তৃনীল কবিতাদেবীর একমাত্র সন্তান । ছোটো থেকে কবিতা দেবীর স্বপ্ন তৃনীলকে মনের মত করে মানুষ করবে । কবিতাদেবীর স্বপ্ন দেখার নেশাটা লাগামছাড়াই একটু । উনি একই সাথে তৃনীলকে ইঞ্জিনিয়ার, WBCS অফিসার, Lawyer সব হিসাবে দেখতে চায়। তৃনীল মায়ের নিত্যনতুন ফরমাইশে হাঁপিয়ে উঠেছে । মা ওকে জোড় করে সাইন্স নিয়ে ভর্তি করিয়েছে । তৃনীলের ইচ্ছা ও জার্নালিস্ট হবে। কিন্তু কবিতাদেবী যে এক্তিয়ার করে দিয়েছে, তার বাইরে তৃনীলের ভাবাও পাপ। তৃনীল মা আর দারোগার মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পায় না । তৃনীল বেরোতে চায় এসব থেকে । কবিতা দেবীর সাজানো জগতে ও আর বাঁচতে পারবে না । তৃনীল একটু বাঁচতে চাইছে । কবিতা দেবী কি শুনতে পাচ্ছে?
কবিতা দেবী শুনতে চায়না ।কবিতা দেবীর সবটা তৃনীল জুড়ে । তৃনীল ছাড়া এক মুহূর্ত কল্পনা করতে পারে না । উনি মনে করেন ওনার সাজানো জগৎ তৃনীলের পক্ষে উপযুক্ত । লোকে দেশ বিদেশে ওকে চিনবে । নতুন কিছুর জন্য নতুন পুরষ্কার পাবে প্রতিদিন। এটাই তো জীবন! কবিতা দেবী নিজের জীবনটা কলোনির এই ঘুপচি ঘরটাতে নিজের জীবন নষ্ট করে দিয়েছে কিন্তু তৃনীলকে নষ্ট করতে দেবে না ।
তিন বছর কেটে গিয়েছে । এই বয়েসে প্রেম এক স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। এখন তৃনীল মাস কমিউনেশন নিয়ে পড়ে একটি সংবাদপত্রের অফিসে কর্মরত । রাগিনী বলে একজন কলিগের সাথে ওর ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তৃনীল ওকে বিয়ে করতে চায়। কথাটা কবিতা দেবীর কানে যেতেই উনি বাড়িতে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিয়েছেন । অফিসে গিয়েও এমন অশান্তি করেছেন যে ওদের চাকরিটাই অনিশ্চয়তার মুখে ।
তবে তৃনীল আর দেরি না করে রাগিনীর সাথে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করে ফেলেছে । ওরা দিল্লি চলে যাবে পরশু । এইসব ঘটল কবিতা দেবীর অজান্তেই ।
তৃনীল বাড়িতে যখন ঢুকল তখন প্রায় দশটা বেজে গিয়েছে । কবিতাদেবী তৃনীলের সমস্ত সার্টিফিকেট আর মেডেল গোছাচ্ছিল।
- হ্যা রে কটা বাজে! এটা কারুর বাড়ি ফেরার সময় হলো? নিশ্চয়ই ওই মেয়েটার সাথে ঘুরছিলিস!
- হ্যা ঘুরছিলাম তো! শোনো we are adult enough । “
- ছাড় ছাড় বাদ দে । দেখ এই সার্টিফিকেট টা তুই সাইন্স হান্ট এ পেয়েছিলিস.. মনে পড়ছে? দেখ দেখ এই মেডেলটা..
মেডেলটা মায়ের হাত থেকে ছুড়ে ফেলে তৃনীল বলল,
- মা, আমি এই সার্টিফিকেট নই। আমি রক্ত মাংসের মানুষ। এই দেখো এই মানুষটা আমি । ওই সার্টিফিকেট গুলো আমি নই।
- এই তুই এসব কি বলছিস! নিশ্চয়ই ওই মেয়েটা তোর মাথা খেয়েছে ।
- কেউ আমার মাথা খায়নি । যাকে ওই মেয়েটা বলছ না সে আমার লিগ্যাল ওয়াইফ । আমাদের রেজিস্ট্রি হয়ে গিয়েছে । আর আমরা পরশুই দিল্লি চলে যাব ।
এই কথাগুলো বলে মায়ের প্রত্যুত্তর শোনার অপেক্ষা না করে তৃনীল ওর ঘরে চলে গেল ।
কবিতা চুপচাপ পাথরের মত বসে রইল । বড্ড জোড় আঘাত পেয়েছে ও । তৃনীলকে আঁকড়েই তো কবিতাদেবীর পৃথিবী। তৃনীলও তো অন্য কারুর হয়ে গেল। ওর শেষ খড়কুটো ওকে ছেড়ে চলে গেলো। কাউকেই ধরে রাখা যায় না।
কবিতাদেবী ঘর অন্ধকার করে সার্টিফিকেট গুলো বুকে জড়িয়ে একা বসে রইল ।
কলমে অর্ণব মিত্র, সত্যজিৎ রায় সরণি, কলকাতা