এখন ঠাকুমাকে প্রায় দেখি। তাই ঠাকুমাকে দিয়ে শুরু করি…..
একতলার ঘরের একদম কোনার দিকে যে ঘর , সেটি ছিল ঠাকুমার। সেখানে ঠাকুমার ঠাকুরের সিংহাসন আর এদিক ওদিক লোকানো কিছু অমূল্য সম্পদ , অবশ্যই তা ঠাকুমার কাছেই ছিল অমূল্য , কারণ তাতে খুঁজে পাওয়া যেত পানের ডিব্বা , নস্যি , তিলক কাটার মাটি , কিছু কৌটো আর জমানো কিছু খুচরো টাকা পয়সা।
ঠাকুমা সেই কল পার থেকে স্নান করে , তুলসীতলা ধুয়ে চারিদিকে জল ছিটাতে ছিটাতে শেষমেশ পৌছাতো এই কোনের ঘরটিতে। সেখানেই বসে পুজো আর অনেক সময় চুপ করে বসে কিছু ভাবনা নয়তো গজগজ করতো রাগে,বেশির ভাগ সময় রাগের কারণ , স্নানের পর তাকে ছুঁয়ে দেওয়া।
এই ঘরের পাশের ঘরে একটি চৌকি, যার একপাশে একটি আলনা আর একদম কোনায় একটু ফাঁক। ওই চৌকিতে ঠাকুমা কে দেখেছি শুতে দুপুর রাতে, দৌড়ে মা এর ভয় এ পৌঁছে গেছি কতবার ঠাকুমার পেছনে। রাতের অন্ধকারে ঠাকুমার পাশে শুয়ে বাংলাদেশের সব বিখ্যাত চোরের গল্প শোনার সৌভাগ্য শুধু আমারই হয়েছিল মনে হয়, কারণ পরিবারে আমার মতো ঠাকুমার কাছের কেউ ছিল না, আর জীবনের ব্যাস্ততায় কারোর বোধহয় এতটা সময় ছিল না গল্প শোনার ।
ভালোবাসা -ঝগড়া – চেঁচামেচি -কান্না , সব কিছুতেই ঠাকুমা ডেকে উঠতো ‘মণি’ শোন্ শোন্। ঠাকুমাকে জ্ঞান হওয়া থেকে কুঁজো হয়ে দেখেছি, তবে কি তার কষ্ট , তা আজ অনুভব হয়। আমার জন্মের আগে দাদু মারা যান, আর ঠাকুমা আমার জন্মের ৩০ বছর পর। এই এতটা পথ অনেকটা একা।
খিটখিটে-শুচিবাই ঠাকুমা সব সময় যে এরকমই ছিলেন তাই কি ! শুনেছি ছোটবেলায় আমায় কোলে করে ঘুরে বেড়াতেন , আমাদের বাড়িতে ঠাকুমার অনেক বান্ধবীরাও আসতেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এক এক করে ঠাকুমার সব বান্ধবী ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন। ঠাকুমা থেকে যান একা। আস্তে আস্তে জীবন এর গন্ডি ছোট থেকে ছোট হয়ে চার দেওয়ালে বন্দি হয়ে যান। ঠাকুমা সব সময় খেতে খুব ভালোবাসতেন , কিন্তু শেষ বয়েসে হজমশক্তি একদম কমে যাওয়াতে খেয়ে কিছু সহ্য করে উঠতে পারতেন না। ‘আমায় একটু নস্যি এনে দিবি’ – এই ছিল তার শেষ জীবনের বায়না। কিছু অপূর্ণ বাসনা নিয়ে তিনি মারা যান, যা অতি সহজেই হয়তো পূর্ণ করা যেত, কিন্তু আমরা কেউ ভাবিনি ঠাকুমা হঠাৎই এভাবে চলে যাবেন। শেষযাত্রায় সামিল হতে পারিনি। জীবনের প্রথম শোকযাত্রা। শেষযাত্রায় তাঁকে দেখতে পারিনি বলে আর শ্রাদ্ধে গিয়ে অনুষ্ঠানে সেজেগুজে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়াটা আমার আত্মায় সাই দেয়নি। তাই আজও ঠাকুমার জীবন্ত মুখ চোখে ভাসে। খুব অনায়াসে ঠাকুমাকে নিয়ে অনেক কথা ভাবতে পারি , ক্ষমা চাইতে পারি।
আজ ওই কোনার ঘরের ফাঁকা জায়গাটা বড্ডো টানে। যেখানে শৈশবের অনেক সুখস্মৃতি জমে আছে। ওই জায়গাটা এমন করে সাজিয়ে ছিলাম , কেউ অনেক খুঁজলেও আমাকে কোনো দিনও খুঁজে পেতো না , অনেক অনেক বছর পরে ছোটকাকা শুধু মাত্র সন্ধান পেয়েছিলো ওই জায়গার। মা এর ভয় এ , মার খাওয়ার ভয় এ , অনেক সময় মা কে শায়েস্তা করতে চুপ করে বসে থাকতাম ওই গুপচি অন্ধকারে ঘন্টার পর ঘন্টা। একবার ৪-৫ ঘন্টা ঐরকম লুকিয়ে থেকে বাড়ির সবার কথা শুনে বেরিয়ে আসি , কারণ মা আমাকে না খুঁজে পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সেদিন ও তারা খোঁজ পাননি আমি কোথায় লুকিয়ে ছিলাম। বয়েসের সাথে সাথে ওই ছোট্ট জায়গা আমাকে আর লুকিয়ে রাখতে পারেনি। তাই আর সবার চোখে ধুলো দিয়ে লুকোনো হয়নি অনেকদিন।
আজ খুব ইচ্ছে হয় ঠাকুমার পাশে গিয়ে শুই, মা কে জ্বালাতন করি, বাবার সাথে খুব ঝগড়া হোক। আজ ঘুম আসে না। ঘুম আসতে ফিরে যেতে হয় শৈশবের দিনে। ঘুমের দেশে আজ আমাকে শুধু নিয়ে যায় ওই ঠাকুমার গল্প – মা এর মুখ – বাড়ির ঘরের আনাচে কানাচে ফেলে আসা বাল্যদিনের ভাবনাগুলো। দিনের শেষে ঘুমের দেশে আমি রোজ পৌঁছে যাই ‘আমার বাড়ি’। চোখ বন্ধ করলে ঘুম না এলেই আজকাল এটাই আমার একমাত্র উপায় , মুম্বাই থেকে বেরিয়ে গাড়ি – উড়োজাহাজে চড়ে – কলকাতা নামার আগেই কখনো ঘুম জড়িয়ে আসে চোখে। ঘুম ভাঙলে আগামী ঘুমের অভ্যাস শুরু করি, গত দিনের শেষ থেকে। এভাবে চলছে বহুদিন, আজ ওই অন্ধকার গর্তে পৌঁছাতে পারিনি , মা কে ছুঁতে পারিনি , ঠাকুমার দেখা পাইনি।
মনের বিষণ্ণতা দূর করতে আজ অনেক উপায় বাজারে গিজগিজ করছে! কত যোগাসন, কত এপ্লিকেশন, কত ব্যায়াম!! আমার কিন্তু এই একটি বিধি বেশ কাজে লেগেছে। চোখ বন্ধ করলে হাজারো চিন্তা যখন মাথায় টোকা দিয়ে বলে আমার সুরাহা করো , আমার আমার !!!!!! আমি তখন এক ধাক্কায় সবাইকে দূরে ফেলে ছুটে যাই , ২০০০ কিলোমিটার দূরে , শান্তিধামে ‘লক্ষ্মী ভিলায়’ . আমার মা এর নামে সে বাড়ির নাম।
সময়ে পরিবর্তিত রূপ নিলেও ভালো লাগে পুরোনো ছোট বাড়ির কথা ভাবতে। যেখানে ১০-১২ টি ঘরের জায়গায় মাত্র ছিল ২-৩টি ঘর , বারান্দা , সব সময় গমগম করা কাকা পিসি ঠাকুমার আওয়াজ। বারান্দার সামনের পেয়ারা গাছ আর পিছলে কুয়োতলা। মাঝে মাঝে বাবার সাথে জোর করে রবিবারের বাজারে যাব বলে সাইকেল এর পেছনে বসে পড়া, সারা রাস্তা বাবার সাথে অনেক জ্ঞানের কথা। জ্ঞান যদিও আমিই দিতাম। জ্যান্ত মাছ পেলে তা সরাসরি পৌঁছে যেত কুয়োতে। রোজ তাদের একটু একটু বড় করা, আর মিছিমিছি ছিপ ফেলে তাদের ভয় পাওয়ানোতে সেই সময়ের ডানপিঠে মেয়ের জুড়ি মেলা ছিল ভার।আজ কেন ! অনেক বছর আগে সেই কুয়ো বুজে গেছে, কেটে গেছে পেয়ারার শিকড়, শুধু মন তাদের সরিয়ে ফেলতে পারেনি আজও।
ঘুমের দেশে যাওয়ার আগে ১ মিনিট ভেবে নি , আজ কাকে নিয়ে ভাববো ! আছে সেই ছাদ ! কিংবা মিঠুর দেওয়া প্রথম জন্মদিনের উপহার নাকি প্রতিবার প্রথম হয়ে এলে ন’কাকার এনে দেওয়া কাঁচের বোতলের কালো ঠান্ডা পানীয়।মা কে নিয়ে বেশি ভাবিনা , ঘুমের মধ্যেও ফুঁপিয়ে কান্না পাই। না না !! এতেই শেষ নেই , আমার ভাবনার অনেক মজার কথা আছে তালিকায়। ধীরে ধীরে মোড়ক খুলবো। জানা নেই যে কত দিন লাগবে অতীতকে সম্বল করে ভবিষ্যতে আসল মানুষগুলোকে ছুঁয়ে দেখতে। তাই। …
আমি অতীতে বড্ডো বেঁচে থাকি , বিশেষ করে আমার ছোটবেলায়। আজ যেমন ঘুমের অস্ত্র করে নিয়েছি , তেমন মন খারাপে একমাত্র ভালোলাগা আমার অতীত। আমার ভালোলাগার অতীত গতকালও।
ক্রমশঃ…..
স্মৃতিমন্থনে মৌসুমী কুন্ডু
Satti anabil sukher smriti.khub sundor