ঠিক সকাল দশটা।

ক্রিংক্রিং শব্দে টেলিফোনটা বেজে উঠলো। রিসিভারটা তুলে ইন্সপেক্টর সান্যাল বললেন, “হ্যালো, ইন্সপেক্টর সান্যাল স্পিকিং..”

ফোনের ওপার থেকে একটা অচেনা গলা ভেসে এলো, এক ভদ্রমহিলার গলাবললো, “ আমি মিস্টার অনুব্রত সেনের বাড়ি থেকে কথা বলছি। আমার মালিক খুন হয়েছেন। আপনারা তাড়াতাড়ি চলে আসুন দয়া করে।

ইন্সপেক্টর সান্যাল বললেন, “ঠিকানাটা বলুন।

ভদ্রমহিলা ঠিকানা বলে দিলে রিসিভারটা নামিয়ে রেখে কনস্টেবলকে বললেন জিপ বের করতে। ড্রাইভারকে বললেন, “সেক্টর ফাইভসেন ভিলা।

আধঘন্টার মধ্যে যথাস্থানে পৌঁছে পুলিশ আর ফরেন্সিক টিম তাঁদের কাজ আরম্ভ করলেন। তাঁদের যে ফোন করেছিলেন তিনি মিস্টার সেনের পরিচারিকা।  মিস্টার সেনের বাড়িটা বেজায় বড়ো।  প্রায় সাত বিঘা জমির ওপর একতলা বাড়িটির অবস্থান। বাড়িটার দুটো অংশএকটা অংশে মিস্টার সেনের পেল্লায় বড়ো স্টাডিরুম আর একটা ঘর এবং অন্য অংশে লিভিং রুমগুলো রয়েছে। এই একতলা বাড়িটায় মিস্টার সেন একাই থাকতেন, পরিচারিকার কাজের সময়সীমা সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যে ছটা।

পুলিশ স্টাডিরুমে ঢুকে স্টাডি টেবিলের ঠিক ডানদিকে মিস্টার সেনের লাশটা পড়ে থাকতে দেখেন। ফরেন্সিক টিমের কিছু কাজের পর আর দেশ কতগুলো ছবি তলার পর  অ্যাম্বুলেন্স ডেকে লাশটাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো।

মিস্টার সেনের বাড়ির স্টাডিরুমটার ঠিক মাঝবরাবর একটা চেয়ার আর টেবিল।  টেবিলের ওপর কয়েকটা নোটবুক, ইতিহাসের কতগুলো বই, কিছু কাগজ, একটা গ্লোব, একটা ডায়েরি আর একটা ফাউন্টেন পেন। ঘরের  দুদিকে কাঠের তৈরি দুটো ছোটো আলমারি, দুটো আলমারিই বাংলাইংরেজিহিন্দি নানা ভাষার বইয়ে ভর্তি। ঘরের একদিকে দুটো কাঠের চেয়ার পরপর রাখা আর ঠিক তার পাশে একটা দরজা, পরিচারিকাকে জিজ্ঞাসা করলে সে জানায় এই দরজাটা বাগানের দিকে যায়। মিস্টার সেনের সাথে তাঁর পরিচিত যাঁরা দেখা করতে আসতেন, তাঁরা এই দরজা দিয়েই একেবারে স্টাডিরুমে ঢুকতেন। স্টাডিরুমের পাশের ঘরটা আর লিভিং রূমগুলোও দেখলেন মিস্টার সান্যাল।  ফরেন্সিক টিমও পাশাপাশি তাদের কাজ চালালো।    

পরিচারিকাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, “এই বাড়িতে কে কে যাতায়াত করতেন? কাউকে দেখে তোমার সন্দেহজনক বলে মনে হয়েছে?”

পরিচারিকা ভয়ে ভয়ে জবাব দিল, “মালিকের সাথে অনেক জানাঅজানা মানুষই দেখা করতে আসতেন। কাউকেই আমি সেভাবে চিনি না। মালিকের দুই দাদা আছেন, কিন্তু মালিক বেঁচে থাকাকালীন কেউই এখানে আসেননি কোনোদিন।

আবার ইন্সপেক্টর সান্যাল জিজ্ঞাসা করলেন, “গতকাল কতজন দেখা করতে এসেছিলেন দাদাবাবুর সাথে?”

পরিচারিকা জানালো, “ মোটামুটি পাঁচছয়জন, স্যার। আমি খালি একজনকে চা দিতে মালিকের পড়ার ঘরে গেছিলাম বিকেল পাঁচটা নাগাদ।

তুমি তাকে চিনতে?”

না স্যার।

প্রাথমিক তদন্ত শেষ করে মিস্টার সান্যাল আর তাঁর সঙ্গীরা বাড়ি থেকে বিদায় নিলেন।

                  ()

আজ কাগজটা দেখলে?”, খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে শয়নকক্ষ থেকে বসবার ঘরে বেরিয়ে আসা তিলোত্তমাকে প্রশ্ন করলেন তাঁর স্বামী নিশিকান্ত।

সল্টলেকবাসী নিশিকান্ত ভূগোলের শিক্ষক, তার পাশাপাশি গবেষণার কাজ করছেন। তিলোত্তমা নিশিকান্তের বৈবাহিক জীবন মাত্র ছয়মাসের। একবিংশ শতাব্দীর এই দম্পতি অন্যান্য সকল দম্পতির মতনই নিজের লক্ষ্যপূরণে সারাদিন ব্যস্ত। নিশিকান্ত তাঁর বিবাহের আগে সল্টলেকের এই ফ্ল্যাটটাতেই থাকতেন, তবে বিয়ের পরের দিন থেকেই স্ত্রী তিলোত্তমার ইচ্ছা তাঁরা একটা নতুন বাড়ি কিনবে আর সেরকম না হলে একটা বাড়ি ভাড়া নেবেন, সে একতলা হলেও চলবে। নিশিকান্ত এতটাই শান্ত স্বভাবের মানুষ, মাঝে মাঝে তাঁর স্ত্রীও নিজের স্বামীর অস্তিত্বের আভাস পাননা।

তিলোত্তমার শাড়ির ব্যবসা, খুব বড়ো না হলেও মোটামুটি ভালোভাবেই চলে। যদিও তিলোত্তমা সেটা মনে করেন না, তাঁর মতে জায়গা ছোটো হওয়ার জন্য ব্যবসায় যথেষ্ট সমস্যা, তাই একটা বাড়ির খুব প্রয়োজন। তিলোত্তমার ইচ্ছা নতুন বাড়ি হলে তার একটা অংশে একটা ছোটো দোকান করবেন। কিন্তু নতুন বাড়ি কেনার মতন টাকা তাঁদের কাছে বর্তমানে নেই। বাড়ির গিন্নি তিলোত্তমা তাই সংসার খরচ কমাতে ব্যস্ত আর  এইজন্য মাঝে মাঝে স্বামীস্ত্রীর ঝামেলাও হয়।

কেন, আবার কি হলো?”, কিছুটা অনুৎসাহের সহিতই যেন বললেন  তিলোত্তমা। আজ রবিবার, কিছুদিনের জন্য তিলোত্তমা বাপেরবাড়ি যাবেন  তাঁর  মাকে দেখতে আর তাছাড়াও আজ মাসের ১৯ তারিখ, তাঁকে মায়ের ওষুধও কিনে দিয়ে আসতে হবে। তাই কিছুটা তারাহুড়োয় রয়েছেন  তিলোত্তমা, কারণ তিনি জানেন বাড়ির সব কাজ শেষ করলে তবেই তাঁর মুক্তি। তিলোত্তমা এতটাই পিটপিটে স্বভাবের মানুষ যে  ফ্ল্যাটের আসবাবপত্র থেকে আরম্ভ করে বিছানাপত্র, জানালার পর্দা সবকিছুই ঝকঝকে হওয়া চাই  আর নিশিকান্তের মতে, তাঁর স্ত্রী একটু বেশিই শৌখিন, তাই অনেক জিনিসই তাঁর মন জয় করতে পারেনা। 

খাবার টেবিলে বসে বসেই নিশিকান্ত বললেন, “মিস্টার সেন খুন হয়েছেন..”

মিস্টার সেন?”

আরে বাবা, তোমার মনে নেই সেদিন যিনি তোমার সাথে দেখা করতে এলেন, কি একটা বিশেষ দরকারে। কি বিচিত্র কান্ড বলো দেখি!”

জলের গ্লাসটা হাতে নিয়ে সোফায় বসে কিছুটা অন্যমনস্কভাবেই তিলোত্তমা প্রশ্ন করলেন, “তাকি বলছে কাগজে?”

গতকাল সকালে স্টাডিরুমে মৃত সেনকে প্রথম দেখেন তাঁর পরিচারিকা, তারপর সে পুলিশকে খবর দেয়। যদিও পুরো ব্যাপারটা আমিও পড়িনি, খালি শেষে দেখলাম বলা হয়েছে পুলিশ তদন্ত জারি রেখেছে..”

অচেনা ব্যক্তিকে তোমার ভালোই মনে থাকে দেখছি.. ”

উনি যা খুশমেজাজি মানুষ আর সেদিনই তো আমার সাথে কতক্ষণ গল্প করলেন। ওহ:, তোমাকে তো বলাই হয়নি, সেদিন বাজারে ওনার সাথে দেখা হয়েছিল, তোমার কথা জিজ্ঞাসা করছিলেন। ভালো মানুষ বলেই তো মনে হয়, তাঁর আবার এত ভয়ংকর শত্রু!-প্রাণটাই নিয়ে নিলো।

দুদিনের আলাপেই যদি সবাইকে চেনা যেত তাহলে তো….”, পুরো কথাটা শেষ না করেই সোফা ছেড়ে উঠে রান্নাঘরে চলে গেলেন।

টেবিলে বসে বসে খবরের কাগজটা উল্টাতে উল্টাতে নিশিকান্ত জিজ্ঞাসা করলেন, “মৃত্তিকার খবর পেলে? কোথায় যে গেলো মেয়েটা কে জানে! দুসপ্তাহ হয়ে গেলো ওর কোনো দেখাই নেই।

রান্নাঘর থেকেই কন্ঠস্বর ভেসে এল, “না, পাইনি।

বিড়বিড় করতে করতে তিলোত্তমা বলে চললেন, “ সব হচ্ছে অতিরিক্ত কৌতূহলের ফল। বাক্সটা কেন চুরি করতে গেলো, বলেই তো ছিলাম….”

হঠাৎ সব চুপচাপ।

কিছুক্ষণ পর তিলোত্তমা ব্রেকফাস্ট নিয়ে এলে মুখে ভরা প্রথম ব্রেডটোস্টটার কিছুটা অংশ চিবোতে চিবোতে নিশিকান্ত বললেন,

কোন বাক্সের কথা বলছিলে গো?”

কিছু না।

নিশিকান্ত ভালোভাবেই বুঝলেন তিলোত্তমা ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে চাইছে তাই  আর কোনো কথা বললেন না। 

আধঘণ্টা পর স্বামীকে চা করে দিয়ে তিলোত্তমা আবার ঘরে চলে গেলেন।  চা খাওয়াটা তিলোত্তমার অভ্যাসের বাইরে। তাই এই বাড়িতে খালি নিশিকান্তের জন্যই চা হয়, আর স্ত্রী না থাকলে পাশের পাড়ার লক্ষণের দোকান থেকেই প্রতিদিন চা আসে  ঠিক তিন সময়েসকালে, বিকেলে আর ঠিক রাত নটায়।   

দুপুরের মাছভাতটা রেঁধে রেখে তিলোত্তমা বাপেরবাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলেন, কারণ দুপুর দুপুর না বেড়াতে পারলে ওদিকে পৌঁছাতে ঢের রাত হয়ে যাবে।

এদিকে নিশিকান্ত রবিবারেও নিজের কাজ নিয়ে ডুবে আছেন। তাছাড়া কিছু নোট্সও বানাতে হবে কিছু বিষয়ের ওপর।

কিচ্ছুক্ষণ পর হঠাৎ ক্রিংক্রিং শব্দ করে ডোরবেলটা বেজে ওঠায় ভিতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দরজা খুলে তিলোত্তমা যেন কিছুটা অবাকই হলেন।

কে এল তিলোত্তমা?” বলতে বলতে বাইরে বেরিয়ে এসে পুলিশকে  দেখতে পেলেন নিশিকান্ত।

তিলোত্তমার দিকে তাকিয়ে ইন্সপেক্টর রক্তিম সান্যাল প্রশ্ন করলেন, “আপনি কি তিলোত্তমা দেবী? আমি ইন্সপেক্টর রক্তিম সান্যাল।

অস্বস্তি কাটিয়ে সাধারণভাবে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলেন তিলোত্তমা,

হ্যাঁ, আমিই তিলোত্তমা। কিন্তু কি হয়েছে স্যার, হঠাৎ আমি কেন?কিকি ব্যাপারে, স্যার?”

মিস্টার অনুব্রত সেনের খুনের ব্যাপারে আপনাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাই। ভিতরে আসতে পরি?”

হ্যাঁ স্যার, আসুন।

সদর দরজা দিয়ে বসবার ঘরে ঢুকে সোফায় জায়গা করে নিলেন ইন্সপেক্টর সান্যাল। তার চোখ দুটো সম্পূর্ণ বসবার ঘরটাকে একবার প্রদক্ষিণ করে নিলো, এই স্বামীস্ত্রী ঠিক কতটা পিটপিটে আর শৌখিন তা তাঁদের বসবার ঘর দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ঘরে জিনিসপত্র বেশি না থাকলেও যেই আসবাবপত্র ঠিক যেই জায়গায় রাখলে মানায়, ঠিক সেই জায়গায় রাখা। 

ইন্সপেক্টর সান্যাল তিলোত্তমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি মিস্টার সেনকে কতদিন ধরে চিনতেন?”

খুব বেশিদিন নয় স্যার, এই ধরুন দুই সপ্তাহ।

আমরা ওনার একটা পার্সোনাল ডায়েরিতে আপনার নাম পেয়েছি।

ডায়েরি?”, ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন তিলোত্তমা।

রক্তিমবাবু তাঁর হাতে থাকা লাঠিটা নিশিকান্তের দিকে নির্দেশ করে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কে হন?”

আমি তিলোত্তমার স্বামী। আমার নাম নিশিকান্ত বসু।”, অত্যন্ত নমনীয়ভাবে উত্তর দিলেন নিশিকান্তবাবু।

আবার তিলোত্তমার দিকে তাকিয়ে রক্তিমবাবু বললেন, “তদন্ত করাকালীন আমরা মিস্টার সেনের ঘর থেকে একটা ডায়েরি পাই, যেখানে উনি উল্লেখ করেছেন যে উনি ওনার মৃত্যুর ঠিক চারদিন আগে আপনার কাছ থেকে একটা বাক্স কিনেছিলেন। আমি সেই বিষয়ে আপনাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাই।

আচ্ছা স্যার।

আচ্ছা, উনি আপনার কাছেই হঠাৎ একটা বাক্স কিনতে এলেন, মানে উনি এই ব্যাপারে জনলেন কিভাবে যে আপনি বাক্সটা বিক্রি করতে চাইছেন?”

আসলে স্যার, অফিস থেকে একদিন ক্যাবে করে বাড়ি ফেরার সময় উনিও সেই ক্যাবে ছিলেন। আমি ভুল করে আমার ব্যাগটা ফেলে এসেছিলাম ওই ক্যাবে। তো উনি সেটাই আমায় দিতে এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে দুই সপ্তাহ আগে, তখনই আমার সাথে কথা বলতে বলতে আমি ওনাকে বাক্সটার কথা জানাই আর উনি সেটা কেনার জন্য আবেদন জানান। এই ভাবে ওনার সাথে আমার পরিচয়, আসলে প্রাচীন জিনিসের ওপর ওনার বেশ আকর্ষণ আর সেটা আমি প্রথম বারেই বুঝে গেছিলাম। তবে স্যার আর একটা ঘটনা আছে, যেটা আমার মনে হয় আপনাকে সহায়তা করতে পারে।

কোন ঘটনা?”

আসলে মিস্টার সেন যেদিন এসেছিলেন, সেদিন আরও একজন এসেছিলেন। ওনার স্ত্রী আমার রেগুলার কাস্টমার, সংগীতা মিত্র। ভদ্রলোকের নাম প্রতীম মিত্র, ওনারও এই প্রাচীন জিনিস সম্পর্কে বেশ আকর্ষণ আর উনিও আমার কাছ থেকে ওই বাক্সটা কিনতে চেয়েছিলেন আর এই নিয়েই দুজনের মধ্যে ঝামেলা আরম্ভ হয়।  শেষে সেটা ধস্তাধস্তির রূপ নেয়।

তা আপনি বলছেন এই ঝামেলার কারণেই ওনার খুন হয়েছে? আচ্ছা এমন কোনো কথাযেটা মিস্টার মিত্র মিস্টার সেনকে বলেন, মানে হুমকি জাতীয় কিছু আরকি?”

ঝামেলার কারণেই ওনার খুন হয়েছে কিনা, এটা আমি জানিনা স্যার। কিন্তু হ্যাঁ, শেষে মিস্টার মিত্র বলেছিলেন যে উনি মিস্টার সেনকে দেখে নেবেন।

শুধুমাত্র একটা প্রাচীন জিনিসের জন্য দুজন অপিরিচিত মানুষের মধ্যে এত ঝামেলা!”

না স্যার, ওনারা পরস্পর পরস্পরকে চিনতেন। ওনাদের কথাবার্তা শুনে আমার তাই মনে হয়েছিল। এবার কতদিনের পরিচয়, সেটা আমি বলতে পারবো না।

ম্যাডাম, আমরা কিন্তু মিস্টার সেনের ঘর থেকে কোন প্রাচীন বাক্স জাতীয় কিছু পাইনি।  যদি বাক্সটার কোনো ছবি আপনার কাছে থেকে থাকে তাহলে….”

না স্যার, কোনো ছবি আমার কাছে নেই। এই বাক্সটা আমি আমার পরিবরসূত্রেই পেয়েছি,  বাক্সটা আমার প্রপিতামহের…. ”

ইন্সপেক্টর রক্তিম সান্যালের ফোনটা মাঝখান থেকে হঠাৎ বেজে ওঠায় তিলোত্তমাকে কথা থামাতে হলো।

হ্যাঁ, আমি এখনই আসছি।”, কোনোরকমে ফোনটা পকেটে ভরে সোফা থেকে উঠে পড়লেন তিনি।

আচ্ছা, চলি তাহলে। তদন্ত শেষ না হওয়া অবধি দুজনের কেউ কোথাও যাবেন না আর আমায় মিস্টার মিত্রের ঠিকানাটা একটু লিখে দেবেন।

তিলোত্তমা একটা ছোট সাদা কাগজে ঠিকানাটা লিখে দিলে ইন্সপেক্টর চলে গেলেন।

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে তিলোত্তমা বললেন, “আর কি, থাকো এবার। উফ….”

নিশিকান্ত জেরা করার সুরে বললেন, “তুমি আমায় বলোনি তো? এত কিছু হয়ে গেছে।

তিলোত্তমা এড়িয়ে যেতে চাইলেন, “ওই আর কি!”

নিশিকান্ত কিছুটা রেগে গিয়েই বললেন, “তিলোত্তমা একটা খুন হয়ে গেছে, তুমি কি সেটা বুঝতে পারছো না?”

তিলোত্তমাও বললেন, “তোমায় কে বললো, যে ওই বাক্সটার জন্যই এসব হয়েছে?”

তিলোত্তমা এড়িয়ে যাচ্ছে দেখে নিশিকান্ত কিছু না বলেই ভিতরের ঘরে চলে গেলেন।

                                     ()

পুলিশ স্টেশনে পৌঁছে ইন্সপেক্টর রক্তিম সান্যাল ফরেন্সিক এক্সপার্ট মিস্টার এস. নাথনকে জিজ্ঞাসা করলে উনি জানান, “বুঝলে সান্যাল, মিস্টার সেন খুন হয়েছেন ১৭ তারিখ বিকেল .৩০ মিনিটের মধ্যে। মিস্টার  সেনের গলা আর ঘাড়ের ঠিক মাঝবরাবর অর্থাৎ left common carotid artery আর cervical spine-এর ঠিক মাঝবরাবর তীরজাতীয় কোনো ধারালো বস্তু দিয়ে আঘাতটা করা হয়েছে , তিন থেকে চারবার আঘাত করা হয়েছে, যতদূর মনে হচ্ছে খুনি নিশ্চিত হতেই এতবার আঘাতটা করেছে।  ঘায়ের গভীরতা সেমি। মাথার পিছনের দিকে ভাল চোটের দাগ আছে, যেটা সাধারনত পড়ে যাওয়ার ফলেই হয়েছে। দেহে কোনো ক্ষতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি, তার মানে আঘাতটা করা হয়েছে আকস্মিকভাবে আর তাছাড়াও আঘাতটা করা হয়েছে সামনে থেকে।

সবই তো বুঝলাম, কিন্তু সামনে থেকে যে আঘাতটা করা হয়েছে, তার প্রমাণ?”

দেখো সান্যাল, তুমি বোধ করি ভুলে যাচ্ছো, crime scene-এর ছবিগুলো দেখো।”, এই বলে মিস্টার সেনের বডিটা যে জায়গায় পাওয়া যায়, সেই জায়গার একটা ছবি নিয়ে টেবিলের ওপর রেখে বোঝাতে আরম্ভ করলেন।

দেখো, একনম্বর কথা, ঘরে জোড় করে প্রবেশ করার কোন চিহ্ন  নেই, আর অস্ত্রটা চলেছে ঠিক তির্যকভাবে, ঘায়ের অবস্থানঅনুযায়ী সেটাই বোঝা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই কেউ আলমারির মাথায় বসে অস্ত্র চালাবে না আর মিস্টার সেনের স্টাডি রূমে তো খুব উঁচু কিছুই নেই। তো রইল বাকি কি? নয় সামনে থেকে আর নয় পিছন থেকে আঘাত করা। এবার দেখোস্টাডিরুমে কেবলমাত্র একটা জায়গায় রক্তের দাগ পাওয়া গেছে আর সেটা হচ্ছে স্টাডি টেবিলের ঠিক ডানদিকটায়, যদি তুমি সামনের দরজা থেকে ঘরে প্রবেশ করো। আর যে জায়গায় রক্তের দাগ পাওয়া গেছে সেটা ওই ঘরটার পিছনের দিকের দেওয়াল থেকে অর্থাৎ চেয়ারের পিছনে থাকা দেওয়াল থেকে প্রায় ১০১২ সেমি দূরে। এর থেকে পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে সামনে থেকে আঘাত করে হয়েছে।

বুঝলাম, দেখি মিস্টার মিত্র কি বলেন। চললাম”, বলে হাঁটতে হাঁটতে পুলিশস্টেশন থেকে বেরিয়ে জিপ উঠে মিস্টার মিত্রের বাড়ির দিকে রওনা হলেন।

                                               ()

ডোরবেল বেজে উঠলো, দরজা খুললেন সংগীতা মিত্র।

নমস্কার, আমি ইন্সপেক্টর রক্তিম সান্যাল। আপনিই কি সংগীতা মিত্র?”

হ্যাঁ স্যার, কিন্তু কি হয়েছে?”

মিস্টার প্রতীম মিত্র আছেন? থাকলে ওনাকে একবার ডেকে দিন।

কিন্তু স্যার….”

পুরো কথাটা না শুনেই রক্তিমবাবু বললেন, “মিস্টার অনুব্রত সেনের খুনের মামলার তদন্ত করতে এসেছি, আপনি মিস্টার মিত্রকে ডেকে দিন।

বাইরে অচেনা লোকের গলা শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন মিস্টার মিত্র।

নমস্কার, আমিই প্রতীম মিত্র। কিন্তু ঠিক….”

আমি মিস্টার অনুব্রত সেনের খুনের মামলায় এখানে এসেছি।

হ্যাঁ স্যার, আমি আজকের খবরের কাগজে পড়েছি ওনার মৃত্যুর খবর। কিভাবে এসব হয়ে গেলো?”

আপনি তিলোত্তমা বসুর বাড়ি গিয়েছিলেন?”

হ্যাঁ

সেখানে একটা প্রাচীন বাক্স নিয়ে আপনাদের মধ্যে বিস্তর ঝামেলা হয়?”

ইয়ে মানে হ্যাঁহ্যাঁ স্যার।

আর সেই রাগে আপনি ওনার খুন করে বসেন?”

না স্যার, কখনই না।

তাই যদি না হয়, মিস্টার সেন খুন হওয়ার দিন আপনি কোথায় ছিলেন?”

আমি একসপ্তাহের জন্য দুর্গাপুর গেছিলাম আমার মাকে দেখতে। বাসের টিকিটটা আছে আমার কাছে, আপনি চাইলেই….”

না থাক।

আসলে স্যার, আমরা একইসাথে বেশ কিছু বছর একই কলেজে অধ্যাপনা করেছি, আমরা দুজনেই ইতিহাসের অধ্যাপক আর দুজনেই প্রাচীন শিল্পের ভক্ত। তবে এটা ঠিক প্রাচীন জিনিস নিয়ে আমাদের মধ্যে বেশ কয়েকবার ঝামেলা হয় কিন্তু পরে তা মিটেও যায়। এবারেও তাই হয়েছিল।

ঠিকাছে, তবে আমরা না বলা পর্যন্ত এই শহর ছেড়ে বাইরে যাওয়ার কথা ভাববেন না, প্রয়োজন হলে আবার আসতে পরি। চলি।

পুলিশ স্টেশনে পৌঁছে সাবইন্সপেক্টর নগেন বক্সীর কাছে আরও একটা  খুনের খবর পেলেন।

স্যার, সেক্টর ফাইভে আরও একটা লাশ পাওয়া গেছে। মেয়েটির নাম মৃত্তিকা বারুই, মেয়েটি তিলোত্তমা বসুর ব্যবসার যাবতীয় বিষয় দেখাশোনা করতেন। মেয়েটি একা থাকতেন। তবে স্যার খুনের প্যাটার্ন এক, একইভাবে প্রায় একই জায়গায় আঘাত করা হয়েছে। নাথনবাবু মৃতদেহ পরীক্ষা করে আমায় এতটাই জানিয়েছেন।

চেয়ার থেকে উঠে রক্তিমবাবু জিপে করে তিলোত্তমা দেবীর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন।

                                    ()

ডোরবেলের শব্দ শুনে গবেষণার কাজে ডুবে থাকা নিশিকান্ত টেবিল ছেড়ে উঠে দরজা খুলতেই ইন্সপেক্টর রক্তিম সান্যাল দরজা পেরিয়ে কিছুটা ভিতরে ঢুকে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মৃত্তিকা আপনার স্ত্রীর সাথে কতদিন কাজ করছেন?”

ব্যবসার শুরু থেকেই প্রায়। কিন্তু কেন স্যার?”

উনিও মিস্টার সেনের মতন একইভাবে খুন হয়েছেন পরশু রাত্রে।  আমরা আপনার স্ত্রীর সাথে কথা বলতে চাই এই ব্যাপারে, আপনি দয়া করে ওনাকে ডেকে দিন।

হ্যাঁ স্যার”, ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সোফায় এসে বসলেন তিলোত্তমা।

মৃত্তিকা বারুই আপনার কে হয়?”

ইয়ে মানেগত দুসপ্তাহ থেকে ওর সাথে কোন যোগাযোগ করা যায়নি।

আর সেটা আপনি পুলিশ কে জানানও নি?”

আমার মনে হয়েছিল, হয়তো ফিরে আসবে। কারণ এর আগেও একবার এরকম করেছিল।

মৃত্তিকা দেবী খুন হয়েছেন এবং যতদূর সন্দেহ করা যাচ্ছে খুনি একই ব্যাক্তি।

কি?”

হ্যাঁ। আচ্ছা আপনার কাছে যে বাক্সটা ছিল, সেটার ব্যাপারে আপনি কিছু একটা বলছিলেন।

হ্যাঁ স্যার। আমার প্রপিতামহ, রুদ্রপ্রসাদ মজুমদার, উনবিংশ শতাব্দীর একজন লেখক ছিলেন। যেমন লিখতে ভালোবাসতেন, তেমনি কলম, সেই কলমদানী, তার বাক্স সব বিষয়েই তাঁর যেন এক অদ্ভুত শৌখিনতা ছিল। তাই সেইসময়ের সবথেকে নামজাদা শিল্পীর কাছ থেকে তিনি এই কলম রাখার বাক্সটি কিনেছিলেন।  সোনা সবরকমের মূল্যবান রত্ন দিয়ে সেই বাক্সটি তৈরি করেন সেই শিল্পী।  তাছাড়াও এই বাক্সের কারুকার্যটা দেখার মতন; কাঠের ওপর এক অসাধারণ নকশার কাজ করেছিলেন সেই শিল্পী। আর আরও আশ্চর্যের জিনিস হলো এই বাক্সের কলম, এই কলমটি তৈরির মধ্যে দিয়ে এক তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় দেন সেই শিল্পী। এই কলম যেমন লেখনীর ভূমিকা পালন করতো, তেমনি আত্মপ্রতিরক্ষায় এক বিশেষ ভূমিকা পালন করতো। যদিও সেই শিল্পীর নাম, কাল, পাত্র, এই বাক্স তৈরির পদ্ধতিকোনকিছুই আমি জানিনা। হ্যাঁ তবে এই বিষয়ে একটা বই আমার আগের ফ্লাটটায় রয়েছে, ছোটবেলায় মাঠাকুমার কাছে এইটুকুই শুনেছিলাম।

আত্মপ্রতিরক্ষা? কিভাবে?”

এই কলমের একদিকে আছে নিব আর অন্যদিকে আছে তীরজাতীয় একটা তীক্ষ্ণ ফলা। তা এতটাই তীক্ষ্ণ কোনো মোটা কাপড়কে ভেদ করতে এক সেকেন্ড লাগেনা।

কিছুক্ষণ থেমে সামনে রাখা জলের বোতল থেকে বেশকিছুটা জল পান করে আবার বললেন, “তবে কিছুদিন পরই সেই শিল্পী খুন হন আর তার কিছুদিন পর আমার প্রপিতামহ খুন হন। কে খুন করেছিলেন, কেন খুন করেছিলেনএসবই আমার অজানা।

তাহলে মৃত্তিকা?”

আসলে মৃত্তিকা আমার জেঠার একমাত্র মেয়ে, বাবার সাথে জেঠার বিছেদ হয়ে যাওয়ায় ছোটবেলা থেকেই আমাদের দুই পরিবার আলাদা। জেঠার আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় তিনি খুব কম বয়সেই বিছানা নিয়ে নেন এবং খুব তাড়াতাড়ি মারা যান। আমার সাথে দেখা হওয়ার একদিন মৃত্তিকা আমার কাছে এসে সব ঘটনা জানায়, ওর আর্থিক অসঙ্গতির কথা ভেবেই ওকে আমার ব্যবসার কাজে নিয়েছিলাম।

যোগাযোগ হয় কিভাবে আপনাদের?”

শাড়ির ব্যবসা শুরু করার তিন থেকে চার মাসের মাথায় আমি একটা জায়গায় যাই কিছু বিশেষ শাড়ির কালেক্শন দেখতে আর সেখানেই ওর সাথে দেখা হয়।

আচ্ছা, আপাতত এতটুকুই।

                      (

পুলিশস্টেশনে ফিরে সাবইন্সপেক্টর নগেন বক্সী জানান,

স্যার, আমি আজ আবার একবার মিস্টার সেনের বাড়ি গেছিলাম। তখন ওনার স্টাডিরুমে বইপত্র দেখতে দেখতে একটা খাতা পাই ওনার আলমারির দ্বিতীয় তাক থেকে। এখানে উনি ওই বাক্সের কথাই লিখেছেন আর আরও কিছু লিখেছেন।

আরও কিছু বলতে কি নিয়ে?”

যেটুকু লেখা হয়েছে সেটুকু থেকে বুঝলাম, এই খাতাটায় উনি ওনার ঠাকুরদা, নবীণচন্দ্র সেনের তৈরি করা একটা বিশেষ বাক্স শিল্পী হিসেবে তিনি সারাজীবনে যা অবদান রেখে গেছেনএইসব নিয়েই লিখছিলেন। তবে এই বাক্সটার কথাই আর কোন একটা কলম সম্পর্কে তিনি লিখছিলেন। তাঁর মতে, তাঁর ঠাকুরদাকে খুনও হয়েছিল এই কলম দিয়েই।

সেই কলমটা।

কোন কলমটা, স্যার?”

আচ্ছা এখানে কোনো লেখকের উল্লেখ আছে, যাঁর কাছে তাঁর ঠাকুরদা এই কলমটা বিক্রি করেছিলেন?”

আসলে স্যার, শিল্পী নবীণচন্দ্রের কাছ থেকে এই বাক্সটা একবার কেনা হয় আর আরও একবার চুরির চেষ্টা করা হয়। চোর তাতে সফলও হয়।

দুবার কিভাবে?”

লেখকের বক্তব্য অনুযায়ী, রুদ্রপ্রসাদ মজুমদার নামক একজন লেখক শিল্পী নবীণচন্দ্র অর্থাৎ তাঁর ঠাকুরদার কাছ থেকে ৫০০০ টাকা দিয়ে কলমসহ বাক্সটা কেনেন, রুদ্রপ্রসাদ অত্যন্ত অমিতব্যয়ী হওয়ায় কলমটা আবার বিক্রি করে দিয়ে টাকা ফেরত নিয়ে যান। আবার কিছুদিন পর বাক্সটা নিতে এলে শিল্পী দিতে নাকোজ করেন। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে ঝামেলার আরম্ভ হয় আর সেখান থেকেই রাগের বশে রুদ্রপ্রসাদ মজুমদার তাঁকে এই বাক্সের কলম দিয়ে হত্যা করেন এবং এবং সেখান থেকে বাক্স নিয়ে পালিয়ে যান।

আর এসবের কোনো প্রত্যক্ষদর্শী?”

লেখকের মতে, তাঁর পিতা সবটা দেখেছিলেন। তিনিই মিস্টার সেনকে পুরো ঘটনাটা বলেন। মিস্টার সেনের মতে, লোকটা এতটাই শৌখিন ছিলেন, যে শেষে চুরি করে বসে আর খুনও করতে তাঁর হাত কাঁপে না শেষে বাকি জীবনটা পালিয়ে পালিয়ে কাটান। মিস্টার সেন এখানে আরও একটা বইয়ের কথা বলেন যেটা তিনি তিলোত্তমা বসুর কাছে পান।

তিলোত্তমা বসু?”

আজ্ঞে, হ্যাঁ স্যার। তিলোত্তমা বসু তাঁকে জানান, যে তিনি একটা Antique Shop থেকে এই বাক্সটা আর ওই বইটা কেনেন। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে তিনি তাকে বাক্সটা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।

চেয়ারে বসেই ইন্সপেক্টর সাবইন্সপেক্টর বক্সীকে আদেশ দিলেন, “মিস্টার সেন, মিস্টার মিত্র, তিলোত্তমা বসু, মৃত্তিকা বারুইএদের সকলের ব্যাংক একাউন্ট ডিটেলস চেক করতে চাই এখনি।

                                  ()

রাত নটার সময় তিলোত্তমা আর নিশিকান্ত ডিনার টেবিলে বসে ডিনার খাচ্ছেন এমন সময় ডোরবেল বাজার আওয়াজ শব্দ শুনে দরজা খুলে ইন্সপেক্টরকে দেখতে পেয়ে তিলোত্তমা প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলেন,

একি আপনি?”

এত উত্তেজিত হচ্ছেন যে বড়? সর্বপ্রথম আমি জানতে চাইমৃত্তিকা উধাও হয়েছিলেন কিভাবে?”

সেসেটা আমি কিভাবে জানব?”

সত্যিটা বলুন তিলোত্তমা দেবীখুনগুলো আপনি করেছেন।

না এটা হতেই পারেনা, আমি কেন খুন করব?”

আপনি যদি পরিবার সূত্রেই বাক্সটা পেয়ে থাকেন, তাহলে সেটা তো আগে মৃত্তিকা বারুইয়ের যাওয়া উচিত, তাই না কি?”

স্যার….”

হ্যাঁ কি না?”

হ্যাঁ স্যার।  আর সেটাই জানতে পেরে গেছিল মৃত্তিকা। আমার কাছ থেকে বাক্সটা চেয়েছিল। আমি না দিতে চাইলে আমাকে প্রচুর জ্ঞান দেয়, হাজারটা কথা শোনায় আর তারপরেও যখন আমার কাছ থেকে বাক্সটা আদায় করতে পারে না, তখন কাটাকাটি আর সেখান থেকে মারপিট। আর তারপরই হঠাৎ কাজে আসা বন্ধ করে দেয়। বেশ কয়েকবার চুরিও করতে চেয়েছিল।

উধাও হয়ে যান না উধাও করে দেওয়া হয়? আর চুরি ?”

না স্যার, উধাও হয়ে যায় আর তার দুদিন পরেই চুরি করতে আবার ফিরে আসে।

যাওয়ার আগে আমায় বলে গিয়েছিলযে যেভাবেই হোক না কেন বাক্সটা নিয়েই ছাড়বে।

আর তারপর আপনি সেটা মিস্টার সেনের কাছে বিক্রি করে দেন?”

হ্যাঁ।

বেশ কিছু মাস ধরেই আমি বাক্সটা বিক্রি করার কথা ভাবছিলাম, এরজন্য বেশ কয়েকটা antique shop-এও এটা বিক্রির প্রস্তাব জানাই, কিন্তু কেউই ২০ লক্ষ দিতে রাজি ছিলনা আর আমারও একটা বাড়ি কেনার খুব দরকার ছিল। নিজের সব টাকা ব্যবসায় খরচ করে দিয়েছিলাম আর অন্যদিকে ব্যবসারও সেরকম উন্নতি হচ্ছিল না। তাই শেষে এই পন্থা। মিস্টার সেনের সাথে পরিচয় হয় যখন আমি ওনার antique সংগ্রহ নিয়ে খবরের কাগজে একটা লেখা পড়ি আর ওখানে উনি এই একইধরণের বাক্স সংগ্রহের আগ্রহের কথা লেখেন।

তাহলে প্রথমে আপনি আমাদের মিথ্যে কথা বলেন?”

মাথা নিচু করে আসতে করে উত্তর দেন তিলোত্তমা, “হ্যাঁ।

আবার আকুল হয়ে বলে উঠেন, “কিন্তু, মিস্টার সেনকে আমি খুন করিনি স্যার। কারণ সেইদিন আমি আর নিশিকান্ত  মৃত্তিকার বাড়ি যাই মৃত্তিকাকে খুঁজতে। কিন্তু ওকে বাড়িতে না পেয়ে ওর প্রতিবেশীকে জিজ্ঞাসা করলে উনি জানান যে কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়ে গেছে।” 

কোথায় গেছিলেন, কিছু বলেছিলেন? আর এই বাক্সটা বিক্রির ব্যাপারে আপনি ছাড়া আর কে কে জানতো?”

সেটা উনি জানতেন না। শুধু মৃত্তিকা।

ইন্সপেক্টর রক্তিম সান্যাল একজন কনস্টেবলকে বাড়ির বাইরে বসিয়ে রেখে মৃত মিস্টার সেনের বাড়ি রওনা হলেন।

                                       (

আমার এই কেসের ব্যাপারে আরও কিছু জানার আছে।

হ্যাঁ স্যার, বলুন কি জানতে চান?”, সদর দরজার একপাশে দাড়িয়েই মৃত মিস্টার সেনের পরিচারিকা জিজ্ঞাসা করলেন।

তোমার মালিকের মৃত্যুর দিন যিনি দেখা করতে এসেছিলেন, তাঁর সাথে আপনার মালিকের কি কথা হয়েছিল সেটা কি শুনতে পেয়েছিলেন?”

আজ্ঞে না স্যার, যখন চা দিতে যাই তখন শুধু একটা কথাই শুনি-‘বাক্স আর তাছাড়া চা দিতে যাওয়া ছাড়া ওই ঘরে প্রবেশের অনুমতি আমার ছিল না। আর ওনার চেনা লোক ছাড়াও উনি ওই ঘরে কারোর সাথে দেখা করতেন না।

কোনো অচেনা লোক হলে?”

না স্যার, অচেনা লোক হলে স্যার বসবার ঘরে এসে কথা বলতেন।

তাহলে শেষ বার যিনি দেখা করতে এসেছিলেন, তিনি মিস্টার সেনের পরিচিত ছিলেন।

শেষ বার নয় স্যার, শেষ দুবার।

দুবার?”

হ্যাঁ স্যার।

শেষ জনকে আপনি দেখেছেন?”

না স্যার। মালিকের পড়ার ঘর থেকে যে দরজাটা পিছনের বাগানের দিকে চলে যাচ্ছেকাজ করে বেরোনোর সময় আমি ওই দিকে থাকা ডোরবেলটা বাজার আওয়াজ পেয়েছিলাম।

ইন্সপেক্টর সান্যালের মোবাইল ফোনটা একটা বিকট আওয়াজ করে বেজে উঠলো। ফোনের ওপার থেকে মিস্টার বক্সী চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, “স্যার, তিলোত্তমা বসুর বাড়ি থেকেই বাক্সটা উদ্ধার করা গেছে।

ঠিক যেটা ভেবেছিলাম”, বলতে বলতে এক ছুটে জিপগাড়িতে উঠে বসে ঘোড়ার চেয়েও দ্রুতগতিতে গাড়িটা ছুটিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

                                    ()

   পুলিশের জিপগাড়ি এসে দাঁড়ালো তিলোত্তমাদের ফ্ল্যাটের ঠিক নীচে।        

দুতলায় উঠে ইন্সপেক্টর সান্যাল দেখলেন বাইরে চারজন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে। এক ধাক্কায় দরজাটা খুলে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলেন ইন্সপেক্টর সান্যাল।

আপনি বেকার আমাদের এত ছোটালেন। মিস্টার সেনকে কেন মারলেন আপনি?”

না স্যার, আমি মিস্টার সেনকে মারিনি।

আমাদের সাথে মহিলা কনস্টেবলও আছেন, তাই সত্যিটা স্বীকার করাতে বেশিক্ষণ লাগবে না।

মিস্টার সেন একজন অত্যন্ত সভ্য, ভদ্র সম্মানীয় ব্যক্তি ছিলেন। বাক্স সম্পর্কে তিনি আমায় সবকিছু জানানোর পর আমি ওনাকে মিথ্যে বলি যে এই বাক্সটা আমি একটা Antique shop থেকে কিনেছি।

জানি, মিস্টার সেন তাঁর একটা খাতায় সব কিছু লিখে গেছেন।” 

প্রথমে তিনি মাত্র ১০ লক্ষ টাকা দেন আর বাকি টাকাটা উনি ওনার বাড়িতে নিতে যেতে বলেন আর আমি তাই ১৭ তারিখ ওনার বাড়ি যাই আর তখন..”

তার মানে আপনি মৃত্তিকা বারুইয়ের সাথে দেখা করতেই যাননি?”

না স্যার, সন্ধ্যে ছটা নাগাদ যখন আমি মিস্টার সেনের বাড়ির স্টাডি  রুমের বাইরের দরজায় বেল বাজাই, তখন দেখি দরজা আগে থেকেই খোলা আর মাটিতে মিস্টার সেনের লাশ পড়ে আছে।

আপনি যে খুন করেননি, তার প্রমাণ?”

আমার ওনাকে খুন করে কি লাভ স্যার, না আমি পুরো টাকাটা পেয়েছি আর না বাক্সটা। আর তখনই বুঝতে পারি এটা মৃত্তিকার কাজ, কারণ আমি আর মৃত্তিকা ছাড়া এইবাক্সটার ব্যাপারে কেউ জানতো না আর….”

অন্য কেউ যে খুনটা করেনি, সেটার প্রমাণ কি?”

তার প্রমাণ মৃত্তিকার হাতের এই আংটি, যেটা আমি ওই ঘর থেকে পেয়েছিলাম। আমি তখনই পুলিশ ডাকতে পারতাম, কিন্তু আমি জানতাম তদন্ত হলে মৃত্তিকা ধরা পড়ে যাবে আর এটাও জানতাম বাক্সটা পুলিশের হাতে চলে গেলে ওটা আইনত আমার না হওয়ায় আমি আর পাবো না।

তাই আপনি মৃত্তিকাকে খুন করেন?”

না স্যার, মৃত্তিকার বাড়িতে পৌছানোর পর যখন ওর কাছ থেকে কলম সমেত বাক্সটা ফেরত চাই, তখন আমায় জানায় এর জন্য যেকোনো কিছু করতে পারে। তারপর বলে ওই মিস্টার সেনকে খুন করেছে আর তাও ওই একই কলম দিয়ে কারণ জানতো যে পুলিশ কখনো ওকে ধরতে পারবেনা কারণ পুলিশ কখনই এই কলমটা খুঁজে  পাবেনা। কিন্তু আমি যখন মিস্টার সেনের বাড়ি থেকে পাওয়া ওর আংটিটা ওকে দেখাই, তখন সেটা নিয়ে আমাদের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয় আর নিজেকে বাঁচানোর জন্য ওই কলমটা দিয়েই আমি..”, কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়েন তিলোত্তমা।

এর প্রমাণ?”

এই মোবাইলে সব রেকর্ড করা আছে, আপনি চাইলে দেখে নিন।

এবার আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।

ফ্ল্যাটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা কনস্টেবলকে ডেকে তিলোত্তমা বসুকে নিয়ে যাওয়ার আদেশ দিলেন ইন্সপেক্টর সান্যাল। জিপে উঠে চলে যাওয়ার সময় তিলোত্তমা জলভরা চোখে একবার নিশিকান্তের দিয়ে তাকালেন।

স্যার, এই নিনবাক্স আর এই কলম”, জিনিসগুলো টেবিলের ওপর রেখে দিলেন সাবইন্সপেক্টর বক্সী।

কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার পর ইন্সপেক্টর সান্যাল বাক্স আর কলমটা নিয়ে যেতে বলেন।

নিশিকান্ত বসুর দিকে তাকিয়ে ইন্সপেক্টর সান্যাল শেষে বলেন, “এই জিনিসগুলো এখন আমাদের কাছেই থাকুক, কিছু হলে নিশ্চয়ই জানাবোচলি।

  

 

 

সংযুক্তা বোস, বগুইহাটি

লেখালেখি করার মাধ্যমে নিজেকে খুঁজে পাই। অনেক কথা যখন বলে প্রকাশ করতে পারিনাতখন এই লেখালেখি প্রিয় বন্ধু হয়ে ওঠে। সে দিন হোক কিংবা রাতকাগজ আর কলম থাকলে নিজেকে ভাসিয়ে নিয়ে যাই অনুভূতির সেই শহরেযেখানে আমার চিন্তাআমার ভাবনাআমার লেখনী শক্তির বাস।


Jooble Presents Quarterly Creative Writing Competition

  

SOURCEসংযুক্তা বোস
Previous articleঅনুতাপ
Next articleআইনস্টাইনের জন্য
Avatar
Disclaimer: Monomousumi is not responsible for any wrong facts presented in the articles by the authors. The opinion, facts, grammatical issues or issues related sentence framing etc. are personal to the respective authors. We have not edited the article. All attempts were taken to prohibit copyright infringement, plagiarism and wrong information. We are strongly against copyright violation. In case of any copyright infringement issues, please write to us. লেখার মন্তব্য এবং ভাবনা, লেখকের নিজস্ব - কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত..................

1 COMMENT

  1. খুব ভালো লিখেছো সংযুক্তা। এভাবেই এগিয়ে যাও । শুভকামনা রইল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here