বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্প, উপন্যাসের ব্যতিক্রর্মী জ্যোতিষ্ক জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী( ২০ আগস্ট, ১৯১২ — ৩ আগস্ট ১৯৮২)
তাঁর জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। একই জেলায় আরেক প্রবাদপুরুষ সাহিত্যিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ জন্মেছিলেন। মল্লবর্মণের মতো নন্দীরও দারিদ্র্য আর অভাব নিয়ে জন্ম। তাঁর ডাকনাম ছিল ধনু। পিতা অপূর্বচন্দ্র নন্দী ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন, তাঁর মায়ের নাম চারুবালা দেবী। অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৩০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেছিলেন তিনি। ১৯৩২-এ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করে ওই কলেজেই স্নাতক স্তরে ভর্তি হন। কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্র ১৯৩৫ সালে প্রাইভেটে বিএ পাশ করেন । ১৯৩৬ সালে কাজের নিমিত্ত কলকাতা যান। তিনি প্রথম চাকরি পান বেঙ্গল ইমিউনিটিতে। তারপর টাটা এয়ারক্রাফ্ট, জে ওয়ালটার থমসন-এর পাশাপাশি কাজ করেন যুগান্তর সংবাদপত্রের সাব এডিটর হিসেবে এবং দৈনিক আজাদ পত্রিকায়ও ছিলেন। তার কর্মক্ষেত্রে ছিল ইন্ডিয়ান জুটমিলস অ্যাসোসিয়েশনের ইংরেজি ও বাংলা ভাষার মুখপত্র মজদুর ও জনসেবক পত্রিকায় ছোটবেলা থেকে তিনি সাহিত্যচর্চ্চা করতেন। স্বদেশি আন্দোলনে যুক্ত থাকার অভিযোগে ১৯৩১ সালে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এক বছর গৃহবন্দী থাকাকালীন তার সাহিত্যচর্চার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। জ্যোৎস্না রায় ছদ্মনামে ।এখানে বলে রাখা ভাল, কলকাতায় এসে তিনি সাগরময় ঘোষের সান্নিধ্যে আসেন। ও দেশ পত্রিকায় ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয় ছোটগল্প রাইচরণের বাবরি। মাতৃভূমি, ভারতবর্ষ, চতুরঙ্গ, পরিচয় পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের নজরে আসে জ্যোতিরিন্দ্রর লেখা। তাঁর লেখা ছোটগল্প ভাত ও গাছ, ট্যাক্সিওয়ালা, নীল পেয়ালা, সিঁদেল, একঝাঁক দেবশিশু ও নীলফুল এবং বলদ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়। ১৯৪৮ সালে দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক উপন্যাস সূর্যমুখী প্রকাশিত হয়। এর পর থেকে তিনি সাহিত্যচর্চাকেই জীবনের অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁর উপন্যাসগুলো হল
সূর্যমুখী,মীরার দুপুর,গ্রীষ্ম বাসর,নিশ্চিন্তপুরের মানুষ,হৃদয়ের রং,প্রেমের চেয়ে বড়,সর্পিল,তিন পরী ছয় প্রেমিক,নীল রাত্রি,বনানীর প্রেম।
ছোট গল্প ১৯৩৬ সালে মাত্র চবিবশ বছর বয়সে তাঁর ছোটগল্প ‘নদী ও নারী’ পরিচয় পত্রিকায় প্রকাশের পরপরই গাল্পিক হিসেবে নাম ছড়িয়ে পড়ে। এখানে বলে রাখা ভাল, কবিতা লিখে শব্দ-সহবাস শুরু হয়েছিল জ্যোতিরিন্দ্রের। কিন্তু কোথাও কিছুর একটা অভাব বোধ করছিলেন তিনি। কী যেন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। ‘গদ্য চাই। গদ্য খুঁজছি।’ তাই আতিপাতি করে বই খোঁজা শুরু হল। বাড়িতে কারও সাহিত্যচর্চা ছিল না সে ভাবে। ফলে বই খুঁজে পেতে প্রথমে একটু হোঁচটই খেতে হল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাবার টেবিলের উপরে আইনের বইয়ের পাশেই মিলল সেই অমূল্য ধন! তিনটি উপন্যাস। তখন বয়স মাত্র এগারো থেকে বারো। রুদ্ধশ্বাসে পড়া হয়ে গেল রমেশচন্দ্র দত্তের লেখা সে তিন উপন্যাস। তার মধ্য দিয়েই যেন সাবালক হল সাহিত্যপাঠ। ধনু আর এখন পুকুরঘাটে যাওয়ার রাস্তার পাশের পুঁইমাচার সামনে একা একা দাঁড়িয়ে থাকে না। উপন্যাস-গল্পের বইয়ের পাতা থেকে বেরিয়ে চরিত্রেরা তখন তার সঙ্গে যেন কথা বলে, গল্প করে। কিন্তু তাতে বিপদ হল এক দিন। বাবার বন্ধু বাড়িতে এসেছেন। তখন ধনু বসে উপন্যাস পড়ছে। সামনে আরও দু’-চারটে উপন্যাস-গল্পের বই ছড়ানো। বাবার বন্ধু তো দেখে অবাক। এগারো-বারো বছরের ছেলে এ রকম উপন্যাস পড়ছে! ‘‘এত অল্প বয়সের ছেলেকে এ সব উপন্যাস-টুপন্যাস পড়তে দেবেন না,’’ বলে তিনি চলে গেলেন। ‘অবাক হলাম বাবাকে দেখে। তিনি কিন্তু একবারও আমাকে বললেন না যে এখনও তোমার উপন্যাস পড়ার সময় হয়নি’, নিজের বাবা সম্পর্কে লিখছেন জ্যোতিরিন্দ্র। আবার তাঁর (জ্যোতিরিন্দ্র) পুত্র তীর্থঙ্করবাবু বলছেন, ‘‘বাবার সঙ্গে লেখা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করেছি। তিনি কথা শুনেছেন মন দিয়ে। মনঃপূত না হলে তখন নিজের মতটা বলেছেন।’’ আসলে নিজের বাবার কাছ থেকে মুক্তমনা সংস্কৃতির যে শিক্ষা পেয়েছিলেন, তা থেকে বিচ্যুত হননি জ্যোতিরিন্দ্র। কবিতা দিয়ে লেখালেখি শুরু হলেও ক্রমশ গদ্যই সঙ্গী হয়ে গেল তাঁর। প্রথমে অমুক সমিতি, তমুক ক্লাব, এ পাড়া, ও পাড়ার হাতে লেখা কাগজে গল্প পাঠানো চলছিল নিয়মিত। ছোট হলেও একটা নির্দিষ্ট বৃত্তে আস্তে আস্তে তৈরি হচ্ছিল গল্পকারের পরিচয়। এই করতে করতে স্কুলের গণ্ডি পার হয়ে গেল। কলেজে পড়াকালীন মঁপাসার একটা গল্প অনুবাদ করে ঢাকার এক পত্রিকায় পাঠিয়ে দিলেন তিনি। সেটি ছাপা হল। ছাপার হরফে সেই প্রথম নিজের নাম দেখলেন জ্যোতিরিন্দ্র। সে কী আনন্দ! তার এক মাস পরেই ওখানে একটি মৌলিক গল্প পাঠালেন। ছাপা হল সেটিও। এর মধ্যেই ঘটল সেই ঘটনা। স্বদেশী আন্দোলনে যোগদান করার জন্য তাঁকে সন্ত্রাসবাদী অ্যাখ্যা দিয়ে গ্রেফতার করা হয়! জ্যোতিরিন্দ্র লিখেছেন, ‘সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে। চার মাস জেলে আটক করার পর আমাকে স্বগৃহে অন্তরীন করা হয়।’ শুধু অন্তরিন করে রাখাই নয়, চাপল সরকারি নিষেধাজ্ঞাও—কোনও পত্রপত্রিকায় লেখা যাবে না। কিন্তু মাথার মধ্যে শব্দেরা যে ভর করছে, ভনভন করছে তারা। অতঃপর ‘জ্যোৎস্না রায়’-এর আগমন ধরণীতে! ‘জ্যোৎস্না রায়’ ছদ্মনামেই চলল সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি। কিন্তু সে সব লেখার কিছুই নিজের কাছে রাখা গেল না। দেশভাগ হল। ও পার বাংলার আলমারিতেই পড়ে রইলেন ‘জ্যোৎস্না রায়’!তাঁর প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ আবার কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রশিষ্য ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র। তাঁর গল্প-উপন্যাসের চরিত্রগুলো এসেছে নিম্নবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনের বিচিত্র এলাকা থেকে। কখনো মনে হয়েছে তারই মতো ভেসে এসেছে কুলহারা-স্বজনহারা সব, ১৯৩৪ সালে জীবিকার সন্ধানে কলিকাতায় (কলকাতা) চলে যান, কলকাতা গিয়েও প্রথম জীবনে দীর্ঘসময় টিউশনিই ছিল তাঁর পেশা, যদিও অনেক পরে সাংবাদিকতার পেশাকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেন। নির্লিপ্ত আর নির্জনতাপ্রিয় মানুষটি জীবনের অনেকগুলো বছর ক্ষুদ্র পরিসরের মেসবাড়ির জীবন অতিবাহিত করেছেন এবং সেখানকার কত বাস্তব জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন; কত সমস্যা কত কাহিনির জন্ম তিনি দেখেছেন এখানে। মানুষ এবং মানুষের বিচিত্র ঘটনা-উপঘটনা এবং তাদের সংগ্রামমুখর পথচলা সবই তার হৃদয়কে স্পর্শ করে গেছে। তাদের পেশা-বয়স-মানসিকতা সবই ভিন্ন, বারো ঘর এক উঠোন (১৯৫৫) উপন্যাসে বস্তিজীবনের কাহিনি বিধৃত। অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং নৈতিক অবক্ষয় নিয়ে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী উপন্যাসে তৎকালীন বাংলাদেশের রূপক নির্মাণ। নির্মম ও দুঃসাহসিকতায় এবং সে-নিরাসক্তি প্রায় নিষ্ঠুরতার শামিল। তাকে তিনি প্রজ্বালিত অগ্নিগিরির মতো জ্বালিয়ে রেখেছিলেন উপন্যাসে। ১৯৫৩ সালে তাঁর লেখা উপন্যাস ‘মীরার দুপুর’। এই উপন্যাস সম্বন্ধে কেউ তাঁকে বলেন ‘সুন্দরের কারিগর’, কেউ বলেন, ‘শব্দের জাদুকর’— তিনি বাংলা সাহিত্যের এক সাম্রাজ্যের অধীশ্বর।
বিংশ শতকের ত্রিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে বাংলা সাহিত্যের জন্য বিশেষ উল্লেখযোগ্য একটা যুগ। গল্প-উপন্যাসের যে-জন্মবেদনা এবং সাহিত্যিকদের উঠে আসার সময়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯২৪-২৮) শুরু এবং শেষের সীমা নির্দিষ্ট ছিল পাশ্চাত্যে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ১৯৩৯, যার শেষ হয় ১৯৪৫ আনুষ্ঠানিকভাবে। ১৯৪৩-এর প্রথম দিকে প্রাকৃতিক ঝড়, দুর্যোগ এবং মন্বন্তর, ১৯৪৬-এ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, বাস্ত্তহারাদের সহায়-সম্বল হারানোর তীব্র বুকভাঙা যন্ত্রণা, ১৯৪৭-এ দেশভাগ, দুটো স্বাধীন দেশের মানচিত্র অর্থাৎ ধর্ম এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপর ভিত্তি করে স্বাধীনতা, স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর বিভাজিত দেশের উদ্বাস্ত্ত সমস্যা – সেই গভীর সমস্যা থেকেঅবক্ষয়-অনন্বয়-অস্তিত্বের সংকট, উদ্ভব ঘটে নতুন ধনিকশ্রেণির, প্রান্তিক মানুষকে চুষে খাওয়ার সেই রক্তচোষার দলেরা ঐক্যবদ্ধ হয়। মুখোশ খুলে সামনে আসে পুঁজিবাদি-কালোবাজারি-মুনাফাখোর-মজুতদার-দাদন ব্যবসায়ী – ১৯৫০ অবধি এদের দৌরাত্ম্যের কাছে হার মানে রাষ্ট্র, ক্রমে ক্রমে তা আবার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। এ-সময় মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে ওঠে। ভাত-কাপড়-বাসস্থানের অভাবের সঙ্গে আরো কিছু প্রয়োজনীয় অভাব দেখা দেয়। বাঁচার মতো বাঁচার জন্য বিনোদন-সংস্কৃতি চায়। এ-সময়ে মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজ থেকে গজিয়ে ওঠেন একঝাঁক সাহিত্যিক। মূলত যাঁরা সাহিত্য-সংস্কৃতির নেতৃত্বে আসীন হন, তাঁদের পদচারণে এ-সময় বাংলাসাহিত্যের ভূমি উর্বর হয়। নতুন অভিনব জীবনের কথাকাররা বেরিয়ে আসেন তিক্ত-অভিজ্ঞতায় বলিষ্ঠ হয়ে। কাজী নজরুল ইসলাম অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত,নরেন্দ্রনাথ মিত্র-্,অমিয়ভূষণ মজুমদার,কমলকুমার মজুমদার,সন্তোষকুমার ঘোষ-মনোজ বসু,অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়-জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী-সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়,-্সমরেশ বসু,সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ প্রমুখ। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর গল্প বা উপন্যাসে ব্যক্তিক ও পারিবারিক অস্তিত্বের সংকট নিয়ে যে-কাহিনি গড়ে তুলেছেন তা এককথায় মর্মস্পর্শী বা হৃদয়স্পর্শী বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁর রচনার বিষয়ে প্রবলভাবে অপবাদ দেওয়া হয় যে, তিনি কবিতা দ্বারা আক্রান্ত-অধিকৃত। কথাটা হয়তো পুরোপুরি সত্য। এও তো চিরসত্য, তাঁর লেখা বাস্তবতা থেকে কখনো বিচ্যুত হয়নি। তাঁর প্রিয় কবি জীবনানন্দের মতোই জ্যোতিরিন্দ্র চিত্রময়তাকে আশ্রয় করে এগিয়ে যান, যার কারণে চিত্রকল্প-চিত্রকলা উপমা-রূপক প্রতীক ইত্যাদি কবিতার অলংকার গদ্যে অবিরল ধারায় বহুল ব্যবহার করেছেন। তাতে অবশ্যই রচনার মান উতড়ে গেছে। জ্যোতিরিন্দ্রের সাহিত্যের প্রধান বিষয় যদিও মানুষ এবং প্রকৃতি। তাঁর গল্প উপন্যাসের চরিত্রগুলো দারিদ্র্যর সঙ্গে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকে। কিন্তু তিনি কখনো শ্রেণিসংগ্রামের কথা ভাবেননি। তার প্রকৃতি বাস্তবিকই নিজের অর্থাৎ স্বতন্ত্র, রবীন্দ্রনাথ বা বিভূতির প্রকৃতির মতো এক নয়। তাই তো দেখা যায় মানুষ এবং প্রকৃতিকে তিনি একটা সামান্তরালে এনে দাঁড় করিয়েছেন। এও সত্য, তাঁর রচনা যৌনতায় ভরপুর; অনেকটা যৌনতাই উপজীব্য যেন। তারপরও তাঁর মানুষ, তাঁর প্রকৃতি সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ বা প্রকৃতিকে নিজের মতো করে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সমানভাবে তাঁর গল্প-উপন্যাসে স্থান দিয়েছেন। শুধুমাত্র পটভূমিকায় বিরাজিত নয়, প্রকৃতি কখনো নিষ্ঠুর, শুধুই পেলব নয়, মানুষের অন্তঃপ্রকৃতি যেমন, বিমুগ্ধতা তাকে বিবরে অথবা কোটরে প্রবেশ করিয়েছে, চরিত্র হয়েছে সজীব-সাবলীল। তাই তাঁর গল্প-উপন্যাস আকাশপ্রমাণ সাফল্য বয়ে এনেছে। সত্তর বছরের আয়ুষ্কালে দরিদ্রতা-স্বেচ্ছাবৃত-নিঃসঙ্গতায় কেটেছে। মন্বন্তর-মহামারি-দাঙ্গা-দেশভাগের কারণে জন্মভূমির মায়া ত্যাগ।
আজীবন স্বপ্ন দেখেছেন লেখকই হবেন। শুধু মাত্র লেখার প্রয়োজনে বস্তিতে থাকতে পর্যন্ত কার্পণ্য করেননি। তিনি বাস্তব অভিজাতার আলোকে সব কিছু উপলব্ধি করেন তা আমরা তাঁর লেখা থেকে পাই।
ছোটবেলার ধনু, বড় হয়ে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী নামে লিখলেন, ‘আজ আমি বুঝি তখনও আমার ভাল লাগার বোধ জন্মায়নি। …কোন্ দৃশ্য, কোন্ শব্দ— কিসের গন্ধ আমাকে আনন্দ দেবার জন্য অপেক্ষা করছিল তখনও জানতে পারিনি, বুঝতে পারিনি।’ আর সেই না বোঝাকেই আজীবন বুঝতে চেয়েছিলেন লেখক জ্যোতিরিন্দ্র, একের পর এক লেখায়। কখনও তাঁকে বলা হয়েছে যে তিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লেখেন, কখনও বলা হয়েছে লেখার মাধ্যমে আদর্শ প্রচার করছেন। কিন্তু সে সব কিছুকে প্রবল ভাবে অস্বীকার করেছেন জ্যোতিরিন্দ্র। শুধু বিশ্বাস করেছেন, ‘মনে হয়, কোনো রচনাই ‘নিখুঁত’ হল না ‘সর্বাঙ্গীণ সুন্দর’ হল না— আরও ভাল করে লেখা উচিত ছিল।’
প্রাতভ্রমণের নেশা ছিল ঠার্কুদার। ঠার্কুদার হাত ধরে রেললাইন পার হয়ে একদম শহরের শেষ সীমায় এক খালের কাছে সে দিন চলে গিয়েছিল ধনু। তারপর সেখান থেকে খালের ধারে হেলিডি সাহেবের বাংলোর কাছে এক ফুলবাগানে। বুড়ো দারোয়ান ঠার্কুদাকে খুব ভালবাসতেন। দারোয়ান গেট খুলে দিলেন। কিন্তু বাগানে ঢুকেই চমকে উঠল ধনু। এই, এই বুঝি সেই অবিশ্বাস্য! ধনুর মাথার সামনে একটা গাছের দুটো ডালে দুটো সদ্য ফোটা গোলাপ। একটু একটু শিশির লেগে রয়েছে পাপড়ির গায়ে। সূর্য উঠছে সবে। তার রক্তাভ আলো এসে পড়েছে পাপড়িতে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই একটি নীল প্রজাপতি একটা কলির বোঁটায় এসে বসল। পলক পড়ছে না ধনুর। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ভিতরটা কী রকম করছে যেন।
জ্যোতিরিন্দ্র লিখছেন, ‘ভাললাগা কাকে বলে, ভাল দৃশ্য কী সেদিন প্রথম টের পেলাম। আর গন্ধ। নির্জন ঊষার সেই বাগানে গোলাপের মৃদু কোমল গন্ধে আমার বুকের ভিতর ছেয়ে গেল। সেই গন্ধ বুকে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। যেন একটা আশ্চর্য সম্পদ আহরণ করে বাড়ি ফিরলাম।’
বুকের মধ্যে বয়ে নিয়ে আসা প্রকৃতির গন্ধের সঙ্গে সেই যে সম্পর্কের শুরু, তা আজীবন বয়ে নিয়ে চলেছেন তিনি। আমৃত্যু। আসলে এক এক জনের স্মৃতি এক এক জিনিসের অনুরণন নিজের মতো করে ধরে রাখে। কখনও কোনও দৃশ্য, কখনও গন্ধ, কখনও আবার রং, এক এক জনের ক্ষেত্রে স্মৃতির অনুষঙ্গের বিষয়গুলি এক এক রকম। জ্যোতিরিন্দ্রের কাছে তা ছিল গন্ধ। তিনি প্রয়োজন মতো সেই সব স্মৃতির অনুষঙ্গে ডুব দিয়েছেন। ডুব দিয়ে কখনও ‘ভাদ্র মাসে জলে ডোবানো পাটের পচা গন্ধ থেকে বা অঘ্রাণের পাকা ধানের গন্ধ থেকে বা কখন আবার পুঁটি, মৌরলা মাছের আঁশটে গন্ধ’ থেকে সৃজনের প্রয়োজনীয় উপকরণটুকু নিয়ে উঠে এসেছেন। সকলের চোখের আড়ালে গিয়ে বসে পড়েছেন নিজের লেখার খাতার সামনে। তার পর পাতা জুড়ে জন্ম নিয়েছে একের পর এক দৃশ্যাবলি। ‘বুটকি-ছুটকি’, ‘গিরগিটি’, ‘বনের রাজা’-সহ অনেক গল্পে ফিরে ফিরে এসেছে ছোটবেলার নানা রকম গন্ধের স্মৃতি। জ্যোতিরিন্দ্রের নিজের কথায়, ‘সব ক’টা ইন্দ্রিয়ের মধ্যে সেই শৈশব থেকে আমার নাকটা অতিমাত্রায় সজাগ সচেতন। পরবর্তী জীবনে সাহিত্য সৃষ্টি করতে গিয়ে এই গন্ধ আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।’ তিনি নিজের বিয়ের মেয়ে দেখতে গিয়ে তাও চমকপ্রদ।বিলাসিতা নেই, বন্ধুবান্ধব নেই, আড্ডা নেই, অহেতুক সময় নষ্ট নেই। অন্তর্মুখী অথচ স্পষ্টবক্তা, গভীর অথচ সূক্ষ্ম রসবোধ রয়েছে, যাঁরা জ্যোতিরিন্দ্রকে কাছ থেকে চিনতেন, তাঁদের কাছে এমন ভাবেই ধরা দিতেন তিনি। যেমন বিয়ের জন্য পাত্রী (পারুল নন্দী) দেখতে গিয়েছেন। পাত্রী দেখা শেষের মুখে। হঠাৎ কোনও রকম ভনিতা ছাড়াই পাত্রীর দাদাকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, ‘‘আমি কত মাইনে পাই জানতে চাইলেন না তো!’’ পাত্রীর দাদা একটু বিব্রত। কিন্তু তাঁকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জ্যোতিরিন্দ্র নিজেই বলে দিলেন, ‘‘আমি মাইনে পাই একশো তিরিশ টাকা।’’ মেয়ের বাড়ির সকলে একটু অবাকই হয়েছিলেন। কিন্তু খুব একটা গুরুত্ব দেননি জ্যোতিরিন্দ্র। সাদামাটা মানুষ তিনি। পারিবারিক সূত্র থেকে জানা যায়, বিয়ে করতে গিয়েছেন তিনি। একরাশ ঝাঁকড়া চুল, সাজগোজের মধ্যে শুধু লন্ড্রি থেকে কাচানো নতুন ধুতি-পাঞ্জাবি। ব্যস, ওইটুকুই। দেখে বোঝার উপায় নেই যে, তিনিই বর!বিবাহ ও কর্মজীবনতখন জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী কলকাতার জে ওয়ালটার থমসন-এ কর্মরত। কামিনীকুমার ধরচৌধুরী ও ক্ষীরোদাদেবীর মধ্যম কন্যা পারুলের সঙ্গে ১৯৪৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তাঁর বিয়ে হয়। ইংরেজ আমলের প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছিলেন পারুল, ভাল বাঁশি ও সেতার বাজাতে পারতেন।
বিয়ের আগে পারুলদেবীকে দেখতে গেলেন গিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র। সঙ্গে নিয়ে গেলেন বন্ধু গণেশ দত্তকে। গণেশবাবুর গায়ের রং ছিল মিশমিশে কালো। বিয়ের পরে তিনি পারুলদেবীকে বলেছিলেন— ও পাশে থাকলে আমায় একটু দেখতে ভাল লাগবে, তাই নিয়ে গিয়েছিলাম গণেশকে।
লেখার সময় আধশোওয়া হয়ে বসতেন আরাম কেদারায়। সামনের দক্ষিণ দিক পুরো খোলা। সেখান থেকে প্রচুর আলো এসে পড়ছে ছিপছিপে একহারা চেহারায়। তিনি ভাবছেন আর লিখছেন। হঠাৎ করেই হয়তো মেয়ে বা স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করতেন, ‘‘অমুক চরিত্রের কী নাম দেওয়া যায় বলো তো?’’ তাঁরা হয়তো নাম বলতেন দু’-একটা। কিন্তু কোনওটাই মনঃপূত হতো না তাঁর। স্ত্রী হয়তো জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘ওই গল্পটার নাম কী দিলে?’’ নিরাসক্ত গলায় উত্তর আসত, ‘‘সে পরে দেখবে’খন।’’ আসলে নিজের লেখা নিয়ে আগাম কিছু বলাটা মোটেই পছন্দ করতেন না তিনি।
স্ত্রী পারুল নন্দীর স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে সে প্রসঙ্গ,—‘তারপর যখন লেখাটা ছাপা হল, দেখলাম ফাইনাল চেহারাটা কী দাঁড়িয়েছে। বারান্দায় ঝুকে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। হঠাৎ বললেন, একটা ভাল প্লট মাথায় আসছে জান। ব্যস, ঐটুকুই। তারপর শুধু লেখা।’
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর বিখ্যাত উপন্যাস ” বারো ঘর এক উঠোন”। এই উপন্যাস লেখার একটা পটভূমি আছে। এই উপন্যাস লেখার জন্য
জ্যোতিরিন্দ্র বেছে নিয়েছিলেন বস্তি এলাকা। এমনিতে সারা জীবনে সাত-সাত বার ভাড়া বাড়ি পাল্টেছিলেন। চাকরি পাল্টেছেন একাধিক বার। কিন্তু যেখানে গিয়েছেন সেখান থেকেই সংগ্রহ করেছেন সৃজনী-উপকরণ। পারিবারিক সূত্র থেকে জানা যায়, মেয়ের বয়স তখন মাত্র চার বছর। বেলেঘাটার বারোয়ারিতলায় একটা বস্তি দেখে এসেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র। হঠাৎ করেই স্ত্রীকে এসে বলেছিলেন, ‘‘ওই বস্তিতে থাকতে হবে আমাদের। লেখার প্রয়োজনে।’’ তারপরে লেখার তাগিদেই থাকা শুরু ওই বস্তিতে। বাড়ির মাঝখানে বড় উঠোন। ভাড়াটে সব মিলিয়ে মোট এগারো ঘর। সকলের ব্যবহারের জন্য ওই একটিই উঠোন। কেউ কাজ করতেন দোকানে, কেউ আবার ছিলেন নার্স। বেশির ভাগই ছিলেন পূর্ববঙ্গের। ওখানে থাকাকালীনই সকলের হাবভাব খুঁটিয়ে দেখা শুরু করলেন। দেখতে থাকলেন আচার-আচরণ, জীবনযাত্রা। সে সব অভিজ্ঞতা, স্মৃতি তার পরে হ্যারিকেনের আলোয় বসে বসে লিখেছিলেন। জন্ম নিয়েছিল ‘বারো ঘর এক উঠোন’ নামের তাঁর
বিখ্যাত উপন্যাস।
সাদামাঠা ওই ভাব আজীবন সঙ্গী ছিল তাঁর। যেমনটা সঙ্গী ছিল নিয়মানুবর্তিতা। চূড়ান্ত আর্থিক কষ্ট, অনটনেও নিয়মানুবর্তিতায় কোনও খাদ ছিল না। সে এক মেয়ে ও দুই ছেলের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য পালনই হোক কিংবা লেখাই হোক না কেন। লেখা আসুক আর না আসুক, রোজ নিয়ম করে লেখার খাতার সঙ্গে তাঁর সময় কাটানো চাই-ই চাই। পারুল নন্দীর স্মৃতিচারণা অনুযায়ী, ‘লেখার সময়ও ছিল অত্যন্ত বাঁধা। যখনই মনে হল তখনই লিখতে বসলাম একদম পছন্দ করতেন না। যখনই মনে হল রাতে বাড়ি ফিরলাম একদমই পছন্দ করতেন না। আমার স্বামী নিজেই ঘড়ি হয়ে যেন নিজেকে এবং সেই সঙ্গে সংসারটিকে চালনা করতেন।’
সকালে ও বিকেলে দু’বেলা নিয়ম করে হাঁটতে যেতেন। কিন্তু ওই হাঁটার সময়ে খুব একটা কথাবার্তা পছন্দ করতেন না। মনে করতেন, সাধারণ কথা-গল্পের চেয়ে ওই সময়ে যদি কোনও গল্প-উপন্যাসের ভাবনা তাঁর মাথায় আসে, তাতেই অনেক লাভ! লেখার জন্য এ ভাবেই নিজেকে একা করেছেন, বিযুক্ত করেছেন সকল কিছুর থেকে। ফেসবুক-ধ্বস্ত এ সময়ে লেখার জন্য নিজেকে নিঃসঙ্গ করার এই কৃচ্ছ্রসাধনের রীতি প্রায় বিরল।
১৯৩৬ সাল। কলকাতায় চলে এলেন জ্যোতিরিন্দ্র। শুরু হল লেখকজীবন। পাইস হোটেলে খাওয়া, পড়া, দু’-একটা টিউশন আর লেখা— এই ছিল নিত্যদিনের রুটিন। সিনেমা নয়, খেলা দেখা নয়, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা নয়। প্রত্যেক দিন শুধু নিয়ম করে লেখা চলত। পড়িয়ে আয় হত ওই বাইশ-তেইশ টাকা। হোটেলে থাকা-খাওয়া বাবদ বারো-তেরো টাকা দিতে হত। ধোপা-নাপিত-বিড়ি-পান সব মিলিয়ে যা আনুষঙ্গিক খরচ, ওই আয়ের মধ্যেই হয়ে যেত। প্রেমেন্দ্র মিত্র নিজের সাপ্তাহিক পত্রিকায় জ্যোতিরিন্দ্রের বেশ কয়েকটি ছোট গল্প ছাপলেন। ‘পূর্বাশা’ ও ‘অগ্রগতি’তেও ছোটগল্প বেরোল। তার মধ্যেই এক সংবাদপত্রে সাব-এডিটরের চাকরি পেয়ে গেলেন জ্যোতিরিন্দ্র। অল্প কয়েক দিনের চাকরি। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে ‘দেশ’ পত্রিকায় আরও একটি গল্প বেরোল। একে একে ‘মাতৃভূমি’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘পরিচয়’-সহ একের পর এক পত্র-পত্রিকায় গল্প বেরোতে থাকল। বন্ধুদের মধ্য থেকে দাবি উঠল উপন্যাসের। কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্র তখনও প্রস্তুত নন। তাঁর কাছে ‘উপন্যাস তো এক অধরা। তবু্ উপন্যাস লিখলকাশ হওয়ার পরে তা নিয়ে প্রশংসা জুটল, নিন্দা জুটল তার চেয়েও বেশি। কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্র থামলেন না। ‘সূর্যমুখী’র পরে ‘মীরার দুপুর’, তার পর ‘বারো ঘর এক উঠোন’। ‘বারো ঘর এক উঠোন’ তাঁকে খ্যাতি দিল, পরিচিতি দিল, প্রতিষ্ঠা দিল। তবে অনেক সমালোচক জানালেন, লেখক ওই উপন্যাসে শুধু অন্ধকারই দেখেছেন। নিজে যেমন আলো দেখতে পাননি, তেমনই একটি চরিত্রকেও আলোয় উত্তরণ করাতে পারেননি। সমালোচকদের যাবতীয় আক্রমণ, নিন্দাপর্ব মেটার পরে, ‘বারো ঘর এক উঠোন’-এর হয়ে কলম ধরেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র। লিখেছিলেন, ‘আলো দেখাবার জন্য উত্তরণ দেখাবার জন্য আমি এ-বই লিখিনি। কেননা আমার দেখা একসময় সাগরময় ঘোষ ছোটগল্প চেয়ে চিঠি দিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রকে। সঙ্গে লিখলেন— ‘এবার উপন্যাসে হাত দাও।’ ব্যস! জ্যোতিরিন্দ্র লাফিয়ে পড়লেন উপন্যাসে। এত দিন ছোটগল্প লিখে তিল তিল করে যে শব্দবিন্যাস তৈরি করেছেন, তাই উজাড় করে দিলেন নিজের প্রথম উপন্যাসে। ‘সূর্যমুখী’ সম্পূর্ণ হল। ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিতও জানা চরিত্রগুলির মধ্যে এমন একটি মানুষও ছিল না, যে এদের মধ্যে উপস্থিত থেকে মহৎ জীবনাদর্শের বাণী শোনাতে পারত। বিপন্ন, বিপর্যস্ত, অবক্ষয়িত সমাজের মানুষগুলি শুধু বেঁচে থাকার জন্য, কোনোরকমে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য কতটা অন্ধকারে, কতটা নিচে নেমে যেতে পারে আমি তাই দেখিয়েছি।’বিয়ের পরে নবদম্পতি বসবাস শুরু করল কলেজ স্ট্রিটের একটি বাড়িতে। সেখান থেকে প্রথমে রূপবাণী সিনেমার কাছে রামচাঁদ লেনের বাড়ি, তার পর বেলেঘাটার বারোয়ারিতলা লেনের ‘এগারো ঘর বাসিন্দা’-র বাড়িতে বসবাস করেন তাঁরা। বেলেঘাটার বস্তি, বাগমারি রোডের ভাড়াবাড়ি, তিলজলার সরকারি ফ্ল্যাট— মোট সাত বার বাড়ি পাল্টান জ্যোতিরিন্দ্র। তবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন তিলজলা হাউজিং-এই (ব্লক এল/এ, ফ্ল্যাট ফোর
তাঁর ছোট গল্পের কথা বলা যেতে পারে। তাঁর লেখা’ আ’ম কাঁঠালের ছুটি’গল্পটিতে তিনি একটি বর্দ্ধিষু পরিবারের ধ্বংসের কাহিনী সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন। সবাই মারা গেছে, বেঁচে আছে শুধু আঁশি বছরে পুত্র শিবনাথ ও তার বুড়ো মা। মায়ের বয়স নব্বইয়ের উপরে। এক সময় বাড়িতে কত আনন্দ ছিল। বিয়ে,অন্নপ্রাশন, নবজাতকের আগমন লেগেই থাকতো। তারা সবাইকে অকালে মরে যেতে দেখেছেন। এখন বুড়ো মা ও ছেলে সেই সব মৃত্যুর বেদনাদায়ক স্মৃতি বহন করে কালাতিপাত করছে।গিরগিটি গল্পের কথা বলা যেতে পারে। বৃদ্ধের ছিল সৌন্দর্যপ্রিয়তা। সে দেখত রূপ। আর তার চোখের ভিতর দিয়ে মায়া দেখত নিজেকে। বৃদ্ধ যে তাকে দ্যাখে তা কি মায়া জানত না? গাছের পাতা, শালিখ, ফড়িংও তাকে দ্যাখে সেই কুয়োতলায় স্নানের সময়। বৃদ্ধের দেখা সেই রকম। নদী ও নারী, বনের রাজা, মঙ্গল গ্রহ, সমুদ্র, সামনে চামেলি, তারিনীর বাড়ি বদল, চোর, খালপোল ও টিনের ঘরের চিত্রকর, রাইচরণের বাবরি… কত গল্পের কথা বলব। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী আমাদের সাহিত্যে ছোট গল্পের এক বিরল শিল্পী।
‘পাঠকদের সমাদর বেশি পাননি বলে মনে মনে হতাশা ছিল কিনা বলতে পারব না। স্বভাবটা ছিল ভীষণ চাপা। এতদিন পাশে-পাশে থেকেও হতাশা-টতাশা কিছুই বুঝি নি। কেউ হয়ত বাড়ি এসেছেন কথায় কথায় তাঁকে বললেন, অ্যা—আমার বই টই বিক্রিই হয় না, আমি আর কি লিখব! তবু ভিতরে একটা আগুন ছিল নিশ্চয়ই, নইলে সারাজীবন এত লিখলেন কি করে?’ মৃত্যুর আগে নিজের স্বামীর সম্পর্কে এমনটাই লিখে গিয়েছিলেন পারুল দেবী। আগুন, সেই সঙ্গে চূড়ান্ত নিরাসক্তি। সাফল্য এবং ব্যর্থতা, উভয়ের প্রতিই নিরাসক্তি। হয়তো এই নিরাসক্তিই ছিল তাঁর চালিকাশক্তি। বর্তমানে যেখানে যে কোনও সৃষ্টিই যেমন ‘ফিফটিন মিনিটস অব ফেম’-এর আলোকবৃত্তে নিয়ে আসতে পারে কাউকে বা অশালীন আক্রমণ শুরু হয়ে যেতে পারে ওই সৃষ্টি ঘিরে— সেখানে জ্যোতিরিন্দ্র বহু কাল আগে যে কথাগুলো বলে গিয়েছিলেন, তা এখনও ভীষণ ভাবে সমসাময়িক ও প্রাসঙ্গিক। জ্যোতিরিন্দ্র লিখছেন, ‘যুগটা বড় বেশি মুখর। অনেক কাগজ অনেক পাঠক অনেক মতবাদের সামনে আপনাকে অহরহ দাঁড়াতে হচ্ছে। …একই সময়ে নিন্দা প্রশংসার ঝড়ের সামনে আপনাকে দাঁড়াতে হচ্ছে। …শিল্পীর জীবনে এ এক অভিশাপ। আবার পরীক্ষাও। আমি তাই মনে করি। পরীক্ষা হচ্ছে শিল্পী তাঁর নিজের সৃষ্টিক্ষমতার উপরে অকাট্য বিশ্বাস রেখে তাঁর পরবর্তী রচনায় হাত দিচ্ছেন কিনা। …প্রত্যয়ের হাত শক্ত করে ধরে হাজার রকম মতামতের ঢেউয়ের উপর দিয়ে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া শিল্পীর আর কিছু করার আছে বলে আমি অন্তত মনে করি না।’
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী বাংলার নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত নরনারীর জীবন চিত্র অঙ্কন করছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে তার জন্য বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে অমর হয়ে থাকবেন।
সূত্র: আমার সাহিত্যজীবন, আমার উপন্যাস: জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী;আমার স্বামী জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী: পারুল নন্দী