কবিকে অনেক কথাই বলার ছিল বনলতা সেনের, কিন্তু দীর্ঘদিন অদেখার ফলে সব কথা যে বলা হয় নি সে আক্ষেপ ছিল তার। অবশেষে ঘটল প্রতীক্ষার অবসান। কবি ও তো প্রতীক্ষা করছিলেন। এক শুক্ল পক্ষের নিশীথে অষ্টমীর চাঁদ যখন কিশোরীর সদ্যোন্নত বুকের স্নিগ্ধতা নিয়ে চতুর্দিক প্লাবিত করে তুলেছিল, কবি তখন পুষ্প কাননের ম্লান জ্যোৎস্নাধৌত রাতে যে রাতে কেউ কোথা ও ছিল না, নিঃশব্দ কাননে , নিস্তব্ধ জনহীনতার মধ্যে নির্জনে একা বসে তদগত চিত্তে ভাবছিলেন তাঁর প্রেয়সীর কথা, ঠিক সেই সময় এক অতি পরিচিত মধুর কণ্ঠধ্বনি শুনে বিভোর কবি এক কণ্ঠস্বর শুনে চমকিত হয়ে উঠলেন, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ এই সুরেলা কণ্ঠ যে তাঁর হৃদয়ে গেঁথে আছে যুগ যুগান্তর ধরে। সে তিনি ভুলবেন কি করে? পেছন ফিরে কবি দেখতে পান নীল নির্জন সন্ধ্যায় যখন সব পাখি ঘরে ফেরে সেই অস্পষ্ট আলোয় দাঁড়িয়ে আছে তাঁর চিরজনমের প্রিয়া বনলতা সেন।
‘বনলতা? তুমি?’ অন্তরের আকুলতা নিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে ওঠেন কবি, কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যায় তাঁর । এই সেই বনলতা সেন, যার চুল কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশার মত, যার অপরূপ মুখসৌন্দর্যের তুলনা হতে পারে একমাত্র শ্রাবস্তীর কারুকার্যের সঙ্গে। কবি ভাবেন তিনি স্বপ্ন দেখছেন না তো?
‘হ্যাঁ, আমি সেই বনলতা’, সে একটু এগিয়ে এসে তার পাখির নীড়ের মত চোখদু’টো তুলে কবিকে সম্বোধন করে বলে, ‘আমায় চিনতে পারেন কবি?’
কবি বাকরুদ্ধ হয়ে যান। কতদিন পরে তাঁর মানসী, স্বপ্নসুন্দরী, চিরযৌবনা বনলতা সেন তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে। তাকে তিনি চিনতে পারবেন না? কবির নীরবতায় ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বনলতা আবার বলে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
এবার কবির চেতনা হয়। তিনি আবেগভরা কণ্ঠে বলেন, ‘তুমি জান না বনলতা আমি কতদিন ধরে তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি বিশ্বময়। মনে হয় হাজার বছর পার হয়ে গেছে তোমাকে যখন শেষবার দেখি তখন থেকে। মনের ময়ূরকণ্ঠী নাও চেপে আমি বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত তোমায় খুঁজছি। কালের দূরত্বের সীমা পার হয়ে আমি তোমাকে খুঁজেছি সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগর পর্যন্ত। কল্পনার নাও বেয়ে চলে গেছি কোন অতীতের রাজার রাজত্বে যেখানে অধিষ্ঠিত ছিলেন নৃপতি বিম্বিসার থেকে সম্রাট অশোক পর্যন্ত, কিম্বা আরো দূরে বিদর্ভ নগরে। আজ যখন এতদিন পরে তোমায় দেখতে পাচ্ছি আমার সামনে মনে হচ্ছে আমরা দু’জনে রয়েছি অন্ধকারে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর । সেখানে দারুচিনির আঘ্রানের সঙ্গে মিশে আছে তোমার অংগসৌরভ। সে কি কখন ও ভোলা যায়?’
একটু আদুরে ভংগীতে বনলতা বলে, ‘আপনি কেন এভাবে হন্যে হয়ে আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন কবি?’
কবি বলেন, ‘আমার হৃদয় সমুদ্রে যে উত্তাল তরংগ আছড়ে পড়ছে তাকে সংযত করে আমাকে দুদণ্ড শান্তি দিতে পার তো শুধু তুমিই বনলতা, একথা কি তুমি বোঝ না?’
‘আপনার এই কথাটা বিশ্বাস করতে পারলে আমি নিজেও যে অপার শান্তি পেতাম,’ স্নিগ্ধ কণ্ঠে বলে বনলতা, ‘কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছি কই?’
‘কেন নয় বনলতা?’ কবি আকুল কণ্ঠে বলেন, ‘তুমি বিহীন আমার জীবন, আমার পৃথিবী যে শূণ্য, অর্থহীন। তুমি আমার অনুপ্রেরণা, আমার কাব্যের উৎস, ভাব, ভাষা, ছন্দ সব কিছু। তুমি নিশ্চয়ই একথা বোঝ প্রিয়া। তুমি বিনা আমি মূক, অন্ধ, বধির। ‘
‘আবার বলছি’, বনলতা বলে, ‘সে কথাটা বুঝতে পারলে ভালই লাগত।‘ হতাশা ঝরে পড়ে তার কণ্ঠে সে যখন বলে, ‘কিন্তু আপনার কথাগুলো মেনে নিতে যে আমার কষ্ট হচ্ছে কবি।‘ বলতে বলতে বনলতার চোখ দু’টি অশ্রুপূর্ণ হয়ে টল টল করতে থাকে।
‘তুমি এমন করে কথা বলছ কেন বনলতা’, বিমর্ষ সুরে আবেগ ভরা কণ্ঠে বলেন কবি, ‘তোমার অশ্রুসজল আঁখি আমি দেখতে চাই না।‘
‘একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে কবি’, তার চোখের তারায় দ্যুতি এনে বনলতা বলে, ‘আপনার ভাব জগতে বনলতা সেন ছাড়া আর অন্য কোন নারীর স্থান নেই কি? আপনার কাব্যের জগতে, স্বপ্নের জগতে বনলতাই কি শেষ কথা? অন্য কোন নারী কি আপনার হৃদয়ে স্থান পায় নি? অন্য কোন নারীর স্পর্শ আপনাকে শিহরিত করে নি?’
‘এই চরম সত্যিটা কি তুমি উপলব্ধি করতে পার না প্রিয়া’, কবি বলেন, ‘একদিকে তুমি আমার স্বপ্ন আর অন্যদিকে তুমি বাস্তব, তুমি শুধু কবির কল্পনা নও বনলতা। তুমি আমার জীবন জুড়ে ব্যাপ্ত হয়ে আছ। থাকবে চিরকাল কল্পনার রাজ্যে এবং বাস্তবতার নিরিখে। তুমি, একমাত্র তুমিই, আর কেউ নয়।‘
‘তাই কি? তাহলে অন্য নারীরা কারা ?’ এবার বনলতার কণ্ঠে বিদ্রূপের আভাষ।
‘তুমি কাদের কথা বলছ বনলতা?’ বিহ্বল হয়ে কবি জিজ্ঞেস করেন, তাঁর চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে।
‘কেন?’ বনলতার কণ্ঠস্বর এখনো বিদ্রূপাত্মক, ‘অরুনিমা সান্যাল, মৃনালিনী ঘোষাল তারা কারা কবি? যাদের কথা আপনি বারবার বলেছেন আপনার কবিতায়।‘
‘এরা হচ্ছে সবাই আমার কল্পজগতের নারী,’ কবি আকুল হয়ে বলেন, ‘আর তুমি? কি বলে বোঝাই আমি বনলতা, তুমি হলে আমার জন্ম জন্মান্তরের প্রিয়া, স্বপনে, কল্পনায় এবং বাস্তবে।‘
‘সবাই কি কল্প জগতের?’ বনলতা একটু এগিয়ে কবির মুখের কাছে এসে বলে, ‘তাহলে আপনি কুড়ি বছর পর কার্তিক মাসের সন্ধ্যায় কিম্বা মাঝরাতে বনহংস হতে চেয়েছিলেন কেন বনহংসীর নিরালা নীড়ে গিয়ে? সে নিশ্চয় আমার কথা ভেবে নয়। মনে করে দেখুন তো আপনি কার কথা ভেবে এই কথাগুলো উচ্চারণ করেছিলেন।‘
কবিকে চুপ করে বিভোর হয়ে থাকতে দেখে বনলতা আবার আবেগ জড়িত কণ্ঠে বলে, ‘আপনি আরো অনেক কিছু বলেছেন কবি। আপনি বলেছেন ‘তোমার পাখনায় আমার পালক, আমার পাখায় তোমার রক্তের স্পন্দন।‘ তাই বলেন নি আপনি? স্মরণ করে দেখুন কাকে উদ্দেশ্য করে এসব কথা বলেছেন আপনি। আমাকে নিশ্চয় নয়। আবার এক অদ্ভুত সমাপতন যোগে সেই সময়েই আপনার মনে পড়ে গিয়েছিল অরুনিমা সান্যালের মুখ। কেই বা সেই অরুনিমা সান্ন্যাল?’
‘ তুমি ঠিকই বলেছ বনলতা’, কবি মৃদু কণ্ঠে বলেন, ‘তুমি কি লক্ষ্য করে দেখ নি আমি বলেছি কল্পনার হাঁস সব …………উড়ুক তার হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর। তারা সবাই কল্পনার জগতের। কেউ বাস্তবের নয়।‘
‘আপনার কাব্যিক ভাষা, আপনার কাব্যময় ভাব বোঝার শক্তি আমার মত সামান্য নারীর নেই কবি। সাধারণ নারীর বুদ্ধিতে আমি যা বুঝি, যা উপলব্ধি করি, তাই বললাম,’ বনলতা দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে বলে।
গভীর ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে কবি বলেন, ‘তুমি সাধারণ নও বনলতা, তুমি অনন্যা, অতুলনীয়া,অসাধারণের চেয়ে ও অসাধারণ।‘
বনলতা কিয়ৎক্ষন চুপ করে থাকে, তারপর তার বঙ্কিম ভুরু যুগল ঈষৎ কুঞ্চিত করে বলে, ‘শঙ্খমালা কার নাম কবি? যার কথা আপনি বেশ কয়েকবার বলেছেন।’
শঙ্খমালা! নাম শুনে কবির হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে যায়, তিনি আপন মনে বলতে থাকেন, ‘শঙ্খমালা, শঙ্খমালা!’ তাঁর মন চলে যায় এক সুদূর অতীতে, দৃষ্টি চলে যায় অনন্ত আকাশ পানে।
চোখ তুলে বনলতা বলে, ‘হ্যাঁ, আমি সেই শঙ্খমালার কথাই বলছি, যার স্তন করুণ শঙ্খের মত দুধে আর্দ্র। তার ডাক শুনে আপনার মনে হয়েছে তার চোখ বেতের ফলের মত নীলাভ ব্যথিত। আপনি নিশ্চয় তাকে ভুলে যান নি কবি? কে সেই শঙ্খমালা? ’
কবি নিজের মনেই বলতে থাকেন, ‘তাকে আমি ভুলব কেমন করে, সে যে নিত্য স্বপ্নে আমায় দেখা দেয়।‘
‘তাহলে আমার ধারণা ভুল নয় কবি,’ বনলতা আবেগ ভরা কণ্ঠে বলে, ‘তাছাড়া আপনি আক্ষেপ করেছেন সুদর্শনার জন্যও। আপনি তাকে বলেছেন ‘তোমার শরীর তুমি দান করনি তো? কবি,’ বনলতা বলতে থাকে, ‘আপনি আমাকে বলেছেন আমাকে তেমনি অন্ধকারে দেখেছিলেন যেমন করে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর পথহারা নাবিক খুঁজে পায় কুলায়। আপনার কথা শুনে আমি আবেগে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু আমার হৃদয়ের সেই আবেগ বেশিক্ষন স্থায়ী হয় নি যখন দেখলাম সেই দারুচিনি বনানীর ভিতরেই এক নির্জনতার মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন সুচেতনাকে। তাকে আপনি বলেছেন ‘ তবু তোমার কাছে আমার হৃদয়।‘ বলেন নি?’
একটু থেমে বনলতা বলে, ‘তারপরেই আবার দুঃখ করে বলেছেন ‘জানি আমি —-তোমার দুচোখ আমাকে খোঁজে না।‘ আপনি কি এসব কথা অস্বীকার করতে পারেন যে সেই সুচেতনাকেই আবার আপনি বলেছেন ‘—–কতদিন তুমি আর আমি এইখানে বসিয়াছি ঘরের ভিতর খড়ের চালের নিচে অন্ধকারে—–দেখিয়াছি ধূপ জ্বাল, ধর সন্ধ্যারতি থোড়ের মতন সাদা ভিজে হাতে —–নির্জন পালঙ্কে তুমি ঘুমায়েছ —–’। বলেন নি কি?’
বনলতা থামতে কবি উদাস চোখে তাকিয়ে থাকেন কোন দূরদূরান্তরের নক্ষত্রমালার দিকে। কয়েক মুহূর্ত মাত্র, দু’জনেই নীরব। হঠাৎ কবির মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তিনি আকুল দৃষ্টিতে বনলতা সেনের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘আমি জানি বনলতা, আমি সব জানি। সুরঞ্জনা, সুচেতনা, শঙ্খমালা, অরুনিমা সান্যাল কিম্বা মৃনালিনী ঘোষাল সবাই ছিল এবং এখনো আছে। আবার সবাই এক এক করে চলে যাবে। তারা যে সব কবির কল্পনা, বাস্তবে তুমি তাদের দেখা পাবে না। আর বনলতা, তুমি শুধু কবির স্বপ্নলোকের মানসী নও, আমার কল্পনার প্রিয়তমা নও, তুমি রয়েছ আমার হৃদয়ে, আমার চোখে, আমার জীবনে চিরন্তন হয়ে মহাকালের শেষ সীমান্ত পর্যন্ত। জীবনের সব লেনদেন চুকে গেলেও যখন সব পাখি ঘরে ফেরে, সব নদী, তুমি আর আমি অন্ধকারে মুখোমুখি বসে থাকব অনন্ত কাল ধরে।‘
স্তব্ধ হয়ে যায় বনলতা কবির কথা শুনে। তার অশ্রু সজল চোখ নত করে সে বসে থাকে। তার ভাবনায় কোনদিন আসে নি যে জীবনের লেনদেন চুকিয়ে অমৃতলোকের পথের যাত্রী হয়ে কবি চলে যাবেন অকালে, তাঁর রূপসী বাংলাকে ছেড়ে, তাঁর প্রিয়তমা বনলতা সেনকে ছেড়ে এক অবিমৃষ্যকারীর সামান্য ভুলের ফলে।
প্রকৃতির কবি, রূপসী বাংলার কবি, এক ব্যতিক্রমী কবি চলে গেলেন তাঁর অমর কীর্তিকে আমাদের জন্য রেখে আর বাঙ্গালীর হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন লাভ করে রইল তাঁর চিরকালের প্রিয়া বনলতা সেন। আমাদের কর্ণকুহরে এখনো ভাসে তার কণ্ঠ ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’

কলমে সুব্রত নন্দী মজুমদার

Write and Win: Participate in Creative writing Contest & International Essay Contest and win fabulous prizes.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here