রাত বারোটা বাজে । ট্রেনটা এসে গোদাপিয়াশালে থামলো, জায়গাটা বেশ নিরিবিলি । পশ্চিম মেদিনীপুরের মধ্যে একটা গঞ্জ বলা যায় । ট্রেন থেকে নামলাম একা আমি । ট্রেনটা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হুইশল বাজিয়ে স্টেশন ছেড়ে চলে গেল । স্টেশনটি অত্যন্ত ছোট, ওয়েটিং রুম একটাও নেই । একটা ছোট ঘর আছে বটে কিন্তু তাকে ওয়েটিং রুমের সম্মান দেওয়া চলে না । ঘরের মেঝেতে বালি ছাড়া আর কিছুই নেই । এখানে একটা বেঞ্চি হয়তো ছিল কোন একসময়ে কিন্তু এখন বেঞ্চিটার পায়া ঘষে যাওয়ায় বসবার জায়গাটা মেঝেতে পড়ে আছে । আমার নাম অর্ণব সামন্ত, পঁচিশ বছর বয়েস । এখনো অবিবাহিত । পড়াশোনায় মোটামুটি ছোটবেলা থেকেই ভালো ছিলাম, তাই গ্র্যাজুয়েশান শেষ করে খুব বেশীদিন বেকার ভাবে বসে থাকতে হয়নি । চাকরির পরীক্ষায় পাশ করে আমি বর্তমানে ভারত সরকারের রেল বিভাগে টিকিট পরীক্ষক রূপে কর্মরত বিগত একবছর ধরে । যদিও আমার আদত বাড়ি শালবনিতে তবু চাকরি সূত্রে আমায় খড়গপুরেই থাকতে হয় ।
আসলে শেষ কয়েকদিন যাবত আমার বাবার শরীরটা খুব অসুস্থ থাকার খবর পেয়ে আজ সন্ধ্যের পর থেকে কয়েকদিনের জন্য অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি । প্রথমে বাড়ি ফেরার জন্য তাই আসানসোলে যাবার প্যাসেঞ্জার ট্রেনে চেপে খড়গপুর থেকে সরাসরি শালবনি ফেরার ইচ্ছে ছিল আমার, কিন্তু বিধি বাধ সাধলে কারুর কিছু করার থাকেনা । এদিকে আমার অফিসের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আমারই হাতে একটা জরুরী ফাইল দিয়ে বললেন যে বাড়ি ফেরার পথে যেন গোদাপিয়াশালে নেমে এখানের স্টেশন মাস্টার কে ঐ ফাইলটা দিয়ে দিই , তাকে আগেভাগেই ফোন করে জানানো আছে এই ব্যাপারে ।
অগত্যা, কি আর করা যাবে ! অফিসের কাজ সেরে আমাকে লাস্ট প্যাসেঞ্জারেই উঠতে হয়েছিল, সেই মতো আমিও জানতাম গোদাপিয়াশালে এই গভীর রাতে নামলে আজকে রাতে বাড়ি ফেরা হবে না । চাকরি করতে গেলে যে অফিসারদের মন জুগিয়ে সবসময় চলতে হবে সেটা একবছরে আমি ভালই বুঝে গেছিলাম । গোদাপিয়াশাল এ নামলাম । ভেবেছিলাম স্টেশনমাস্টার তার অফিস ঘরে বসে লাইন ক্লিয়ার এর বার্তা গ্রহণ এবং প্রেরণ করার কাজ করছেন কিন্তু স্টেশনে নেমে দেখলাম স্টেশন পুরোপুরি ফাঁকা । একজন যাত্রী ও নেই, এবং স্টেশন মাস্টারের ঘরটিও বন্ধ । এই ব্যাপারটা আমার একটু আশ্চর্য বোধ হলেও মনে করলাম তিনি এখানে হয়তো কাছাকাছি নিজের কোয়ার্টারে চলে গেছেন । অপেক্ষা করতে থাকলাম যদি উনি ফেরত আসেন । এমনিতেও আমি জানি সকাল ছ’টার আগে শালবনি যাবার কোন ট্রেনই নেই । অতঃপর শুধু অপেক্ষা ।
ঘড়িতে দেখলাম, এখন রাত্রি প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে । অফিসের জরুরী বিভাগে ফোন করলাম, যদি রাত্রিকালীন দায়িত্বে থাকা কেউ ফোনটা ধরে, এই আশায় । ফোনটা বেজে গেল, কেউ ধরলনা । আমিও একটা ফ্যাসাদে পড়ে গেছি এবার । ওদিকে তাড়াহুড়োয় অফিস থেকে বেরোবার সময় এখানকার স্টেশন মাস্টারের ফোন নাম্বারটা অফিসারের কাছ থেকে নেওয়া হয়নি । একমনে মনে হল ওনাকে ফোন করি, পরক্ষণেই ভাবলাম এতো রাত্রিতে ওনাকে ফোন করলে উনি ক্ষুণ্ণ হতে পারেন, তার সাথে সেই সময় কেন স্টেশন মাস্টারের ফোন নাম্বার চাইনি সেটার জন্য দায়িত্বজ্ঞানহীন বলে অভিদোষ ও করতে পারেন । আসলে অফিসাররা তো কখনো নিজেদের কাঁধে দোষ নেন না, অধঃস্তন কর্মচারীদের দোষ ধরাটাই তাদের নেশা এবং পেশা । মনে মনে নিজের কপালকে দোষ দিতে লাগলাম ।
আরও কিছুক্ষণ এইভাবে যাবার পর নিজেই ঠিক করলাম যে এইভাবে ছোট ঘরটাতে মাটির উপর বসে মশার কামড় খেয়ে নিজেকে ব্যতিবস্ত করার চাইতে বাইরে বেরিয়ে রাত্রিকালীন প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করা অনেক বেশী ভাল । এরমধ্যে যদি স্টেশন মাস্টার এসে পড়ে, তাহলে ফাইলটা তাকে দিয়েও দেওয়া যাবে আর রাত্রিটা ভদ্রলোককে বলে কয়ে কিছু একটা ব্যবস্থা করে নিতে হবে । যেমন ভাবা তেমন কাজ, বাইরে এসে আকাশটাকে দেখছি । কি সুন্দর চাঁদ উঠেছে আজকে, আকাশ পুরো পরিষ্কার । চারিদিক জ্যোৎস্নার আলোয় ঝলমল করছে ।
জ্যোৎস্নার আলোয় এই মনোরম রাত্রির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনাবিল আনন্দ উপভোগ করতে করতে একমনে ভাবছিলাম, “ ভালোই হলো, ওই ছোট্ট ঘরের মধ্যে বসে থাকলে এই এত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যেত না ।” স্টেশনের উত্তরদিকে দূরের শালবনটা জ্যোৎস্নার আলোয় কেমন যেন মনোমুগ্ধকর ও রহস্যময় লাগছে । মৃদুমন্দ হাওয়া দিচ্ছে, সেটাও বেশ ভালো লাগছে । তার সাথে দেখতে পাচ্ছি ওই দূরের শালবন থেকে স্টেশনের দিকে আসতে থাকা জোনাকির দলের অদ্ভূত রকম আলো–জ্বলা এবং আলো–নেভার অবিরত ছন্দময়তা । এভাবে কতক্ষণ যে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেটা আমার মনে ছিলনা । আসলে এরকম দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই আস্তে আস্তে যেন ভুলে গেছিলাম জাগতিক যা কিছু আছে, যেমন নিজের হাতে ধরে থাকা অফিসের গুরুত্বপূর্ণ ফাইলের কথা, স্টেশন মাস্টারের কথা, কিম্বা আমার বাড়ি ফেরার কথা, সবকিছুই । এমনসময় খুক খুক কাশির আওয়াজে আমার সম্বিত ফিরে এলো ।
পর্ব – ২
পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন । ভদ্রলোকের দাঁতগুলো যেন মুখের বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে সবসময়, দাঁতগুলো এতটাই বড় বড় যে ভদ্রলোকের মুখবোজাটা খুবই কষ্টসাধ্য । এমনিতে ভদ্রলোকের বেশ বলিষ্ঠ চেহারা । মাথায় বেশ ভালো মত একটা টাক ও আছে, লক্ষ্য করলাম চাঁদনি আলো পড়ে টাকটা বেশ চকচক করছে ।
আমার মনে প্রশ্ন জাগল ইনি আবার স্টেশন মাস্টার নয় তো ? আমার কিছু বলে ওঠার আগেই হঠাৎ করে ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, “ ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন বুঝি ?”
“ না ঠিক তা নয় । এমনিই দাঁড়িয়ে আছি । এই লাইনে সকালবেলার আগে কোন ট্রেন পাব না ।”
“ কেন আপনি কি রেলের লোক ?”
ভদ্রলোকের কথার উত্তরে বললাম, “ হ্যাঁ, তা বলতে পারেন । আসলে আমার একটা দরকার ছিল এখানে স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে । কিন্তু ওনার ঘর তো দেখলাম বন্ধ তাই এখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম উনি কখন আসবেন ।”
“ ও, তাই বলুন ।” ভদ্রলোক বিচ্ছিরি ভাবে খি খি শব্দে হেসে উঠলেন ।
“ আপনার পরিচয়টা তো ঠিক জানলাম না ।” আমি ভদ্রলোকের হাসিতে একটু বিরক্ত হয়ে ওনার দিকে একটু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রশ্ন করলাম ।
“ আমি মশাই এখানকার লোক নয় । আমার আদত বাড়ি কলকাতায়, আমি এখানে শালবনিতে ট্যাঁকশালের সুপারভাইজিং অফিসার । বোঝেনই তো নানা কাজে আমাদেরকে ব্যস্ত থাকতে হয় সবসময় । এখানে এই গোদাপিয়াশালে আমাদের ট্যাঁকশালের একটা নতুন ট্রেজারি খোলা হচ্ছে, তাই সেটার কাজকর্ম কিরকম চলছে সেটা নিয়ে ইনস্পেকশন করতে এসেছিলাম আমার দলের বাকি লোকেদের সাথে ।” বলেই আবার খি খি করে হাসতে থাকলেন ।
এই সামান্য কথায় হাসবার কি আছে সেটা আমি বুঝতে পারলাম না । ভদ্রলোকের কথাবার্তার বিষয়টিতে কোন রহস্য না থাকলেও কথাবার্তার ধরণটা ছিল বড় রহস্যজনক । তার মধ্যে অনবরত দেঁতোহাসি আমার গা–পিত্তি জ্বালিয়ে দিচ্ছিল ।
“ তা আপনার দলের বাকি লোক কই ? আপনাকে ফেলে চলে গেছে ?” আমি ভ্রূ কুঁচকে ভদ্রলোককে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম ।
“না না । আমি অফিসার মানুষ । আমাকে ফেলে ওরা যাবে কেন ! আসলে আজকে কাজের যা অবস্থা দেখলাম তাতে মনে হচ্ছে ট্রেজারি তৈরির কাজ শেষ হতে হতে এখনো বেশ কয়েক মাস লেগে যাবে । ইন্সপেকশন সেরে আমাদের ফেরার কথা ছিল আমাদের অফিসের গাড়িতেই কিন্তু গাড়িটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল । দলের বাকি লোকেরা খাওয়া দাওয়ার পর ওখানে বসে একটু মদ্যপানে ব্যস্ত । আমার আবার বুঝলেন কিনা, হেঁ হেঁ ওসব ঠিক চলেনা ।” ভদ্রলোক যথারীতি দাঁত বের করে হেসে উঠলেন ।
ভদ্রলোক বলে যেতে থাকলেন, “ তাই একটু বেরিয়ে পড়লাম । আশপাশটা একটু ঠিকঠাক করে দেখে নি এই ফাঁকে । বেশ একা একা বেরোলে এই রাতে একটা রোমাঞ্চ হয় । এর সাথে ভাবলাম যদি লাস্ট ট্রেন আসে, তাহলে ট্রেনে উঠে ফিরে যাব শালবনি । শালবনি স্টেশনের কাছেই আমার কোয়ার্টার । খুব বেশি সমস্যা হবেনা হেঁটে স্টেশন থেকে কোয়ার্টার ঢুকতে ।”
“ আমার মনে হয় তাহলে আপনাকে সকালে অবধি দাঁড়াতে হবে, কারণ আমি যতদূর জানি রাত্রিবেলার লাস্ট ট্রেন বেরিয়ে চলে গেছে । লাস্ট ট্রেনে আমিই নেমেছিলাম ।”
“ ওহো আপনি তো মশাই তাহলে আমাকে খুব আশাহত করে দিলেন ।” পুনর্বার একটু হেসে উঠলেন ভদ্রলোক ।
এমন মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার সময় এই আগন্তুকের আগমন আমার বিশেষ পছন্দ না হলেও একাকী থাকার চাইতে আরেকজন সঙ্গীকে নিয়ে থাকাটা বেশ ভালো বলেই বিবেচিত হল । একা একা এই অন্ধকারে থাকাটা কতটা বিরক্তিকর সেটা আমি খুব ভাল করেই উপলব্ধি করেছি । মা–বাবার থেকে দূরে চাকরির জন্য নিজেকে পড়ে থাকতে হয়, মনটা ভালো লাগে না কিন্তু কি করবো চাকরির জন্য থাকতে তো হয়ই কারণ নিজের রুটি–রুজির ব্যাপার ।
ভদ্রলোক এবার বলে বসলেন, “আপনাকে না ভাই, আপনি আপনি বলছি বটে কিন্তু আপনার বয়স টা বেশ কাঁচা । তাই বলছিলাম আপনাকে ‘তুমি’ বলা যায় কি ?”
ভদ্রলোকের এহেন হঠাৎ আবদারে প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলেও সামলে নিলাম । জানালাম, “ বেশ । সেটা ইচ্ছে হলে বলতেই পারেন ।”
ভদ্রলোক বললেন, “ আমার নাম শ্যামল, শ্যামল মুখার্জী ।”
আমি বললাম, “আমার নাম অর্ণব সামন্ত ।”
পর্ব – ৩
“ওহ, বাহ বেশ ভালো, বেশ ভালো । তোমার সাথে দেখা হয়ে ভাই বেড়ে ভালো লাগলো । আসলে কি জানো তো আমি আবার খুব আলাপি মানুষ, নতুন নতুন লোকের সাথে আলাপ করতে আমার বেশ উত্তেজনা লাগে । মানে আমি একটু দল–ভারি করি আর কি ! হেঁ হেঁ, আমি আবার চুপচাপ কথা বন্ধ করে থাকতে পারিনা ।”
আমার কেমন খটকা লাগলো । “দল–ভারি মানে কি বলতে চাইছেন ?” আমি বেশ গম্ভীর ভাবেই প্রশ্নটা ভদ্রলোকের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিলাম ।
“আহা, বুঝতে পারলেনা ? মানে এই যে রাতে যখন প্রকৃতির আসল সৌন্দর্য প্রকাশ পায়, যখন চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে যায় তখন প্রকৃতির সাথে একাত্মবোধ ক’জন করতে পারে ? সেই লোকেদের খুঁজে বের করে আমার শান্তি লাগে । মনে হয় পৃথিবীতে আমার মত আরও অনেক লোক আছে । তাদের সাথে কথা বললে নিজের একাকিত্ব টাও দুরীভুত হয় ।” ভদ্রলোককে এবারই বোধহয় একটু গম্ভীর হতে দেখলাম। মনে মনে একটা প্রশ্ন এলো, “আচ্ছা, ভদ্রলোকের চোখ দুটো কি মুহূর্তের জন্য জ্বলে উঠল ? নাকি আমার চোখের ভুল !” ঠিক বুঝতে পারলাম না ।
আমি একটু ব্যঙ্গাত্মক সুরেই বললাম, “ প্রকৃতির সাথে একাত্মবোধ করা লোকেদের নিয়ে দল–ভারি করতে গেলে বুঝি আশেপাশের মানুষদের সাথে খুব বেশী করে কথা বলতে হয় ? আমি তো জানতাম চুপ করে নৈসর্গিক শোভার রসাস্বাদনই সর্বাপেক্ষা শ্রেয় । সেটা থেকেই বোঝা যায় কে প্রকৃতি–প্রেমী আর কে নয় !”
আমার কথা শেষ হবার আগেই ভদ্রলোক মুখ দিয়ে ‘চুকচুক’ আওয়াজ করে বলে উঠলেন, “ আমি তোমায় বিরক্ত করেছি বুঝি ? সরি ভাই, কিছু মনে করো না । আসলে এটা আমার একটা বাজে স্বভাব । ওই যে বললাম না, আমি কথা বন্ধ করতে পারি না ।” ভদ্রলোক আবার হেসে উঠলেন ।
এইবার আমিও হেসে ফেললাম । যাই হোক, আমি আর বেশী কথা বাড়ালাম না । মুখে জানালাম যে আমি বিশেষ কিছু খারাপ মনে করিনি । তবে ভদ্রলোকের সাথে কথা বলে আরো জানতে পারলাম যে ভদ্রলোক অকৃতদার এখনো বিয়ে করে ওঠেন নি এবং ভবিষ্যতেও সেটির কোনো ইচ্ছা নেই । মুক্ত বিহঙ্গের মতই বোধহয় সারা জীবন ঘুরে বেড়াতে চান ।
ঘড়িতে একবার চোখ রেখে দেখলাম রাত্রি একটা কখন বেজে গেছে । এদিকে এখনো স্টেশন মাস্টারের আসার কোনো নাম নেই । নিজের কপালকেই অগত্যা দোষ দিতে লাগলুম । মনে হচ্ছে সকাল অবধিই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে । কি আর করা যায়, ভদ্রলোকের সাথে একথা ও কথা বলতে বলতে রাত্রির মনোরম নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করার যে মানসিকতা ছিল সেটাও যেন আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে লাগলো ।
হঠাৎ করেই ট্রেনের তীব্র হুইসেলে আমাদের দুজনের চমক ভাঙল । কি ব্যাপার ! এখন তো কোনো ট্রেনেরই আসবার কথা নয়, অন্ততঃ আমি যতদূর জানি সেই জ্ঞান অনুযায়ী তো নয়ই । তবে ট্রেন এল কোত্থেকে ? তবে কি রেল কর্তৃপক্ষ আজকে কোন স্পেশাল ট্রেন এই লাইনে চালাচ্ছে যেটা আমার অজানা ? আমি একটু অবাকই হয়ে গেলাম এবার । আজ রাতে আর কি কি অদ্ভূত ঘটবে আমার সাথে কে জানে !
আমার ঘোর কাটল ভদ্রলোকের কথায় । “ভাই, তুমি তো বলছিলে যে লাস্ট ট্রেন বেরিয়ে গেছে । হেঁ হেঁ দেখলে তো ! আরেকটা ট্রেন ঠিক চলে এল । কপালে থাকলে সবই হয় । কথায় আছে না যদি যাও বঙ্গে কপাল তোমার সঙ্গে ।”
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম যে আমার যতদূর জানা ছিল এখন এই লাইনে কোন ট্রেন নেই ভোরবেলার আগে, এখন এই ট্রেন কোথা থেকে এলো এটা আমারও ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না ।
যাইহোক ট্রেনটা এসে প্লাটফর্মে দাঁড়ানো মাত্রই ভদ্রলোক একটা কামরায় লাফ দিয়ে উঠে পড়লেন এবং আমার দিকে ইশারা করে বললেন, “চলে এসো ভায়া, তুমি যাবে কোথায় ?”
“শালবনি ।” ছোট্ট করে উত্তর দিলাম আমি ।
“ আরে, ক্যায়াবাত ! একই পথের পথিক আমরা । ঠিক চিনেছি । উঠে এস । দাঁড়িয়ে কি করবে ? এই ট্রেন তো দেখছি আপ লাইনে যাচ্ছে । তার মানে শালবনিতে নিশ্চয়ই স্টপ দেবে । চলে এসো । রাত্রিবেলা এখানে একা এই প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করে কোন লাভ নেই ।” ভদ্রলোক খুব উৎসাহ ভরে আমায় ডাক দিলেন ।
আমিও ভেবে দেখলাম সত্যিই তাই । স্টেশন মাস্টার কখন আসবে তার কোন ঠিক নেই, তার চেয়ে বরঞ্চ আমি ভদ্রলোকের সাথে চলেই যাই । আজকে রাত্রিবেলা দরকার পড়ে নিজের বাড়িতে চলেই যাই, তারপর কাল সকালে এসে স্টেশন মাস্টারকে ফাইলটা দিয়ে দেওয়া যাবে । সেই মতো আমার অফিসারকেও জানিয়ে দেওয়া যাবে কাল সকালে ।
পর্ব – ৪
আমি দোনামোনা করতে করতে ট্রেনের কামরায় উঠে পড়লাম । ভদ্রলোক খি খি করে আবার হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “কি রকম অদ্ভূত না বল ! আমাদের জন্য একটা গোটা ট্রেন চলে এলো । তায় আবার পুরো ফাঁকা ।”
আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম সত্যি কথাই, কামরাতে আমরা ছাড়া আর কোন লোকজন নেই । এবার আমারও জানিনা কেন, গা–টা একটু ছমছম করে উঠল । স্টেশন মাস্টারের না থাকা, পুরো স্টেশন ফাঁকা থাকা, ভদ্রলোকের হঠাৎ করে উদয় হওয়া ইস্তক ভদ্রলোকের আচার–ব্যবহার আর এই হঠাৎ করে উদয় হওয়া ট্রেন জানিনা আমায় কিসের অশনি সঙ্কেত দিচ্ছিল । একটু আগে যখন এই জ্যোৎস্না স্নাত রাতের নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করছিলাম তখন এই রাত্রির গভীরে থাকা রহস্যময়তার কথা এই পোড়া মাথায় আসেনি ।
একটু আগে মনে হচ্ছিল একা একা সময়টা কাটানোর চাইতে একজন সহযাত্রী যদি থাকে তাহলে অন্তত অস্বস্তিটা কিছুটা হলেও কাটে কিন্তু এখন এই ভদ্রলোককে কাছে পেয়ে অস্বস্তিটা বাড়লো না কমলো সেটা আমিও ঠিক বুঝতে পারছিলাম না । যাই হোক, ট্রেনে ওঠার একটু পরেই ট্রেনটা ছেড়ে দিল । আমরা কামরায় জানলার পাশে মুখোমুখি দুটো সিটে বসে পড়লাম । ট্রেন চলতে শুরু করার পর আস্তে আস্তে ট্রেনের গতি বাড়তে আরম্ভ করলো । জানালার শার্সিটাকে উপর দিকে তুলে দিলাম, হাওয়াটা আসুক বেশ ভালোই লাগছে ।
এমনিতেই গ্রাম বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমায় সবসময় টানে । আর টানবে নাই বা কেন ! আমি যে গ্রামেই বড় হয়েছি । কিছুক্ষণ আগে যখন প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করছিলাম সেই ভাবটা যেন আস্তে আস্তে আবার ফিরে আসতে লাগলো ।
ভদ্রলোক বলে উঠলেন, “আমি ভারতবর্ষের নানা জায়গা ঘুরেছি । জানো তো ভাই, আমার ঘুরতে এত ভালো লাগে যে আমি বদ্ধ ঘরে নিজেকে বেঁধে রাখার পক্ষপাতী একদম না, যার জন্য আমি বিয়েই করলাম না সারাজীবন । কোনো বাঁধায় নিজেকে বাঁধবোনা । এই চাকরিটা করে যা পয়সা–কড়ি জমাই তা নিয়ে বছরে একবার আমি বেরিয়ে পড়ি ।”
আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললাম, “ বাহ! এতো খুবই ভালো কথা ।”
ভদ্রলোক আবার অদ্ভূতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে খি খি করে হেসে উঠলেন । এবার একটা জিনিস আমায় একটু বিব্রত করল । ভদ্রলোক দেখছি ক্রমাগত আমায় দেখে নিজের জিভ দিয়ে নিজের ঠোঁটদুটি চেটে যাচ্ছেন । স্টেশনে যখন দাঁড়িয়েছিলাম তখন ভদ্রলোক আমার থেকে একটু দুরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন আর জ্যোৎস্নার আলোয় পুঙ্খানুপুঙ্খ ভদ্রলোককে দেখা বা দেখবার ইচ্ছে কোনটিই আমার তখন ঠিক ছিলনা । তাই একটা ব্যাপার তখন খেয়াল করে উঠতে পারিনি । এখন ট্রেনের কামরার আলোয় স্পষ্ট দেখলাম ভদ্রলোকের ঠোঁট দুটি অস্বাভাবিক রকমের লাল । দুটি ঠোঁটের কোণ বেয়েই লাল রঙের কষ যেন শুকিয়ে জমাট বেঁধে আছে ।
মিনিট পাঁচেক কারুর মুখেই কোন কথা নেই । নীরবতা ভঙ্গ করলাম আমি ।
“ একটা রাত একটা মানুষের জীবন কত বদলে দিতে পারে না ? কত রকমের অভিজ্ঞতা একটা মানুষ একটা রাতের থেকে সঞ্চয় করতে পারে বলুন ?” আমার কথার উত্তরে ভদ্রলোক যথারীতি আমার মুখের দিকে চেয়ে উল্লাসে বলে উঠলেন, “ দেখেছ ভাই, এই জন্য আমি তোমাকে তখনই স্টেশনে বলেছিলাম তোমাকে চিনতে আমি কোন ভুল করিনি । তুমি আমার দলেরই লোক ।”
আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না । অনেক আজেবাজে প্রলাপ সহ্য করেছি, আর নয় তাই এবার বলে উঠলাম, “আপনি তখন থেকে বলে যাচ্ছেন আমি আপনার দলের লোক । কিসেরই বা দল আপনার আর আমি অজান্তে তার সদস্যই বা হলাম কি করে ? আর তাছাড়া যদি সদস্য না হতে চাই ?”
ভদ্রলোকের মুখের মধ্যে একটা আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম । কেমন হিংস্র হয়ে উঠলেন যেন । আমার দিকে একটু বিদ্রুপাত্মক হেসে বলে উঠলেন, “দলের কর্তা হিসেবে তোমাকে যখন পছন্দ হয়েছে, তখন তো সেই দলের সদস্য তোমাকে হতেই হবে ভাই । পালাবার যে কোনো পথ নেই এখানে আমার হাত থেকে । কে বাঁচাবে তোমায় ?”
আমি এই কথাটা শুনে একটু ঘাবড়ে গেলাম, “আপনি কি বলতে চাইছেন বলুন তো ?”
“ বলতে তো আমি অনেক কিছুই চাইছি । সব জিনিস তুমি বুঝলে হয়, এই যে হাত দেখছ এই হাত হলো দৈত্য ফ্রাংকেনস্টাইনের হাত । এটাকে চেন ? এর থেকে কারুর নিস্তার নেই ।” অট্টহাসি হেসে উঠলেন ভদ্রলোক । ট্রেনের আওয়াজ ছাপিয়ে উঠল সেই হাসি । উনি নিজের হাত দুটো তুলে আমার গলার দিকে এগিয়ে আসতে থাকলেন ।
খুব অস্বস্তি হচ্ছে আমার । উনি কে ? কেনই বা আমার সাথে এরকম করছেন ? আমি ছিটকে আমার সিট থেকে সরে কামরার আরেক কোণে ভয়ে সিটিয়ে গেলাম । খেয়াল গেল ওর হাতের দিকে । বলিষ্ঠ হাতের তালু দুটো, আঙ্গুলগুলো অস্বাভাবিক লাল । ও কি লাল রঙে ডোবানো নাকি রক্তে ? আমার মাথা ঝিমঝিম করছে ।
ভদ্রলোকের হাতদুটো আমার দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকল, এমন সময়ে আমার মর্মভেদ করে ট্রেনের হুইসেলের তীক্ষ্ণ শব্দ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল । খেয়াল করলাম শুধুমাত্র আমি নয় ওই লোকটাও শব্দটা শুনতে পেয়েছে । এতো তীক্ষ্ণ হুইসেলের শব্দ কানের পর্দা যেন ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেবে ।
“বন্ধ কর । বন্ধ কর” লোকটা নিজের কানে নিজের দু’হাত চেপে ধরে নিজের সিটে আবার বসে পড়েছে, যেন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে । নিজের চোখে দেখছি লোকটার কান থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে । এই বিভীষিকাময় দৃশ্য সহ্য করতে পারছিনা । এই তীক্ষ্ণ শব্দ কোনো বিপদের অশনিসংকেত বহন করে আনছে কিনা সেটা আমি বুঝতে পারলাম না তবে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম যে ট্রেনের কামরাটা অস্বাভাবিক রকমের দুলতে শুরু করেছে, যেন মনে হচ্ছে কোন ভূমিকম্প হচ্ছে ।
জানালার দিকে চোখ পড়তেই হঠাৎ চমকে উঠলাম । নিজের চোখে দেখছি ট্রেনটা আবার গোদাপিয়াশাল স্টেশনে ঢুকছে । এ কি করে সম্ভব ! এটা তো আপ লাইনের ট্রেন, এই ট্রেন গোদাপিয়াশাল ছেড়ে এগিয়ে যাচ্ছিল সামনে, তাহলে এই ট্রেন কি করে আবার আগের স্টেশনে ফিরে আসতে পারে ?
আতঙ্কে আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল । আমাকে পালাতেই হবে । ওই লোকটার থেকে, এই ট্রেনটার থেকে, সবকিছুর থেকে আমি পালাবো । আমি কোনরকমে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম, আমি ট্রেন থেকে লাফ মারতে যাচ্ছি । আর কোন উপায় নেই, এটা ছাড়া বাঁচতে পারব না ।
“ কোথায় যাচ্ছিস ? আমার হাত থেকে তোর নিস্তার নেই । ” বাজখাঁই গলায় গর্জে উঠল লোকটা । আরে, ওই লোকটা তো নিজেকে সামলে নিয়েছে । দ্রুত গতিতে আমায় ধরার জন্য রক্তমাখা হাতে এগিয়ে আসছে । হ্যাঁ, ওই তো , ওই তো আমায় ধরে ফেলল প্রায় । আমি লাফ দিলাম । লোকটাও কি লাফ দিল ? দেখতে পেলাম না ।
পর্ব – ৫
লোকাল থানার ইন্সপেক্টর সেন কিছুক্ষণ আগেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেছেন । ভোররাত এখন, ঘড়িতে এখন বাজে ঠিক চারটে । গোদাপিয়াশাল স্টেশনে স্টেশন মাস্টার গোপাল বাবুর ঘরে ওনার সাথে ইন্সপেক্টর সেন কিছু কথা বলছেন গম্ভীর ভাবে । গোপালবাবু একটু ভীতু প্রকৃতির লোক ।
“স্যার, লোকটা কে ? এখানেই বা এল কি করে ? ”
গোপাল বাবুর প্রশ্নের উত্তরে ইনস্স্পেক্টর সেন একটু চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “ লোকটা মানসিক ভারসাম্যহীন এক দাগি আসামী । ওর নাম শ্যামল মুখার্জী । শালবনির ট্যাঁকশালে সুপার ভাইজারের কাজ করতো । সব রকমের নেশায় ছিল অত্যন্ত পারদর্শী । ওকে অনেকবার ট্যাঁকশাল কর্তৃপক্ষ শুধরে যাবার সুযোগ দিয়েছিল কিন্তু ও শোনেনি । এর মধ্যে আবার চুরিবিদ্যাও রপ্ত করে নেয় । গতকাল বিকালে পাঁচ লক্ষ টাকা চুরি করে ট্যাঁকশাল থেকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে যাওয়ায় মরিয়া হয়ে ট্যাঁকশালের দুজন রক্ষীকে নির্মম ভাবে হত্যা করে শ্যামল ।
মানসিক বিকার ছাড়া ওরকম ভাবে পাথর দিয়ে মাথা ঠুকে দুটো মাথা কেউ থেঁতলে দিতে পারে না গোপালবাবু । আমার চাকরি জীবনে অনেক মার্ডার দেখেছি কিন্তু এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড আমি খুব কম দেখেছি । লাশ দুটো দেখে আমি নিজেও কাল শিউরে উঠেছি । যাইহোক, শ্যামল মুখার্জী পালাতে পারেনি । ওকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যাবার পথে হঠাৎই গাড়িতে থাকা দুই অফিসার আর ড্রাইভারকে আক্রমণ করে বসে শ্যামল । অমানুষিক শক্তিতে এক অফিসারের গলার নলি ছিঁড়ে নেয় নিজের দাঁতে, আরেক অফিসার এবং ড্রাইভারকে দাঁতে–নখে ক্ষত বিক্ষত করে দেয় । ওদের অবস্থা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক । ওদের মধ্যে ড্রাইভারটি আমাকে ফোনে কোনক্রমে জানায় যে শ্যামল আবার শালবনি পালিয়ে যাচ্ছে কারণ যে ট্যাঁকশালের অফিসার ওকে চুরি করতে হাতে নাতে ধরে ফেলেছিল তাকে ও নিজের হাতে খুন করতে চায় । আমি খবর পেয়ে এই অঞ্চল তন্নতন্ন করে খুঁজে একটু আগে এই স্টেশন থেকে ওর রক্তাক্ত দেহটা উদ্ধার করেছি । এখনো বেঁচে আছে, কিন্তু মারাত্মক জখম, দুটো কানের থেকেই খুবই রক্তপাত হয়েছে দেখছি । হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে ওকে । আমি বড় অবাক হয়ে যাচ্ছি এই ঘটনায় । কি এমন হল ওর সাথে কি জানি ! ও কথা না বলতে পারা অবধি কিছু জানতে পারবনা । যাইহোক, যেহেতু রেল বিভাগের অন্তর্গত জায়গা থেকে ওকে আমরা উদ্ধার করেছি তাই আপনাকে জানানোটা আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে ।”
গোপালবাবু এতক্ষণ চুপচাপ সব শুনছিলেন । এবার আস্তে আস্তে বললেন, “ কাল ওর সাথে কি হয়েছিল সেটা স্যার এখন আমি আন্দাজ করতে পারছি । ”
“ কি সেটা ? ” অস্ফুট স্বরে ইন্সপেক্টর সেন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন ।
“ স্যার, আপনি ভূতে বিশ্বাস করেন ?” গোপাল বাবুর পাল্টা প্রশ্ন ইন্সপেক্টরকে ।
“ কিসব যাতা বলছেন বলুন তো ?” ইন্সপেক্টর সেন ভ্রূ কুঁচকে বেশ বিরক্ত হয়েই বললেন, “আপনার কি মনে হয় এই ভোররাতে আমি আপনার সাথে মস্করা করতে এসেছি ?”
গোপাল বাবু ধীর গতিতে বলে চললেন, “ না স্যার । মস্করা কেন করব ? জানি অনেকেই বিশ্বাস করবে না । তবু বলি এই স্টেশনের একটা বদনাম আছে । বছর দশেক আগে কোনএক রাতে অর্ণব সামন্ত নামে এক তরুণ টিকিট পরীক্ষক তার নিজের বাড়ি শালবনি যাবার পথে লাস্ট প্যাসেঞ্জারে এই স্টেশনে নামে । তার উদ্দেশ্য ছিল তার সাথে থাকা একটা গুরুত্বপূর্ণ ফাইল এই স্টেশনের স্টেশন মাস্টারকে দেওয়া কিন্তু স্টেশন মাস্টার খুব অসুস্থ থাকায় এবং হসপিটালে ভর্তি থাকায় সেদিন রাত্রিবেলায় সে কাউকে দেখতে পায়নি এখানে । ওদিকে প্যাসেঞ্জার ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছিল , তাড়াহুড়োয় ট্রেনে উঠতে গিয়ে ওই ট্রেনেই কাটা পড়ে অর্ণব । তারপর থেকেই এখানে বছরের ওই নির্দিষ্ট রাতে সে আসে । আসলে ও বড় একা, মহাকালের পথের একাকী পথিক অর্ণব এখনো আশায় আছে যাতে একজন সহযাত্রী অন্ততঃ সে জোটাতে পারে । কালই ছিল সেই বিশেষ রাত । শ্যামলের কপাল ভালো, হয়তো ওকে অর্ণবের সহযাত্রী রূপে পছন্দ হয়নি । তাই ও বেঁচে আছে ।”
ইন্সপেক্টর বেশ মন দিয়ে কথাগুলি শুনছিলেন হঠাৎ দরজার বাইরে একটা ছায়ামূর্তি দেখে “ কে ওখানে ?” করে ছুটে এলেন কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না । মনে হোল ছায়ামূর্তি টা কোথায় চট করে মিলিয়ে গেল ।
“আসলে ভোর হয়ে আসছে । আমাকেও চলে যেতে হবে । আমিই অর্ণব, আড়াল থেকে গোপাল বাবু আর ইন্সপেক্টর সেনের কথাগুলি শুনছিলাম । আমাকে নিয়েই তো ওদের যত আলোচনা । আবার পাক্কা একটি বছরের অপেক্ষা, জানি না কবে আমার সহযাত্রী আসবে ! মহাকালের এই পথে আমি বড় একা , বড় একা ।”
লেখক পরিচিতি : সৌমাভ নন্দী