এয়ারপোর্টের বাইরে এসে মি: দেশাই চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন।ছোট এয়ারপোর্ট।খুব বেশী ভীড় নেই।লাগেজ নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে দেখলেন বেশ কিছু প্রাইভেট ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে।তাঁকে অবশ্য তাঁর বন্ধু বলেছিল যে নিতে আসবে ।তিনিই মানা করেছেন।এয়ারপোর্ট থেকে বড়জোর আধাঘন্টা যেতে হবে।জায়গাটার নাম কল্যাণপুর।ও উনি নিজেই পারবেন।এখানে মি: দেশাই এর পরিচয় একটু দেওয়া যাক।উনি চিত্রনাট্যকার ।ওনার লেখা গল্প থেকে অনেক হিট সিনেমা হয়েছে।ওনার সর্বশেষ গল্পটি থেকে যে সিনেমাটি হবে তার জন্যই উনি কল্যাণপুরে এসেছেন।নির্দেশক মি :মিনার অনুরোধে।মিনা ওনার অনেকদিনের বন্ধু।সিনেমাটি যুদ্ধকেন্দ্রিক।আপাতত তার শুটিঙের জন্য একটি পরিত্যক্ত কলোনি বাছা হয়েছে।প্রাথমিক কিছু কাজের জন্য এখন তাঁরা এখানে এসেছেন। আধঘন্টার মধ্যেই উনি হোটেল রঙ্গনে পৌঁছে গেলেন।এখানেই ওনার পুরো টিম আছে।কিন্তু গিয়ে শুনলেন ছঘন্টা আগেই ওরা হোটেল ছেড়ে দিয়েছে।দেশাই অবাক হলেন।এটা তো উনি জানেন না।কেউ খবর দেয়নি ওনাকে।অবশ্য বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না।ফোন এল।“আরে দেশাই তুমি হোটেলের বাইরে বেরোও।আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে তোমায় নিতে আসছি।“ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যে মিনা একটা গাড়ী নিয়ে হোটেল গেটে চলে এলেন।“ওঠো গাড়ীতে।” “আরে যাব কোথায়,সেটাও তো বলো!” “চলো না,গেলেই দেখতে পাবে।“ “হোটেলটা ছাড়লে কেন?” “আর বোলোনা,”বলে মিনা একপাতা সমস্যা বলে গেলেন।এই নেই,ওই নেই….ইত্যাদি ইত্যাদি।এতক্ষণে দেশাই লক্ষ্য করলেন তাঁরা ছাড়াও গাড়ীতে আরেকজন রয়েছে।23-24 বছরের এক যুবক।সুদর্শন চেহারা।“ও অর্ক।স্থানীয় ছেলে।আমাদের বিভিন্ন কাজে সাহায্য করছে।”মিনা দেশাই এর সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন।মিনিট পনেরো পর গাড়ীটা একটা ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়ালো।সামনে একটা বড় মাঠ।মাঝখানটা পরিষ্কার,কিন্তু চারধারে জঙ্গল।মাঠের ওপারে বেশ কিছু কোয়ার্টার যার অধিকাংশের অবস্থাই খুব করুণ।আগে এখানে একটি সার কারখানার শ্রমিক ও অফিসারদের আবাসন ছিল।কারখানাটা কিছুটা দূরে।২0১৬ সালে কারখানা বন্ধ হয় আর কুড়িতে এখান থেকে লোকজনরা চলে যায়।সরকারের প্ল্যান ছিল নতুন এক কারখানা গড়ার কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি।মিনার মুখে এত তথ্য শুনে দেশাই বুঝলেন ও ভালোই হোমওয়ার্ক করেছে ।আর একটা কথা মাথায় এল আশেপাশে দেখে-এ যেন দ্বিতীয় হড়প্পা। কিন্তু উনি এটা বুঝলেন না থাকবেন কোথায়।“আরে চলই তো!মিনা আর অর্কর সাথে মাঠ পেরিয়ে এলেন।এসে দেখেন কোয়ার্টারগুলোর সামনে বেশ বড় একটা বিল্ডিং।ওটা নাকি গেস্ট হাউস ছিল।তিনটে বড় রুম,কিচেন বাথরুম।এটার দেখভাল এখনো হয়।কারণ দুতিনবার নতুন কারখানার কর্তারা এখানে এসে বিশ্রাম নিয়েছেন।তবে এই নয় যে দারোয়ান আছে।যাঁরা ভাড়া নেন তাঁরাই পরিষ্কার করেন।অন্য ব্যবস্থা করেন।দেশাই অর্কর মাধ্যমে স্থানীয় লোক দিয়ে গেস্ট হাইহাউস পরিষ্কার করিয়ে রেখেছেন।পাশের চারপাঁচটা কোয়ার্টারের অবস্থা অনেকটাই ভালো।তাই সেখানেও বাকীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।খাবারদাহার সব বাইরে থেকে আসবে।এইখানে নাকি উচ্চপদস্থ অফিসাররা থাকতেন।তাঁরা এতদিন বন্ধ কারখানার মেশিনপত্রের দেখাশোনা করছিলেন। দিন পনেরো আগে তাঁরাও এখান থেকে চলে গেছেন।তাই কোয়ার্টারগুলো ভালো অবস্থায় আছে।।এছাড়াও মাঠের একদিকে একটা লম্বা মতন বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে।ওটা নাকি স্কুল ছিল।এখন একতলার ডানদিকের ঘরগুলো তাও ঠিক আছে,বাকিটা ব্যবহার যোগ্য নয়।ওনাদের গেস্ট হাউসটার পেছনে আরো একসারি ফাঁকা কোয়ার্টার রয়েছে।তার দরজা আছে তো বারান্দা নেই,জানলা তো প্রায় কারোরি নেই।ওখানে যে মানুষ দীর্ঘদিন থেকেছে তা এখন বিশ্বাস করা মুশকিল।তিনি মিনাকে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,”আমরা এখানে থাকব?””আরে হ্যাঁ,ওই সব দিকে কোন ভালো হোটেল খালি নেই।এর থেকে এখানে থাকা নির্ঝন্ঝাট।ফিল্মের লোক এসেছে শুনল কিছু লোক ফালতু এসে বিরক্ত করে।এখানে ওইসব ঝামেলা নেই।“দেশাই শুনেছিলেন মিনার নাকি আগের ফিল্মগুলো ভালো চলেনি।তাই হয়তো খরচ কমাচ্ছে এইভাবে।গেস্ট হাউসের জন্য আর কত ভাড়া লাগবে?
সেদিনটা পুরোই কাজের আলোচনায় চলে গেল।তাও দেশাইয়ের মনে হল মিনাজী একটু যেন অন্যমনস্ক।হয়তো টাকা পয়সা নিয়ে চিন্তায় আছে।রাত্রের খাবার অর্ক কোথা থেকে যেন নিয়ে এল।পালক পনীর আর রুটি।বেশ সুস্বাদু।মিনা তো ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।এত কাজের ছেলে খুব কম পাবে তুমি….ইত্যাদি ইত্যাদি।ক্লান্তি লাগছিল বলে ওনারা দুজনেই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লেন।এমনিতেও শীতকাল।কিন্তু দেশাইয়ের ঘুম আসছিল না।তিনি মনে মনে ভাবছিলেন এই প্রথম মিনাকে দেখলেন এত সাধারণ ভাবে থাকতে।অন্তত ফোর স্টার ছাড়া ওনার মন ভরে না।হয়তো বয়েস বাড়ছে তাই একটু একটু বৈরাগ্য আসছে।যাহোক ক্লান্তি থাকলেও ঘুম এলো না।
দেশাই নিজের রুমে ঢুকে জানলাটার কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন।একটা সামাজিক গল্প লিখতে হবে নেক্স্ট প্রজেক্টের জন্য।দশাইদের গেস্ট হাউসের পাশে একটি ব্লকে চারটি কোয়ার্টার একসাথে আবার একটু দুরত্বে আরো একটি ব্লক। পাশের ব্লকের ওপরের কোয়ার্টারে রেড্ডী আছেন।উনি ক্যামেরাম্যান।ওনার কাজ খুবই ভালো কিন্তু লোকটা একটু খিটখিটে।অবশ্য দেশাইয়ের সঙ্গে এর আগে ওনার পরিচয় হয়নি।এই টিমের মিনা বাদে আর সবাই তাঁর অপরিচিত।মানে ওই পার্টিতে হয়ত এক আধবার দেখা হয়েছে,ব্যস ওইটুকুই।কিন্তু নাম শুনেছেন। হঠাৎদেশাইয়ের কানে কথা বলার আওয়াজ এল।রেড্ডীর ঘর থেকে।।নির্জন জায়গা তাই স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।হয়তো বাড়ীতে কথা বলছেন।আরেকটু এগিয়ে শুনতে পেলেন কথাবার্তা বাংলায় হচ্ছে।ভীষণ অবাক হলেন।রেড্ডী বাংলা বলতে জানে এটা দেশাই জানতেন না।যাহোক পরে জিজ্ঞেস করবেন।এইসব ভেবে উনি শুয়ে পড়লেন।
পরেরদিন সকাল।ওনারা শুটিং স্পটে চললেন।মানে যে জায়গাটা ভাবা হয়েছে শুটিং স্পট হিসেবে।অর্ক ও চলে এসছে।দেশাই রেড্ডীকে একফাঁকে বললেন,”আপনি কি সুন্দর ঝড়ঝড়ে বাংলা বলতে পারেন স্যার!কোথায় শিখলেন?” “পাগল হো ক্যায়া,”বলে রেড্ডী ক্যামেরা সেট করতে অন্যদিকে রওনা হলেন।দেশাই রীতিমত অপমানিত বোধ করলেন।এ আবার কি!কাজ চলতে চলতে একটা ছোট অঘটন ঘটল।দুপুর দুটো নাগাদ ওনারা সবাই লাঞ্চ করছিলেন।খাওয়া হয়ে গেলে রেড্ডীর আ্যাসিস্টেন্ট দীনেশ আর মনীশ হাত ধুতে বাথরুমে গেছিল।ফেরার সময় দীনেশ বেশ বাজে ভাবে হোঁচট খেল।পায়ের পাতায় ভালো লাগল।মনীশ ,দেশাই,রেড্ডী ওকে তুলে ধরে বসাল।“কিরে দেখে হাঁটিস না নাকি?পড়লি কি করে!”রেড্ডী তাঁর স্বভাব অনুযায়ী ধমকে বললেন।দীনেশ মৃদু হাসল কিন্তু কিছু বলল না।কারণ ওর মনে হয়েছিল মনীশ ওকে পেছন থেকে ঠেলা মেরেছে।কিন্তু এরম বোকা বোকা কাজ ও করবেই বা কেন? সঙ্গে সঙ্গে বরফ,মলম সব লাগালেও পায়ের পাতাটা ফুলে গেল।“তুমি গিয়ে রেস্ট নাও।“মিনা বললেন।“মনীশ ওকে দিয়ে এসো।“মনীশ গিয়ে দীনেশকে কোয়ার্টারে পৌঁছে এল।চৌকির ওপর পাতা বিছানায় দীনেশ সটান শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর মিনা দেশাইকে পাঠালেন দীনেশকে দেখতে।দেশাই ঘরে ঢুকতেই দীনেশ উঠে বসল।“আরে তুমি রেস্ট নাও।আমি এমনি এলাম।ব্যথা কেমন?””ওই পেনকিলারে একটু কমেছে আরকি।“দেশাই এদিক ও দিক ঘুরতে ঘুরতে দীনেশের সামনের ঘরের জানলা দিয়ে একটা সুন্দর দৃশ্য দেখলেন।ওই জানলা দিয়ে সরাসরি পাশের কোয়ার্টারটা দেখা যায়।এখন আপাতত ওটা ফাঁকা।কেউ নেই।দেশাই দেখলেন ওটার প্রায় সবকটা রুমে কোন না কোন কার্টুন চরিত্র আঁকা এবং রঙ করা।খালি সামনের ঘরের দেওয়ালে আঁকা মিনি মাউস বেরঙীন।কেন শিল্পী কাজে অবহেলা করলেন সেটা দেশাই বুঝতে পারলেন না।দেখতে দেখতে দেশাই একটু ভাবুক হয়ে গেছিলেন।আর ঠিক তখনি ওদের দুজনকে চমকে দিয়ে ঝনঝন শব্দ করে কি যেন পড়ল।একটু খেয়াল করে বুঝলেন দীনেশের মাথার কাছে একটা দেওয়াল আলমারী আছে।সেখান থেকেই একটা কিছু পড়েছে।বিছানার তলায় উঁকি মেরে দেখলেন একটা স্টিলের গ্লাস।দেশাই গ্লাসটা উঠিয়ে আলমারীর তাকে রাখতে গিয়ে দেখলেন একটা কালো কাপড়ের ব্যাগ রয়েছে।ওটা খুলে দেখতে যাবেন কিন্তু তখনি দীনেশ বাধা দিল…স্যার ছেড়ে দিন।কি জানি কি….” “ধুর তোমরা আজকালকার ছেলে হয়ে এত ভীতু!”বলে একটানে ব্যাগের গলায় বাঁধা দড়িটা খুলে ফেললেন।ভেতরে হাত দিয়ে দেখেন বেশ কিছু পেতলের হাতা,চামচ,কড়াই বাটিথালা রাখা আছে।আর বেশ চকচকে সব।তাহলে যাঁরা সবে কোয়ার্টার ছেড়ে গেছেন তাঁরাই হয়তো ফেলে গেছেন!।দেশাই মনে মনে এটাই ভাবলেন।
সন্ধেবেলা দেশাই আর মিনা নিজেদের রুমে আড্ডা মারছিলেন।ওনাকে রেড্ডীর বাংলা বলার ঘটনাটা বলতেই সটান মনের ভুল বলে চালিয়ে দিলেন।দেশাইয়ের বেশ রাগ হল।।রাত্রেবেলায় মিনার ঘুম একটু গাঢ় হতেই উনি দরজা খুলে সিঁড়ার কাছাকাছি গেলেন।যদি আবার রেড্ডীর বাংলা কথা শোনা যায়!এবার শুনলে উনি রেকর্ড করবেন। কিন্তু কথা না শুনলেও একটা পায়ের শব্দ পেলেন।কেউ যেন সিঁড়ি দিয়ে নামছে।দেশাই বারান্দা থেকে দেখলেন রেড্ডী সিঁড়ি দিয়ে নেমেকোথাও যাচ্ছেন।খুব কৌতুহল হল।রাত পৌনে এগারোটা বাজে।উনি চললেন কোথায়?ওনার জায়গায় অন্য কেউ হলে দেশাই হয়তো সরাসরি জিজ্ঞেস করতেন।কিন্ন্তু ওনার যা মেজাজ! তবে এই লোকটাকে কেমন যেন রহস্যজনক লাগছে।দেশাই চুপচাপ ওঁর পিছু নিলেন।ওমা!এতো মাঠটা পেরিয়ে স্কুল বাড়ীটার দিকে যাচ্ছে আর সেদিকটা তো পুরো অন্ধকার এখন।কিন্তু রেড্ডী মাঠটা পেরোনোর আগেই ভেতরের একটা আলো জ্বলে উঠল।দেশাই পুরো ঘটনাটায় খুব ভয় পেলেন।তাহলে রেড্ডী কি সন্ত্রাসবাদী?তাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে কোন বড় ছক কষছে?না হলে ওই নির্জন স্কুলবাড়ীতে যাবেই বা কেন?আর ওরাই বা কারা যারা ওখানে আলো জ্বেলে বসেছিল?ব্যাপারটা খুব সহজ মনে হল না।
পরেরদিন সকাল।পুরো দমে কাজ চলছে।মিনা শিল্প নির্দেশক রাজেশের সাথে কোথায় কিরকম সেট ফেলবেন তার আলোচনায় ব্যস্ত।দেশাই সুযোগ খুঁজছেন মিনাকে ব্যাপারটা বলার কিন্তু ঠিক সময় পাচ্ছেন না।কিছুক্ষণ পর বাধ্য হয়ে উনি অর্ককেই ব্যাপারটা বললেন।অবাক কান্ড…সে খুব হাসল।“আতঙ্কবাদী?এখানে?স্যার কিছু স্থানীয় লেবার কাল বাড়ী ফিরতে পারেনি।ওরাই স্কুল বাড়ীতে কাল রাত কাটিয়েছে।রেড্ডী স্যার হয়তো ওদের কাছেই গেছলেন।হয়ত খাওয়া দাওয়া হয়েছে কিনা তাই জানতে…ভদ্রলোকের ওপরটা কড়া হলেও ভেতরটা খুব নরম।“ “দেশাই তো অবাক হয়ে গেলেন ওর কথা শুনেবাবাহ!অর্ক তো অনেক খবর রাখে টিমের!অবশ্য ও বেশ কিছুদিন আগে থেকেই টিমের সাথে আছে।।সেদিন সারাদিন কাজের পর সন্ধেবেলা যে যার মতোন বিশ্রাম নিচ্ছিল।কিন্তু খুব জরুরী একটা কাজে মিনা অর্ককে নিয়ে বাইরে গেছিলেন।ফিল্মের জন্য একটা বাতিল ট্যাঙ্কার লাগবে।তার যোগাড় করতে উনি অর্ককে নিয়ে সামনের আর্মি ক্যাম্পে গেছিলেন।ারো দু চারটে কাজ একেবারে সেরেই ফিরবে ওরা।আজ অবশ্য দীনেশের পা বেশ কিছুটা ঠিক হয়ে গেছে। রুমে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে দেশাই ল্যাপটপ খুলে লিখতে বসলেন।বেশ কিছুটা লেখার পর হাই উঠতে লাগল ওনার ।ল্যাপটপ বন্ধ করে এদিক ওদিক ঘাড় ঘোড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ নজরে পড়ল স্কুলবাড়ীতে আলো জ্বলছে।কি ব্যাপার?ওখানে কারা?দেশাই ঘড়ি দেখলেন।সবে সন্ধ্যে সাতটা বাজছে।একবার গিয়ে দেখবেন নাকি?দেশাই নিজের কৌতুহলকে বাগ মানাতে পারলেন না।মিনার ফিরতে এখনো দেরি আছে।উনি টর্চ আর মোবাইল নিয়ে ওদিকে রওনা দিলেন।স্কুল গেটের কাছাকাছি এসে একবার মনে হল ফিরে যাই কিন্তু ওনার কৌতুহলই জয়ী হল।গেট খুলে ভেতরে ঢুকলেন।যে রুম থেকে আলো আসছিল তার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কড়া নাড়লেন।সঙ্গেসঙ্গে দরজা খুলে গেল।আসুন স্যার আসুন,দেশাইকে ওরা অভ্যর্থনা জানাল।ওরা মানে স্থানীয় লেবারদের গ্রুপটা।আমি জানতাম আপনি আসবেন।আপনার গল্পের প্লট চাই তো!রমেন বলে উঠল।তুমি কি করে জানলে?দেশাই একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।আরে স্যার আপনার নাম কে না জানে!আপনার কাজই তো গল্প তৈরী করা …..তাই না!আসুন আসুন….ভেতরে।রমেন সাদরে দেশাইকে ভেতরে নিয়ে গেল।ভেতরে ঢুকে দেখলেন একটা বড় ঘরে সাতজন বসে আছে।সবাইকে চিনতে পারলেন না।ওরা মাদুর পেতে বসেছে।সামনে একটা চেয়ার ।সেখানে দেশাই বসলেন।”তোমরা বাড়ী যাওনি?””না স্যার আমাদের যাওয়ার রাস্তায় খুব জ্যাম লেগেছিল।তাই আর যাইনি।আবার তো সকালে আসতে হবে।”দেশাই লক্ষ্য করলেন দেওয়ালের দিকে বসে দুজন একটা টেলিগ্রাফ পেপার নিয়ে কি যেন করছে।ওরা কি করছে?উনি রমেনকে জিজ্ঞেস করলেন।”ও…..ও তো সমীর আর মলয়ের নেশা।ওরা ক্রশওয়ার্ড পাজল সল্ভ করছে।”দেশাই বেশ চমকে গেলেন।এরা ইংলিশ পেপারের পাজল সল্ভ করতে পারে?অবশ্য দেশে চাকরির যা অবস্থা!কিছুক্ষণ এলোমেলো কথাবার্তার পর রমেন বলে উঠল,”চলুন স্যার আপনাকে আমাদের স্কুলটা ঘুরে দেখাই।”রমেনের কথায় দেশাই এর ভাবনায় ছেদ পড়ে।”এই অন্ধকারে এই ভাঙা জায়গায় কি ঘুরব ?””কাল সকালে বরং দেখব।না স্যার সকালে তো একদম সময় থাকে না…..এখনই চলুন।”রমেন বেশ জোর দিয়েই বলল।আমরা সবাই এখানেই পড়েছি।দেশাই আর না করতে পারলেন না।ওই ঘরটা থেকে বেরিয়ে দেখলেন রমেন টর্চ নিয়ে দাঁড়িয়ে।ওর পেছন পেছন অন্ধকার কড়িডর দিয়ে দেশাই হাঁটতে লাগলেন।ওনার নিজের চিন্তাভাবনার ওপর আর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।কড়িডরের একপাশে ক্লাসরুম।যার কোনটাই আস্ত নেই।তিন চারটে ক্লাসরুম পেরোনোর পর একটা রুমের সামনে দাঁড়ালো রমেন।এটাও অন্ধকার।চেয়ার টেবিল ভেঙে গেছে।একটা দেওয়ালের দিকে রমেন আলো ফেলল।স্যর দেখুন আমাদের গ্রুপ ফটো।মাঝে আমাদের ক্লাস টিচার বসু স্যার।দেশাই দেখলেন এখনকার দলের মধ্যে বেশ ছ -সাতজনকে চেনা যাচ্ছে।তোমরা কলেজেও পড়েছ নাকি?না সেটা আর হয়নি।রমেন ম্লান হেসে বলল,চলুন ফিরে যাই।রাত হয়েছে।আপনিও রুমে ফিরুন।দুজনে আবার ওই বড় ঘরটায় ফিরলেন।মলয় বলল ,”স্যরকে একটু প্রসাদ দে।আসলে আমরা আজ বিকেল ওই মন্দিরে গেছিলাম।একটু মিষ্টি আছে।আপনিও নিয়ে যান।বলে দুটো সন্দেশ এগিয়ে দিল।””নেব কিসে?”দেশাই বলে উঠলেন।ওরা টেলিগ্রাফের সামনের পাতাটা দিয়ে সন্দেশ দুটো মুড়ে দেশাইকে এগিয়ে দিল।রমেন হাতে টর্চ নিয়ে ওনাকে রুম অবধি পৌঁছেও দিয়ে এল।দেশাইয়ের মনে এতক্ষণ অনেক প্রশ্ন ঘুরছিল কিন্তু এখন মনটা বেশ হাল্কা লাগছে।ছেলে গুলো বেশ ভালো মনের।রুমে পৌঁছে দেখলেন মিনা ফিরে এসেছেন এবং নিজের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছেন।দেশাই নিজের ঘরে লাইট জ্বেলে সন্দেশটা মুখে দিলেন।অন্যটা কাগজে মুড়েই একটা বাটিতে রাখলেন।তারপর ল্যাপটপ খুলে লিখতে বসলেন।দশটা নাগাদ মিনা হাঁক পাড়লেন।ঐসো খেয়ে নাও।আজ একেবারে খাবার নিয়ে ঢুকেছি।সারাধিন যা দৌড়ঝাপ গেল!অর্ককেও তাই জলদি ছেড়ে দিলাম আজ।না,না ভালো করেছ,তুমি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ো।দেশাই বলে উঠলেন।তারপর পরোটা আর আলুর দম দিয়ে ডিনার সেরে যে যার রুমে আবার ঢুকে পড়লেন। রাত এগারোটা নাগাদ ল্যাপটপ অফ করে দেশাই শুয়ে পড়লেন।কিন্তু কেন কে জানে ঘুম এল না।কেমন একটা অস্বস্তি হতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর।রাত সাড়ে এগারোটা হবে ।ওনার নাকে বেশ একটা সুগন্ধ ভেসে এলো।ভাজা মসলার মতো।যে গন্ধটা আজ উনি আলুরদমেও পেয়েছেন।কেউ কিছু রান্না করছে কি?কিন্তু এখানকার সব খাবার তো বাইরে থেকে আসে।অর্ক নিয়ে আসে।গন্ধটা যেন দেশাইকে বিছানায় থাকতে দিল না।তিনি উঠে পড়লেন।বাইরে বেরিয়ে দেখেন গন্ধটা ওপর থেকে আসছে।মানে যেখানে রেড্ডী থাকে।ওনার পাশের কোয়াটার্টায় থাকে রাকেশ।এক নতুন শিল্প নির্দেশক ।দেশাই আর কিছু ভাবলেন না।সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলেন।ঘরে ঢুকে দেখেন সামনের ঘরে কেউ নেই।কিন্তু রান্না ঘর থেকে কথাবার্তার আওয়াজ আসছে।ওদিকে যেতেই দেশাইয়ের হার্টফেল হবার যোগাড়!দেখেন রেড্ডী একটা কড়াই আর খুন্তি নিয়ে কিছু করছে, রাকেশ সব্জী কাটছেন আর ওনাদের দুজনকে নানা রকম নির্দেশ দিচ্ছেন মিনা!আর হ্যাঁ কথাবার্তা হচ্ছে পরিষ্কার বাংলায়।এছাড়াও দেশাই চিনতে পারলেন যে গতকাল দীনেশের রুমে দেখা হাতা খুন্তি কড়াইগুলোই এখন রান্নায় ব্যবহৃত হচ্ছে।দেশাইয়ের পুরো শরীর কাঁপতে লাগল।এও সম্ভব!মিনা তো তার পাশের রুমেই শুয়ে ছিলেন?সে এখানে কি করে এল?ওর পায়ের আওয়াজে বাকি তিনজন ঘাড় ঘোরাল।ওদের চোখের ভাষা কেমন যেন অন্য ধরনের।“কি ব্যাপার স্যার!ভয়ে পেয়েছেন নাকি?”রেড্ডী প্রশ্নটা ছুঁড়লেন।এবার হিন্দী।কিন্তু ভাঙা ভাঙা।আর রেড্ডী স্যার বলছে কেন তাকে?ভাবতে ভাবতেই মিনা বলে উঠলেন,” রেড্ডী কেমন রান্না করছে দেখুন!আপনি কেমন সুরসুর করে উঠে এলেন।“মিনা তাঁকে আপনি আজ্ঞে করছেন!এদের হল কি? ”আ-আপনারা কি করছেন?”কোনরকমে দেশাই জিজ্ঞেস করলেন।“ওমা রান্না করছি,এতগুলো লোক খাবে কি?” রেড্ডী বলল।দেশাই খেয়াল করলেন ঘরের এক কোণে বেশ বড় গামলা,ডেকচি,ডালের বালতি,বড় হাঁড়ি সব সাজিয়ে রাখা। হঠাৎ একটা জোর হাওয়াতে রান্নাঘর লাগোয়া ডাইনিংরুমের জানলাটা খুলে গেল।আর সেটা দিয়ে দেশাই স্পষ্ট দেখতে পেলেন পাশের কোয়ার্টারের দেওয়ালে আঁকা বেরঙীন কার্টুনগুলি এখন রঙীন হয়ে উঠছে।আর তাতে রঙ ভরছে দীনেশ আর মনীশ! দেশাইয়ের অবশিষ্ট বুদ্ধি তাকে বলল কারো সাহায্য লাগবে।কোনরকমে অর্ককে ফোন লাগালেন।প্লিজ,তুমি এখোনি এসো।“অর্ক যে খুব দূরে থাকেনা সেটা দেশাই জানতেন।আর ওর যে বাইক আছে, সেটাও।ফোনটা করেই কোনরকমে দেশাই সিঁড়ি দিয়ে নেমেই রূমে ঢুকে পড়লেন।কিন্তু ঢুকে যা দেখলেন তাতে আতঙ্কে ছিটকে গেলেন।য টেলিগ্রাফটা ওরা দিয়েছিল সন্দেশ আনার জন্য সেটা দেশাইয়ের বিছানায় পড়ে আছে।আর তার প্রথম পাতায় পাঁচ কিশোরের আত্মহত্যার ছবি সহ খবর।তারিখ ২৹২০ সালের ৫ই জুন।তারা সবাই ওই স্কুলেই পড়ত যেখান থেকে দেশাই এইমাত্র ঘুরে এসেছেন।২৹১৮ সালে তারা তখন ক্লাস টুয়েল্ভ।তাদের বাবাদের কারখানা বন্ধ হওয়ার সময় রাজ্য সরকার স্কুলের দায়িত্ব নেবে সেরকম কথাই দিয়েছিল।কিন্তু নেয়নি।তাই ২৹১৮ তে স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। টুয়েলভের ছাত্রদের কোন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলই ভর্তি নিতে রাজি হয়নি।দু একটি নতুন স্কুল রাজি হয় কিন্তু অনেক টাকা ডোনেশন চায়।সেটা এরা দিতে পারে না।বাধ্য হয়ে সরকারি বাংলা মিডিয়মেই ঢুকতে হয়।এক ক্লাস নীচে।কোর্স আলাদা,মাধ্যমও আলাদা।ওরা পাল্লা দিতে পারেনি।টুয়েল্ভে ফেল করে।সেই সঙ্গে ঘরছাড়াও হতে হয়।এত চাপ ওরা নিতে পারেনি।এই সমস্ত খবর দেশাই ওই কাগজের প্রতিবেদন থেকে জানলেন।আর ছবিটি দেখে ওনার বুঝতে অসুবিধা হল না যে একটু আগেই তিনি ওই কিশোরদের সাথে গল্প করে ফিরেছেন।যাদের এখন যুবক হওয়ার কথা।দেশাই রুম থেকে প্রায় ছুটে বারান্দায় গেলেন। ওখানে দাঁড়িয়ে একমনে ঈশ্বরকে ডাকতে লাগলেন।এভাবে কতক্ষণ কাটল খেয়াল নেই।তারপর দেখলেন স্কুলের গেট থেকে ওদের দলটা বেড়িয়ে এল।এসে অন্ধকারে কিভাবে মিলিয়ে গেল দেশাই বুঝতে পারলেন না।ঘোর কাটল বাইকের আওয়াজে।যাক!অর্ক এসে গেছে।“তুমি এলে?”মরণাপন্ন রোগী যেমন ডাক্তারের কাছে মিনতি জানায় তেমনি ভাবে দেশাই বলে উঠলেন।“কি হয়েছে বলুন তো!” দেশাই জটপাকানো অবস্থায় কোনরকমে পুরোটা বললেন।“এতো বিশ্বাস করা কঠিন স্যার?”দেশাই প্রায় কেঁদে ফেললেন।“অর্ক আমি তোমার থেকে প্রায় তিরিশ বছরের বড়।তোমার মনে হয় এত রাতে কোন প্র্যাঙ্ক করার জন্য আমি তোমায় ডেকে এনেছি?” “না স্যার,আমি ঠিক সেটা বলতে চাইনি”….অর্ক আমতা আমতা করে।“আপনি কি কোন ওষুধ খান যার জন্য হ্যালুসিনেশন হয়?” “নাহ…আমি পাতি একটা প্রেশারের ওষুধ ছাড়া আর কিছু খাই না।আর এই ওষুধটা আমি ছবছর ধরে খেয়ে আসছি।“ উত্তেজনায় দেশাইয়ের গলা কাঁপতে লাগল।অর্ক বুঝল ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে।“আচ্ছা স্যার, কুল, কুল।আপনি আপনার ব্যাগটা নিয়ে আসুন,আপনি আমার বাড়ী চলুন।“কোনরকমে রুম থেকে নিজের ট্রলিটা বার করে অর্কর বাইকে চেপে বসলেন দেশাই।মিনিট কুড়ির মধ্যেই একটা একতলা বাড়ীর সামনে এলেন তারা।বাড়িটা কিন্তু মূল শহরের মধ্যে।কিন্তু অন্ধকার।“আসুন স্যার ,ভেতরে আসুন।ভয় নেই এখানে কেউ আপনার কোন ক্ষতি করবে না।“ দুজনে মিলে ঘরে ঢুকলেন।বেশ গোছানো ঘর।“আমার মা বাবা এখন ব্যাংগালোর গেছে,আমার দাদার কাছে।তাই আমি একাই আছি।।আপনি কিছু খাবেন?একটু জল-মিষ্টি?”দেশাই এতক্ষণে অনুভব করলেন তাঁর ক্ষিদে পেয়েছে।তিনি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন।তারপর দুটো মিষ্টি খেয়ে জল খেয়ে একটু ধাতস্ত হলেন।“তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার মুম্বাই যাবার টিকিট কেটে দাও।আর এখানে নয়।“ “হুম সে তো দেওয়া যায়।কিন্তু ওদের হল কি সেটাও তো জানতে হবে।নাহলে মুম্বই ফিরে আপনি কি জবাবদিহি করবেন?”তাও ঠিক।বললেন দেশাই।“ঠিক আছে।আপাতত একটু বিশ্রাম নিন।আমি ভাবছি কি করা যায়।“বলে অর্ক অন্য বেডরূমে ঢুকে গেল।দেশাইয়ের শরীর আর দিচ্ছিল না।তিনিও শুয়ে পড়লেন এবং ঘুমিয়েও পড়লেন।
কিছুক্ষণ পর অর্ক এসে দেশাইয়ের ঘুম ভাঙালো।“চলুন স্যার, দেখে আসি ব্যাপারটা কি!” “কোথায় যাবো!”দেশাই আঁতকে উঠলেন।“আরে কলোনিতে না গেলে কি করে রহস্য উদ্ধার হবে?আপানার সঙ্গীরাও তো বিপদে আছে তাই না!দেশাই ঘড়ি দেখলেন….পাঁচটা বাজে।এখনো ভোরের আলো ফোটেনি ভালো করে।তিনি ভাবলেন যা শুনেছেন সেই অনুযায়ী অশরীরিরা দিনের আলোয় থাকে না।আর সাথে তো অর্ক আছে।একটু সাহস পেলেন।তাঁরো তো কৌতুহল আছে ব্যাপারটা ঠিক কি ঘটছে বোঝার।“চল তাহলে”….দুজনে আবার বেরোলেন।গেস্ট হাউস,কোয়ার্টার কোথাও কাউকে পেলেন না।”ওরা কোথায়?”দেশাই প্রায় আর্তনাদ করে উঠলে!চলুন তো স্কুলটা দেখে আসি।”আবার স্কুল?”দেশাই আঁতকে উঠলেন।”আরে চলুন না!আমি আছি তো,”অর্ক ধমক দিয়ে বলল।গেট খুলে ঢুকে ভিতর থেকে গলার আওয়াজ পেলেন।দুজনে গিয়ে দরজা একটু ঠেলতেই পাল্লা খুলে গেল।সামনে চার পাঁচজন ভদ্রলোক বসে।আইয়ে আইয়ে বলে তারা ওদের ঢুকতে বলল ।সামনের পাঁচজন দেশাইয়ের পরিচিত কিন্তু চেহারা ছাড়া আর কোন মিল তিনি পাচ্ছেন না।অবাক কান্ড,তার কিন্তু আর অতটা ভয়ও লাগছেনা।“আরে স্যার আমারা খুব দু:খিত আপনাকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার জন্য।কিন্তু এছাড়া আর কোন রাস্তা ছিলনা।“রেড্ডী বলে উঠলেন ।ভাঙা হিন্দীতে।“আপনি কে?”নিজের অজান্তেই প্রশ্নটা বেরিয়ে এলো দেশাইয়ের মুখ থেকে।“এহে খুব স্যরি।নিজের পরিচয়টাই দেওয়া হয়নি।আমি বাদল মুখার্জী।দীর্ঘ ত্রিশ বছর এই আবাসনে ছিলাম।তারপর কারখানা বন্ধ হল।অনেক আলোচনা চলল।শুনলাম আমাদের মাথার ছাদটুকু নাকি রক্ষা পাবে।স্বল্প মূল্যে আমাদেরকেই বিক্রী করা হবে।বছর এল, বছর গেল,দল বদলালো,কিন্তু ভাগ্য বদলালো না।জানেন,আমি না খুব বাগান করতে ভালোবাসতাম।অনেক সব্জী লাগিয়েছিলাম বাগানে।সে সব দিয়ে রান্না করে বন্ধুবান্ধবদের খাওয়াতাম……কিন্তু সব ছেড়ে চলে যেতে হল।সরাসরি তাড়িয়ে না দিলেও জল,বিদ্যুৎ সব বন্ধ করে দিল।আর কি থাকা যায়? শিকড় উপড়ে ফেলে অন্য জায়গায় যেতে হল….এককামরার ঘর,একটা ছোট্ট রান্নাঘর আর বাথরুম।বাড়ীর আশেপাশে এক ফালি জায়গা নেই যে দুটো গাছ লাগাবো।একটা পরিচিত মানুষ নেই।নিজের বাড়ী করার মতো পকেটে জোর নেই।ডিপ্রশেনে চলে গেলাম।ছেলেমেয়ে দুটো দাঁড়ায় নিই।দমবন্ধ হয়ে আসত।তারপর একদিন………..হার্টটা আর চাপ নিতে পারল না।”অল্প হেসে বাদল মুখার্জী থামলেন।ওপরের দিকে তাকালেন। “তবে এতদিন আপনাদের টিমের জন্য রান্নাবান্না করতে ভালোই লেগেছে।“কিসব বকছে লোকটা!দেশাইয়ের মাথাটা কেমন যেন ঘুরে গেল।“ওকি স্যার…ঘাবড়াবেন না।আমরা আপনার কোন ক্ষতি করব না।“ দীনেশ বলে উঠল।কিন্তু গলা ওর নয়।গলাটি এক তরুণীর। সে বলতে শুরু করল“ আমার নাম বিশাখা আর ও দেবরাজ….মনীশের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল।আমরা যমজ ভাইবোন। ““আমি চেয়েছিলাম পেন্টার হতে আর ভাই প্রফেসার ।আঁকতাম ছোটবেলা থেকেই।কিন্তু মাথার ওপর ছাদটা হঠাৎ চলে গেল।ভাড়াবাড়ীতে উঠলাম।নানা বিধিনিষেধ।বাবা বলে দিল,”যে কোন একজনকেই পড়াতে পারবে।“আর আমার বিয়ের কথাবার্তা চলতে লাগল।বিয়েটা হয়েও গেল। না না,যাকে চেয়েছিলাম তার সাথে নয়…ওর তো তখন এম.এস.সি ফাইনাল চলছে।রং তুলি ছেড়ে হাতা খুন্তি ধরতে পারলাম না….ওকে ছেড়ে অন্য কারো হাত ধরতেও পারলাম না।কেউ বুঝতে চেষ্টা করল না।তাই….. খবরটা পাবার দুসপ্তাহের মধ্যে দেবরাজ এ্যাক্সিডেন্টে…..অবশ্য অমন পাগলের মতন বাইক চালালে ওইরকমই তো হবে!ও ধরেই নিয়েছিল আমার মৃত্যুর জন্য ওই দায়ী।“ “দেশাই ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন।“তা-তাহলে ওই পেন্টিংটা আপনার করা।কিন্তু ওটা শেষ করলেন কিভাবে?”বিশাখা মুচকি হেসে বলল,”এখন তো আমি মুক্ত,কোন বিধি নিষেধ নেই।“ দেশাই তখন কাঁপতে শুরু করেছেন।“আরে স্যার ঘাবড়াবেন না।আপনার কোন ক্ষতি আমরা করব না।আপনাকে আমাদের হয়ে শুধু একটা কাজ করে দিতে হবে।“রাকেশ বলে উঠল।“কি কাজ?” “আমাদের এই বঞ্চনার কাহিনী সিনেমায় তুলে ধরতে হবে।মানুষ জানুক আমরা কি পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি।আমাদের মতন আরো অনেকের তথ্য আমরাই আপনাকে দেব যাতে এরকম কারো আর না হয়।সবাই হয়তো মরেনি কিন্তু অনেকেই মরে বেঁচে আছে। আর হ্যাঁ এটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করতে হবে।“ “আ-আমি পারব না।“দেশাইয়ের গলা কেঁপে গেল।“প্লিজ আমায় ছেড়ে দিন।“ “সরি স্যার আপনাকে এত সহজে ছাড়তে পারব না।আপনার সহকর্মীদেরো নয়।চুপচাপ রাজী হয়ে যান।এত বানিয়ে গল্প লেখেন আর কিছু সত্যি ঘটনা থেকে একটা গল্প লিখতে পারবেন না?আর হ্যাঁ মনে রাখবেন এখানে কোন শুটিং হতে আমরা দেবনা।শুধু আমাদের গল্পের শুটিং ছাড়া।“ বাদল মুখার্জী বেশ কড়াভাবেই কথাগুলো বললেন।“ বেশ তাহলে আমায় অন্তত দুমাস সময় দিন।“দেশাই বলে উঠলেন।“ঠিক আছে,তাই হোক।“ “ওরা কোথায়?”দেশাই জিজ্ঞেস করলেন।“ওরা এই স্কুলের হলঘরে।ওদের গত তিনদিনের কথা কিচ্ছু মনে থাকবেনা।আপনি যান।“দেশাই টলতে টলতে স্কুলের হল ঘরে ঢুকলেন।দেখলেন তাঁর পাঁচ সঙ্গী অচেতন হয়ে পড়ে আছে।
“স্যার,”অর্ক পেছন থেকে ডাকল।এতক্ষণ দেশাই প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন ওর কথা।“আমি সব ব্যবস্থা করে এসেছি।এদের নামে একটা পুজো দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।চলুন আমরা যাই।“ “চল,চল” বলে দেশাই তাড়াতাড়ি বাইরে চলে এলেন।আধো অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে গিয়ে একটা বন্ধ বাজারের সামনে তাঁরা পৌঁছালেন।বাজারের একপাশে একটা মন্দির।তখনো খোলেনি।“স্যার আপনি এখানে একটু অপেক্ষা করুন।আমি একটা জরুরী কাজ সেরে আসছি।”অর্ক বাইক নিয়ে দৌড়ালো।এদিকে মিনিট পনেরো অপেক্ষার পুরোহিত এলেন।দেশাই টিমের সবার মঙ্গলকামনায় পুজো দিলেন।।প্রায় ঘন্টা দেড়েক পর দেশাই মোবাইলে একটা মেসেজ পেলেন।“স্যার,আপনি নিশ্চিন্তে রুমে যান।আমি একটু পরে এসে যোগাযোগ করছি।“দেশাই বাজারের স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো একটা টোটো ধরে রুমে ফিরে গেলেন। গিয়ে দেখেন দরজা লাগানো।কিন্তু তালা নেই।একটু ঠেলতেই খুলে গেল।ঢুকে দেখেন মিনা তাঁর চেয়ারে বসে খোশমেজাজে চা খাচ্ছেন।“আরে সকাল সকাল কোথায় গেছিলে?” “ওই একটু হেঁটে এলাম।“দেশাই ততক্ষণে ভেবে নিয়েছেন কিভাবে এখান থেকে বেরোবেন।তিনি সটান মিনাকে বললেন,”আমি আজ বিকেলের ফ্লাইটে মুম্বই ফিরছি।আমার দিদি খুব অসুস্থ“।
বিকেলবেলা চারটে কুড়িতে ফ্লাইট। ঠিক দুটো নাগাদ অর্ক এল।এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেশাই অর্ককে অনেক ধন্যবাদ জানালেন।“তুমি আমার যা উপকার করেছ!তুমি খুব তাড়াতাড়ি মুম্বই চলে আসো।আমি কথা দিচ্ছি ভালরকমের কোন চাকরীর ব্যবস্থা আমি করে দেব।“সে আপনার ভালোবাসা স্যার, অভ্র একটু হেসেই বলল।“আপনি সাবধানে যাবেন।আর এটা নিন।“”কি এটা?আপনার জন্য ছোট্ট একটা উপহার।আমার তরফ থেকে।“ ব্রাউন পেপারে মোড়া একটা চৌকো মতো বস্তু ও দেশাইয়ের হাতে তুলে দিল।।অনেক ধন্যবাদ!বলে দেশাই প্লেনে উঠলেন।নিজের সিটে বসে কাগজের মোড়কটা খুললেন।একটা ফটো।ফ্রেমে আটকানো।এক তরুণ-তরুণীর।একে অপরের হাত ধরে আছে।মুখে অল্প হাসি।নিচে লেখা- অর্ক মুখার্জী আর বিদিশা গাঙ্গুলি।।২000-২0২0।দেশাইয়ের গলা দিয়ে একটা চাপা আর্তনাদ বেড়িয়ে এল।পাশের সিটের ভদ্রলোক অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন।মোড়কটার মধ্যে একটা চিঠিও ছিল।তাতে লেখা-আমাদের শেষ ছবি ।বিদিশার বাবা ছাদ হারাবার ধাক্কা নিতে পারেননি।ওনার ম্যাসিভ এটাক হয়।আপনি ওনাকে মিনা হিসেবে দেখেছেন।যাই হোক,ওর মামাবাড়ীর লোক তার তিন মাসের মাথায় ওর বিয়ের ঠিক করে।সেই ধাক্কাটা আমরা নিতে পারিনি।একসপ্তাহ আগে আমরা দুজনে ওই স্কুল বাড়ীটার ছাদ থেকে….. ।আসলে আমাদের গল্পটা তো স্কুল থেকেই শুরু হয়েছিল তাই স্কুলেই শেষ করলাম।আমার মা বাবা তারপর থেকে দাদার কাছে মুম্বইতেই আছেন।আজ দু বছর হয়ে গেল।কিন্তু আমি বা আমরা মুক্তি পেলাম না।কিছুতেই এই জায়গা ছেড়ে বেরোতে পারলাম না।তাই যখন খবর পেলাম আপনারা আসছেন তখন বুঝলাম এই সুযোগ কাজে লাগাতেই হবে।সেই মতো প্ল্যান করে হোটেলে ঝামেলা তৈরী করে আপনাকে এখানে নিয়ে এলাম।আমাদের সবার মুক্তি এখন আপনার হাতে।ভালো থাকবেন।বিদায়। আর হ্যাঁ,কাজটা সময়মতো করে দেবেন।বিদায়।“চিঠিটা শেষ করার পর দেশাইয়ের চেহারায় আর আতঙ্কের থাকল না। থাকল শুধু দুচোখে জল।