মানুষ স্বপ্ন দেখবে এটাই স্বাভাবিক, স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্ন দেখবে এটাও অসম্ভব কিছু না। বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে স্বপ্ন সবসময় সুখকর অনুভূতি দেয় না আবার সবসময় খারাপ অনুভূতি দেয় তাও সত্য না, মোটামুটি একটা ভারসাম্য মেনে চলে। মাথায় যদি প্রচন্ড উঁকুন থাকে তবে ঘুমানোর আশিভাগ আনন্দই মাটি, স্বপ্ন দেখার কথা নাই বললাম।
পাঠক এবার প্রশ্ন করতে পারেন, “উঁকুন মারার ব্যবস্থা করে, ঘুমালেই হয়”? আমি উত্তরে বলবো “এই সঙ্গতি সবার থাকে না, অন্তত আমার গল্পের নবাব সিরাজউদ্দৌলার নাই”। নবাব সিরাজউদ্দৌলার নাম শুনে পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন – সিরাজউদ্দৌলা নাম হতে পারে, সিরাজ হতে পারে কিংবা শুধু নবাব। নবাব সিরাজউদ্দৌলা – এ আবার কেমন নাম।
আমার জানা মতে- নবাব সিরাজউদ্দৌলা তার বাবা-মার দেওয়া, আকিকা করা নাম নয়। এই নামের একটা সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আছে, ইতিহাস হলো- গাঁজা খাওয়ার সময় সে একবসায় তিন পুরিয়া গাঁজা খেতে পারে কিন্তু যার ঘর সংসারই মিরপুর আনসার ক্যাম্প সংলগ্ন ময়লার ভাগার তার কাছে তিন পুরিয়া গাঁজা বিলাসিতাই বলা যায়। নামটি যিনি দিয়েছেন তিনি মোটামুটি একজন রসিক মানুষই বটে, তার দেওয়া নামই তার রসিকতার সাক্ষী।
আমার একটা ছোট্ট ভুল হয়ে গেছে যে, আশা করছি পাঠক নিজ গুণে তা ক্ষমা করবেন। নবাব সাহেবের উঁকুন মাথায় ঘুমানোর একটা নিজস্ব ব্যাবস্থা আছে যা বলতে ভুলে গেছি, ব্যাবস্থাটি হলো- গাঁজা।
অধিকাংশ সময়েই নবাবের ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটে। ইদানিং কোনটা ঘুমের ভিতরের স্বপ্ন আর কোনটা বাস্তবতা, সে পার্থক্য করতে পারছে না, কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে গাঁজার প্রভাব কিংবা অত্যাধিক অনাহার – নির্জলা উপবাস।
নবাবের স্থায়ী নিবাস যদিও ময়লার ভাগাড়ের পাশে থাকা ময়লার ভ্যানের ছাউনি তবে সে একজন আত্ম নির্ভরশীল ব্যাক্তি। মূলত ময়লার মধ্যে থাকা বিভিন্ন প্লাস্টিকের সামগ্রী তার আয়ের প্রধান উৎস। তবে আয় কিন্তু মোটেই খারাপ না,এই কাজে সম্মান নাই এই যা। প্রতিদিন ভাগাড়ে প্রচুর ময়লার আমদানি হয়, তবে সবসময় ময়লা আসে না। ময়লার আসার যদিও নির্দিষ্ট সময় নাই তবে সকাল দশটার আগে আবার দুপুর তিনটার পর কোন ময়লা আসে না। তবে এই নিয়মের দুটো ব্যতিক্রম আছে, এক কুরবানীর সময় যখন তখন ময়লা আসে
দ্বিতীয়টি হলো ময়লা সংগ্রহকারী আব্বাস- যে রাতে আব্বাসের সাথে আব্বাসের বউয়ের ঝগড়া হয় সেদিন ফজরের পরেই সে ময়লার জন্য বের হয় এবং দশটার আগেই ভাগাড়ে চলে আসে।
ঝগড়ার দিনগুলোতে নবাবের কাজ শুরু হয় সকাল সকাল, শেষ হতে হতে প্রায় মাগরিবের আযান। যদিও আজকের দিন তাড়াতাড়ি শুরুর কারন আব্বাস নয়।
সকাল থেকেই বৃষ্টি পড়ছে। অঝোরে বৃষ্টি, এ যেন প্রকৃতির কান্না।
মাঝে মাঝে প্রকৃতিও হাঁপিয়ে উঠে, বৃষ্টিই যেন প্রকৃতির দুঃখ প্রকাশের নিজস্ব ব্যাবস্থা, আর মেঘগুলো যেন দুঃখ প্রকাশের চোখ। বৃষ্টি পড়াতে নবাবের ছোট্ট একটি উপকার হয়ছে- পানি আনতে কষ্ট করে ওয়াসার পানির কল পর্যন্ত যেতে হবে না, ভাগাড়ের ছাউনির-বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করলেই হবে।কাঁচ দিয়ে পা কাটায় বর্তমানে তার চলাফেরা বেশ সীমিত হয়ে গেছে।
ভাগাড়ের ছাউনি বেশ ভালোই উপকারী, মুষল বৃষ্টিতেও ভেজার কোন সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু পানির বোতলটার দিকে তাকিয়েই তার পানি সংগ্রহের রুচি চলে গেলো, সে বিড়বিড় করে বললো এ যেন আমার মনেরই প্রতিচ্ছবি।
বৃষ্টি থামার কোন নামই নেই, দুপুর গড়িয়ে বৃষ্টি যতো বাড়তে লাগলো তার স্মৃতির খাতা ততোটাই বাস্তব হয়ে উঠতে লাগলো। মেয়ের মৃত্যু, স্ত্রীর কাছে নিজের মনের নগ্নতা প্রকাশিত হওয়া, নিজের কাছেই নিজেকে অসহ্য লাগা, গৃহ ত্যাগ সব স্মৃতিগুলো যেন বাস্তব, বাস্তবের চেয়েও অতি বাস্তব।
-না, না, এ আমি কী করছি? আমি তো সবকিছু ভুলতে চাই।
-ভুলতে চাইলেই কী ভোলা যায়, মীর কাসেম?
-কে মীর কাসেম? আমি তো নবাব সিরাজউদ্দৌলা।
-হা হা হা, তুমি নিজের কাছে থেকে নিজেকে লুকাচ্ছো, আমি তোমাকে সতর্ক করেছিলাম এই দিনটার জন্যই, তুমি শুনতে চাও নাই আমার কথা। তুমি তোমার মেয়ের হত্যাকারী!!
-না, আমি না, আমি কখনোই না। আল্লাহর আমানত আল্লাহ নিয়ে গেছে, আমার কী করার আছে?
-হা হা হা, বিশ লক্ষ টাকা সংগ্রহের পরেও তুমি বলবা আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে?
-তুমি কে? তুমি এসব জানো কীভাবে?
-আমি সব জানি, মীর কাসেম। আমি যে তোমার বিবেক।
-আমি তোমারে চিনি না, বড়লোকদের বিবেক থাকতে নাই।
-সৃষ্টিকর্তার কাছে যদি মানুষের কিছু চাওয়ার থাকতো তবে সে তার প্রিয়জনদেরই চাইতো।
-কিন্তু আমার প্রিয়জন যে আমি নিজেই। মেয়ের লিউকেমিয়া হওয়ার পর পাগল প্রায় হয়ে গেলাম। টাকা কই পাবো, চিকিৎসা কীভাবে করবো? সচিবালয়ের সামান্য পিওন আমি, টাকা কই পাবো। সহকারী সচিব আব্দুল্লাহ স্যার বুদ্ধি দিলো বিভিন্ন এনজিও, সরকারি-বেসরকারি অফিসে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চিঠি দিতে, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে। স্যার এর পরামর্শ কাজে দিলো, সাড়াও পেলাম প্রচুর। বিশ লক্ষ টাকা সংগ্রহ মাত্র পঁচিশ দিনে। আমার তখন লোভ পেয়ে বসলো, টাকা চাই, আরো টাকা চাই। এর পরের স্মৃতি মনে করতে চাই না, চাই না আমি।
বৃষ্টির বর্ষণ আর নবাবের চোখের বর্ষণে বিশেষ কোন পার্থক্য রইলো না, এ যেন মিলেমিশে একাকার
-শোন হে বিবেক, “তুমি কী জন্য এসেছো আমি জানি? তবে জেনে রাখো আমার গৃহত্যাগী চাঁদ উঠে গিয়েছিল তাই আজ আমি সমাজচ্যুত, পরিবারচ্যুত।
-হা হা হা, আমার তো মনে হয় তুমি আত্মচ্যুত।
রাতের দিকে বৃষ্টি কমে এলো, বৃষ্টির পরে আকাশে হালকা মেঘের ছুটাছুটি, দেখার মতোই দৃশ্য।, সাথে থালার মতো চাঁদ। এ যেন কান্নার পর নিজেকে হালকা হিসেবে আবিষ্কার করা। নবাব চিন্তা করে- আসলে দুঃখ বলে এই পৃথিবীতে কিছু আছে নাকি? মনে মনে চিন্তা করে সবকিছুই কর্মফলের ঘোর। আত্ম মগ্নতা ভাঙলো গভীর রাতে ছায়ামূর্তি দেখে। গভীর রাতে কেউ একজন ভাগাড়ের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে কিন্তু রাস্তার পাশে থাকা হলুদ ল্যাম্পপোস্টের ক্ষিণ আলোতে মুখ স্পষ্ট নয়। সাধারণত ভাগাড়ের পাশে দিয়ে রাতের বেলা কেউ একটা আসে না, পথচারীরা রাস্তা পার হয়ে ভাগাড়ের বিপরীত পাশের ফুটপাথ দিয়ে চলাচল করে। ভাগাড়ের পাশ দিয়ে চলাচলের ক্ষেত্রে ভাগাড়ের উৎকট গন্ধ যত না দায়ি তার চেয়ে বেশি দায়ি রাতের নিরাপত্তা।
এই ছায়ামূর্তি নিরাপত্তার প্রশ্ন উপেক্ষা করেই ভাগাড়ের সামনে চলে এসেছে। ছায়ামূর্তি দুইবার ডানে বামে তাকালো, পিছনে তাকিয়ে লাভ নেই কারণ পিছনে সারারাতই গাড়ি চলে তাই পিছনে না তাকিয়েই অতি সন্তর্পণে একটি চটের ব্যাগ রাখলো।ঝড়ের বেগে ছায়ামূর্তি হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো, যেন বুকের ভিতরের পাথর হালকা হওয়ার আনন্দই তার মিলিয়ে যাওয়ার প্রধান নিয়ামক।
নবাবের মন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়লো, একি বাস্তব নাকি গাঁজার প্রভাব। তার কাছে মনে হলো এতো রাতে কে আসবে? আমার চোখের ভুল, আমি তাহলে সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছি।
পরক্ষণেই তার অবচেতন মন বললো- সে তো সারাদিন গাঁজা খায় নি। মনে মনে আনন্দ অনুভব করলো যাক আমার অনুধাবন ক্ষমতা এখনো ভালোই আছে কিন্তু আবার মনটা খারাপ হয়ে গেলো আমি তো পাগল হচ্ছি না।
ধুর হালার মন- তরে যদি পেতাম, আমি যাবোই, দেখবো ছায়ামূর্তি কী রেখে গেলো?
ব্যাগের কাছে এসে দেখলো ব্যাগটি মোটামুটি বড়সড়ই, ওজনও যথেষ্টই। আগ্রহ নিয়ে ব্যাগটি যেই না খুললো- নিষ্পাপ চোখের বিস্ময় দৃষ্টি তাকে বিদ্ধ করলো, চোখে কেবলই বিস্ময়, দুজনের চোখেই বিস্ময়। কিছুক্ষণ পরেই নিষ্পাপ চোখের বিস্ময় অভিযোগে রূপান্তরিত হলো। এই পৃথিবীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, সত্যকে লুকিয়ে রাখার অভিযোগ। নিষ্পাপ লোকের সাথে কথা বলতে হয় আদবের সাথে এটা তার নিজস্ব দর্শন। কিন্তু কীভাবে শুরু করবে তাই খুঁজে পেলো না। অবশেষে বলেই ফেললো,
- হে নিষ্পাপ, ওই দেখো কত সুন্দর চাঁদ, তোমার অভিযোগ কী ঐ চাঁদের সৌন্দর্য থেকেও ভারী?
-নিষ্পাপ চোখের উত্তর হয়তো – হ্যাঁ, তার চেয়েও ভারী। - তাইলে তোমার অভিযোগের কাছে আমার কিছু বলার নাই। না, না আছে। যে আর্তনাদ ঠোঁটে এলো না তা বুক ফাটিয়ে দেয়
যে জলবিন্দু মাটিতে পৌঁছালো না তা মাটি শুষে নেয়। - তোমার নাম দিলাম সিদ্ধর্থ, মহামতি সিদ্ধর্থ। তোমার গৃহত্যাগী চাঁদ আজকে উঠে গেছে।
কবিতার চরণ: মির্জা গালিবের কবিতার বাংলা ভাবানুবাদ..
কলমে সাব্বির আহম্মেদ , ঢাকা, বাংলাদেশ