহলেও মনে হচ্ছিল সকাল পর্যন্ত মাথা ঠিক রাখাটাই এখন আমার সামনে সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ,এই রাতের শেষে মাত্র দুটো সম্ভাবনাই আমার মাথায় ঘুরছে। এই জঙ্গলের কোন অদ্ভুত জীবের হাতে যদি বেঘোরে মারা না পড়ি তাহলে আমার উন্মাদ হওয়াটা একপ্রকার অবধারিত।

হাটছি তো হাটছি, মনে হচ্ছে তিন ক্রোশ পথ বুঝি আর ফুরাবে না। হাতের ঘড়িটা বৃষ্টির জলে ভিজে আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। তবে মনে হয় রাত দেড়টা দুটো তো হবেই, বাবুলালের টিলা আর কতদূর? ঈশ্বরই জানেন! হঠাৎ দুরের ঝোপ গুলোর মধ্যে একটা অস্বাভাবিক আলোড়ন টের পেলাম, মুহুর্ত মধ্যে গাছের ডালে ঘুমন্ত পাখিগুলো যেন কীসের ভয়ে শোরগোল লাগিয়ে দিল। পাখিগুলোর চিতকারে কি যে ছিল! আমি অমঙ্গলের সংকেত পেলাম, যে ভয়টা চলে গেছিল সেটা আবার নতুন করে এসে আমার হাড়গুলো কাঁপিয়ে দিল, মনে হল আপাত শান্ত এই বনভূমি হঠাৎ যেন জেগে উঠে আমাকে গিলে খেতে সবেগে ধেয়ে আসছে। চোখের সামনে দেখতে পেলাম দুদ্দাড় করে ঘন জঙ্গলের ভিতর থেকে কিছু একটা এদিকেই ছুটে আসছে, ভারী পায়ের চাপে মাটিতে পরে থাকা শুকনো ডাল গুলো মটমট করে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে পরছে, কি করব বুঝে ওঠার আগেই হাওয়ার প্রচণ্ড একটা বেগ সামলাতে না পেরে পাথুরে মাটির ওপর ছিটকে পরলাম, আর তখুনি সাঁড়াশির মতো হাত দিয়ে অদৃশ্য শত্রু আমার গলাটা টিপে ধরল, লোহার মতো আঙুলের প্রচণ্ড চাপে আমার দম আঁটকে এলো মনে হল শেষ সময় বুঝি উপস্থিত! কিন্তু জীবন রক্ষার তাগিদে মানুষ অনেক সময় অসম্ভবকেও সম্ভব করে ফেলে, অমানুষিক চেষ্টায় থাবাটাকে ঠেলে নিজেকে সাময়িক মুক্ত করে ফেললাম, ভোজবাজীর মতো অদৃশ্য দুষমন আবার অদৃশ্য হয়ে গেল। ফের কোন হামলা সে করল না। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে এদিক ওদিক চাইছি তক্ষুনি নজরে পড়ল খরগোসটা আমার পায়ের কাছে কেমন যেন হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রয়েছে, মুহুর্তটাক সময় নষ্ট না করে ছুরিটা তুলে খরগোসেটাকে লক্ষ্য করে ছুড়ে মারলাম। জন্তুটাও দ্রুত লাফ দিল তবে ততোক্ষণে ছুরির ডগা ওর পিঠের খানিকটা মাংস উপড়ে ফেলেছে। এবারে বীভৎস অপার্থিব একটা হাহাকারে জঙ্গল কেঁপে উঠল। দানবটার কাতর আর্তনাদ আমার কানে মধুর সংগীতের মতো উপভোগ্য মনে হল। উৎকট আনন্দে আমিও গলা ফাটিয়ে হেসে উঠলাম।

রাতভর অজ্ঞাত বিভীষিকার সঙ্গে যুঝতে যুঝতে ভীষণ রকমের ক্লান্ত হয়ে পরেছিলাম। পূবের আকাশে নজর পড়তে দেখলাম অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে, রাত শেষ হতে চলল। হাতে আর বিশেষ সময় নেই। শ্রান্ত ক্ষতবিক্ষত শরীরটাকে টানতে টানতে এগিয়ে নিয়ে চললাম।

শেষেমেসে একটা রুক্ষ পাথুরে জমির ওপর এসে পৌছলাম। জমিটার মাঝ বরাবর একটা পাথুরে ঢিপি, এটাই বোধহয় সেই বিখ্যাত বাবুলালের টিলা।

ত্রিলোচন আর মোড়ল দেখলাম টিলার একপাশে বসে গাঁজায় দম দিচ্ছে, বুঝলাম ওরা অনেক আগেই পৌছে গেছে। দুজনে আমাকে দেখে উঠে দাঁড়াল। ত্রিলোচন উৎফুল্ল স্বরে বলল –বাবু তোকে জ্যান্ত দেখে ভালো লাগছে, সবই রাজার ইচ্ছে। দে ফুল দে, মাটি দে? রুমালটা বের করে ত্রিলোচনের হাতে তুলে দিলাম, ত্রিলোচন সবার আগে রুমালের ভিতর হেজে যাওয়া ফুল আর মাটি টাকে আলাদা করল। মাটির তিনটে দলা একসাথে করে পিণ্ড বানিয়ে মন্ত্র পরে সেটার পুজো করল তারপর দুহাতের অঞ্জলিতে পুড়ে এগিয়ে গেল বাবুলালের টিলার দিকে। টিলার ওপর খানিকটা মাটি হাত দিয়ে সরিয়ে গর্ত মতো করে সেখানে পিণ্ডটা চেপে ধরল, আর তখুনি যেন ইলেকট্রিক শক্‌ খেয়ে ছিটকে পরল।

ত্রিলোচন সভয়ে উঠে দাড়িয়ে হাতজোড় করে বিড়বিড় করে দুর্বোধ্য ভাষায় কিসব বলতে লাগল, এরকম প্রায় তিন মিনিট একনাগাড়ে চলার পরে একপা দুপা করে অতি সাবধানে টিলার সামনে হাটু গেড়ে বসে পাথর গুলোর ওপর কান পাতল। এসব কি হচ্ছে, তা ত্রিলোচন বলে না দিলে আমার বোঝার উপায় অবশ্য নেই। অকস্মাৎ ত্রিলোচন যেন ক্ষেপে গেল, প্রচণ্ড চিৎকার করে বলল – এই মোড়লের ব্যাটা, সত্যি কথা বল ওই লাশ ওখানে কে মেরে পুতেছে? মোড়লের দিকে চোখ পরতেই কৌতূহলী হয়ে পরলাম, মনে হচ্ছিল ওর মুখ থেকে সব রক্ত যেন কেউ ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিয়েছে, মোড়ল কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল –আমি কি করে জানব দাদাঠাকুর? ত্রিলোচন হিংস্র স্বরে বলল –বাবুলালের টিলার সামনে মিছে বলার সাজা জানিস? তবে তুইই সামলা, আমি এই চললাম। ত্রিলোচন কাঁধে ঝোলা তুলে নিয়ে পা বাড়াবার উদ্যোগ করতেই মোড়ল ত্রিলোচনের পায়ে প্রায় ঝাঁপিয়ে পরল।

মোড়ল কাঁতর কন্ঠে বিলাপ করতে লাগল –হ্যা দা-ঠাকুর ও পাপ আমিই করেছি, কিন্তু না করেই বা কি করতাম, কুন মরদের বাচ্চা এমন আছে যে নিজের বিহা করা বউরে অন্য মরদের সঙ্গে শুতি দেখেও চুপ করে থাকে, আমিও তাই খুন করে হিসেব চুকিয়েছি। ত্রিলোচন পা ছাড়িয়ে নিয়ে মোড়লকে সামনে বসিয়ে দিল, খানিক পরে মোড়ল ধাতস্থ হয়ে ধীরে ধীরে বলল –শাওনির সঙ্গে বিহা হবার পর থেকে ও যখন যা চেছে সব দিসি, এমনকি আগের দুই বউরেও অবজ্ঞা করেসি অরি জন্যি কিন্তু দা-ঠাকুর এ বড়ই বেইমানের জাত, একদিন শুনতে পেলাম শাওনি চুপি চুপি পাশের গ্রামের কোন জোয়ান মদ্দের সঙ্গে দেখা করে, পিথমে এ খবর বিশ্বাস করি নাই কিন্তু পরে মনে হল একবার বুঝেই নি, ঠিক কি আর ভুলই বা কি। একদিন ওরে লুকিয়ে ধাওয়া করি জঙ্গলের রাস্তা ধরলাম, দেখি কি না চৌরি গ্রামের মানিক মাহাতর জোয়ান ছেলে ওই রাখহরির সঙ্গে মাগী ল্যাংটো হয়ে শুয়ে আমার মুখে আমার বাপ চোদ্দগুষ্টির মুখে চুনকালি লাগাসে। মাথায় রক্ত উঠে গেল দা-ঠাকুর হাতের রাম-দা দিয়ে মারলাম হারামজাদার মাথায় এক বাড়ি, এক কোপেই শেষ। মাগিকে চুলের মুঠি ধরে ঘরে এনে বন্ধ করলাম আর রেতের দিকে আমার ভাইকে সঙ্গে নিয়া জঙ্গলের ওই খানটায় লাশ গেড়ে দিলাম, কেউ কুথাও জানতে পারল না। কিন্তু হারামজাদা রাখহরি বদলা নিতে ভুত হয়ে মাগীর শরিরে আর একবার ভর করল, সে এবার শাওনিকে এক্কেবারে নিয়ে যেতে চায়। এর বেশী আর কিছু নেই দা-ঠাকুর, এবার তুমিই আমার বিচার করো ত্রিলোচন সব শুনেটুনে গুম হয়ে বসে রইল, কিছুক্ষণ পরে বলল –তুই যা করেছিস মোড়লের ব্যাটা তা তো ঠিকই কিন্তু আমারে সব না বলে ভুল করেছিস, যদি আজ রাতে কারও একটা ক্ষেতি হত তাহলে কি হত সে ভেবেছিস? মোড়ল মাথা নিচু করে বসে রইল, একথার কোন উত্তর দিল না। ত্রিলোচনই ফের বলল –যা এবার বাবুলালের সামনে গিয়ে ভিক্ষে মাগ, তবেই তর ওই মাটি উ লিবে, নচেৎ নয়। ত্রিলোচনের নির্দেশে মোড়ল ধীর পায়ে টিলার সামনে গিয়ে নতজানু হয়ে বসে বিশ্রুম্ভালাপ করতে লাগল আর আমি তখন মনে মনে ভাবছি বুড়ো মোড়লের বাকি জীবনটা বোধহয় যুবতী স্ত্রীকে পাহারা দিতেই চলে যাবে।

কিছু পরে ত্রিলোচন বলল –চলে আয় রে মোড়ল, বাবুলাল তোরে মাপ করসে কিনা এবার বুঝা যাবে! সব আগে আগুন জ্বালবার ব্যাবস্থা দ্যাখ দেখি।

ত্রিলোচনের নির্দেশে মোড়ল কয়েকটা শুকনো ডাল যোগার করে আগুন ধরিয়ে দিল। আগুনটা ভালোমতে জ্বলে উঠতেই ত্রিলোচন দুর্বোধ্য মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে একটা একটা করে ফুল তাতে নিক্ষেপ করতে লাগল। প্রতিটা ফুলের আহুতিতেই জঙ্গল কাঁপিয়ে ভুতুড়ে মরাকান্না আমাদের শরিরের রক্ত হিম করে দিল। ত্রিলোচন শেষ ফুলটা কপালে ঠেকিয়ে অঞ্জলি করে জ্বলন্ত অগ্নিতে প্রদান করা মাত্র কান্নার শব্দটা থেমে গেল। মোড়ল কিছু বলতে যাচ্ছিল ত্রিলোচন ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ থাকার ইঙ্গিত করে সামনের দিকে দেখাল। দেখে চমকে উঠলাম, সেই খরগোসটা হঠাৎ যেন একহাত দূরে মাটি ফুড়ে গজিয়েছে। প্রাণীটার শেষ সময় উপস্থিত। ধুকতে ধুকতে মুখ দিয়ে ফেনা তুলে ছোট্ট দেহটা থর থর করে কেঁপে উঠল। সামনের দু-পা আর পিছনের পা দুটো টান টান করে ছড়িয়ে উল্টে পড়ল, আর তখুনি ক্লান্ত আর নির্জিব চোখের পাতাদুটো বন্ধ হয়ে গেল। তখন আমরা তিনজন সেই পাথুরে জমির ওপর, বাবুলালের টিলার সামনে নিস্তব্ধ নির্বাক হয়ে দাড়িয়ে রইলাম, আমার মনে তখন ঝড় উঠেছে। এই বত্রিশ বছরের জীবনে এই রাতটা নিঃসন্দেহে সবথেকে অবিস্মরণীয়।ত্রিলোচনের ডাকে হুঁশ ফিরল –চল বাবু ঘরে ফিরতে হবে। ত্রিলোচনের নির্দেশে মোড়ল মৃত প্রাণীর শবটা হাতে তুলে নিল, ওটা সূতা নদীর জলে ভাসিয়ে দিলে কাজ শেষ হবে। সেদিন শ্রান্ত শরিরটা টানতে টানতে কোনরকমে গ্রামে ফিরে এসেছিলাম, শরির ক্লান্তিতে ভেঙে পড়লেও মন কিন্তু ছিল আশ্চর্য রকমের সতেজ আর উদ্দিপ্ত। ভাগ্যক্রমে এমন একটা জগতের সন্ধান আমি পেয়ে গেছি, যেটা এতদিন শুধু রূপকথার বইয়েই পড়ে এসেছি, তবে দুঃখের বিষয় হল আমার দুর্দান্ত সব অভিজ্ঞতা শহুরে মানুষের কাছে পাগলের প্রলাপ ছাড়া অন্য কিছুই বিবেচিত হবে না।সাংবাদিকতার পেশায় আমার উন্নতির সম্ভাবনা যে তিমিরে সেই তিমিরেই।

 

 

<<প্রথম সংখ্যা                                                                          পরবর্তী সংখ্যা : আগামী সপ্তাহ>>

 

Writer Sanjoy Bhattacharya

লেখক : সঞ্জয় ভট্ট্যাচার্য, পদ্মপুকুর রোড , কলকাতা।

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here