“অজিত ব্যানার্জি , কোথায় রাখা হয়েছে একটু বলতে পারবেন ?” অনিন্দিতা রিসেপসনিস্ট কে জিজ্ঞাসা করল
“রুম নাম্বার ১০৬ , থার্ড ফ্লোর বাঁদিকের রো“
“ধন্যবাদ”
“আচ্ছা আপনি ওনার কে হন ?”
প্রশ্নটা শোনার পর বেশ খানিকটা আশ্চর্য হয়েছিল অনিন্দিতা । মনে মনে ভেবেছিল সত্যিই তো আমি ওর কে?
“ম্যাম ম্যাম….”, সাদা সালোয়ারের রিসেপশনিস্ট যেন হিপ্নটাইজড অনিন্দিতা কে আবার তার ফুলে ফেরানোর চেষ্টা করছিল ।
অনিন্দিতা বলল , ” কাছের আত্মীয় , অনেক কাছের আত্মীয় ” । বলে তো সে ফেলল আত্মীয় কিন্তু আদেয় কি আত্মীয়তা আছে , এই চিন্তা যেন আবার তোকে কোন এক ভাব সাগরে নিয়ে গেল
এবার নিজের হুস নিজেই ফিরিয়ে সোজা সিঁড়ি ধরে এগিয়ে গেল তিন তলায় । এই হাসপাতালে আগেও দু‘বার এসেছে , প্রথমবার যখন অজিতের পায়ে ফ্রেকচার হলো আর দ্বিতীয়বার নিজের যখন খুব জ্বর হলো ।
সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নার্সকে জিজ্ঞেস করল অনিন্দিতা “১০৬ ঘরটা কোথায় ?”
“বাঁদিকে একদম সোজা চলে যান”
বাদিক ঘুরে সোজা হাঁটতে হাঁটতে অনিন্দিতা চারপাশটাকে দেখল , সাত বছর আগে শেষ আসা হাসপাতালের চেহারাটা পুরোটাই পাল্টেছে দেখে নিজেই নিজেকে বলল পাগলি এত অবাক হওয়ার কি তোর জীবনটাও তো এই হাসপাতালটার মত বদলে গেছে …
ঘরের সামনে পৌঁছেই অনিন্দিতার যেন সব ওলট–পালট হয়ে গেল এখানে আসার কারণটা তার মাথা থেকেই বেরিয়ে গেল । এটা তো সবসময়ই হয় অজিতের মুখটা দেখলে যেন সে অনিন্দিতা থেকে নন্দিতা হয়ে যায়, অজিতের নন্দিতা ।
আজ থেকে ১৩ বছর আগে সদ্য বউয়ের সাজে অজিতের বাড়ির লক্ষ্মী হয়ে আসা অনিন্দিতা আজ শাড়ির ব্যবসায়ী । কিন্তু তফাৎ একটাই সে আজ অজিতের বাড়ির লক্ষ্মী নয় । হয়তো জগতের নিয়ম বাড়ির লক্ষ্মী হতে গেলে জগতের লক্ষ্মী হওয়াটা অসম্ভব, অসম্ভব না হলেও প্রচণ্ড কঠিন ।
আলতো করে দরজাটা ধাক্কা দিয়ে অনিন্দিতা ঢুকলো । অজিত তখন শুয়ে । অনিন্দিতা যে ঢুকেছে সে টের পায়নি । অজিতের বিছানার পাশে থাকা চেয়ারটায় আস্তে করে বসল অনিন্দিতা । আলতো করে ডাকলো , ” অজিত অজিত ……. “
একটা চেনা সুর যেন অজিতের কানে ভেসে উঠলো , খুব খুব চেনা সুর । শুয়ে থাকা অজিতের দেহে হয়ে থাকা বিষম রোগ যেন কোথাও স্বস্তির সুখ খুঁজে পেল । কষ্ট হলেও চোখ খুলল অজিৎ , বলল ” নন্দিতা তুমি এসেছ? আমায় ক্ষমা করে দাও । ফিরে আসো আমার কাছে ।“
চোখের কোনায় জল জমতে শুরু করেছে অনিন্দিতার । তাও ইচ্ছে করে শক্ত হবার নাটক করলো সে , তীব্রস্বরেই অজিত কে বলল , ” দরকারের বেলায় তো সবসময় ফিরে এসোই বলবে ? কেন তোমার পাশে কেউ নেই এখন ? “
” হ্যাঁ ঠিকই , আমার পাশে কেউ নেই , আর থাকবেই বা কি করে বল ? সবাইতো আমার নন্দিতা নয় ।“
“এসব কথা আর বোলো না অজিৎ , তোমার মুখে আর মানায় না” মনের চেপে রাখা রাগ আর কষ্ট ঠিকরে পড়ল অনিন্দিতার মুখ থেকে ।
” ডাক্তার বলেছে আমি আর বাঁচবো না ”
“তোমাকে তো আগেই বলেছি এই সব ছাইপাশ না ছাড়লে একদিন এর ফল তো ভোগ করতেই হতো , আমার কথা তোমার তো কোনদিনই পোষায় নি”
“যত রাগ আছে সব বার করে দাও নন্দিতা পরে হয়তো সুযোগ পাবে না ।” অজিতের স্বরে যেন কোথাও এবার ভয় এর চিহ্ন পাওয়া গেল ।
“রাগ । রাগ তো তাদের উপর করে যার উপরে অধিকার থাকে । তোমার উপরে আমার অধিকার তো কবেই শেষ হয়ে গেছে ।” ভেজা চোখে অনিন্দিতা বলে উঠলো
“মনে আছে যখন আমরা দার্জিলিং গেছিলাম , কত মজা হয়েছিল । ট্রেকিং এর সময় তোমার পা ব্যথা করছিল , উঠতে চাই ছিলেনা তুমি । আমি তখন তোমার কাঁধে নিয়ে উঠেছিলাম । আমাদের গাইড দাদা একটা ছবি তুলে দিয়েছিল। ছবিটা এখনো আমার কাছে আছে । ” অজিতের মুখে পুরনো স্মৃতি স্বস্তি হয়ে ফুটে উঠল।
“আর ওই ট্রেকেই তুমি আমার গায়ে প্রথম হাত তুলে ছিলে । কেন মনে আছে ? প্রচুর নেশা করে যখন তুমি হোটেলের মহিলা স্টাফের সঙ্গে ফ্লার্টিং করছিলে তার প্রতিবাদ জানিয়ে ছিলাম বলে।” অনিন্দিতা ঠেস দিয়েই বললো । প্রত্যেকবারই তো কোন পার্টিই হোক কোথাও ঘুরতে যাওয়া হোক একই ঘটনা । আমি কিছু বলতে যেতাম আর আমার কপালে জুটতো তোমার এই শক্ত হাতের ঘা । ঘা দিয়ে আবার নিজেই মলম লাগাতে আসতে । প্রথম কয়েক বছর সত্যিই ভেবেছিলাম তুমি প্রচন্ড ভালোবাসো, এগুলো সব এমনি হয়তো সময়ের সাথে ঠিক হয়ে যাবে । ”
“আহ্ ভালো লাগছেনা এসব বলো না ।” অজিত বেশ কান্নার স্বরেই বলল ।
“ভালো লাগবে বৈকি , সত্যি বলতে গেলে তো প্রত্যেকবারই চুপ করিয়ে দিতে ।”
আসলে হয়তো মরার আগে মানুষ ভালো স্মৃতিগুলোকে মনে করার চেষ্টা করে ।
“ভুল হয়ে গেছে । ক্ষমা করে দাও ।” অজিৎ ওঠার চেষ্টা করে বলল
“আমি তোমাকে ক্ষমা করার কেউ নই । ৭ বছর আগে যখন বুঝতে পেরেছিলাম নিজের পায়ের মাটি শক্ত করা খুবই দরকার নাহলে ভগবান আমাকে ক্ষমা করবে না তখন থেকেই তোমার আর আমার মধ্যে কার ক্ষমা চাওয়া আর ক্ষমা করার সম্পর্ক শেষ । তোমাকে শুধু একটা কথা বলার ছিল যার জন্য এখানে এসেছি , কোনো সাহায্য লাগলে বলো । আমার নতুন ফোন নাম্বারটা দিয়ে গেলাম ।”
“নন্দিতা তুমি এখন খুব বড় হয়ে গেছো, সত্যি অর্থে বড় । তোমার নামটা আগের সপ্তাহের আনন্দবাজারে বেরিয়েছিল ” শ্রেষ্ঠ শ্রীসম্মান পুরস্কার এবার পেলেন অনিন্দিতা । তখনই বুঝেছি তোমার কাছে আমার পৌঁছানোর উপক্রম নেই । তাও একবার বলি কাছে টেনে নাও, জীবনভরের মত”
“আর নয়, তবুও জীবনে যখন একজনকে সমর্পন করেছিলাম । তাঁর প্রতি আমার কিছু কর্তব্য থাকে , তাই এখানে এসেছি কোন দরকার লাগলে বলো।” এবার অনিন্দিতার চোখ দিয়ে অঝোরে কান্না বেরিয়ে এলো ।
শাড়ির আঁচলে চোখ চেপে উঠে চলে যেতে লাগল অনিন্দিতা ।
“নন্দিতা যেও না যেও না নন্দিতা” হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে ডাকতে থাকলো অজিত ।
কলমে প্রতিভাস চৌধুরী, গাঙ্গুলী পাড়া লেন,কলকাতা
মানবতা জীবনের পরম ধর্ম হওয়া উচিত । আমি এই আদর্শটা মেনে চলি কিন্তু কোথাও মনে মনে আমি প্রচন্ড নারীবাদী । কারণ সমাজটা তৈরি হয়েছে প্রাচীনকাল থেকেই পুরুষতান্ত্রিকতার উপর নির্ভর করে । যেখানে নারীদের জন্য জায়গা বর্তমানে তৈরি হলেও , সেটা নারীদেরকে অনেক কষ্ট করে নিতে হয়েছে । তাই আমার প্রধান উদ্দেশ্য সমাজ থেকে কি করে নারী-পুরুষ সমান অর্থে ব্যবহার করতে পারে সেইরূপ পরিকাঠামো গঠন করা ।