ছোটগল্প পাহাড়ী নদীর মতো। বাঁকে বাঁকে তার নতুন অজানা রোমাঞ্চ। পাথুরে দেওয়ালের শত প্রচেষ্টা তার খরধারা রোধ করতে ব্যর্থ। সে শুনতে পা নিজগর্ভে প্রস্তরখণ্ডের ঠোকাঠুকি আওয়াজ। যে প্রস্তর ধূলি একটি ভূমির জন্ম দেয় কালস্রোতে। যে ভূমির প্রতিটি ধূলিকণায় লেগে থাকে তার বুকের সকল ঐক্যতানের ধ্বনি।

বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের উপক্রমণিকা তাঁরই হাত ধরে। বিশেষ কিছু নিয়মাবলী ও পরিচর্যার মাধ্যমে ছোটগল্প নামক বিশেষ ছায়া প্রদানকারী বৃক্ষটির যে বীজ আপন শৈল্পিক হস্তে রোপণ করে দিয়েছিলেন সেই সময়, তা আজ সম্পূর্ণ মহীরূহে রূপান্তরিত হয়েছে। এবং সেটির পরিবেশগত রূপান্তরও ঘটেছে। যার ছত্রছায়ায় আজ আমরা জীবন ও দর্শনের শিল্পরূপ দর্শন করি। একমাত্র চেতনাধারী প্রাণ হিসাবে বেঁচে থাকার আনন্দ উপভোগ করি। নেপথ্যে থাকা সেই মহামানবটি হলো রবীন্দ্রনাথ। তার অভূতপূর্ব সৃষ্টি আমাদের সমগ্র সত্তা ও মননে চির আনন্দের আকর হয়ে থেকে গেছে। একবারও মনে হয় না, এ লেখা শতবর্ষ অধিক পুরনো! শতবার পাঠেও হয়না মলিন! এক অদৃশ্য ক্ষমতা পাঠককে গল্পের অন্তিম লগ্নের দিকে পরিচালিত করে। যে অক্ষরমালা জ্যোতিপুঞ্জের ন্যায় ভাস্বর! প্রত্যেকবার পাঠে সেই গল্পকারের অতলান্তিক গভীরতাকে নতুন ভাবে উপলব্ধি করা যায়।

ছোটগল্পের শিল্পরীতি তিনি নির্ধারণ করেছিলেন আপন কাব্যছলে, ‘সোনারতরী’র ‘বর্ষাযাপন’ কবিতায়-

“ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা ছোটো ছোটো দুঃখকথা

নিতান্তই সহজ সরল,

সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি

তারি দুচারিটি অশ্রুজল।

নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা,

নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ

অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মন হবে

শেষ হয়ে হইল না শেষ।

জগতের শত শত অসমাপ্ত কথা যত,”

রবীন্দ্র ছোটগল্পে এই শিল্প রীতির সম্পূর্ণ অনুকরণ পরিলক্ষিত হয়। এই রীতি তাঁর নিজস্ব। এক অসাধারণ শিল্প ভাবনার পরিচয়বাহী। তাঁর ছোটগল্পে তৎকালীন সমাজের, বিশেষত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের জীবন প্রণালী, সামাজিকতা, আচার-ব্যবহার, ভাষা প্রযোগ, শিক্ষা, সামাজিক প্রথার বেড়াজাল, নারীজন্ম তথা নারীজীবনের সীমাবদ্ধতা, মানবিকতার অবক্ষয়, উচ্চবিত্তের চারিত্রিক দীনতা, সম্পদ ও প্রাচুর্যের লোলুপতা, শ্রেণী বৈষম্য প্রভৃতি বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। এর পাশাপাশি তাঁর প্রকৃতি প্রেম, সৌন্দর্য প্রীতি, প্রকৃতির শাশ্বত সত্যরূপের জয়গান শুনতে পাই। দেখতে পাই ব্যথাতুর পিতৃহৃদয়ের আবেগঘন অশ্রুবাষ্প। দেখতে পাই ক’য়েক মুহূর্তের ব্যবধানে বালিকার নারী হয়ে ওঠার কাহিনী। সেই নারী, কখনো কন্যা, কখনো সেবিকা, কখনো দিদি, কখনো প্রেমিকা, কখনো স্ত্রী, কখনো স্নেহময়ী জননী। এছাড়া পরিলক্ষিত হয় তাঁর অন্তরে বসবাসকারী শিশুসত্তাটির আঁকিবুঁকি। আর তাঁর নিজস্ব রোমাণ্টিকতা।

বর্তমানে ছোটগল্পে এই রবীন্দ্র রীতির প্রচলন সবসময় মানা হয় না। আধুনিক লেখকেরা অবশ্য এই ধারার বহুলাংশে পরিবর্তন এনেছেন। সাহিত্য তো পরিবর্তনশীল। এটাই ধর্ম। সমভূমি প্রবাহে নদীর গতিপথ যুগের সাথে যেমনটি পরিবর্তিত হয়, সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তেমনটি খাটে। তবু রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প হলো সেই প্রথম সূর্যোদয়, যার অপেক্ষায় একটা নতুন দিনের সূচনা হয়। যে অপেক্ষার অবসান হয় না। নতুন আশা জাগে অন্তরে।

ছোটগল্প যখন পাঠককে বৃহত্তর সত্যের সম্মুখীন করিয়ে অস্তগামী সূর্যের মতো দিনের সমাপ্তি ঘটায় তখন সেই অস্তরাগের রক্তিমতা পাঠকের সমগ্র অন্তর জুড়ে বহুক্ষণ থেকে যায়। “শেষ হয়ে হইল না শেষ” এর মাহাত্ম্য পাঠক উপলব্ধি করে। যখন পাঠকের মনে নতুনভাবে গল্পের জন্ম হতে থাকে! অন্তরের অতৃপ্তি পাঠককে বার বার ভাবুক করে তোলে। এক অদৃশ্য প্রশ্নচিহ্ন পাঠককে চিন্তামুক্ত হতে বাধা প্রদান করে। পাঠক মনের ভাবনা ছোটগল্পের সীমাবদ্ধ অক্ষরমালা থেকে তৃপ্তির রস শুষে নেওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে আমরা তাঁর সেই আকর্ষণীয় শিল্পরীতি পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করি। তৎকালীন সমাজের একটি ঐতিহাসিক প্রতিফলক রূপে এই রচনাগুলির সার্থকতা উপলব্ধি করতে পারি।

দর্শন ও রবীন্দ্রনাথ এই শব্দযুগল একই মুদ্রার দুটি তল। এক অতলান্তিক দার্শনিক গভীরতা অনুভব করা যায় তাঁর ব্যক্তিত্বে! মানব জীবনের সকল জটিলতা সুখহীনতা নিরাপত্তাহীনতা ও যাবতীয় অতৃপ্তির মূল কারণ এবং তা থেকে পরিতৃপ্তির উপায় তিনি ব্যক্ত করেছেন ‘গুপ্তধন’ গল্পে। স্বরূপানন্দের মাধ্যমে জীবনের প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করতে শিখিয়েছেন, “তৃষ্ণা দূর করো তাহা হইলেই বিশ্বব্যাপী অক্ষয় সম্পদ আপনি তোমাকে ধরা দিবে।” এই চরম সত্যকে শংকর শেষ অবধি হৃদয়ঙ্গম করতে সমর্থ হয়, “তিনি আমার মনের দাহ জুড়াইয়া দিলেন। তাঁহার প্রসাদে আকাশের আলোক আর ধরণীর শ্যামলতা আমার কাছে রাজ সম্পদ হইয়া উঠিল।” এই আলোক, এই প্রকৃতি, এই ক্রন্দসী বিনা জীবন অস্তিত্বহীন, অসার্থক, অসুন্দর। প্রকৃতি প্রদত্ত চেতনা যদি প্রকৃতির সঙ্গে আন্তঃসম্পর্ক রচনা করে আপন জীবনের সার্থকতা উপলব্ধি করতে পারে তবেই এই একক জীবন একটি মহাজীবনে উত্তরণ ঘটে। আবার ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে পোস্টমাস্টারের মনে এই দার্শনিক ভাবনার উদয় হতে দেখি, “জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কি। পৃথিবীতে কে কাহার।” বিচ্ছেদ জীবনের যে একটি চরমতম সত্য, তা তিনি বুঝিয়েছিলেন। ‘এক রাত্রি’ গল্পে একটি বাস্তব জীবন সত্যের সন্ধান করেছেন তিনি “মনুষ্যসমাজ একটা জটিল ভ্রমের জাল। ঠিক সময়ে ঠিক কাজ করিতে কাহারো মনে পড়ে না, তাহার পরে বেঠিক সময়ে বেঠিক বাসনা লইয়া অস্থির হইয়া মরে।” জীবনের এক গভীর উপলব্ধিজাত এই বাণী। ‘দৃষ্টিদান’ গল্পে এক অসাধারণ দর্শন তত্ত্বের উপহার দিয়েছেন কবি, “মন যখন রাজত্ব করে তখন সে আপনার সুখ আপনি সৃষ্টি করিতে পারে, কিন্তু ধন যখন সুখসঞ্চয়ের ভার নেয়, তখন মনের আর কাজ থাকে না। তখন, আগে যেখানে মনের সুখ ছিল, জিনিসপত্র আসবাব আয়োজন সেই জায়গাটুকু জুড়িয়া বসে। তখন সুখের পরিবর্তে কেবল সামগ্রী পাওয়া যায়।”

এই মহাজগত, বিশ্বপ্রকৃতি, আর সুদূরের জ্যোতিপুঞ্জের প্রতি তিনি যে দুর্নিবার এক আকর্ষণ অনুভব করতেন তা তাঁর লেখনীতেই সমুজ্জ্বল। তিনি ছিলেন সত্য ও সুন্দরের উপাসক। মানব সত্যই ছিলো তাঁর কাছে একমাত্র সত্য। তাঁর মতে, মানব চেতনা বহির্ভূত কোনোকিছুর অস্তিত্ব নেই, অর্থ নেই! আপন চেতনায় যেভাবে তিনি মহাবিশ্ব তথা বিশ্বচরাচরকে প্রত্যক্ষ করতেন তাকেই সত্য জ্ঞান করতেন। আর সত্য সর্বদাই সুন্দর! তিনি ছিলেন সত্য ও সৌন্দর্যের পূজারী! শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সাথে বার্লিনের সাক্ষাতে এই বিষয়ে তাঁর সাথে দীর্ঘ আলোচনা হয়। আলোচনা শেষে আইনস্টাইন কবির মধ্যে এক মহান দার্শনিক ও বিজ্ঞানীকে খুঁজে পেয়েছিলেন। চেতনার বহু রঙে তিনি অসংখ্য জীবন চিত্র এঁকেছেন। বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানব জীবনের সুখ দুঃখকে প্রত্যেকবার একাত্ম করে দেখাতে চেয়েছেন। জীবন আলেখ্যের করুণ পরিণতিতে প্রকৃতিকে সমব্যথী করেছেন বহুবার। যখন, পোস্টমাস্টার রতনকে চিরতরে চলে যাওয়ার কথা অকপটে বলে, একটি নিশ্চুপ থমথমে পরিবেশ রচনা করে তখন, প্রকৃতি যেন রতনের হৃদয়ভাঙা দুঃখে একাত্ম হয়ে ওঠে, “মিটমিট করিয়া প্রদীপ জ্বলিতে লাগিল এবং একস্থানে ঘরের জীর্ণ চাল ভেদ করিয়া একটি মাটির সরার উপর টপ টপ করিয়া বৃষ্টির জল পড়িতে লাগিল।” এই জল পড়া যেন রতনের দুঃখে কাতর প্রকৃতির ক্রন্দনরত রূপ। অনুরূপে ‘ছুটি’ গল্পে ফটিকের মতো প্রাণচঞ্চল কিশোরের অন্তিম মুহূর্ত আগমনের পূর্বে বিরামহীন ভাবে শ্রাবণের ধারা বইতে থাকে। “পরদিন প্রাতঃকালে ফটিককে আর দেখা গেল না। চতুর্দিকে প্রতিবেশীদের ঘরে খোঁজ করিয়া তাহার কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না। সেদিন আবার রাত্রি হইতে মুষলধারে শ্রাবণের বৃষ্টি পড়িতেছে।” আবার, ‘জীবিত ও মৃত’ এ যখন “কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই।” তখনও অবিশ্রান্ত বৃষ্টির মাধ্যমে প্রকৃতিকে সমব্যথী করেছেন তিনি, “সমস্ত রাত্রি বৃষ্টি পড়িতে লাগিল, তাহার পর দিন সকালেও বৃষ্টি পড়িতেছে, মধ্যাহ্নেও বৃষ্টির বিরাম নাই।” আবার, সুখমুহূর্তেও প্রকৃতিকে সামিল করেছেন, “প্রভাতটি অতি সুন্দর হইয়া উদয় হইয়াছে। বর্ষার পরে এই শরতের নূতনধৌত রৌদ্র যেন সোহাগায়-গলানো নির্মল সোনারমতো রঙ ধরিয়াছে।” ‘কাবুলিওয়ালা’য় মিনির বিবাহ মুহূর্ত উপস্থিত হলে মিনির বাবার পিতৃহৃদয়ের অদ্ভুত বেদনামিশ্রিত সুখ অনুভূতিকে তিনি বর্ণনা করছেন, “করুণ ভৈরবী রাগিনীতে আমার আসন্ন বিচ্ছেদব্যথাকে শরতের রৌদ্রের সহিত সমস্ত বিশ্বজগৎময় ব্যাপ্ত করিয়া দিতেছে।” সুভাকে প্রকৃতি নিজের খেয়ালে গড়েছে সেও প্রকৃতির মতো প্রাণদীপ্ত, নির্বাক, প্রকৃতির এক সচেতন অংশবিশেষ। তার ধমনীর স্রোতে অন্তঃসলিলারূপিনী প্রকৃতির টান জন্মগত ভাবে অনুভব করে। রবীন্দ্রনাথ খুব নিপুন হস্তে সুভাকে প্রকৃতির সাথে একাত্ম করেছেন। তাদের মধ্যে এক গভীর আন্তঃসম্পর্কের ভাষা আছে, যে ভাষা কম্পনহীন, তরঙ্গহীন বিস্তার লাভ করে। “পূর্ণিমা-প্রকৃতিও সুভার মতো একাকিনী সুপ্ত জগতের উপর জাগিয়া বসিয়া– যৌবনের রহস্যে পুলকে বিষাদে অসীম নির্জনতার একেবারে শেষ সীমা পর্যন্ত, এমনকি তাহা অতিক্রম করিয়াও থমথম করিতেছে, একটি কথা কহিতে পারিতেছে না। এই নিস্তব্ধ ব্যাকুল প্রকৃতির প্রান্তে একটি নিস্তব্ধ ব্যাকুল বালিকা দাঁড়াইয়া।”

রবীন্দ্রনাথ প্রায় প্রতিটা গল্পেই আপন সৌন্দর্যবোধের ভাষ্যরূপ রেখেছেন। তাঁর বহু গল্পে, বর্ষা প্রকৃতি যেন সদর্পে স্থান করে নিয়েছে। তার ঠিক পরেই শরৎ, বসন্ত, গ্রীষ্ম একে একে জায়গা করে নিয়েছে। তাঁর লেখনী প্রতিটি বসন্তের নবপল্লবের মতো ছায়াঘন। কালের প্রবাহমুক্ত, চির নবীন। যে অক্ষরমালার সমষ্টিগত কল্লোলে হিল্লোল জাগে দেহ মন প্রাণে।

প্রকৃতি ও নারীর রহস্যময়তাকে যেন একসূত্রে গেঁথেছেন ‘মহামায়া’ গল্পে। নারী শক্তির অবমাননায় প্রকৃতি যেন বিদ্রোহিনী হয়ে উঠেছে! মহামায়া প্রকৃতি চাইলে সবকিছু করতে পারে। সে তার মানবী অংশকে দশমীর রাতে নিজরূপে সমাহিত করেছে। “একদিন বর্ষাকালে শুক্লপক্ষ দশমীর রাত্রে প্রথম মেঘ কাটিয়া চাঁদ দেখা দিল। নিস্পন্দ জ্যোৎস্নারাত্রি সুপ্ত পৃথিবীর শিয়রে জাগিয়া বসিয়া রহিল। এই গল্পে ক্লাইম্যাক্স তথা চরম মুহূর্তের দিকে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকেও অনুরূপ ভঙ্গিতে সাজিয়ে তোলেন। “আজ যেন সমস্ত পূর্ব নিয়ম ভাঙিয়া গিয়াছে। আজ বর্ষারাত্রি তাহার মেঘাবরণ খুলিয়া ফেলিয়াছে এবং আজিকার এই নিশীথিনীকে সেকালের সেই মহামায়ার মতো নিস্তব্ধ সুন্দর এবং সুগম্ভীর দেখাইতেছে।” রাজীব কর্তৃক মহামায়ার ঘোমটা উন্মোচনের মতো এই বর্ষা প্রকৃতিও যেন তার মেঘাবরণ মুক্ত হয়েছে।

‘সমাপ্তি’তে রবীন্দ্রনাথ, প্রকৃতির রমণীরূপ এবং মৃন্ময়ীকে একাত্ম করেছেন। “এই-যে একটি গম্ভীর স্নিগ্ধ বিশাল রমণীপ্রকৃতি মৃন্ময়ীর সমস্ত শরীরে ও সমস্ত অন্তরে রেখায় রেখায় ভরিয়া উঠিল,” প্রকৃতির প্রতিটি ঋতু অলঙ্কারে সুসজ্জিত রূপ তাঁর লেখনীতে প্রকাশ পেয়েছে।

‘মাল্যদান’-এ যতীন ফাল্গুনের মায়ারূপে যখন আবিষ্ট হতে থাকে তখন কুড়ানির জীবনের সকল বঞ্চনার কাহিনী ধীরে ধীরে প্রকট হতে থাকে, “ফাল্গুনের এই কূজন-গুঞ্জন-মর্মরের পশ্চাতে যে সংসার ক্ষুধাতৃষ্ণতুর দুঃখকঠিন দেহ লইয়া বিরাট মূর্তিতে দাঁড়াইয়া আছে, উদঘাটিত যবনিকার শিল্পমাধুর্যের অন্তরালে সে দেখা দিল।” কুড়ানীর অকৃত্রিম অব্যক্ত ভালোবাসার অনুভূতি বোঝাতেও প্রকৃতির উপমা ব্যবহার করেছেন তিনি “যে ভালোবাসা জগতে দুর্লভ, যতীন তাহা না চাহিতেই, ফাল্গুনের একটি মধ্যাহ্নে একটি পূর্ণবিকশিত মাধবীমঞ্জরীর মতো অকস্মাৎ তার পায়ের কাছে আপনি আসিয়া খসিয়া পড়িয়াছে।”

পোস্টমাস্টারের নিঃসঙ্গতার অসহায়তাকে প্রকট করতে, প্রিয়জনের সান্নিধ্যের অভাব বোঝাতে তিনি প্রকৃতিকে আশ্রয় করেছেন। “এই সময় কাছে একটি-কেহ নিতান্ত আপনার লোক থাকিত– হৃদয়ের সহিত একান্তসংলগ্ন একটি স্নেহপুত্তলি মানবমূর্তি। ক্রমে মনে হইতে লাগিল, সেই পাখি ঐ কথাই বার বার বলিতেছে এবং এই জনহীন তরুচ্ছায়ানিমগ্ন মধ্যাহ্নের পল্লবমর্মরের অর্থও কতকটা ঐরূপ।”

‘ঘাটের কথা’য় কুসুমের যৌবন ও সৌন্দর্যের উপমা স্বরূপ তিনি বর্ষা স্ফীত গঙ্গার কথা বলেছেন। ‘শাস্তি’, ‘ছুটি’, ‘জীবিত ও মৃত’ এর মতো আরো অনেক গল্পে বর্ষণসিক্ত প্রকৃতিকে সামিল করেছেন তিনি।

‘বলাই’ গল্পে কবি বলাইয়ের মধ্যে নিজ সত্তাকে প্রবেশ করিয়েছেন। কবির অব্যক্ত উদ্ভিদ প্রেমের ভাষা বলাইয়ের সরলতাকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে। কবির বৈজ্ঞানিক মননে আদি প্রাণের সেই ধ্বনিকে নিজের ভেতর শুনেছিলেন। “সেই বিশ্বপ্রাণের বাণী কেমন-এক-রকম করে আপনার রক্তের মধ্যে শুনতে পেয়েছিল ওই বলাই।”

আবার ‘ছুটি’ গল্পে কবি বয়ঃসন্ধিতে উপনীত ফটিকের অন্তরের তীব্র মর্মবেদনা, বিড়ম্বনা এবং ফলস্বরূপ জীবনের করুণ পরিণতির চিত্র এঁকেছেন।

কবি ছিলেন পাঁচ সন্তানের পিতা। তিন কন্যার সাথে তাঁর অত্যন্ত সুগভীর স্নেহ, ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিলো। কবি নিজেই ছিলেন একজন কন্যা দায়গ্রস্ত পিতা। তাঁর অন্তরের পুঞ্জীভূত সুতীব্র বেদনার প্রতিফলন রেখেছেন তাঁর লেখনীতে। কবি সেই সুকোমল পিতৃহৃদয়েরই ছাপ রেখেছেন ‘কাবুলিওয়ালা’তে, আবার, ‘দেনাপাওনা’ অথবা ‘হৈমন্তী’তে এক কন্যা দায়গ্রস্ত, অধিকার বঞ্চিত, নিগৃহীত, স্নেহ বিগলিত, অসহায় পিতৃহৃদয়ের হাহাকার পরিলক্ষিত হয়েছে। যেকোনো পিতৃহৃদয়ের মূলগত ধ্বনি যে সর্বদা অভিন্ন তা তিনি ‘কাবুলিওয়ালা’তে দেখিয়েছেন। কাগজের উপর নিজ শিশুকন্যার ক্ষুদ্র কোমল হস্তের স্পর্শমাখা প্রতিলিপিটাকে বুকে নিয়ে বেড়িয়ে সুদূর প্রবাসে, কন্যার শৈশবের সকল মুহূর্ত গুলোকে স্নেহ মিশ্রিত কল্পনায় প্রত্যক্ষ করে এক পরম তৃপ্তির স্বাদ পায় কাবুলিওয়ালা। “যেন সেই সুকোমল ক্ষুদ্র শিশুহস্তটুকুর স্পর্শ খানি তাহার বিরাট বিরহী বক্ষের মধ্যে সুধাসঞ্চয় করিয়া রাখে।” আট বছর ব্যবধানে যখন মিনির সঙ্গে কাবুলিওয়ালার সাক্ষাত হয়, তখন সে পরিপূর্ণ এক নারী। কাবুলিওয়ালার সঙ্গে পূর্বের মতো সরল স্বাভাবিক ভাব ও ভাষা বিনিময় করতে পারে না। মিনিকে প্রত্যক্ষ করে কাবুলিওয়ালা নিজ কন্যার পূর্ণাঙ্গ প্রতিরূপ কল্পনা করে নেয়। শেষ মুহূর্তে মিনির বাবাকে, কাবুলিওয়ালার কন্যা বিরহী হৃদয়ের অনেক বেশি সমব্যথী হতে দেখা যায়। “শরতের স্নিগ্ধ রৌদ্রকিরণের মধ্যে সানাই বাজিত লাগিল, রহমত কলিকাতার এক গলির ভিতর বসিয়া আফগানিস্থানের এক মরু-পর্বতের দৃশ্য দেখিতে লাগিল।” পিতৃত্বের বিচারে তার আর রহমতের হৃদয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পায় না মিনির বাবা। অপর দিকে, ‘দেনাপাওনা’য় নিরুপমার পিতা রামসুন্দর কন্যার সুখ অনুসন্ধানের লক্ষ্যে সর্বস্বান্ত হয়েও প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। ব্যাপারটা অবগত হওয়ার পর নিরুপমা শ্বশুরবাড়ির “শরশয্যা”র যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করেও বাবার সেই প্রচেষ্টাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে। বিবাহের পর কন্যাকে নিজ গৃহে নিয়ে যাওয়ার সাধারণ অধিকারটুকুকেও অর্থের বিনিময়ে বন্দক রাখতে হয় তাকে। নিরু বাপের বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও, পণের সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধ না হওয়ায় রামসুন্দর শেষ পর্যন্ত তাকে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়। রামসুন্দরের বুকের অব্যক্ত বেদনাকে ভাগ করে নেওয়ার মতো কেউ ছিলো না তার পাশে। কিন্তু, হৈমন্তী’তে হৈমন্তীর পিতা গৌরীশঙ্কর হৈমন্তীর শ্বশুরবাড়ির কোনো ঋণ বাকি না রাখার সত্ত্বেও হৈমকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার মৌলিক অধিকারটুকু থাকে না। কারণ, তিনি তাদের কাঙ্খিত অর্থের তথা সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন না। বাপ ও মেয়ের মধ্যে হাসি ঠাট্টা ও বন্ধুত্বের সম্পর্কের আড়ালে এক প্রবল হতাশা, কণ্টকযন্ত্রণা উভয়েই নীরবে সহ্য করতো।

‘অনধিকার প্রবেশ’ এ তিনি জয়কালী দেবীকে সকল প্রকার তুচ্ছ সংস্কারের ঊর্ধ্বে এক পরম মমতাময়ী রূপে স্থাপন করেছেন। নারীত্ব, মাতৃত্ব, মমত্ব ও প্রাণের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ‘দিদি’ গল্পেও শশীর মমতাময়ী মাতৃসম ভাতৃস্নেহরূপের নিদর্শন পাই। আবার ‘পোস্টমাস্টার’ এ রতনের মধ্যে এক অনাথিনী অভাগা অপরিচিতা বালিকার এক পরম স্নেহময়ী রূপ প্রত্যক্ষ করি আমরা। ক’য়েক মুহূর্তের ব্যবধানে সেই বালিকা যেন সম্পূর্ণ নারী হয়ে উঠে পোস্টমাস্টারের সেবায় ব্রতী হয়। সমগ্র মাতৃত্ব, মমত্ব উজার করে দিয়ে তাকে সুস্থ করার লক্ষ্যে সম্পূর্ণ আত্মনিয়োগ করতে দেখা যায়। “সেই মুহূর্তেই সে জননীর পদ অধিকার করিয়া বসিল,”। ‘জীবিত ও মৃত’এ কাদম্বিনীর স্নেহ ও মাতৃ সত্তার ভরপুর লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। জীবন মৃত্যুর সীমারেখাকে স্বজ্ঞানে অতিক্রম করলেও খোকার প্রতি তার স্নেহ মমত্বের কখনো ভাটা পড়ে না।

তাঁর বহু গল্পে তিনি বালিকা থেকে নারী হয়ে ওঠার কথা বলেছেন। রবীন্দ্রনাথের নারীরা প্রধানত সুন্দরী। স্বমহিমায় বিরাজিত তাঁর নায়িকারা। প্রকৃতির মতো তিনি নারী সৌন্দর্যের বর্ণনা করছেন আপন বস্তবাদী ভাবনায় প্রেক্ষিতে। তার নারী চরিত্রের মধ্যে সর্বদা বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্য চরিত্রটিকে লাবণ্যমণ্ডিত করেছে। বিশেষ কোনো ঘটনায় হঠাৎ করেই বালিকা সত্তার ভেতর থেকে নারী সত্তার মুক্তি ঘটেছে। এই প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে আসে ‘সমাপ্তি’র মৃন্ময়ীর কথা। মৃন্ময়ীর চঞ্চলতাই তার সৌন্দর্য। “বিধাতার তরবারি সেইরূপ সূক্ষ্ম, কখন তিনি মৃন্ময়ীর বাল্য ও যৌবনের মাঝখানে আঘাত করিয়াছিলেন সে জানিতে পারে নাই; আজ কেমন করিয়া নাড়া পাইয়া বাল্য-অংশ যৌবন হইতে বিচ্যুত হইয়া পড়িল এবং মৃন্ময়ী বিস্মৃত হইয়া ব্যথিত হইয়া চাহিয়া রহিল।” ‘মাল্যদান’এ পিতৃমাতৃহীনা কুড়ানিকেও তিনি অনুরূপ ভাবে অঙ্কিত করেছেন। হরিণীর মতো চঞ্চলতা, সরলতা তার সৌন্দর্য। জীবনের অন্তিম মুহূর্তে এসে, বালিকার আবরণ খসিয়ে সে নারী হয়ে ওঠে, “কুড়ানি মৃগশিশু ছিল, সে কখন হৃদয়ভরাতুর যুবতী নারী হইয়া উঠিল।” সুভার সৌন্দর্য তার ভাষাহীনতায়, নিস্তব্ধতায়। হৈমন্তীর সৌন্দর্য তার সততায়, সহিষ্ণুতায়। পোস্টমাস্টার অসুস্থ হলে রতন সহসা বালিকা সত্তা ঝেড়ে ফেলে জননীর পদ অধিকার করে বসে। দেনাপাওনা’র নিরুপমাকেও চরম মুহূর্তে এক দৃপ্তকণ্ঠ প্রতিবাদী নারী হয়ে উঠতে দেখা যায়।

‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘মণিহারা’, ‘নিশীথে’ অথবা ‘কঙ্কাল’এর মতো গল্পে রবীন্দ্রনাথ অতিপ্রাকৃত, রহস্য ও রোমাঞ্চের পাশাপাশি প্রেম ও জীবন সত্যের সন্ধান করেছেন। বস্তুবাদ ও ভাববাদ দুইয়েরই সংমিশ্রণ ও সমান্তরাল প্রবাহ লক্ষ্য করা যায়। ‘মধ্যবর্তিনী’ এবং ‘নিশীথে’ উভয় ক্ষেত্রেই নর নারীর মধ্যে তৃতীয় নারী সত্তার উপস্থিতি ছাপ ফেলে যায়। ‘কঙ্কাল’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ একটি অতিপ্রাকৃত বাতাবরণ সৃষ্টি করলেও, তার মধ্যে এক অসাধারণ জীবন দর্শন রেখেছেন। জড়তা, সজীবতা আর চেতনার মিলনক্ষেত্র এই মানব দেহ। জড়তাকে আশ্রয় করে যে সজীবতা ঘনীভূত হয় তাতেই চেতনার ইশারায় জন্ম নেয় সৌন্দর্য। চেতনার বিলুপ্তি ঘটে সজীবতার রসায়নের প্রাকৃতিক খেলা থেমে গেলে, অবশিষ্ট থাকে একটি জড় কাঠামো কঙ্কাল। প্রতিটা মনুষ্য দেহের সৌন্দর্যের ধারক হলো কঙ্কাল নামক সত্য! জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে একটি সাধারণ সংযোজক হলো কঙ্কাল। মণিহারাতেও জীবনকালের কাঙ্খিত বাসনার প্রতিরূপ প্রদর্শিত হয়েছে সেই কঙ্কালেরই মাধ্যমে।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোটগল্পে অসংখ্য নারী চরিত্র এঁকেছেন। তাঁর প্রতিটি নারী চরিত্র স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। নিজ গুণে, নিজ কালে, নিজ অবস্থানে, তারা অনন্যা। বঞ্চিতা, অবহেলিতা, সামাজিকতার বেড়াজালে রবীন্দ্রনাথের নারীরা চিরকাল আবদ্ধ থাকেনি। তাঁর পরবর্তী কালের নারীরা অনেক বেশি কালোত্তীর্ণ, আধুনিক, শিক্ষিতা, দৃঢ়, নির্ভীক, প্রতিবাদী, স্বাধীন ও মানবতাবাদী। এক উন্নত, স্বাধীন, মুক্ত সমাজ চেতনার প্রতিভূ হিসেবে দেখা দেয় তারা। রবীন্দ্রনাথের নারী চরিত্ররা সমাজ সভ্যতার বিবর্তনে বিবর্তিত হতে শুরু করে। তারা চিরকাল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের যাঁতাকলে আবদ্ধ থাকে না।

রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের দর্পনে নারীর অবস্থানগত প্রতিবিম্ব অনুসরণ করে পৌঁছে যাওয়া যায় অতীতের সেই লগ্নে যখন, প্রচলিত সামাজিক কুপ্রথা, ধর্ম, কুসংস্কার যা তৎকালীন নারীদের মজ্জাগত করে দেওয়া হতো জন্মলগ্ন থেকে। যে সমাজে স্ত্রী কে স্বামীর আজ্ঞাবহ, সেবিকা, কন্যাকে পরধন রূপে গন্য করা হতো। কন্যা জন্মকে সামাজিক অঘটন হিসাবে দেখা হতো। যে সমাজে কন্যা পক্ষকে সহজেই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা যায়, সকল অধিকার খর্ব করা যায়, অনাদর, অপমান, অসম্মান করা যায়, এবং বোঝানো হতো তাদের কোনো শিক্ষাগত অধিকার নেই, চিকিৎসার অধিকার নেই, প্রতিবাদের অধিকার নেই। যাদের ভাগ্য নির্ধারিত ছিল শ্বশুর বাড়ির হেঁসেলে। বিবাহের পর পিতৃগৃহে আসাটা ছিলো বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষ। যোগ্য উত্তরাধিকার পাওয়া এবং পণপ্রথার দাক্ষিণ্যে অর্থ উপার্জন ছিলো যখন বিবাহের মূল লক্ষ্য। কন্যার পিতা আর্থিক অনটনের স্বীকার হলে কন্যার বিবাহ তথা সমাজিক মর্যাদা নিয়ে এক চরম সংকটের সম্মুখীন হতে হতো। যেনতেনপ্রকারেণ স্বামীর ঘর করাটাই ছিলো নারী জন্মের পরম সার্থকতা। ‘ত্যাগ’, ‘যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ’, ‘মহামায়া’, ‘খাতা’, ‘সম্পত্তি সমর্পণ’, ‘বিচারক’, ‘জীবিত ও মৃত’, ‘ঘাটের কথা’, ‘শাস্তি’, ‘দেনাপাওনা’, ‘হৈমন্তী’ প্রতি ক্ষেত্রেই নারীর অবস্থান সমাজ কাঠামোর ইঙ্গিতবাহী।

কবিগুরুর জীবন সঞ্জাত উপলব্ধি, সমাজ পুনর্গঠনের মানসিকতা তথা সমাজ সংস্কারক মানবতাবাদ, নারী শিক্ষা ও মুক্তি ভাবনা, সর্বোপরি নারী স্বাধীনতার বিকাশ, পরবর্তী কালের ছোটগল্পগুলোতে অধিকতর প্রকট হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের শূন্যতা, অপূর্ণতা, দুঃখ, যন্ত্রণা সমাজ শুদ্ধিকরণের আধুনিক ভাবনা ভাবাতে সহায়ক হয়েছিলো। তাঁর তিন কন্যার অসুখী দাম্পত্যজীবনের সম্পূর্ণ ছায়া পড়েছে আলোচ্য এই গল্পগুলিতে। এখানে, রবীন্দ্রনাথের নারীরা একধাপ একধাপ করে ক্রমবিকাশের পথে অগ্রসর হওয়া শুরু করে দিয়েছে। এখানে তারা যেন একে অপরের সহযোগী। ‘দেনাপাওনা’, ‘হৈমন্তী’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘অপরিচিতা’, ‘পয়লা নম্বর’এ। এছাড়া, ‘ল্যাবরেটরি’র সোহিনী ও ‘নষ্টনীড়’এর চারুলতাকে বিশেষভাবে নির্মাণ করেছেন তিনি। ‘দেনাপাওনা’য় প্রথমবার নিরুপমাকে তিনি সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী করে তুলেছেন। “তোমার মেয়ের কি কোনো মর্যাদা নেই। আমি কি কেবল একটা টাকার থলি, যতক্ষণ টাকা আছে ততক্ষণ আমার দাম।” নিরুপমার দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারিত শব্দমালার প্রতিধ্বনি যেন আজও কষাঘাত করে চলেছে পণপ্রথা নামক ঘৃণ্য ব্যবস্থার উপর। ‘হৈমন্তী’র হৈমন্তী শিক্ষিতা, ঘরকন্নার কাজে দক্ষ না হলেও শিখতে আগ্রহী। সত্যভাষী, আত্মসম্মানী, স্বামী ও শ্বশুরঘরের প্রতি ভালোবাসায় কষ্টসহিষ্ণু, হাস্যময়ী। কিন্তু, হৈমন্তী যা ভাবতে পারে না, ‘স্ত্রীর পত্র’ এর মৃণাল তা পারে। মৃণাল স্বামীর সংসারের অসারতা থেকে মুক্তির জন্য সংসার ত্যাগ করে ধর্মের পথ বেছে নেয়। এ এক প্রথম সাহসী পদক্ষেপ। সে তার নিজ অন্তরের স্বাধীনতার ডাক শুনতে পায় এবং সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়। আবার, ধর্মের পথ অনুসরণ বা সংসার ধর্ম পালন না করেও যে, জীবনকে অধিক অর্থবহ ও সার্থক করে তোলা যায়, তা প্রমাণ করে দেখিয়েছে ‘অপরিচিতা’র কল্যাণী। যে পুরুষ শিক্ষা গ্রহণ করেও অন্যায়ের প্রতিবাদে ব্যর্থ, বিবাহ স্থলে কন্য পক্ষের সম্মান রক্ষার্থে ব্যর্থ, স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ ও সেই ব্যাপারে নিকট আত্মীয়ের উপর নির্ভরশীল। সেই পুরুষকে বিবাহযোগ্য মনে করে না সে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, নারী শিক্ষার আলো বিস্তারের লক্ষ্যে নিজেকে নিয়োজিত করে। পাশাপাশি কল্যাণীর পিতা শম্ভুনাথ সেই প্রথম সাহসী ব্যক্তি যে, ডিগ্রিধারী, উচ্চবংশজাত, সুপাত্রকে বিবাহ সভায় কন্যার বিবাহ লগ্নে, পাত্রের চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাবের কারণে ও কন্যাপক্ষের আত্মসম্মান রক্ষার্থে নাকচ করে দেয়। ‘পয়লা নম্বর’এ সংসারের প্রতি স্বামীর হিম শীতল উদাসীনতা, মানসিক নিঃসঙ্গতার একাকীত্ব, অনিলাকে মুক্তির পথ অনুসন্ধানে বাধ্য করে। উদাসীনতা এতটাই চরম মাত্রায় পৌঁছায় যে, অনিলার ভাইয়ের আত্মহত্যার খবরটুকুও সে রাখে না। সংসার ছেড়ে চিরতরে চলে গিয়ে শিক্ষা দিয়ে যায় সে। এই পাঁচজন নায়িকার সকলেই বাবার আদরের কন্যা। সকলেই সুন্দরী। রামসুন্দর পণের অর্থ পরিশোধ করতে না পারায়, নিরুকে শ্বশুর বাড়িতে নিগ্রহের স্বীকার হতে হয়। কিন্তু, গৌরশংকর চাহিদামতো পণের অর্থ পরিশোধ করার সত্ত্বেও তার যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ তথা সম্পত্তি না থাকার কারণে হৈমর প্রতি অযত্ন শুরু হয়। কল্যাণীকে দেওয়া শম্ভুনাথের, গহনার বিশুদ্ধতা যাচাই করা হয় বিবাহসভায় স্বর্ণকার দ্বারা। অদ্ভুত সমাজের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ যেখানে, বিবাহের মূল উদ্দেশ্য যেন অর্থ আগমনের পথ প্রশস্ত করা এবং নিশ্চিত করা।

রবীন্দ্রনাথের আর একটি সমোচ্চারিত আধুনিক গল্প ‘নষ্টনীড়’। মনস্তত্ত্ব যেখানে প্রাধান্য পেয়েছে। এখানে নায়িকা চারুলতা শিক্ষিতা, মার্জিত, রুচিশীল, প্রতিভাবান আধুনিক নারী। এখানে, প্রথম রবীন্দ্রনাথ দাম্পত্য প্রেমের সমান্তরালে বিবাহ বহির্ভূত প্রেমের কথা বলেছেন। নারী মনের স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। মনস্তত্ত্বের বিকাশ ঘটিয়েছেন। নারীত্ব ও সতীত্ব এই চিরাচরিত শব্দযুগলের মধ্যে বিভেদরেখা টেনেছেন। চারুলতা দাম্পত্য প্রেমকে অস্বীকার না করে অন্তরে আরেকটি প্রেমের শিখা প্রজ্বলিত রাখে। নিজের মনের উপর তার অগাধ নিয়ন্ত্রণ। তাই সে অনন্যা।

কবিগুরুর ‘তিন সঙ্গী’ সংকলনে এক অন্যরকম রবীন্দ্রনাথকে চোখে পড়ে। তাঁর প্রথম যুগের গল্পগুলির মধ্যে প্রকৃতি ও মানুষের সহাবস্থান, কুসংস্কার ও কুপ্রথা দ্বারা আচ্ছন্ন মনস্তত্ত্ব ও সমাজ, পুরুষতান্ত্রিকতা, প্রভৃতি নজরে আসে। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে অনেক বেশি আধুনিক সমাজ গঠনের ভাবনা, নারী স্বাতন্ত্র্য সর্বোপরি মানবতাবাদ প্রাধান্য পায়। এই পর্বের তিনটি গল্প ‘শেষ কথা’, ‘রবিবার’ ও ‘ল্যাবরেটরি’ যেন মানবতার সূত্রে গাঁথা। মানবতাকেই সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থাপন করেছেন। নারী পুরুষের সাফল্যের প্রতিবন্ধক নয়। বরং নারী পুরুষের যথাযথ সহাবস্থানেই সমাজের সকল প্রকার প্রগতি সম্ভব।

রবীন্দ্রনাথ ছোটগল্পের নামকরণের ক্ষেত্রে মুখ্যত দুটি ধারা অনুসরণ করতেন। বিষয় কেন্দ্রিক ও চরিত্র কেন্দ্রিক। কোনো গল্পের নামকরণ বিষয় কেন্দ্রিক হবে না’কি চরিত্র কেন্দ্রিক হবে তা তিনি সূক্ষ্ম অনুভূতি দ্বারা বিচার করতেন। যেমন, ‘দেনাপাওনা’ ও ‘হৈমন্তী’ অনুরূপ সমাজ সমস্যামূলক গল্প হলেও, ‘দেনাপাওনা’র ক্ষেত্রে বিষয় কেন্দ্রিক ও ‘হৈমন্তী’র ক্ষেত্রে চরিত্র কেন্দ্রিক নামকরণ করেছেন। কিন্তু, ‘দেনাপাওনা’ গল্পের নাম তিনি নিরুপমা রাখেননি। তৎকালীন সমাজে দেনাপাওনা নামক শব্দটা অভিশাপ স্বরূপ সমাজের সুগভীরে প্রোথিত ছিলো। নিরুপমা ছিলো সেই সব অভাগী নারীর প্রতিনিধি যারা এই কুপ্রথার বলি হয়। দেনাপাওনা, নারী জন্মের বিভীষিকার মতো। তাই দেনাপাওনা শব্দটির ব্যঞ্জনাকে অঙ্গুলী নির্দেশ করতে, এই নামটিকেই সর্বোত্তম বলে মনে করেছিলেন। এইভাবে গল্পের নামকরণের পিছনে এক সুদূরপ্রসারী শিল্পভাবনার পরিচয় রাখতেন।

মানব চেতনা চরম স্তরে উন্নীত হলে তবেই এমন মহান সৃষ্টি সম্ভব। স্বল্প পরিসরে এই মহামানবের গল্পগুলিকে অনুধাবন করে তার সম্পূর্ণ নির্যাসটুকু উপলব্ধি করা সম্ভব না। তবু এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা, কবিগুরুর আগামী জন্মদিনে একটি শ্রদ্ধার্ঘ্য হয়ে বর্ষিত হোক।

কলমে অভিজিৎ মুখার্জী, হুগলী

বিজ্ঞান ও সাহিত্যের প্রবল অনুরাগী। মহাকাশ বিজ্ঞান ও বাংলা সাহিত্য সবচেয়ে প্রিয় বিষয়। কুসংস্কার তথা অযৌক্তিক প্রথার ঘোর বিরোধী। মহাবৈশ্বিক প্রকৃতির রহস্যময়তা অনুধাবনের প্রচেষ্টা, লেখালেখি, শেখা ও শেখানোর মধ্যে দিয়ে জীবন আনন্দের অনুসন্ধানী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here