প্রচণ্ড জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। সঙ্গে ঝড়ের দাপট। ওরা যখন বেরিয়েছিল আকাশে মেঘের চিহ্নও ছিল না।
দাদু লাঠি ঠুক্ ঠুক্ করে এসে একটা বড়ো গামলায় চানাচুর, আমতেল দিয়ে মাখা মুড়ি দিয়ে গেল,”এগুলো খাও দাদাবাবুরা পরে চা আনছি। “
ঝন্টু, তপা,বুকুন আর বাবলু এসেছে ঝাড়গ্রাম বেড়াতে। ঝাড়গ্রামে এক দোকানদারের কাছে শুনে এই চিল্কিগড় রাজবাড়ি দেখতে এসেছিল। ঝাড়গ্রাম থেকে চিল্কিগড়ের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। ওই দোকানদার বলেছিল, “দুপুরে খেয়েদেয়ে বেরোলে সব দেখে রাতের মধ্যে ফিরে আসতে পারবেন। আর ওখানে দেখার মত আছে ডুলুং নদীতীরে কনক দুর্গা মন্দির আর রাজবাড়ি। চলে যান। ভালো লাগবে।”
ওদের গাড়িটা যখন কনকদুর্গা মন্দিরের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল একটু যেন গা ছমছম করছিল বুকুনের। চারিদিকে ঘন জঙ্গল। কতসব লতানো গাছ। কত নাম না জানা ফুল ফুটে আছে। বুকুন একটু ভয়ে ভয়েই বলল, “এই জঙ্গলে যদি কাউকে গুম করে দেয় কারো বাবার সাধ্যি নেই খুঁজে পাবে। আমার একটু ভয় ভয়ই করছে রে।”
বুকুনের কথা শুনে ওরা তিন বন্ধু হো হো করে হেসে উঠেছিল। তপা বলেছিল, “কী সুন্দর এডভেঞ্চারাস জঙ্গল বল তো। এনজয় কর বুকুন।”
ওরা মন্দিরে ঢুকে প্রণাম করল। দুর্গা মূর্তিটা খুব বড়ো নয়। মন্দিরের পুরোহিত তাড়াহুড়ো করে পুজো করছিলেন। কারণ সন্ধ্যের পর এখানে নাকি কেউ থাকে না। তখনও দিনের আলো গাছের ফাঁক থেকে উঁকি মারছিল। পুরোহিতের কাছ থেকে ওরা জানতে পারল, অনেক অনেক বছর আগে এই জঙ্গলে ডাকাতরা বাস করত। ওরাই এই মন্দির তৈরি করে সোনার দুর্গা প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু এখন এই মূর্তিটা অষ্টধাতুর তৈরি। সোনার মূর্তিটা অনেক বছর আগেই চুরি হয়ে গেছে। আগে নাকি এখানে নরবলিও হত। এখন হয় না। তবে এখন প্রত্যেক বছর দুর্গা নবমীতে পাঠা আর নিরানব্বইটা মোষ বলি হয়। নাটমন্দির চত্বরটা ভেসে যায় রক্তে। সেই রক্ত গড়িয়ে ডুলুং নদীতে মেশে।
সব শুনে বাবলু বলেছিল, “একবার নবমীর দিন আসবো এখানে। “
কনকদুর্গা দেখে ওরা যখন রাজবাড়িতে পা রাখল তখনই আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। তার সাথে বাতাসের দাপট। বুকুন বলেছিল, “চল ফিরে যাই, রাজবাড়ি দেখতে হবে না। “
বাবলু বলেছিল, “তোর এত চিন্তা কিসের? সঙ্গে তো গাড়ি আছে। দেখেই যাবো। আবার কবে আসতে পারবো জানি না।” তপা ও ঝন্টু সাপোর্ট করেছিল বাবলুকে। বুকুন আর কী করে। ওদের সাথে ঢুকেছিল রাজবাড়িতে। রাজবাড়িতে ঢোকার পরই বজ্র বিদ্যুৎ সহ তুমুল বৃষ্টি আর সাথে ঝোড়ো হাওয়া। ওরা অপেক্ষা করছিল বৃষ্টিটা একটু কমলেই বেরিয়ে পড়বে। ঝাড়গ্রামের হোটেলে রাতে মটন কষা আর রুমালি রুটির অর্ডার দিয়ে এসেছিল ।
কিন্তু বৃষ্টি তো কিছুতেই থামতে চায় না। রাজবাড়ির কেয়ার টেকার বুড়ো দাদু লাঠি ঠুক্ ঠুক্ করে এসে বলেছিল, “আজ আর ফিরতে পারবে না দাদাবাবুরা৷ এত বৃষ্টিতে ডুলুং নদী ফুলে ফেপে উঠেছে। ব্রীজের উপর দিয়ে জল বইছে। এইসময় কোনো গাড়ি ব্রীজ পেরোতে গেলে নদী ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। তারথেকে বরং উপরের ঘরটা খুলে দিচ্ছি রাতটুকু কাটিয়ে যাও।”
আসার সময় বাবলুই গাড়ি চালাচ্ছিল। যদিও গাড়িটা ঝন্টু কিনেছে। গাড়ি কিনে প্রথমেই ওরা এখানে বেড়াতে এসেছে। বাবলু আসার সময় দেখেছে ডুলুং নদীর ব্রীজটা খুব নিচু। বড় রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা ঢালুতে নামতে হয় ব্রীজ পার হওয়ার জন্য। আর এত বৃষ্টিতে যে ব্রীজের উপর দিয়ে জল বইবে সেটা বাবলু বুঝেছিল। তাছাড়া ডুলুং নদীটা ছোটো হলেও প্রচণ্ড কারেন্ট জলে।
দাদু আবার বলল,
“এই ঝড়বৃষ্টির রাতে তোমাদের জন্য অন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করতে পারবো না। আমার ঘরে মুড়ি আছে তাই খেতে হবে। “
বাবলু একমুঠো মুড়ি মুখে ফেলে বলল, “হায়রে, কোথায় মাটন কষা দিয়ে রুমালি রুটি খাবো তা না এখানে বসে মুড়ি চিবাতে হচ্ছে।
নিজেদের মধ্যে টুকটাক গল্প করছিল ওরা। হঠাৎ যেন মনে হল দরজার বাইরে কে যেন আড়ি পেতে ওদের কথা শুনছে। দরজাটা ভেজান ছিল। বাবলু উঠে সটান দরজাটা খুলে একটু জোরের সাথেই বলল, ” কে? কে ওখানে? “
কিন্তু বারান্দার চল্লিশ ওয়াট বাল্বের হলুদ আলোতে কাউকেই দেখতে পেল না ও।
ওদের যে ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছে সেই ঘরটা বিরাট বড়ো। ঘরের ঠিক মাঝ বরাবর বিশাল একটা মেহগনি কাঠের খাট। দুটো বড়ো বড়ো জানালা। একপাশে একটা কাঠের টেবিল ও দুটো চেয়ার। খাটে কোনো বিছানা পাতা নেই। কেবল একটা বড়ো শতরঞ্জি পাতা। দাদু বলে গেছে আজ রাতটা এখানেই শুয়ে কাটাতে হবে। বারান্দার মত ঘরেও চল্লিশ ওয়াটের একটা বাল্ব ঝুলছে।
মুড়ির গামলা শেষ করে ঝন্টু বলল,”দূর,এভাবে থাকা যায়? তার চেয়ে চল বৃষ্টিটা একটু ধরলে আমরা চলে যাই। “
বুকুনও সায় দিল ঝন্টুর কথায়। কিন্তু বৃষ্টি কমার তো কোনো লক্ষনই নেই। এমন সময় দাদু আবার লাঠি ঠুক ঠুক করতে করতে ওদের ঘরে এলো। হাতে একটা জ্বলন্ত হেরিকেন। দাদু বলল, “শোনো বাবারা, তোমাদের জন্য আর চা আনতে পারলাম না। চা পাতা ফুরিয়ে গেছে।”
তারপর হাতের হেরিকেনটা মেঝেতে নামিয়ে বলল, “এত বৃষ্টিতে যে এখনো কারেন্ট আছে সে তোমাদের বাপের ভাগ্যি।যে কোন সময় পাওয়ার কাট হয়ে যেতে পারে। তাই হেরিকেনটা দিয়ে গেলাম।আর ঘরের দরজা ভালো করে দিয়ে শোবে। মাঝরাতে কেউ ডাকলেও খুলবে না। এমনকি আমিও যদি ডাকি তাও খুলবে না। সকালবেলা দেখা হবে। “
কথা ক’টা বলে আবার লাঠি ঠুক্ ঠুক্ করতে করতে বুড়ো চলে গেল।
বুড়ো চলে যেতেই ঝন্টু দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে এসে খাটে বসতে বসতে বলল, ” মালটা কী বলে গেল রে? আমাদের কী হালকা করে একটু ভয় দেখিয়ে গেল? “
বুকুুন বরাবরই একটু ভীতু প্রকৃতির। ও বলল,” ভয় দেখাবে কেন? হয়তো সত্যি কোনো প্রবলেম আছে তাই দরজা খুলতে বারণ করেছে। ” বুকুনের কথায়
সকলে হো হো করে হেসে উঠল।
বাবলু ঘড়ি দেখে বলল, “রাত সবে ন’টা। সারারাত কাটাবো কী করে বলতো। বোতলগুলোও হোটেলে। একটা যদি আনতাম। তপা একটু হেসে ওর কোমরে রাখা ব্যাগ থেকে ছোট্ট একটা পাইট বের করে বলল, ” ডোন্ট ওরি ফ্রেণ্ড। এক ঢোক করে সকলের হয়ে যাবে। ” বন্ধুরা দেখল তপা সাথে তিন চারটে ছোটো বাদামের প্যাকেটও বের করল ব্যাগ থেকে। চার বন্ধু যখন এক ঢোক করে খেয়ে মৌতাতে ব্যস্ত হঠাৎ বুকুন বলে ওঠে, “এই শুনছিস কেমন একটা গোঙানির আওয়াজ আসছে না? “
তপা বুকুনকে একটু ধমকে বলল,”তুই আবার শুরু করলি? “
বাবলু বলল, “হ্যাঁরে বুকুন, এই টুকুতেই আউট হয়ে গেলি। “
বুকুন নিজের কথার সমর্থনে বলল, “ভালো করে শোন। কেমন একটা শব্দ আসছে না? “
ঝন্টু বলল, “না রে। ঠিক বলেছে বুকুন। আমিও যেন দু’বার শুনলাম। বুকুনের কথার সত্যতা প্রমান করতে সকলে চুপ করে রইল। দেখা যাক গোঙানির আওয়াজ সকলে শুনতে পায় কিনা। প্রায় পাঁচ মিনিট চুপ করে থেকেও ওরা শুনতে পেল না। অথচ বুকুন একা নয়, ঝন্টুও দাবি করছে ও শুনেছে। বাবলু হেসে উড়িয়ে দিল ওদের কথা। আবার নিজেদের মধ্যে আড্ডা ইয়ার্কিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। বুকুন কিছু বলল না। পকেট থেকে মোবাইল বের করে গেম খেলতে গিয়ে দেখল চার্জ নেই। ওর কেন জানি ভালো লাগছে না। বাবলু ওর কথা হেসে উড়িয়ে দিল। অথচ ও স্পষ্ট শুনেছে একটা মেয়ের গলার গোঙানির আওয়াজ। ওরা ঠিক করল আজ রাতে কেউ ঘুমাবে না। তপা বলল, ” এত বৃষ্টি হচ্ছে তাও যেন গরম যাচ্ছে না। “
ওদের মাথার উপর ঢাউস একটা ফ্যান ঘুরছে ক্যাঁচ কোঁচ শব্দ করে। কিন্তু হাওয়া নেই তেমন। হঠাৎ বিশাল একটা শব্দ করে ফ্যানটা বন্ধ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা হলুদ বাল্বটাও নিভে গেল। বাবলু বলে উঠল, “যাঃ কারেন্ট গেল।”
তপা ঘরের কোণ থেকে জ্বলতে থাকা হেরিকেনটা খাটের একপাশে রাখল। ফ্যানের শব্দে এতক্ষণ শুনতে পাওয়া যায়নি বাইরের ঝড় জলের শব্দ। এখন ওরা শুনতে পাচ্ছে জানালার ওপারে প্রচণ্ড বেগে বৃষ্টির শব্দ। হাওয়ায় জানালাটাকে এমন ধাক্কা দিচ্ছে যে মনে হচ্ছে এক্ষুণি জানালাটা খুলে হুড়মুড়িয়ে ঝড় বৃষ্টি সব ঘরে ঢুকে যাবে। হেরিকেনের আলোয় ঘরে কেমন যেন একটা ভূতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ওদের মধ্যে যে সবচেয়ে সাহসী সেই বাবলুও যেন ভয় পেয়ে একটু গুটিয়ে গেছে। তপা বলল,”বৃষ্টি বোধহয় আজ আর কমবে না। এভাবে বসেই আমাদের সারাটা রাত কাটাতে হবে। আবার সেই গোঙানীর আওয়াজ। এবার বুকুন বা ঝন্টু নয়, চারজনই একসাথে শুনতে পেল একটা মেয়ের কান্নার শব্দ। ঠিক ওদের ঘরের সামনের বারান্দাটায়। দরজা খুললেই যেন ওরা সেই মেয়েটিকে দেখতে পাবে। বাবলু বলল,” সর তো দরজাটা খুলে দেখি কে কাঁদছে। ” বুকুন বাবলুর হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, “একদম না বাবলু। শুনলি না বুড়ো দাদু বার বার বারণ করে গেল দরজাটা খুলতে। ” বাবলু যেন বুকুনের কথা এবার হেসে উড়িয়ে দিতে পারল না। চুপ করে বসে রইল। কী জানি কোন বিপদের মুখে পড়ল ওরা। এদিকে রাত বাড়ছে। সাথে ঝড়ের দাপটও বাড়ছে। জানালায় এমন ঝাপটা মারছে যে মনে হচ্ছে এক্ষুণি খুলে যাবে। হঠাৎ হেরিকেনটা দপ্ দপ্ করতে করতে নিভে গেল।
বুকুন বলল, “যাঃ,তেল নেই বোধহয়। এবার কী হবে?” তপা ওর মোবাইলের টর্চটা জ্বালাতে গিয়ে দেখল মাত্র এইট পার্সেন্ট চার্জ আছে। বুকুন বাবলু ও ঝন্টুর মোবাইল অনেক আগেই চার্জ আউট হয়ে গেছে। তপা ওর মোবাইলে দেখল রাত দু’টো বাজে। এতক্ষণ ঝড়ের দাপট জানালায় হানা দিচ্ছিল এবার কে যেন ওদের দরজা ধাক্কা দিচ্ছে খুব জোরে জোরে। দরজায় তো ঝড়ের দাপট লাগবে না। কারণ ওদিকে তো সব বড়ো বড়ো ঘর। আর প্যাসেজটা একটা বড়ো বারান্দা। তবে কে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। যেন কেউ খুব বিপদে পড়ে মরিয়া হয়ে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। বাবলু বলল,”কে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে বলতো। যেন কেউ আমাদের ডাকছে।” এবার ঝন্টু বলল, “যেই ডাকুক একদম দরজা খুলবি না। দেখলি না বুড়ো দাদু কী বলে গেল। উনি নিজে এসে ডাকলেও যেন দরজা না খুলি।”
বুকুন একটা কথাও বলছে না। খুব ভয় পেয়েছে বেচারি। এমনিতেই একটু ভীতু ও তার উপর এমন পরিস্থিতি। শুধু বুকুন নয়, এই মূহুর্তে সকলেই ভয় পেয়েছে।
ওই যে আবার ধাক্কা দিচ্ছে দরজাটা। এবার শুধু ধাক্কা নয়, এক মহিলার কণ্ঠস্বরও শোনা যাচ্ছে, “একবার দরজাটা খোলো…… আমার খুব বিপদ…… আমার ছেলেটাকে বাঁচাও……আর দেরি করলে ওকে ওরা মেরে ফেলবে….. ছেলেটা ছাড়া যে আমার আর কেউ নেই। “
ওরা স্পষ্ট শুনল কথাগুলো। বাবলু বলল, “নিশ্চয় ওই মহিলা কোনো বিপদে পড়েছে। দাঁড়া, দেখি। “
এবার তপা বারণ করল, “একদম দরজা খুলবি না বাবলু। বুড়ো দাদু কিন্তু বার বার দরজা খুলতে বারণ করেছে। “
ওরা যখন সকলে একসাথে ঠিক করল, যেই ডাকুক না কেন দরজা ওরা খুলবে না। ঠিক তখনই হঠাৎই দরজাটা খুলে গেল আর একরাশ ঠাণ্ডা হাওয়া ওদের চোখে মুখে এসে লাগল। তপা ওর মোবাইলের টর্চটা জ্বালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হল। কারণ ওর মোবাইলের এইট পারসেন্ট চার্জও ফুরিয়ে গেছে। ওরা চারজন খাটে পা উঠিয়ে বসে ছিল। হঠাৎ টের পেল ঘরের মেঝেতে কার যেন উপস্থিতি। দরজাটা হাট করে খোলা। বাইরের চমকান বিদ্যুতে ওরা একঝলক দেখল ওদের ঘরের মেঝেতে একটা নারীর অবয়ব। ঝন্টু বলল, “কে তুমি? দরজাটা খুললে কীভাবে?”
মেয়েটি আবার কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতেই বলল,”আমার খুব বিপদ।”
হঠাৎ দরজা খুলে এভাবে মেয়েটি ঘরের ভিতর ঢুকে যাওয়াতে ওরা চারজনই বেশ ভয় পেল। বুকুন তো ভয়ে ঝন্টুর হাতটা চেপে ধরে আছে। ওদের মধ্যে বাবলুই একটু সাহসী। ও বলল,”আপনার কী বিপদ তা আমরা জানি না। আর আমরা এখানে নতুন আমরাই বিপদে পড়েছি, আমরা আপনাকে কীভাবে বিপদ থেকে উদ্ধার করবো? “
মেয়েটি তখনও কাঁদছে। ও যেন বাবলুর কথাগুলো শুনতেই পায়নি। ও কাঁদতে কাঁদতে নিজের কথাই বলে চলেছে। “আজ অমাবস্যা। ওরা আজ শেষরাতে আমার একমাত্র ছেলেকে বলি দেবে। টেনে হিঁচড়ে আমার কোল থেকে নিয়ে গেল ছেলেটাকে। তোমরা একবার চলো কনক দুর্গা মন্দিরে। ওখানেই বলির আয়োজন চলছে। হাতে একটুও সময় নেই। তোমরা গিয়ে দাঁড়ালে ওরা আমার ছেলেটাকে আর বলির হাড়িকাঠে চড়াতে পারবে না। চলো শিগ্গির।” বলেই মেয়েটি দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে যেতে বলতেই থাকল,”এ..সো….
জলদি এ…সো…। আমার ছেলেটাকে বাঁচাও….এসো….।
মেয়েটির কথায় যেন যাদু আছে। ওরা চারজনেই কেমন মন্ত্রমুগ্ধের মত মেয়েটির পেছন পেছন চলল। অমবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকারে ওরা কোথায় যাচ্ছে নিজেরাও জানে না। ওই তুমুল বৃষ্টিতে যখন আকাশ চিঁড়ে বিদ্যুতের রেখা এপাশ থেকে ওপাশে চলে যাচ্ছিল, সেই আলোতে একটা আবছায়া ছায়া মূর্তির পেছন পেছন নেশাগ্রস্থের মত চলেছে চারজন যুবক। ওরা রাজবাড়ির দালান পেরিয়ে যেই রাজবাড়ির ভাঙাচোরা সিংহদুয়ার পেরোতে যাবে হঠাৎ দারোয়ানের ঘর থেকে লাঠি ঠুক ঠুক করে বেরিয়ে এলো বুড়োদাদু। চিৎকার করে বলতে লাগল, “তুই আবার এসেছিস? আমি জানতাম আজ তুই আসবি।এতগুলো তরতাজা ছেলে দেখেছিস। এদের না মারতে পারলে তোর হচ্ছিল না তাই না? ” বুড়োদাদুর চিৎকার শুনে সেই নারীমূর্তি কান্না ছেড়ে হি হি করে হাসতে লাগল। তারপর কোথায় উধাও হয়ে গেল। ওর কান্নার শব্দও আর পাওয়া গেল না। ঠিক তখনই বাবলু ঝন্টুদের যেন হুঁশ ফিরল। বাবলু জিজ্ঞেস করল,” ওই মহিলা কে দাদু? ওর ছেলেকে নাকি কারা বলি দিতে নিয়ে গেছে।”
দাদু বলল, “বলছি, আগে তোমরা আমার ঘরে এসে বোসো। “
ওরা বুড়োদাদুর ঘরে ঢুকে দেখে কোথাও কোনো বসবার জায়গা নেই। কেবল মেঝেতে একটা রংচটা চাদর পাতা। এক কোণে কালি পড়া কাঁচ নিয়ে একটা হেরিকেন টিম টিম করে জ্বলছে। ওরা সেই ছেঁড়া চাদরে বসলে বুড়োদাদু বলতে আরম্ভ করল, ” শোনো তবে। অনেক বছর আগে এই জঙ্গলে ছিল ডাকাতদের বাস। ওই কনকদুর্গা মন্দিরটা আসলে ডাকাতদের ছিল। ওরা ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে কনকদুর্গা মন্দিরে পুজো দিয়ে যেত। আর প্রতি অমাবস্যায় ওই মন্দিরে হত নরবলি। যে মেয়েটি তোমাদের নিয়ে যাচ্ছিল ও আসলে একটা প্রেতাত্মা।অনেক বছর আগে ওর ছেলেকে ডাকাতরা বলি দিয়েছিল কনক দুর্গার সামনে। সেই শোকে ও গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিল। তারপর থেকে ও এখানেই ঘুরে বেড়ায়। আর প্রতিশোধ স্পৃহায় রাজবাড়িতে কোনো লোক এলে ও নিজের বিপদ বলে টেনে নিয়ে যায় মন্দির লাগোয়া জঙ্গলে। তারপর তাদের খোঁজ আর পাওয়া যায় না। এমন অনেকেই এখানে এসে আর ফিরে যায়নি। তবে ও এই গ্রামের কারোর কোনো ক্ষতি করে না। বহিরাগতদের সাথেই ও এমন করে। আমি জানতাম আজ ও আসবে। তাই তোমাদের দরজা খুলতে বারণ করেছিলাম। “
তপা বলল, “কিন্তু আমরা দরজা খুলিনি। ও কীভাবে ঢুকল কে জানে। “
বুড়োদাদু বলল, “ওরা সবই পারে। আচ্ছা ঠিক আছে রাত শেষ হতে আর বাকি নেই। তোমরা এখানেই একটু গড়িয়ে নাও। বৃষ্টিটা বোধহয় ধরেছে। ভোর ভোর উঠে গাড়ি নিয়ে চলে যেও। “
বৃষ্টিতে ভিজে সারারাত না ঘুমিয়ে খুব ক্লান্তও হয়ে পড়েছিল ওরা।ওদের সাথে কী হতে চলেছিল সেই ভয়াবহ কথা ভাবতে ভাবতে চারজনেই ওই চাদরে ঘুমিয়ে পড়ল। ওদের ঘুম যখন ভাঙল তখন সূয্যিমামা বেশ খানিকটা উপরে উঠে গেছে। ওরা দেখল একটা ভাঙাচোরা ছোট্ট ঘরে ধুলোমাটি মেখে ওরা এতক্ষণ ঘুমোচ্ছিল। কোথায় সেই ছেঁড়া চাদর আর কোথায় বুড়ো দাদু। গ্রামের লোকজন একরাশ প্রশ্ন নিয়ে সেই ভাঙা ঘরের সামনে ভীড় করে দাঁড়িয়ে। তপা ওদের বুড়োদাদুর কথা জিজ্ঞেস করতে ওরা যা বলল তার মর্মার্থ হল, এই রাজবাড়িতে এখন কেউ থাকে না। ওই বুড়োদাদু আসলে এই রাজবাড়ির দারোয়ান ছিল। অনেক বয়স পর্যন্ত এই রাজবাড়ির কেয়ারটেকারের কাজ করেছে। এই রাজবাড়ির বংশধররা এখন সব বিদেশে থাকে তাই এটা পোড়োবাড়ি হয়েই পড়ে আছে। এখানে ভূতের ভয়ে রাতেরবেলা কেউ আসে না। ওরা যখন শুনল বুড়োদাদু আমাদের রাজমহলে থাকতে দিয়েছিল, মুড়ি মেখে দিয়েছিল তখন ওরা কিছুতেই বিশ্বাস করছিল না। বলেছিল, “আপনারা এই ঘুটঘুটি অন্ধকারে রাজমহলে ছিলেন কীভাবে? “
আমরা যখন বললাম লাইট ছিল ওরা হেসে বলেছিল, “আজ প্রায় পনেরো বছর এই রাজবাড়িতে কোনো ইলেকট্রিক কানেকশন নেই। “
বাবলুরা বলেছিল, “চলুন তবে রাজবাড়ির ভেতরে যাই। বাল্বগুলো বোধহয় এখনো ঝুলছে। “
ওরা সকলে যখন ভেতরে গেল দেখল সেখানে কোনো বাল্বই নেই। এমন কি যেই খাটে ওরা বসেছিল সেই খাট বা কোনো ফার্নিচারই নেই। অবিশ্বাস্য লাগছে বাবলুদের। গতকাল রাতেই তো এই বড় ঘরটায় ওরা অনেকক্ষণ সময় কাটিয়েছে। ওদের কথা গ্রামের লোকেরা বিশ্বাস করছে না। হঠাৎ ঝন্টুর নজরে পড়ল সেই বড় গামলাটা,যেটাতে বুড়োদাদু ওদের মুড়ি মেখে দিয়েছিল। ঘরের একপাশে পড়ে আছে। ঝন্টু গামলাটা তুলে গ্রামের লোকদের দেখাল। সকলে দেখল গামলাটা থেকে এখনো আমতেলের গন্ধ বেরচ্ছে। গ্রামের একজন মাতব্বর গোছের লোক এগিয়ে এসে বলল, “আপনারা খুব বাঁচা বেঁচে গেছেন। সত্যি বুড়ো দারওয়ান মরে যাওয়ার এত বছর পরেও রাজবাড়ির অতিথিদের রক্ষা করে চলেছে।”
বাবলু ঝন্টুরা এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না কাল ওদের সাথে যা যা হল সবটাই ভৌতিক। বিশেষ করে ওই বুড়েদাদুও যে প্রেতাত্মা সেটা ওরা মানতে পারছে না। সত্যি বিচিত্র এই দুনিয়া। এখানে সবই সম্ভব। গতকাল রাতের ঝড় বৃষ্টি শেষে আজ সুন্দর মিষ্টি রোদ উঠেছে। গ্রামের একজন বলল, “সাবধানে ব্রীজ পার হবেন। ডুলুংয়ের জল এখনো কিন্তু ব্রীজের উপর দিয়ে বইছে। তবে খুব সাবধানে পার হওয়া যাবে।” বাবলুরা ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল। হঠাৎ ওরা চারজনেই স্পষ্ট দেখল রাজমহলের ছাদে বুড়োদাদু হাত নেড়ে ওদের বিদায় জানাচ্ছে। ওরা চারজনে একসাথে হাত নাড়ল বুড়োদাদুর উদ্দেশ্যে। ভূত হলেও বুড়োদাদুর জন্য মনটা যেন কেমন করে উঠল ওদের।