‘কৃষ্ণ বর্মন’ কবিতা সমগ্র

0
2080

ঈশ্বরের ক্ষতি

বড়ো ক্ষতি হয়ে গেল এই কদিনে।
অপূরণীয় ক্ষতি।
মানুষের ক্ষতি না হয় ত্রান দিয়ে সামলে দেওয়া যায়।
ষোলো আনার ক্ষতি হলে
চার আনা দিয়ে সান্ত্বনা দেওয়া যায়
প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রশমিত করা যায়।
কিন্তু এত বড়ো ক্ষতি পোষাবে কে!

এক নয় দুই নয় তিন নয়।
দেখতে দেখতে প্রায় পচাত্তোর দিন!
এত দিনে ঈশ্বর বোধহয় ভুলতে বসেছেন যে
তিনি সর্বশক্তিমান সর্বশ্রেষ্ঠ।
ভক্তদের আনাগোনা স্তুতি প্রশস্তি না থাকায়
বোধহয় ধীরে ধীরে হারাতে বসেছে তাঁর ঐশ্বরিক শক্তি।
এ তো অস্তিত্ব সংকট!
এমন বিপদের দিনে মানুষ যদি ঈশ্বরের
পুনুরুজ্জীবনের কথা না ভাবে
তবে কে ভাববে!

ইশ্বরের নামে না খেয়ে থাকা যায় পয়তাল্লিশ দিন।
তাঁর নাম করলেই সেরে যায় সব ব্যথা বেদনা মহামারী।
তিনিই তো একমাত্র পারেন মহাজাগতিক চমৎকার ঘটাতে।
মনোষ্কাম পূরণের জন্য মানুষ তাঁর সামনেই
তো দিতে পারেন নিজের সন্তানের আহুতি।
তাঁর নাম নিয়ে মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা
হাঁটতে পারেন জ্বলন্ত কয়লার উপর দিয়ে
কিংবা তাঁর পবিত্র ক্ষতে দিকে তাকিয়ে
কাটিয়ে দিতে পারেন দীর্ঘ অন্ধকার রাত্রি।
তিনি সর্বহরা সর্বজয়া।

এমন ঐশ্বরিক অলৌকিক শক্তির আধারকেও কিনা
মানুষের আদেশের সামনে করতে হোলো মাথা নত!
তাঁকেও থাকতে হোলো মন্দির মসজিদ কিংবা গীর্জায় বন্দী!
অথচ তিনি তো এই পৃথিবীর সকল কিছুর স্রষ্টা।
তাঁর ইচ্ছেতেই জগৎ চলে।

ভাবা যায় ঈশ্বরও নাকি অসহায় !
তিনিও নাকি রক্ষা করতে পারবেন না সেই ভক্তকুলকে
যারা লাখো লাখো টাকার উপাচার সামগ্রী অলঙ্কার
ইমারত কিংবা মূর্তি নির্মানে তাঁর অস্তিত্ব করেন
আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত।
তিনিও এই বিপদের দিনে মুখ ঢেকে আছেন অন্তরালে।
এরপর তো তাঁর একনিষ্ঠ ভক্তরাও তাঁকে সন্দেহ করবে।
আরো বড়ো ক্ষতি হয়ে যাবে তাঁর
কিংবা পূজারী অথবা সেবাইতের।
তখন আর কে পোষাক দেখে ধর্ম দেখে
ঠিক করে দেবেন মানুষের চরিত্র!
এ তো মহামারীর চেয়েও বড়ো বিপর্যয়।

তাই শ্রমিকের কারখানা খুলুক বা না খুলুক
ট্রেনের চাকা চলুক বা না চলুক
শিক্ষাঙ্গনে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা শুরু হোক বা না হোক
ঈশ্বরকে আর কিছুতেই বন্দী করে রাখা যায় না।
মানুষের যদি প্রার্থনার জায়গাও না থাকে
যদি সে অলৌকিক আরোগ্যের দাবীও
না রাখতে পারে ঈশ্বরের কাছে
তখন ব্যর্থতার সব দায়টাই যে পড়বে
মানুষের দ্বারা নির্বাচিত নীতি নির্ধারক
কিংবা নেতৃত্বের উপর।
তাই সবার আগে মুক্তি দাও ঈশ্বরকে।
ঈশ্বরকে থাকতে দাও ঈশ্বের মত
না হলে আরও গভীর হবে
ইশ্বরের ক্ষতি ও ক্ষত।

সত্যিই বড়ো ক্ষতি হয়ে গেলো এ কদিনে!

কবি পরিচিতি : কৃষ্ণ বর্মন

আমি ভরসা রাখি

আমি আজও তোমাকে ভরসা করি
ভরসা রাখি মানুষের উপর
আমার সামনে হাজারো বিশ্বাসভঙ্গের দৃষ্টান্ত
প্রতিদিনই প্রিয়জনেরা হৃদয়ে এঁকে দেয়
প্রতারনা আর আঘাতের চিহ্ন
প্রতিক্ষণে নির্বাক চোখের সামনে ভেঙে যায় স্বপ্নের ইমারত
তবুও আমি তোমাকে ভরসা করি
ভরসা রাখি মানুষের উপরপৃথিবীর অসুখ এখন আরো গুরুতর
রাতের আঁধার এখন ঘিরে রেখেছে প্রখর দুপুরকেও
মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব এখন প্রশ্নের সম্মুখীন
মৃত্যু আর মৃতের জন্য শোক মিছিলও এখন অপরাধ
প্রতিরোধের চেষ্টা হয়তো আছে
তবুও অসহায় আত্মসমর্পন
নিরাময়ের আশা ক্রমশ ক্ষীণতর
প্রতিষেধক এখনও অমিল

যারা মরে যাচ্ছে তাঁরা তো মরছেই
যারা বেঁচে আছে তাঁরাও মরছে প্রতি মুহূর্তে
আতঙ্ক আশঙ্কা আর মৃত্যুভয়ে
কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না
কেউ কাছে আসছে না সান্ত্বনা দিতে
সবাই এখন চৌম্বকের একই মেরু
দূরে তো তাঁরা আগেই সরে গিয়েছিলো
এখন ছিটকে যাওয়ার পালা

এই সন্দেহ শঙ্কা সংকোচে মধ্যেও
আমি আজও তোমার উপর ভরসা রাখি
ভরসা রাখি মানুষের উপর
মানুষই পারে সমস্ত উত্তর আর উত্তরনের দিশা দেখাতে

কবি পরিচিতি : কৃষ্ণ বর্মন

 

 

রোদ্দুর_রায়

প্রিয় রোদ্দুর,
তুমি পৃথিবীর কাছে বড়ো আদরের।
তোমার জন্য ঘুটঘুটে অন্ধকারে
হৃদয়ের আশার প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করে বসে থাকা।
রাতের অন্ধকারের আধিপত্য
আর উষাকালের কুহেলীকার ঔদ্ধত্যকে উপেক্ষা করে
তুমি যখন নির্দিষ্ট নির্ধারিত রেখা বেয়ে নেমে আসো,
পৃথিবীর পরতে পরতে তখন ঔজ্জ্বল্যের উচ্ছ্বাস–
দিগন্তে পেরিয়ে উল্লিসত বিহঙ্গের নিরুদ্দেশ যাত্রা,
তৃণমঞ্জরীর শীর্ষে অধিষ্ঠিত শিশির কণায়
নতুন উদ্যম আর উৎফুল্লতার প্রতিফলন।রোদ্দুর,
তোমার কাছে বড়ো ঋণী আমরা।
তোমর রাশি রাশি আলোর হাসি
দূরীভূত করে প্রকৃতির গাঢ়তম অন্ধকার
আলোকিত করে মনের মলিণতম সংকীর্ণ প্রকোষ্ঠ।
তোমার তেজে দৃপ্ত হয় প্রকৃতি
তুমি শক্তির আঁধার
উদ্ভিদদের তুমি সঞ্চারিত কর অফুরান প্রাণশক্তি।রোদ্দুর,
তুমি নিকানো উঠোনের অতিথি
তুমি বারান্দায় নিত্য নতুন আলাপনের আল্পনা
তোমার সাহচর্যে পর্তব শিখরে আহ্লাদী গোধূলীর বধূবরণ
তোমার স্পর্শেই শীতার্ত শহরের আন্তরিক উষ্ণতা
অন্তরে অন্তরে বিচ্ছুরিত করে অবিচ্ছিন্নতার রশ্মি রেখা।রোদ্দুর,
তুমি চিরন্তন।
তুমি শাশ্বত।
অথচ চিন্ত চিন্তন চেতনায় এখন
তোমার বিষাক্ত উপস্হিতি।
ঠিক অবিকল তুমি নয়
তোমার নামধারী অবাঞ্ছিত রোদ্দুরের প্রখরতম উষ্ণায়ন
বর্তমান প্রজন্মের মগজে মননে।
প্রচন্ড তাপে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে
সজীব সবুজ অনুভূতির কোমল প্রান্তরের সদ্য অঙ্কুরিত চারাগাছ।
এমনকি প্রাচীনতম বৃক্ষের ডালে ডালেও দাবানল।
বসন্তের পলাশ শিমূল কৃষ্ণচূড়ায়
এখন পোড়া দগদগে ক্ষত।
দহনের এক বিকট গন্ধে ম ম করছে আকাশ বাতাস
পথে ঘাটে স্বেচ্ছায় অগ্নিদগ্ধ চেতনার চিহ্ন,
সেই চিহ্ন ধরেই দলে দলে চলছে
অবচেতন অচেতন অনুগামীর দল।

জানো রোদ্দুর,
বড়ো ভয় হয়
একটা অজানা আশঙ্কার শ্বাসমূল আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে চায়
আমার সচেতন বোধ আর বুদ্ধিকে।
মাঝে মাজে সন্দেহ হয়
আমি নিজেও আত্মসমর্পন করছি না তো নির্বিবাদে।
প্রশ্ন জাগে–পারব তো আগামীর জন্য
একটা সুন্দর সুরক্ষিত বসন্ত রেখে যেতে।

রোদ্দুর,
তোমার নামে নিয়ে এই যে এত উন্মত্ততা
এই যে করোনা ভাইরাসের থেকেও
বিষাক্ত নকল রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়ছে
যাদবপুর থেকে রবীন্দ্রভারতী
জোড়াসাঁকো থেকে শান্তিনিকেতন–
তা দেখেও তুমি নীরব থাকবে?
প্রতিবাদ করবে না একবারও?

রোদ্দুর,
জানি তুমি মূক না হলেও নির্বাক।
তুমি শুধু অবাক করতেই জানো।
কিন্তু তোমাকে নিয়ে যে বাদল টুটে যাওয়ার গান গেয়েছে,
যে মেঘের অন্তরালে তোমার অপহরন দেখেও
নির্ভয়ে অপেক্ষার কথা বলেছে,
ঘোষনা করেছে সদাহাস্য সূর্যের অনিবার্য প্রকাশ
তাঁর কাছে বড়ো জানতে ইচ্ছে হয়
সে কি এখন কেবলই ছবি
কেবলই মূর্তি সে পার্কে কিংবা তিন রাস্তার মোড়ে।
তাঁর কাছে আমি কোনো দিনই পৌঁছতে পারিনি,
আগামীতেও যে পারব
সেই বিশ্বাসও দৃঢ় নয়।
তবুও এই দগ্ধ পুরীতে দাঁড়িয়ে
বিদগ্ধদের আশ্চর্যজনক ভাবে নীরব দেখে
সোচ্চারে না হলেও
মনে মনে আকুতি জানাই
আমার চিন্তা চেতনার সূর্য
আমার মেঘলা দিনের রোদ্দুরের কাছে–
এই অনাচার অন্যায়ে দিনে
তুমি আবার ফিরে আসো তোমার ন্যায়দন্ড নিয়ে
এক অমোঘ অকুতোভয় রায় ঘোষনার জন্য
যাতে আর কখনো কেউ কোনো দিনে
দুঃসাহস না দেখায়
দূর্বল বিশ্বাস আর চিন্তনকে বিষাক্ত করে
তোমারই পবিত্র তীর্থভূমিকে
কলঙ্কিত লজ্জিত করার।

কবি পরিচিতি : কৃষ্ণ বর্মন

 

 


সুড়ঙ্গে

প্রতিদিনই মনে হয় একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে
হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলছি।
যতই এগোই অন্ধকার হয় গাঢ়তর।
ঘণ হয়ে আশা ভয় আতঙ্কের মধ্যেও
এই বিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে চলি যে
আর কিছুদূর হামাগুড়ি দিলেই
সুড়ঙ্গের খোলা মুখ
যেখান দিয়ে আলোর ঝর্ণা এসে
ভিজিয়ে দিচ্ছে সমস্ত অন্ধকারকে।
তারপর দুই হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে সোজাসুজি দাঁড়ানো
সামনে অসীম সবুজ উপত্যকা
চোখের পাতায় অনন্ত দিগন্ত
বাতাসে এক বুক স্বাধীনতা।প্রতিদিন সুড়ঙ্গে হামাগুড়ি দিতে দিতে
আমি এই ভাবনাতে ডুব দিয়ে ভুলে যাই
আশেপাশের অন্ধকার ভ্যাপসা গরম কীট আর
আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরা মাকড়শার জাল
অথচ বারবারই হারিয়ে যাই সুড়ঙ্গের গহীন অন্ধকারে
আমার আর ফেরা হয়না আলোর ঠিকানায়
হামাগুড়ি দিতে দিতে আমি মিশে যাই
অন্ধত্ব আর বন্ধ্যাত্বের নিত্য অন্ধকারে …
কবি পরিচিতি : কৃষ্ণ বর্মন

 

Photo: pixabay

আরেকবার পরাধীন হওয়া দরকার

এই দেশটার আরেকবার পরাধীন হওয়া দরকার
আরেকবার দরকার বন্ধনের শৃঙ্খল
স্বাধীনতা এই দেশের কাম্য নয়
এই দেশ জানে না স্বাধীনতার মানেএই দেশ স্বাধীন তাই ভাতের নয় জাতের লড়াই
এই দেশ স্বাধীন তাই তেলেঙ্গানার জন্ম
এই দেশ স্বাধীন তাই গুজরাটে দাউদাউ আগুন
স্বাধীন বলেই এই দেশে রাম রহিম
স্বাধীন বলেই এই দেশে আফজল গুরু
স্বাধীনতার তৃপ্তি নিয়ে এই দেশে
অনাহারে নিদ্রা যায় পথ শিশু সর্বহারা নর নারী
স্বাধীনতার নেশায় মত্ত যুব সমাজ
উদ্বাহু আস্ফালনে ভুলে যায় আপন পরিচয়
স্বাধীনতার অবাধ লাইসেন্সে নিভৃত রাস্তায়
কিংবা নির্জন বাসে কিশোরীর গনধর্ষনস্বাধীনতার মন্ত্র বলে দেশটাকে বেচে দেয়
দেশেরই রক্ষক যারা
স্বাধীনতা আছে বলেই সীমান্তে অকারণ গোলাবর্ষন
স্বাধীন বলেই আজ এত বিভাজন এত বিভেদ
স্বাধীনতা আছে বলেই আজ সকলের পথ আলাদা
স্বাধীনতা আছে বলেই এখন জোট বাঁধে না কেঊ
স্বাধীন বলেই দেশটা আজ নিস্তরঙ্গ ওঠে না ঢেউএই দেশটার আরেকবার পরাধীন হওয়া দরকার
আরেকবার দরকার বন্ধনের শৃঙ্খল
কবি পরিচিতি : কৃষ্ণ বর্মন

Photo: dekhnews

দ্বিশত বর্ষে বিদ্যাসাগর

তুমি শুধু সাগরের মত বড় নও
সাগরের মত গভীরও
তোমার বিশালতা দূর থেকে দাঁড়িয়ে
তোমাকে না স্পর্শ করেও বোঝা যায়
কিন্ত গভীরতা মাপতে গেলে
তোমার মধ্যে ডুব দিতে হয়তোমাকে অবাক হয়ে দেখার ইচ্ছে যতটা
তোমার গভীর থেকে মনি মুক্তো খুঁজে আনার সাহস
তার বিন্দুমাত্র চোখে পড়ে না
তোমার সবচেয়ে বড় অনুরাগীর মধ্যেও
তাইতো নামে তুমি যতটা বড়
অনুধাবনের পরিমানে ততটা গভীর তুমি আজও নওসৌধ মঞ্চ সেতু সড়ক বিদ্যাঙ্গনের নামাঙ্কনে তুমি বহুল
অথচ তোমার ‘বর্ণপরিচয়’ তোমার ‘আদর্শলিপি’
দিগদর্শনহীন অনাদর অবহেলার পাত্র
তোমার স্বপ্নসন্ধানী নারীকুল আজও
বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে বঞ্চিত লাঞ্ছিত অবাঞ্ছিত
তোমার জ্ঞানের আলোক শিশু
আজ অন্ধকারের পথযাত্রী
তোমার সাধের বাংলা ভাষা
আজ আশাহীন পরিভাষা ক্ষীণতবুও সেদিন হতে দ্বিশত বর্ষ পরে
আজও তুমি অম্লান আজও অটুট
আজও পথের মাইল ফলক দেখে হেঁটে চলছো তুমি
আজও পথের প্রান্তে আবছা আলোর নীচে
তোমার স্পষ্ট উচ্চারন
আজও সময় মেনে চলা
আজও অনুশাসনতুমি সাগরের মত বড়
তুমি সাগরের মত গভীর
তুমি স্রোতের সচল ধারা
তুমি আজও হওনি স্হবির
কবি পরিচিতি : কৃষ্ণ বর্মন
Photo: toppr

জাতির জনক

তুমি হিংসার কথা বলনি
তুমি হিংসার পথে চলনি
তবুও তোমাকে নিয়ে হিংসার শেষ নেই
যারা কোনো দিন কারো জন্য হাঁটলো না পথ
গড়ল না জনমত
তারাই তোমার সব চেয়ে বড় নিন্দুক.তুমি চাইলেই হিংসার কথা বলতে পারতে
হতে পারতে অবিংসবাদী সহিংস মুখ
কিন্তু তুমি জানতে সবাই হিংস্র নয়
সবার হিংস্রতা মানায় না.
রক্তপাত আর রক্তদানের মত দামাল সাহস
সকলের বুকে নেই
সবাই পারে না বারুদের বিনিময়ে কথা বলতে বারুদে.তাই তো যারা কোনো দিন পারেনি চলতে
পারেনি নিজের কথা বলতে
তাঁদের মৃত মৃদু মৌণতাকে ভাষা দিয়েছো
বাঁচার নতুন আশা দিয়েছো
তোমার স্হির অচঞ্চল প্রত্যয়ে
হেঁটেছো সকলের সাথে নির্ভয়ে.তোমার সত্যের পথে বাঁধা এসেছে
অসহযোগী মনোভাবে নিন্দা জুটেছে
তবুও তোমার যাদুতেই কন্ঠে কন্ঠে
ভারত ছাড়ার দাবী ফুটেছে.তুমি তোমার মত ছিলে বলেই
আজও তুমি আছো
আজও আছো  বর্ণবিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে
আজও আছো নতুন ভারতের অভিযানে
আজও আছো চম্পারনে
আজও আজো বন্ধুত্বে
আজও আছো নতুনত্বে
আজও আছো স্বাধীনতায়
আজও আছো সহিষ্ণুতায়
তুমি এভাবেই থাকবে চিরকাল
ডুবন্ত সময়ে ধরে
নতুন ভারতের হাল.
কবি পরিচিতি : কৃষ্ণ বর্মন

 

Photo : awakentheworld

সমাধি

আজও সমাধির সামনে দাঁড়ালে
আজও সম্বোধন করলে হৃদয়ের ভাঙা দুয়ারে দাঁড়ায়ে
সারা দেয় সে
পাথরের বুকে জন্মেছে যে সবুজ ঘাসের দল
মাথা নেড়ে বলে ওঠে
মূক মনের সুখ কথা
দু একটি শুকনো পাতা এসে আড়ি পাতে
দুঃখের আলাপনে
আজও চিন্তায় জেগে থাকে গভীর রাত
ছাতা নিয়ে অপেক্ষায় থাকে পাড়ার মোড়ে
কোনো অঝোর ধারায় কিংবা কালবৈশাখী সন্ধ্যায়
আজও স্নেহের আঁচলে খাওয়ার পরে মুছিয়ে দেয় মুখ
আজও অজানা আতঙ্কে দুরু দুরু বুকআজও বছরে এক দু’বার সামনে এসে দাঁড়ালে বলে ওঠে–
মুখটা শুকনো কেন তোর
ফেরার বেলায় বলে—
সাবধানে যাস
খেয়ে নিস সময় মতো
আমি এখানে বেশ আছি
সঙ্গে নিয়ে স্মৃতি যত
কবি পরিচিতি : কৃষ্ণ বর্মন

মাস্টার মশাই, আপনি কিছু দেখেননি.

মাননীয়,
শিক্ষক শিক্ষিকাগন
গতকাল আপনার দিবস ছিল
হ্যা শুধু গতকালটাই আপনার দিবস
গতকাল আপনাকে
পেন দিয়েছি
চকলেট দিয়েছি
নানাবিধ উপহার দিয়েছি
কেক মাখিয়ে দিয়েছি আপনার চোখে মুখে
শ্রদ্ধায় গদগদ চিত্তে আপনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণামও করেছি।

শুধু আমি বা আমরা কেন
প্রায় প্রত্যেকেই আপনাকে কিছু না কিছু দিয়েছে
হঠাৎ করেই পনেরো বছর আগের ব্যাচের
ক্লাসের সবচেয়ে আর মেধাবী আর প্রিয় ছাত্রটি
মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে হাজির হয়েছে
পাড়ার ক্লাব আপনাকে ডেকে
সন্ধ্যা বেলায় পরিয়েছে চন্দনের টিপ
দিয়েছে ফুলের তোড়া আরও কত কি।

আপনার গতকালের এই প্রাপ্তি
সারা বছর অবহেলা অপমান আর গ্লানির মধ্যেও
আপনার পরিবারকে একটু হলেও গর্বিত হয়েছে
আপনার ছোটো সন্তান খুশী হয়েছে ক্যাডবেরীতে
স্ত্রী খুশী হয়েছে দামী উপহারে
বাবা মা খুশী হয়েছে গলায় উত্তরীয় দেখে
গতকাল আপনি ছিলেন
একজন যথার্থ শিক্ষক
একজন আদর্শ।

এই ভাবে পাওয়াটা আপধার অভ্যাস নয়
যারা সারা বছর এই ভাবে কিছু না কিছু পেয়ে থাকে
তাঁদের মেরুদন্ডটা আসতে আসতে বাঁকা হতে শুরু করে
আপনি যদি মেরুদন্ডটা আরও একটু বাঁকা করতে পারতেন
কিংবা মাথা নোয়াতে পারতেন মাথাহীনের কাছে
তাহলে নির্ঘাৎ শিক্ষারত্নের মত কিছু একটা
আপনার কপালে জুটে যেত গতকাল।

মাস্টার মশাই
দিদিমনি
আর সমগ্র শিক্ষককূল-
আপনি বা আপনাদের জন্য আমাদের হৃদয়ে
শ্রদ্ধার কোনো অভাব নেই
আমাদের মত বিনয়ী ছাত্র ছাত্রী এই পৃথিবীতে খুব কমই পাবেন
শুধু একটাই অনুরোধ
একদিনেই যখন এত কিছু পেয়ে যান
তখন সারা বছর আপনারা আমাদের আমাদের মত থাকতে দিন
মাঝে মাঝে অতি উৎসাহী হয়ে
আমাদের বিব্রত কিংবা বিব্রত নাই বা করলেন।

আপনারা তো সচেতন বুদ্ধিমান মানুষ
আপনার নিশ্চই এত পদক উত্তরীয়
ফুলের স্তবক চকলেট কেক চন্দনের ফোটার মানে বোঝেন
নিশ্চয়ই আপনাদের মানস চক্ষে পড়ে নেন অদৃশ্য দেওয়াল লিখন
এখন আর আগের সময় নেই মাস্টার মশাই
এখন আর অত কিছু দেখতে নেই
অত কিছু বুঝতে নেই
বলতে তো নেইই।

মাস্টার মশাই আসল কথাটা মাথায় রাখবেন
হ্যা সারা বছর শুধু এই কথাটাই মাথায় রাখবেন
যে গতকাল যা বলেছেন বলেছেন
কিন্তু আজ থেকে আপনি বা আপনারা কিছুই দেখেননি
তাতে সকলেরই ভালো।

 

কবি পরিচিতি : কৃষ্ণ বর্মন

 

 

 

Photo :zeenews

ঈশ্বরের চাকর

এতদিন একটিও কথা শোনেননি আপনারা
গান শুনিয়ে দু’হাত পাতলে
এড়িয়ে যাওয়াই ছিল
স্বভাব সুলভ সভ্য আচরণ
কথায় কর্ণপাত করা তো দূরের কথা
পাশ দিয়ে গেলে নাকে রুমাল দিয়েছেন
ভ্রু কুঁচকেছেন

আপনার এসব ভালো ভাবেই করতে জানেন
কারণ আপনারা সভ্য পরীশীলিত মার্জিত
আপনারা জানেন কোথায়,কি এবং কতটুকু বলতে হয়
আপনারা তাই বিতর্কের ঊর্ধ্বে
সভ্য সমাজ আপনাদের কথায় আঙুল তোলে না

আপনারা আপাত শান্ত শিষ্ট পার্থিব জীব
তবুও আপনাদের মধ্যেই এক দুই জন ভগবান থাকে
সেই ভগবানের দৌলতে অবহেলিত প্রতিভা
হয়ে ওঠে পরিচিত প্রচারিত সুপ্রভা
দেশ জোড়া হয় নাম
স্ক্রীনে স্ক্রীনে তাঁর মর্ম গাঁথা
হঠাৎ করেই ভাগ্যচক্রের উল্টো ঘূর্নিতে
মিলে যায় যশ খ্যাতি প্রভাব প্রতিপত্তি
ফিরে আসে সন্তান সন্ততি

এই সব কিছুই যেন নিপুন হাঁতের সাজানো এক চিত্রনাট্য
যিনি লিখে চলেছেন অজ্ঞাতে অন্তরালে
যে মানুষটি জীবনের তিন সিকি ভাগ সময়
পেয়ে এসেছে শুধু অবহেলা ঘৃণা বঞ্চনা
সেই অজ্ঞাত মানুষটি তো ভগবান হবেনই
মানুষ তো তাঁর দূত মাত্র

পূথিবীর সিংহভাগ মানুষই আপনার বা আপনাদের মত নয়
তাঁরা মার্জিত নয়
গুছিয়ে বলতে পারে না মনের কথা
হৃদয়ের অনুভব আর মুখের কথায় ফারাক থেকে যায় বিস্তর
তাঁদের কথা হয় না সভ্য শোভন সুন্দর
অথচ হৃদয়ের গভীরে ডুব দেয় না কেউ
চলে বিস্তর টীকা টিপ্পনি জলঘোলা

যদি সত্যিই ঈশ্বরের চাকর বলে কেউ থাকেন
যদি তাঁর মধ্যে ঈশ্বর সুলভ বোধ থাকে
তবে তিনি নিশ্চয়ই আপনার বা আপনার মত করে ভাববেন না
নিশ্চয়ই তিনি ভুল বুঝবেন না
তিনি জানেন আদতে সকলেই মানুষ
সেও মানুষ
মানুষ বলেই ভুল হয়
মানুষ বলেই বিকৃতি হয় বিচ্যূতি হয়

শুধু মানুষ হলেই চলে না
ঈশ্বর হতে গেলে
মানুষের মত মানুষ হতে হয়
ঈশ্বর তো সকলেই নিজেকে ভাবতে পারে
ঈশ্বরের চাকর হতে পার ক’জন।

 

কবি পরিচিতি : কৃষ্ণ বর্মন

 

স্বাধীন মাস্টার

মালো পাড়ার স্বাধীন মাস্টার মশাই
সবাই স্বাধীন মাস্টার বলেই চেনে
স্বাধীন মাস্টার বলেই ডাকে
সবার মত স্বাধীন মাস্টারেরও একটা নাম ছিল
আজও আছে
কিন্তু মনে রাখেনি কেউ
হয়তো মনে রাখেনি স্বাধীন মাস্টারও

স্বাধীন মাস্টারের স্বাধীন ভাবেই জন্ম
বড় হওয়া তাই অনাথ আশ্রমে
বেঁচে থাকাও স্বাধীন ভাবে
পরাধীন হবে না বলেই
আজও স্বাধীন মাস্টারকে বাঁধতে পারেনি কোনো বাঁধন

বাঁধন যে একেবারেই তাঁর ছিল না তা নয়
সে বাঁধন মায়ার থেকে বড়
কায়া সেখানে মূল্যহীন
তাই তো আশ্রমে থেকে বি.এ. পাশ করার পর
একাত্তরের উত্তাল দিনে
যখন লাখো লাখো উত্তাল উদ্বাস্ত স্রোত
আছরে পড়ছে এপার বাংলায়
স্বাধীন মাস্টারও ঝাঁপিয়ে পড়ল
মানবিক স্বাতীনতার মহা মন্ত্র নিয়ে
সে স্বাধীনতা সাত চল্লিশ কিংবা একাত্তরের
স্বাধীনতার থেকেও মহান

বয়স একুশের তরতাজা যুবক
নিজেকে সঁপে দিয়েছিল উদ্বাস্তু কলোনী
মালো পাড়ায় আলো আনয়নে
গড়ে তুলেছিল এক প্রাইমারী স্কুল
বিনা অর্থের বিনিময়ে পৌঁছে দিয়েছিল জ্ঞানের আলো
মালো পাড়া পেয়েছিল বেঁচে থাকার নতুন দিশা

কালক্রমে স্বাধীন মাস্টারের খোলা আকাশের স্কুলের জুটেছিল
কংক্রীটের ছাদ টেবিল বেঞ্চ সবই
তারপর বয়ে গেছে কত ছাত্রধারা
মালো পাড়ায় গড়ে উঠেছে বাহারী ইমারত
রাস্তায় পড়েছে পীচ পুকুর পেয়েছে বাঁধানো ঘাট
আলোর প্রভায় ঘুচেছে রাতের আঁধার

কিন্তু কবে থেকে যে স্বাধীন মাস্টারের স্কুলের ইটগুলো
একে একে খুলে পড়তে শুরু করেছে
স্বাধীন মাস্টার নিজেও বুঝতে পারেনি
স্বাধীন মাস্টার এখন রিটায়ার্ড
সরকারী যাতাকলে দশ বছরেও শুরু হয়নি পেনশন
আসলে পাড়া সমাজ দেশ গোছাতে গোছাতে
নিজেকে আর কাগজপত্র গুছিয়ে রাখা হয়নি স্বাধীন মাস্টারের

স্বাধীন মাস্টারের ঠিকানা এখন ভাঙা স্কুল বাড়ির বারান্দা
তালা পড়েছে সব ক্লাসরুমে
খবর যে একেবারেই কেউ নেয় না তা নয়
দিন চলে যায় কোনো মতে
পুরানো ছাত্রছাত্রীর কৃতজ্ঞতায় বা করুণায়

স্বাধীন মাস্টারের আগস্টে আজও পনেরো তারিখ আসে
সকাল সাতটায় শুধু খোলা হয় না স্কুল
পাড়ায় পতাকা ওড়ে
মোড়ে পতাকা ওড়ে
স্বাধীন মাস্টার চেয়ে থাকে শুধু

একটা সময় আগস্টের পনেরোটা বড় কথা ছিল
এখন আর নয়
এখন পতাকা লাগানোর আর পতাকা তোলার
লোকের অভাব হয় না
এখন বড় কথা হোলো ষোলো কিংবা সতেরো অথবা আঠেরো
কারণ সেদিন পতাকায় হাত দেওয়ার কেউ থাকে না
থাকে শুধু স্বাধীন মাস্টার
গলি থেকে বড় রাস্তা
হাট থেকে বাজার
ক্লাব থেকে স্টেশনে
ঝুঁকে পড়া স্বাধীন মাস্টার আরও ঝুঁকে পড়ে
এক দুই তিন করে তেরঙা পতাকাগুলো তুলে
বুকে জাপটে ধরার জন্য।

কবি পরিচিতি : কৃষ্ণ বর্মন

 

Photo :indiatoday

তোমায় ভুলি বাইশে

যারা ভাবে তুমি নেই
তাঁরা তোমাকে বিশ্বাস করেনি কোনো দিন।
তোমার না থাকাটাই ওদের কাছে বড়।
এই যে কান পাতলেই তোমাকে শোনা যায়
তোমার বিশ্ব প্রকৃতির শান্তিনিকেতনে,
চোখ খুললেই তোমাকে দেখা যায়
শিলাইদহের পদ্মায় ভাসতে ভাসতে কবিতা লিখতে,
স্পর্শে স্পর্শে তোমাকে পাওয়া যায়
বিস্তীর্ন প্রান্তরের সবুজ তৃণভূমিতে–
এসব ওরা কিছুই বিশ্বাস করে না।

অনেকে ওদের নাস্তিক বলে।
কিন্তু ওরা তো ঈশ্বর মানে।
অথচ মানে না মানুষের মধ্যে ঐশ্বরিকতার প্রকাশ।
ওদের তোমার উপর ভরসা নেই বিশ্বাস নেই।
আসলে এতদিনেও তোমাকে ওদের জানা হয়ে ওঠেনি।

ওদের কাছে বাইশে শ্রাবণ মানে
তুমী বন্দী ফটো ফ্রেমে।
বাইশে শ্রাবণ মানে
রজনীগন্ধার মালা ধূপ চন্দন।
ওদের এসবে কোনো ভুল নেই।
ওরা বাইশে শ্রাবণ মনে রাখে সারা বছর
কিন্তু ভুলে যায় তোমাকে।
আর কেউ কেউ তোমাকে মনে রাখে বছর ভর
শুধু ভুলে যায় বাইশে শ্রাবণে।

 

কবি পরিচিতি : কৃষ্ণ বর্মন

নাগাসাকির নাগপাশ

নাগাসাকি আজও আবদ্ধ নাগপাশে।
আজও সেখানে বিষক্রিয়া।
সেই বিষ ক্রমে ছড়িয়ে পড়েছে
এই পৃথিবীর আকাশ বাতাস অন্তঃরীক্ষে।
বিকলাঙ্গ সময়
অসাড় চেতনা
নির্বাক মানবিক মুখ
নিস্তেজ অনুভবকে করে তুলছে আরও নিস্তেজ।
সবাই শুধু ধ্বংসের অনুসারী,
কোথাও কোনো ব্যতিক্রম নেই।

এই পৃথিবীর দেশে দেশে ঘরে ঘরে এক পঙ্গু নাগাসাকি
যেখান হিরোসিমার আঁতুড়ঘর
রক্তবীজের মত জন্ম নেয় সেখানে
ইস্রায়েল প্যালেস্তাইন সিরিয়া।
সকলেই আজ নাগপাশে বন্দী।
মুক্তি নেই কারও কোনো ভাবে।

নাগাসাকি এভাবেই আছে।
তবে সে শুধু মৃত্যুপুরী নয়।
আবার সে জাগছে
শোনাচ্ছে ঋজু মেরুদন্ডের রূপকথা।
এখনও তার চোখ চোখ রেখে কথা বলার স্পর্ধা
তবে তা বিরুদ্ধতার নয় বিনম্রতার।
আপন শক্তিতেই সে বিনম্র।
সে এখন বিনাশে নয়
সে এখন বিপ্লবে।

 

কবি পরিচিতি : কৃষ্ণ বর্মন

 

Photo: Medium

যদি যায় সবে বুড়িয়ে

সবাই হয়তো নিশ্চিত
জীবন বেশী দিনের জন্য নয়
তাই ফুরিয়ে যাওয়ার আগে
বুড়িয়ে যেতে চায় তাঁরা
বয়স এখন আর সময় দেখে বাড়ে না
বাড়ে মন দেখেআশি যখন আবার আঠারো হতে চায়
ছুঁতে চায় ফেলে আসা বসন্ত
আঠারো তখন আশিতে মত্তবোধহয় এও এক পালিয়ে যাওয়া
সময় মত সব পাওয়া হয়নি বলেই
সময় থেকে সকলের পালানো
পালালেই যদি পালানো যেত
ফিরতে হোতো না কাউকে
সকলেই পেত নিজের থেকে নিজে মুক্তিফুরিয়ে যেতে যেতে
যারা বুড়িয়ে যেতে চায়
মুখোমুখি হতে হবে তাঁদেরও একদিন
সেদিন সময়ই মিটিয়ে নেবে
সময়ের কাছে বেড়ে চলা
এতদিনের ঋণ।
কবি পরিচিতি : কৃষ্ণ বর্মন

তুমি খুব জেদী ছিলে

তুমি খুব জেদী ছিলে।
না হলে কেউ বসন্ত দিনে বৃষ্টি হতে চায়!
বসন্তের আগুন হতে পারতে
হতে পারতে অনুরাগের পলাশপ্রিয়া
অথবা পড়ন্ত বিকেলের আবেগী শিমূল।
নীল দিগন্তের দৃষ্টি সীমার বাইরে বলাকা হয়ে উড়ে যেতে চাইলে
তোমাকে বাঁধা দেওয়ার মত ছিল না কেউ।
উদাসী দুপুর অথবা অভিমানী গোধূলী জুড়ে
যদি কোকিল হয়ে ডেকে বেড়াতে আপন মনে
বিরক্ত হোত না তাতে কেউ
কিংবা নিজেকেই যদি বসন্ত বলে দাবী করতে
তাতে কেউ আপত্তি করার মত ছিল না।

তুমি এসব কিছুই করলে না।
শুধু জেদ ধরে রইলে বৃষ্টি হবে বলে।
এমন অসময়ে বৃষ্টি কার ভাল লাগে বলো।
বর্ষা তো তোমার জন্য অপেক্ষাতে আছেই
তবে বসন্তে এই দখলদারি কেন।
তুমি সেদিনও উত্তর দাওনি
জানি আজও কৈফিয়ৎ দেবে না।

একমাত্র আমিই ছিলাম
যার তোমার বসন্ত বৃষ্টি হওয়াতে আপত্তি ছিল না
এমন কি আজও নেই।
আজও তুমি নিজের জেদেই অনড়।
অথচ আজও তোমার বৃষ্টি হওয়া হয়নি।
আমি যে সারা বছর শুধু তোমার জন্যই
বসন্ত হয়ে অপেক্ষায় আছি
বৃষ্টি হয়ে আসবে বলে।
তুমি কিন্তু শুধু জেদই দেখিয়ে গেলে।
আসলে জেদ আর জেদীর বোধহয়
কোনোদিনই বৃষ্টি হওয়া ওঠে না।

 

কবি পরিচিতি : কৃষ্ণ বর্মন

 

Photo : Chattogram Daily

স্মৃতি হত্যা

তোমার স্মৃতি হত্যার দায়ে নির্বাসন দিতে চেয়েছিলে কোনো একদিন।
আমি অনুনয় বিনয় করে কথা দিয়ে ছিলাম
এরপর থেকে আর অবহেলা নয়
বরং স্মৃতির ইটগুলোকে থাক থাক খরে সাজিয়ে
স্মৃতির প্রাসাদ গড়ব আমি।
তুমি নিজে চোখেই দেখছো
এতদিন পরেও কতটা কথা রাখতে পেরেছি আমি।

স্মৃতির জন্ম দেওয়তা যতটা পুংষক আমি
তার লালনে ততটা নয়।
বেশীর ভাগ স্মৃতিই তাই অনাথ ভবঘুরে হয়ে
বিস্মৃতির দেশে নিরুদ্দেশ হয়েছে।
যেকটা স্মৃতি তোমার আবদার আদরে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিল
নবজাতকের মোহে তাঁদের থেকেও মুখ ফিরিয়েছি আমি,
স্মৃতির গভীর ক্ষত বুকে নিয়ে
এখন তুমি নির্বিকার নির্বিষ।

যে কোনো প্রকার হত্যা যদি অপরাধ হয়
তাহলে আমি এক দাগি অপরাধী।
তবুও এতদিন পার করেও শাস্তির বিধান শোনালে না তুমি।
স্মৃতিকে তুমি ভালবাসো
আর আমি সেই ভালবাসাকে মুহূর্তে মুহূর্তে আঘাত করি।
তবুও প্রত্যাঘাত এলো না কোনো দিন।

স্মৃতির হত্যার নির্মম নিষ্ঠুর অধ্যায়কে
নির্বিকারে প্রত্যক্ষ করতে করতে করতে
কবে যে তুমি আমাকে অপসৃত না করে
নিজেই নির্বাসনে চলে গেছো
তা বুঝতেই পারিনি আমি।
এখন এই এই শূন্য মায়া মরুদ্যানে
স্মৃতি হত্যার গুরু পাপের দায়ে
আত্ম গ্লানি আর নির্যাতনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে
তোমাকে যতই তোমাকে আবার আশ্বাস বানী শোনাই,
আমি জানি তুমি এখন আমার পাশে থেকেও
মনে মনে আমার স্মৃতিকে ঘৃনা কর।

 

কবি পরিচিতি : কৃষ্ণ বর্মন

 

kisspng

পুনঃস্হাপন

কে বলেছে
তোমাকে ভাঙলেই ভেঙে ফেলা যায়?
তোমাকে ভাঙার হাত যতটা শক্ত
গড়ার হাত তার চেয়েও বেশী শক্তিশালী।
আসলে তোমাকে ভাঙা হয়েছিল বলেই না
মানুষ বুঝতে পেরেছিল তুমি আছো
আর তোমার ভাঙা টুকরো গুলোকে সম্বল করেই তো টিকে গেল
প্রবল ঘুর্নি ঝড়ে তছনছ হয়ে যাওয়া
ঘরের ছাউনির কয়েক আঁটি বিচালি।

গড়ার জন্য আর গড় রক্ষা করার জন্য
তোমার ভাঙাটা খুব দরকার ছিল।
আসলে বছরের পর বছর ধরে নীরবে
তুমি ভিতরে ভিতরে ভাঙনের যে যন্ত্রনা সহ্য করেছো
তার তুলনায় সেদিন হঠাৎ করে
উন্মত্ত আঘাতে ভেঙে ফেলার বেদনা খুব একটা তীব্র নয়।
এতদিনে বোধহয় সেই ব্যাথার উপশমও হয়ে গেছে।

তোমার ভাঙনে যাদের গড়ের দূর্গ
কিছুটা হলেও অক্ষত রইল
এবার তাঁদের প্রতিদানের পালা।
দিকে দিকে যতই ঘৃণার বিষ ঝরুক,
যতই ভেঙে খানখান হয়ে যাক তোমার বর্ণমালা,
যতই অস্তমিত যাক বোধের লজ্জিত সূর্য,
তোমাকে যে নতুন করে গড়তেই হবে।
জ্ঞান কিংবা বিজ্ঞানে যতই তোমাকে উপড়ে ফেলা হোক
বিজ্ঞাপনে তোমার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতেই হবে।
নতুবা নিষ্ঠা আর নীতি নিয়েই যে প্রশ্ন করবে
চেতনার মরুদ্যানে ভূমিষ্ঠ হওয়া প্রতিটি বিস্ময় শিশু।

আজ তোমাকে আরও আপন করার দিন
নতুন করে স্হাপন করার দিন
পাথরে পাথরে প্রাণের স্পন্দন দিয়ে
নিস্পন্দ অহঙ্কারী অনুভূতির
গ্লানি মোচন করার দিন
তোমার পুনঃস্হাপন করে
প্রায়শ্চিতের অজুহাতে
পুনরায় পাপে লিপ্ত হওয়ার দিন।

 

কবি পরিচিতি : কৃষ্ণ বর্মন

 

স্লোগান

যে স্লোগানে বিশ্বাস নেই
যে স্লোগানে স্পর্ধা নেই
যে স্লোগান সবার হয়ে উঠতে পারে না
সেই স্লোগানে বিপ্লব নেইস্লোগান যেখানে প্রত্যয় নয়
স্লোগান যেখানে শপথ নয়
স্লোগান যেখানে স্তুতি
আর বিদ্রুপের উল্লাস ধ্বনি
সেই স্লোগানে স্বতঃস্ফূর্ততা নেইস্লোগান এক দৃপ্ত চেতনা
স্লোগানে স্লোগানে দীপ্তি
স্লোগানের স্বতঃ উদ্যমে
উন্মাদের অবলুপ্তিস্লোগান শুধু কন্ঠে নয়
স্লোগান থাকুক কার্যে
স্লোগানে স্লোগানে বিপ্লব আসুক
দেশ কিংবা রাজ্যে।
কবি পরিচিতি : কৃষ্ণ বর্মন
Photo : airjordanenligen2015

না শোনাটা অভ্যাস হয়ে গেছে তোমার

না শোনাটা অভ্যাস হয়ে গেছে তোমার
শুনেও শুনতে পাওনা অনেক কিছু
এই যে যে রাস্তা দিয়ে হাঁটছো
বারবার সে যে কান্না করতে করতে বলে
আমার বুকের উপর থেকে ইট বালি স্টোনচিপ সরিয়ে দাও
তাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করোনা তুমি।

কোনো এক শীতলতম রাতে বাড়ি ফেরার সময়ে
স্টেশনে বসে থাকা শীতার্ত অর্ধনগ্ন শিশুর নিষ্পলক চোখ
তোমাকে যে এক একটা গরম কাপড়ের আকুতি জানায়
তা হৃদয় দিয়ে শোনার চেষ্টা করোনি কোনো দিন।

তুমি যখন শ্রীরাম আর জয়হিন্দ স্লোগানের
রাজনীতিকরন নিয়ে তর্কে মশগুল অফিস ফেরত সহযাত্রীর সাথে
তখন আপন নাম আর পরিচয় ভুলে যাওয়া
অশীতিপর বৃদ্ধা তোমার সামনে হাত পেতে বলে–
“বাবা তিনদিন খাইনি কিছু”
তাঁর কন্ঠে নিজের মায়ের কষ্টের উচ্চারণ
শুনতে পাওনা তুমি তোমার উদ্বৃত্ত উপার্জনের দিনেও।

তুমি যখন নিজের মেয়েকে কোলে বসিয়ে
ভিডিও গেমের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় মত্ত
তোমার কান মনের বন্ধ দরজা জানালা ভেদ করে
অনুভূতি আর উপলব্ধিতে প্রবেশে করেনা
তোমার পাশের বাড়ীতে কাশ্মীরে শহীদ হওয়া সেনার
একমাত্র কন্যার শূন্যতার আর্তনাদ।

তুমি যখন ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে
কোল বালিশ জাপ্টে ধরে বিপরীতে মুখ রেখে
ঘুমিয়ে পড় অবসন্ন ভাবের ঘোরে
প্রতি রাতেই প্রায় পাশের মানুষের বালিশ ভেজে
প্রতিদিন টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া
স্বপ্ন কাঙালীর নীরব কান্নায়।

তুমি এভাবেই আরও অনেক কিছু শুনতে পাওনা
হয়তো এভাবেই অবহেলায় শুনতে চাওনা
অথবা চাও সবাই তোমায় শুনুক
একমাত্র তোমাকেই শুনুক

দেখো,না শুনতে শুনতে একদিন
তোমার চারিপাশটাও শূন্য হয়ে যাবে
তুমি হয়তো জানো না এসব
কিংবা জানো সবটাই
তবুও শুনতে পাওনা অনেক কিছু
আসলে না শুনতে শুনতে
না শোনাটা অভ্যাস হয়ে গেছে তোমার।

Poet Krishna Barman

কবি পরিচিতি : কৃষ্ণ বর্মন, 

কবির কলম থেকে “আমি নীরবে নীরবে ধ্বংসের পরব উদযাপন করি/হৃদয় পোড়া ছাই দিয়ে চোখে কাজল পরি”।

SOURCEKrishna Barman
Previous articleজ্যান্ত দুর্গা
Next articleপুজো মানে
Avatar
Disclaimer: Monomousumi is not responsible for any wrong facts presented in the articles by the authors. The opinion, facts, grammatical issues or issues related sentence framing etc. are personal to the respective authors. We have not edited the article. All attempts were taken to prohibit copyright infringement, plagiarism and wrong information. We are strongly against copyright violation. In case of any copyright infringement issues, please write to us. লেখার মন্তব্য এবং ভাবনা, লেখকের নিজস্ব - কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত..................

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here