আজ মহালয়া।শারদীয় দুর্গোৎসবের পূণ্যলগ্ন।পিতৃপক্ষের শেষে দেবীপক্ষের শুরু।প্রতি বছরের মত এই বছরও বারান্দায় বসে রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের দরাজ গলায় চণ্ডীপাঠ শুনছিলেন পঞ্চাশ বছরের অজন্তা চৌধুরী। 
কুড়ি বছর তার স্বামী অভিব্রত চৌধুরী না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছেন।তার পর থেকেই ছেলে ঐতিহ্য এবং মেয়ে মাহিকাকে একা হাতে বড় করেছেন অজন্তা দেবী।ঐতিহ্য তার স্ত্রী আলিশা এবং দুই যমজ সন্তানকে নিয়ে লন্ডনে থাকে।কোনোদিন দেশে ফিরবে না তারা।কেবল মাসে একবার ভিডিও কলের মাধ্যমে মায়ের খোঁজ নিয়ে কর্তব্য পালন করে। 
ইতিমধ্যেই চণ্ডীপাঠ শেষ হয়ে গিয়েছে।এরপর রেডিওটা বন্ধ করে ড্রইংরুমের শোকেসের মধ্যে যত্ন করে তুলে রাখলেন। তারপর স্নান সেরে মিষ্টির দেওয়া নতুন শাড়ি পড়ে নিত্যপুজোর পাঠ চুকিয়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় রাখা দোলনার মধ্যে বসলেন।বারান্দা থেকে বাগানের দিকে তাকিয়ে দেখলেন মিষ্টির হাতে লাগানো শিউলি গাছটা ফুলে ফুলে ভরে গিয়েছে।ছেলেবেলায় বাবার হাত ধরে ফুলের নার্সারি থেকে গিয়ে গাছটা কিনে এনেছিল মাহিকা ওরফে মিষ্টি।রোজ নিজের হাতে জল দিত এবং যত্ন করত। 
কিন্তু চাকরি পেয়ে দিল্লি চলে যাওয়ার পর মিষ্টির প্রিয় গাছটার যত্ন নেয় তার মা।তিনবছর পর বাড়িতে আসছে মেয়েটা।তাই তাড়াতাড়ি চা খাওয়ার পর মিষ্টির ঘরটা নিজের হাতে সাজাতে শুরু করলেন।প্রায় একঘন্টা পর তিনি ড্রইংরুমে এসে বসলেন ঠিক তখনি তার বাড়ির কলিংবেল বেজে উঠলো।দরজা খুলে দেখলেন কাজের মেয়ে মালতী দাঁড়িয়ে রয়েছে। 
মালতী বাড়ির ভেতরে ঢোকার পর ই অজন্তা দেবী তার হাতে তিনহাজার টাকা দিয়ে বললেন “খাসির মাংস,বড় সাইজের গলদা চিংড়ি,নারকেল,ভাপা সন্দেশ,টকদই এইগুলো নিয়ে আয়।কোনো জিনিস আনতে ভুলে গেলে তোকে ভীষণ বকা দেবো।

মালতী অজন্তা দেবীর দিকে তাকিয়ে বললো “ও মা,আজ কি এই বাড়িতে অতিথিদের আগমন ঘটবে নাকি?তাই বুঝি তুমি এত জিনিস আনতে বলছো”?
অজন্তা দেবী বললেন “অতিথি নয় রে।আমার মিষ্টি আসবে।একমাস আগেই তো আমায় জানিয়েছে।এইবছরের পুজোটা সে আমার সাথেই কাটাবে”।
অজন্তা দেবীর মুখ থেকে কথাটা শোনার পর মালতীর মুখটা বিমর্ষ হয়ে গেলো।শুধু মুখে বললো ” আচ্ছা”।তারপর বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
আজ থেকে দুইবছর আগে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে নক্ষত্র জগতে পাড়ি দিয়েছে মিষ্টি।দুইবছর আগে মহালয়ার সকালে কফিনে বন্দী সাদা কাপড়ে মোড়া তার মৃতদেহ এসেছিল এই বাড়ির চৌকাঠে।শেষবারের জন্য মেয়ের মুখটা দেখার পরেও তার চলে যাওয়াটা আজও মেনে নিতে পারেননি অজন্তা দেবী।তাই তো আজও মেয়ের আসার জন্য প্রতীক্ষা করেন তিনি।প্রথম প্রথম মালতী তাকে বহুবার বোঝানের চেষ্টা করেছে যে চিরকালের জন্য চলে যায় সে আর কোনোদিনও ফিরে আসে না।তাই তিনি যেন ছেলের কাছে চলে যান।কিন্তু অজন্তা দেবী ছেলের কাছে যাননি।মালতীও মনে মনে ভাবে “সন্তানহারা এক মা যদি সন্তানের প্রতীক্ষায় মাতৃত্ব খুঁজে পায়।তাতে ক্ষতি কি”।

কলমে রুবি সেনগুপ্ত, পুরুলিয়া,পশ্চিমবঙ্গ

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here