বেঁটে-খাটো, শীর্ণকায় যুগলের কাছে লোকাল ট্রেনে পাঁচ টাকায় একটা সুগন্ধী ধূপকাঠির প্যাকেট নিয়ে ছিলাম গত কয়েক মাস আগে।পোড়ালে তীব্র ধোঁয়া আর মিষ্টি গন্ধ ছাড়ে।তারপর থেকে আমি হয়ে উঠেছিলাম ওর সারা মাসের খদ্দের। আমার সহকর্মীদের কাছে সে ধূপ কাঠির সুখ্যাতি করায় বাড়তি কিছু খদ্দেরও জুটে গিয়েছিল যুগলের। ওই সুবাদে ওকে চিনতাম। কিন্তু ,আজ আর যুগল ধূপ কাঠি বেচে না ।দু-পয়সা হাতে পেয়ে ব্যবসা বদল করেছে বোধহয়। হয়তো কষ্টের জীবন পেরিয়ে এখন সুখেই আছে !
হটাৎ অনেকদিন পর, নদীঘাটে নৌকা পাড়া পাড়ের সময় ওর সাথে দেখা হলে জিজ্ঞাসা করলাম – “আরে যুগল যে ! কেমন আছো? কি করছ এখন? ট্রেনে দেখি না যে আর!”
শরীরে ওর বাহারি পোশাক তবে আদব কায়দা কিছুই বদলায়নি ।হাল ফ্যাশনের চশমা চোখ থেকে নামিয়ে ,জোর হাত করে ও বলল -“ও কাজ আমি ছেড়ে দিয়েছি বাবু। ওতে ঘর চলতো না। এখন বলতে পারেন সুখেই আছি !”
–“কোনো লটারি মিলেছে নাকি হে ? হঠাৎ এতো সাজগোজ !” -জানতে চাইলাম আমি।
–“তেমনি কিছু একটা বলতে পারেন”–শুকনো মুখে উত্তর দিল যুগল।
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, একটা গভীর ক্ষত ও প্রাণপনে লোকাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আচমকা দিন বদলের ইতিহাসটা, কৌতুহল বশত জোর করেই জানতে চাইলাম বারংবার ।খানিক বাদে আধুনিকী খোলস ছেড়ে আসল যুগল বেড়িয়ে এলো।হাঁটু মুড়ে বসে,চোখের জল খসিয়ে ,ও ওর দেহাতি গ্রামবাসীদের মতো যা শুনিয়েছে তাতে পাথর বনে গিয়েছি এক নিমেষে ।
যুগলের কিশোরী মেয়েটা হঠাৎ নিখোঁজ । সারাটা দিন চরকীর ন্যায় ঘুরেও কোনো হদিশ পাওয়া যায়নি। শেষে মিলেছিল ধানের খেতের পাশে ,রক্তাক্ত-জীবিত-ধর্ষিত অবস্থায় ।পুলিশকর্তারা ছুটে এসে ন্যায় বিচার দিতে চেয়েছিলো । কিন্তু নেয়া হয়নি যুগলের ! গরিবদের কী বা এমন মান ইজ্জত !
দু হাতে মুখ ঢেকে চোখের নোনা জল খসিয়ে , বুকের পাঁজর কেটে ,যুগল সেদিন আরো যা বলে ছিল ,তা হলো —
সেদিনই অনেক রাতে বড় বাড়ির বড় কর্তা মোটা টাকা যুগলের হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল –“এটা রাখ যুগল, বাকি সব ভুলে যা। মেয়ের ভালো ঘরে বিয়ে দিস,কী আইনী পথে যাস ! ওতে বরং বিপদ বাড়বে তোর ! আর শোন ধূপ কাঠি বেচা ছাড়! নে আরো কটা টাকা রাখ ,বড় ব্যবসা করিস তুই ! যে কটা দিন আছিস একটু বড়লোকি চালে চল দেখেনি! এখন যা, গ্রামে গিয়ে মুখ খুলিস না আবার । মেয়ে তো তোর বেঁচেই রয়েছে নাকি ! সুখি হো।”
তাই আর ধূপ কাঠি বেচে না যুগল।
কলমে আশিস চক্রবর্তী, সুকান্ত পল্লি, মুর্শিদাবাদ
বর্তমানে একটি স্কুলে পার্শ্ব শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। ছেলে বেলা থেকেই লেখালিখি শুরু। দীর্ঘ সাত বছর নিজের একটি প্রিন্টেড পত্রিকার সম্পাদনা করেছি। বর্তমানে গল্প ,কবিতা , উপন্যাস ,নাটক , প্রবন্ধ , অনুগল্প প্রভৃতি কানাডা , অস্ট্রেলিয়া , বাংলাদেশ এবং ভারত থেকে নিয়মিত প্রকাশ হয়ে চলেছে -অনলাইন ও প্রিন্টেড আকারে।