দোলপূর্ণিমা বা হোলি উৎসবের রংগুলির স্পন্দন এমন কিছু যা আমাদের জীবনে অনেক ইতিবাচকতা নিয়ে আসে এবং হোলি রঙের উৎসব আসলেই আনন্দের একটি দিন। হোলি একটি বিখ্যাত হিন্দু উৎসব যা ভারতের প্রতিটি অংশে অত্যন্ত আনন্দ ও উৎসাহ নিয়ে উদযাপন করা হয়। এই অনুষ্ঠানটি হোলির বা দোলপূর্ণিমার দিন থেকে একদিন আগে ধীরে ধীরে আলোড়ন শুরু করে এবং এই প্রক্রিয়াটি খারাপের উপর ভাল বিজয়কে প্রতীক করে। হোলি দিনে মানুষ তাদের বন্ধুদের এবং পরিবারের সাথে রং খেলে এবং সন্ধ্যায় তারা আবীরের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠদের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে।
হোলি এবং দোলযাত্রা , এই উৎসবটি একসাথে পর পর দুদিন সারা ভারতবর্ষে উৎযাপন করা হলেও দুটি উৎসবের আলাদা মাহাত্ম। হোলি সাধারনত সারা ভারতবর্ষে ও নেপালে খেলা হয় আর তার ঠিক একদিন আগে শুধুমাত্র ওয়েস্ট বেঙ্গল (মানে বাঙ্গালি ), আসাম ও ওড়িশা এ হয় দোলযাত্রা বা দোল পূর্ণিমা উৎসব। দুটো উৎসব পালন করার যেমন কিছু মিল আমরা খুঁজে পায় , ঠিক তেমনই খুঁজে পায় কিছু তফাৎ।
প্রথমেই দেখে নি , দুটি উৎসব পালনের তফাৎ কোথায় ?তফাৎ বলতে গেলে এর ইতিহাসের ও উৎযাপনের ।
দোলযাত্রার ইতিহাস
দোলযাত্রাকে মনে করা হয় এটি রাধা এবং কৃষ্ণের দিন , এই দিন কৃষ্ণ তার রাধার প্রতি ভালোবাসা নিবেদন করেন। এই দিনটি শ্রী কৃষ্ণের জন্য উৎসর্গীকৃত। এটি বাঙালি ক্যালেন্ডার এর শেষ উৎসব ও। দোলযাত্রার সময় সাধারণত পূর্ণিমার দিন দেখেই নির্ধারিত হয় বলে এটি দোলপূর্ণিমা বলেও জানা যায়। এই দিন বাঙালির ঘরে ঘরে চলে লক্ষ্মী ও নারায়ণ পুজো অৰ্থাৎ রাধা কৃষ্ণ এর পুজো ।এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় , শ্রী ক্রিসের পালকি সাজিয়ে চলে পথযাত্রা , ফুল আর আবিরের দোল খেলা। সাথে থাকে শ্রী কৃষ্ণের গান ও পালা । এটিকে বাঙালিদের মধ্যে “বসন্ত উৎসব” ও বলা হয়ে থাকে।বসন্ত উৎসব টি নোবেল বিজয়ী কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার শান্তিনিকেতনে শুরু করেছিলেন , যেখানে আজ একই উৎসাহে এই উৎসব পালন করা হয়। বোলপুর , শান্তিনিকেতন , আজ বিখ্যাত তার বসন্ত উৎসবের জন্য। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসেন ঠিক এই সময় এ শান্তিনিকেতন এ দোলউৎসব বা বসন্ত উৎসব মানাতে।
দোল পূর্ণিমা বাঙালিদের জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ , কারণ এটিই চৈতন্য মহাপ্রভু (1485-1533) এর জন্মদিন। তিনি ছিলেন মহান বৈষ্ণব সন্ন্যাসী । তিনি রাধা ও কৃষ্ণের আবেগকে -প্রেম কে উচ্চ আধ্যাত্মিক করে তুলেছিলেন।
দোলযাত্রা উৎযাপন
দেউলের বা দোলের প্রথম দিন গোন্ধু নামে পরিচিত। বলা হয় ,সন্ধ্যায়, ভগবান কৃষ্ণ , ভগবান বিষ্ণুর অবতার ,কৃষ্ণের স্ত্রী ঘুনুচের স্থান এর উদ্দেশে রওনা দেন। তাই তাঁর অনুগামীরা কীর্তন -ঘরের সামনে একটি অগ্ন্যুত্সব এর আয়োজন করেন (যাকে আমরা ন্যাড়াপোড়া বলে জানি ) এবং বৈষ্ণবীরা ঢোল,করতাল বাজিয়ে কীর্তন করেন। হরিবোল রবে চারিদিক মেতে ওঠে। সাধারণ মানুষরা ওই দিন ন্যাড়াপোড়া ও হরির লুটের আয়োজন করেন এবং ভাবেন ওই ন্যাড়াপোড়ার মধ্য দিনে সকাল অশুভ শক্তিকে তারা শেষ করে দিচ্ছেন।
দেউলের দ্বিতীয় দিন ভোর-দেউল নামে পরিচিত – যার প্রধান অর্থ দোল । ভোর দেউল চৈত্রমাসে একদিনের জন্য এবং ফাল্গুন মাসে তিনদিনের জন্য পালিত হয়।
দোল উৎসবের শেষ ও চতুর্থ দিনটি সুরি নামে পরিচিত। সেই দিন, ভগবান কৃষ্ণ ঘুনুচের ঘর থেকে মা লক্ষ্মীর ঘরে ফিরে যান।কৃষ্ণের অনুগামীরা তাকে বা তার মূর্তিকে ওই দিন একটি পালকি বা দোলা করে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। বৈষ্ণবেরা খোল করতাল বাজিয়ে কীর্তন করেন , আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে দেন বিভিন্ন রঙের আবির। বলা হয় , যখন কৃষ্ণকে নিয়ে অনুগামীদের মিছিল মা লক্ষ্মীর দুয়ারে পৌঁছায় , মা লক্ষ্মী বাঁশ নিয়ে গেট রুখে দাঁড়ান , কারণ তিনি স্বামী , কৃষ্ণের ওপর রাগান্বিত হয়েছিলেন, কারণ তিনি এই দিনগুলোতে ঘুনুছের স্থানে অবস্থান করেছিলেন।কিন্তু মা লক্ষীর শত চেষ্টা ব্যর্থ করে , শ্রী কৃষ্ণ ভেতরে প্রবেশ করেন এবং কীর্তন ঘরের সাত বার পরিক্রমণ করেন। এরপর সাথে আনা মনি মুক্ত সম্পদ দিয়ে মা লক্ষীর মান ভাঙান। এই দি শেষ হয় দেউল বা দোল উৎসব।
সময়কাল: সাধারণত, দোল উৎসব সমাজের ঐতিহ্যের উপর নির্ভর করে এক বা দুই দিনের জন্য চলতে থাকে। কিন্তু মথুরা ও বৃন্দাবন এ , দোল উৎসবটি ১৬ দিনের জন্য পালন করা হয়, কারণ এই দুই স্থানের সাথে কৃষ্ণের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।
হোলি উৎসবের ইতিহাস :
————————
হোলি ভারতের সবচেয়ে শ্রদ্ধাশীল ও উদযাপিত উৎসব হিসেবে বিবেচিত এবং এটি দেশের প্রায় প্রতিটি অংশে পালিত হয়। এটি কখনও কখনও “প্রেমের উৎসব ” হিসাবেও পরিচিত হয়, যেমনটি এই দিনে লোকেরা একে অপরের দিকে সমস্ত ক্ষোভ এবং সমস্ত ধরনের খারাপ অনুভূতি ভুলে একত্রিত হয়। মহান ভারতীয় উৎসব একটি দিন ও রাতের জন্য স্থায়ী হয়, যা ফাল্গুন মাসে পূর্ণিমা বা পূর্ণ চাঁদ দিবসে শুরু হয়। উৎসবের প্রথম সন্ধ্যায় হোলিকা দহান বা চটি হলি নামে এটি উদযাপন করা হয় এবং পরবর্তী দিনটিকে হলি বলা হয়। দেশের বিভিন্ন অংশে এটি বিভিন্ন নামে পরিচিত।
হোলি উৎসবের আগের দিন সন্ধ্যেতে শুরু হয় হোলিকা দহন। যেখানে মানুষ একত্রিত হয়ে অগ্নিকুণ্ড-র চারিপাশে পূজা করে ও প্রার্থনা করেন নিজের ভেতরের অশুভ শক্তি থেকে মুক্তির জন্য, ঠিক যে ভাবে ,হোলিকা , হিরণ্যকিশিপুর বোন,অগ্নিকুন্ডে নিজের জীবন ত্যাগ করেন। তার নাম অনুসারে , এই অনুষ্ঠানের বা আয়োজনের নাম “হোলিকা দহন ” .হিন্দু ধর্ম অনুসারে , হোলি উৎসব হোলিকা নামক এক অশুভ শক্তিকে বিনাশের এক উৎসব , যেখানে ভগবান বিষ্ণু , প্রল্হাদ কে বাঁচাতে হোলিকাকে বধ করেন। এই উৎসবের মধ্যে দিয়ে শুভ শক্তির জয় ও অশুভ শক্তির হার , মনে করা হয়। তাই ভক্তরা অগ্নিকুন্ডের এক একটি কাঠ প্রদান করেন , প্রসাদ বিতরণ হয় ও হোলিকা দহন এর পর নাচ-গানের অনুষ্ঠানও হয়।
কথিত আছে , হোলিকা কে ব্রম্ভা এক বর প্রদান করেন , যা সে কখনো কারোর ক্ষতি না করে ব্যবহার করতে পারে ,সেটি ছিল , সে আগুনের মধ্যে গেলেও তার কোনো ক্ষতি হবে না। হিরণ্যকশাইপ বলে এক রাজা তাঁর রাজ্যে কেবল তাঁরই উপাসনা চেয়েছিলেন, কিন্তু তার পুত্র প্রল্হাদ, ভগবান বিষ্ণু অর্থাৎ নারায়ণনের ভক্ত ছিলেন। সেই কারণে তিনি নিজের পুত্রকে অনেক বার মেরে ফেলার চেষ্টা করেও সফল হননি। তখন তিনি নিজের বোন হোলিকা কে আদেশ দেন প্রল্হাদ কে নিয়ে আগুনে প্রবেশ করতে। হোলিকা ভেবেছিলো , তার বর আছে যেহেতু তার কোনো ক্ষতি হবে না , কিন্তু সে এ জানতো না , তার এই বর শুধু মাত্র তখনি কাজ করবে যখন সে এক আগুনে প্রবেশ করবে। তার কাছে ব্রম্ভা প্রদত্ত একটি শাল ছিল, যেটা পরিধান করলে তাকে কোনো কিছুই ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু ,আগুনে প্রবেশের সাথে সাথেই প্রল্হাদ, ভগবান বিষ্ণুর প্রার্থনা শুরু করেন , এবং ভগবান বিষ্ণু প্রল্হাদকে বাঁচিয়ে নেন এবং হোলিকা আগুনে ভস্ম হয়ে যান।
হোলি উৎসব উদযাপন :
হোলি হিন্দু ধর্মে এক মাহাত্মপূর্ণ উৎসব , যে উৎসব কে শ্রী কৃষ্ণর মহিমা ও বলা হয়ে থাকে। যা ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে উদ্ভূত, প্রধানত ভারত ও নেপালের মধ্যে উদযাপন করা হয়, তবে এটি এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে এবং পশ্চিম বিশ্বের বিভিন্ন অংশেও আজ ছড়িয়ে পড়েছে ।এটিকে প্রেমের উৎসব বা রঙের উৎসব ও বলা হয়ে থাকে। এই দিন সবাই সব দুঃখ বলে , ক্লেশ ভুলে , রঙের খেলায় মেতে ওঠেন। মানুষেরা নিজের বন্ধু -আত্মীয় দেড় বাড়িতে যান , আনন্দে মেতে ওঠেন। তারপর হোলি খাবার, কিছু প্রথাগত পানীয় পান করেন ।
এই উৎসব অনেক উদাসীন হৃদয় এবং অনেক করুন মুখে হাসি আনে । হোলি উৎসব দ্বারা মানবতা ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছে। লোকেরা নিজের পছন্দের রং দিয়ে অন্যদের রঙ করে হোলি উদযাপন করে এবং এভাবে তারা তাদের অন্তরের পার্থক্যগুলি সরাতে এবং একে অপরকে আরও কাছাকাছি আনে ।
এভাবেই প্রতিবছর ফিরে আসুক আপনার-আমার-সবার জীবনে রঙের উৎসব। রঙ্গিন হয়ে উঠুক সবার জীবন।
বেশ সুন্দর লিখেছেন মৌসুমি দিদিভাই এবং এর থেকে অনেক কিছু জানতেও পারলাম ধন্যবাদ আপনাকে।
apner websiter 2 1 ta post chara sokol post amar kache valo labe