“ছায়া ধরার ব্যাবসা করি তাও জানোনা বুঝি?
রোদের ছায়া, চাঁদের ছায়া, হরেক রকম পুঁজি!
শিশির ভেজা সদ্য ছায়া, সকাল বেলায় তাজা,
গ্রীষ্মকালে শুকনো ছায়া ভীষণ রোদে ভাজা”
গুণগুণ করে তালপুকুরের পাড়ে বসে আবৃত্তি করছিলো পুলি কবিতাটা। সুকুমার রায়ের লেখা ‘আবোল-তাবোলের’ কবিতা, নাম- ছায়াবাজি। কবিতাটা বেশ লাগে পুলির। আগের বছর ক্লাবের সরস্বতী পুজোয় কবিতাটা আবৃতি করে ফার্স্ট প্রাইজও এনেছে সে। আর তো সবাই খুড়োর কল কি কুমড়োপটাশ কি সৎপাত্র আবৃত্তি করে, পুলির সেসব ভালো লাগেনা। তার পছন্দ হল ছায়াবাজি, বিজ্ঞান শিক্ষা, একুশে আইন, গানের গুঁতো এইসব। তবে আজ তালপুকুরের বাঁধানো ঘাটে বসে ছায়াবাজি আবৃত্তি করার পেছনে কারণ অবিশ্যি একটা আছে। এই কবিতায় সুকুমার রায় স্পষ্ট বলে গেছেন যে ছায়ারাও নড়েচড়ে বেড়ায় জ্যান্ত জিনিসের মতো, আশেপাশে কেউ না থাকলে তারাও খেয়ালখুশি মতো হল্লা করে; আর কথাটা যে নেহাত মিথ্যা নয় সেটা পুলির থেকে ভালো আর কেই বা জানে!
কারণ পুলির নিজের একটা পোষা ছায়া আছে, আর সে এখন ঠিক পুলির পাশেই বসে আছে, মাছ ধরা দেখছে; আর এমন তাজ্জব জিনিসটা কিভাবে পুলি জোগাড় করলো সেটা এবার বলি।
পাড়ার কিনারায় খালি মাঠটা পেরিয়ে যে কবরডাঙ্গাটা পড়ে, স্কুলের পরে বেশ কিছুটা সময় আজকাল সেখানেই কাটছিল পুলির; কারণ আর কিছু নয়, একটা শেয়াল ছানার সাথে ভাব জমেছে তার সেখানে।
আর এখানেই একদিন আলাপ হল ওর সাথে।
ঘাসের উপর বসে হাসিমুখে শেয়াল ছানাটার ছুটোছুটি দেখছিল পুলি, এমন সময় খেয়াল হল পাশে যেন কে একটা এসে বসলো। ফস করে ঘাড় ফেরাতে দেখল, কই না, কেউ তো নেই! এবার হটাত মনে হল ঠিক যেন তার পেছনে কে একটা এসে দাঁড়িয়েছে, ফস করে ঘুরল পেছনে, একই ব্যাপার, কেউ কোথাও নেই। আর থাকবেই বা কেন? সখ করে কবরডাঙ্গায় আসতে যাবে কেন লোকে? তাও আবার এই পোড়ো বিকেলে? আরও বার তিনেক এরকম হল, আর তারপরই পুলি বুঝতে পারলো, আর বুঝতে পেরে ঘাড়ের রোঁয়াগুলো খাড়া হয়ে উঠলো তার, লোক-টোক নয়, রক্তমাংসের কোনও প্রাণীই নয়, বরং একটা জলজ্যান্ত ছায়া দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছে তার চারপাশে। ব্যাপারটা শুনেই তোমাদের এতো অবাক লাগছে, তবে ভেবে দেখো সেটাকে চোখের সামনে দেখে না জানি কি দশা হওয়ার কথা পুলির। কিন্তু আগেই বলেছি পুলি কেমন সাহসী ছেলে; কাজেই একটা ভুষোকালি ছায়া একবার তার ডানদিকে এসে বসছে, একবার শেয়াল ছানাটার দিকে ছুটে যাচ্ছে, একবার ডালিম গাছটার শুকনো ঝরা পাতা ধরার জন্যে হুটোপুটি করছে- এইসব দেখে সে মোটেই দমে গেলনা, বরং বেশ মজাই লাগলো তার; ভাবটা এমন- আরে এতে আর আশ্চর্যের কি? ভালো করে ভেবে দেখলে মানুষের সাথেই তো তার ছায়াও জন্মায়, বড় হয়, বুড়ো হয়। বাচ্চাবেলায় মানুষের সাথে তার ছায়াও যেমন হামা টানে তেমনই বুড়ো বয়সে তার ছায়াই তার সাথে লাঠি ঠুকেঠুকে হাঁটে; তার মরণের পর তার ছায়াও মিলিয়ে যায়; আর মানুষ তো মরে ভূত হচ্ছে আকছার, তবে তার ছায়ার বেলায় দোষটা কিসের? দিব্বি দুটো হাত, দুটো পা আর একটা গোল মুণ্ডু আছে ছায়াটার; দেখে তো মনে হয় জীবদ্দশায় মানুষের ছায়াই ছিল; যদিও বলা যায়না! শেষে ছায়াটাকে সাথে করে বাড়িতেই নিয়ে এলো পুলি। পাসেপাসে ঘোরে সেটা সারাদিন, পুলির সাথে ইস্কুলে যায়, বল খেলতে যায়, ছিপ ফেলতে যায়। ফরমাশ করলে গ্লাসে করে জল এনে দেয়, কারেন্ট চলে গেলে পাখা নেড়ে বাতাস করে, কবরডাঙ্গায় ছেড়ে দিয়ে আসবে বলে ভয় দেখালে হোমওয়ার্কও করে দেয় সুড়সুড় করে।
আর তো সবাই কতো কি পোষে, হাতি-ঘোড়া-কুকুর-বেড়াল, এমনকি সাপ, ব্যাঙ, বাদুড় পর্যন্ত। কোন একটা ম্যাগাজিনে পুলি পড়েছে ফ্লোরিডা না ক্যানাডা কোথায় একটা সাহেব পিঁপড়ে পোষে; পুলি না হয় সামান্য একটা ছায়াই পুষল। তবে পোষা কথাটা বোধয় ঠিক নয়, আজকাল ছায়াটা পুলির বন্ধুই হয়ে উঠেছে একরকম। দরকারি কাজে তো বটেই, এমনকি অনেক অকাজে-কুকাজেও সে পুলিকে সঙ্গ দেয়- এই যেমন আগের রবিবারের ব্যাপারটা।
দুপুর বেলা। কচি কুমড়ো দিয়ে নিম পাতা ভাজা যে কিভাবে একটা উপাদেয় খাদ্য হিসাবে গণ্য হতে পারে, সেটা পুলি ভেবেই পায় না। অথচ দিদা, মা, এমনকি ছোট মামা পর্যন্ত যে ভাবে সেটা আয়েশ করে মুখে তুলে চোখ বুজে ‘আহাহা’ করে, তাতে করে মনে হয় নিম পাতা তো নয়, যেন দুধ ভাতে আমসত্ত্ব খাচ্ছে। ব্যাজার মুখে কোনও মতে ডিমের ঝোল দিয়ে অল্প ভাত খেয়ে তাড়াতাড়ি ছাদে উঠে এলো পুলি; না ছাদে তার জন্যে পাত পেড়ে পোলাও-কালিয়ার ব্যাবস্থা নেই ঠিকই তবে তার থেকেও বেড়ে আরেকটা জিনিস আছে। ছাঁকনি চাপা দেওয়া সার সার বয়ামে যে জিনিসগুলো ছাদে রোদ খাচ্ছে, সেটায় পেট না ভরলেও মন ভরবে নিশ্চয়ই। আহা! গন্ধেই তো জিভে জল এসে গেলো। একটা বয়াম তুলে নিলো পুলি। আলতো করে আঙুল ঢুকিয়ে বের করে আনল একটা মার্বেল সাইজের কালো মতো বল। টপ করে মুখে চেলে দিলো সেটা। তারপর চোখ বুজে তৃপ্তি ভরে খানিক মুখ নাড়ল। তারপর টুপ করে একটা দানা মুখ থেকে বের করে ছাদের কানা দিয়ে জলপাই গাছটার দিকে ছুড়ে দিলো। কুলের আচার। দিদা বানিয়েছে। এ জিনিস একটায় চলে না, কাজেই আরও দুটো মুখে পুরতে হল। তারপর অতি সন্তর্পণে নামিয়ে রাখল বয়ামটা। আঙুলটা দরদ দিয়ে ভালো করে চেটে পরের বয়ামটা তুলে নিলো এবার। এটায় আঙুল ডোবাতে মেটে রঙের ঈষৎ স্বচ্ছ একটা জিনিস উঠে এলো। এটাও পুলি মুখে পুরে চোখ বুজে চিবল খানিক। তবে দানা-টানা বেরোল না এটার- কারণ এটা বেলের মোরব্বা। এটা তার মায়ের বানানো। মুখ নাড়তে নাড়তে অদ্ভুত একটা সন্তুষ্টি নিয়ে বাকি বয়ামগুলো একবার দেখে নিল সে। শুধু বেল আর কুলই নয়, পরপর সাতটা বয়ামে সাত রকমের আচার-মোরব্বা আছে। আমের তো আছেই, এমনকি চালতা আর লেবুর আচারও আছে। প্রথমটা শেষ করে সবে দ্বিতীয়টা বের করতে যাবে আর তখনই ঘটলো বিচ্ছিরী ব্যাপারটা। তেলা হাতে ধরা কাঁচের বয়ামটা যাবে না হাত থেকে ফসকে! ব্যাস! আর কি! এইবার ‘কে রে’ বলে মা ছুটে আসবে নিচ থেকে; তারপর হাতেনাতে ধরা পড়ে যাবে চোর; তারপর প্রচণ্ড একটা ধমক, সাথে হয়তো কানমোলাও। চোখ বুজে নিলো পুলি।
ঝনাততততত…
অন্তত এরকমই একটা শব্দ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু কই, হল না তো! ব্যাপার কি? বয়ামটা কি তবে ভ্যানিশ করে গেলো নাকি মাঝ পথে? চোখ খুলল পুলি।
আশ্চর্য! বয়ামটা দিব্বি একটা ঝিঁঝিঁ পোকার মতো হাওয়ায় ভাসছে!
আর পাঁচজন হলে ‘ভূততততততত’ বলে আঁতকে উঠে ভিরমি যেতো, পুলি কেবল ঠোঁট বেকিয়ে বলল-
“ওওও…তুই? চমকে দিয়েছিলি!”
হ্যাঁ তা চমকে যাওয়ার মতো জিনিসই বটে। কাঁচের বয়ামের ছায়া ছাদের মেঝে ছোঁয়ার আগেই আরেকটা ছায়া হাত বাড়িয়ে সেটা ধরে ফেলেছে, এখন বস্তুর ছায়া যদি মাটি না ছোঁয়, বস্তু ছোঁয় কিকরে? কাজেই কাঁচের বয়ামটা হাওয়াতেই ভাসতে লাগলো। মুখ দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে তেল পড়তে লাগলো তার টপ টপ করে।
আরও বেশ কিছু দুষ্কার্যে জিনিসটা পুলির দোষর হয়েছে- এই যেমন সেদিন ক্রিকেট খেলার সময় যে ব্যাপারটা ঘটলো। ঊনপঞ্চাশে ব্যাট করছে নেকু, আর এক রান হলেই হাফ সেঞ্চুরি। বল করছে পুলি। ফার্স্ট ইনিংসে পুলিকে রান আউট করেছিলো নেকু, বদলা তো নিতেই হবে। আর সেটার জন্যে বিশেষ কাঠখড় পোড়াবারও দরকার নেই। দৌড়ে এসে সোজা উইকেট টিপ করে বলটা বাঁই করে ছুঁড়ে দিলো পুলি; ঠক করে উইকেটে লাগলো সেটা। ক্লিন বোল্ড। সবাই ছুটে এসে পুলিকে ঘিরে ধরল। আর ব্যাটসম্যান নেকু? সে তো পাথরের মূর্তির মতো সেই ব্যাট হাঁকড়েই দাঁড়িয়ে আছে তখনও, এমনকি বল আসার সময়েও সেই একভাবেই দাঁড়িয়েছিল সে; কে যেন মোমের পুতুল বানিয়ে দিয়েছে তাকে ম্যাজিক করে- ব্যাট ওঠেনি তার। অবাক কাণ্ড!
ওই একই দিনে আরও একটা বদলা নেওয়ার কাজ সেরে ফেললো পুলি।
মাদলবাবুর উপর বেজায় রাগ পুলির। উনি পুলিদের ইস্কুলের খেলার মাস্টারমশাই। পুলির ধারণা ইচ্ছে করে উনি পুলিকে স্কুলের সাঁতারের টিমে নেননা। পুলি একটা সুযোগ খুঁজছিল ওনাকে জব্দ করার, আর সেটা এসেও গেলো আশ্চর্যভাবে। সেদিন পকেট থেকে বাঁশি বার করতে গিয়ে মানিব্যাগটা গেলো মাটিতে পড়ে। কিন্তু মানিব্যাগটা মাদলবাবু যেই না তুলতে গেছেন নিচু হয়ে, ও হরি, এতো হুস করে পাখির মতো উড়ে গেলো। গোলগোল চোখ করে মাদলবাবু তাকিয়ে রইলেন সেদিকে। তিনি যতই ধাওয়া করেন মানিব্যাগটাকে, জিনিসটা ততো সরে সরে যায়- এ সেই খুড়োর কলের মতো ব্যাপার। শেষে জিনিসটা যখন স্কুলবাড়ি লাগোয়া পুকুরটার এক্কেবারে মদ্দিখানে জলের পাঁচ হাত উপরে ভাসতে লাগলো হাওয়ায়, প্রায় ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখ নিয়ে পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে বার পাঁচেক ঢোক গিললেন মাদলবাবু। এরপর টানা চারদিন তিনি স্কুলে আসেননি। জ্বরের ঘোরে ‘পুকুরটা উড়ে গেলো, ধর কেউ’, ‘উড়ান প্রতিযোগিতায় হেলিকপ্টারকে হারিয়ে প্রথম হল মানিব্যাগ’ এইসব বলে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতেন কেবল।
বেশ কিছুদিন থেকে একটা চিন্তা মাথায় ঘুরছিল পুলির। যে তিনটে মানুষ তার সবথেকে কাছের, মা, দিদা আর ছোটমামা, তাদের প্রত্যেকেরই একটা করে হেল্পার থাকলে অনেক সুবিধে হোতো। ছোটমামার সবসময়েই একটা অ্যাসিস্ট্যান্টের দরকার পড়ে ল্যাবরেটরিতে, মায়ের এতো কাজ সারাদিন- আরেকজোড়া হাত থাকলে ভালো হোতো, দিদার বাতের ব্যাথা, সন্ধ্যেবেলা পুজোর সময়ে জিনিসপত্র কেউ হাতের কাছে বাড়িয়ে দিলে মন্দ হতোনা- এইসব সমস্যা সব মিটে যাবে যদি একটা করে হেল্পার থাকে এদের; আর হেল্পারের কথাই যদি ওঠে তবে…
ফন্দিটা ফস করে মাথায় খেলে গেলো পুলির; তাছাড়া একটা আদর্শ উপলক্ষও পাওয়া গেছে।
ছেলেমেয়ে-মা তিনজনেরই জন্মদিন একই দিনে পড়ে, এ নজির পৃথিবীতে বেশী একটা নেই। যে একটা হাতের কাছে আছে সেটা পুলির বাড়িতেই আছে। ছোটমামা, মা আর দিদা- তিনজনেরই জন্মদিন পয়লা এপ্রিল। তা ছোটমামা আর মা জমজ ভাইবোন, জন্মদিন তো এক হবেই, কিন্তু দিদার জন্মদিনটাও যে একই দিনে পড়বে, সেটা একেবারে ফাউ। পুলি তখন হয়নি, বিয়ের প্রথম প্রথম বাবা একবার মায়ের জন্যে ঢাউস একটা কেক কিনে এনেছিল জন্মদিন বলে। লুকিয়ে লুকিয়ে ছোটমামার ঘরে ঢুকে পেল্লায় বাক্সটা ছোটমামার হাতে দিয়ে বলেছিল- শালাবাবু, জন্মদিনের কেক এটা, লুকিয়ে রাখো, সন্ধ্যেবেলা হৈহৈ করে কাটা হবে। ছোটমামা তাতে গদগদ হয়ে বত্তিরিস পাটি দাঁত বের করে বলেছিল- সেকি জামাইবাবু, আমার জন্মদিন আপনার মনে আছে? বাবা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল পুরো পাঁচটি মিনিট, তারপর জানতে পারে পুরো ব্যাপারটা।
আজ একতিরিশে মার্চ, কালই পয়লা এপ্রিল। এদিকে বাবা তো বাড়ি নেই, আছে লন্ডনে। পুলির কাছে যে সামান্য কটা জমানো টাকা আছে তাতে বড়জোর একটা মাঝারি সাইজের জন্মদিনের কেক হবে। আর গিফট? সেটার জোগাড় কিভাবে হবে? সে ব্যাবস্থাও হয়ে গেছে।
পরের দিন, মানে পয়লা এপ্রিল, দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর তিনজনকে উঠোনে পাশাপাশি যখন দাঁড় করাল পুলি, তিনজনই প্রথমে একটু হকছকিয়ে গেছিলো বৈকি। দিদা লাঠি ধরে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়েছিল, বলল- ‘কি জানি বাপু কি মতি তোমার, এই ঠায় দুপুরে রোদে শুকিয়ে আমসত্ত্ব করবে নাকি আমাদের তিনজনকে?’ ছোটমামাও বেশ সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছিল, ভাগ্নেটা তার অত্যন্ত বুদ্ধিমান তাতে সন্দেহ নেই তবে বেয়াড়া রকমের খামখেয়ালীও বটে, না জানি কি ফন্দি এঁটেছে; আর মার কথা তো বাদই দিলাম, তিনি তো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন ছেলেটা তার পাগল, যেকোনো দিনই রাঁচির টিকিট কাটতে হতে পারে।
খুক খুক করে দুবার কেশে গলা ঝাড়া দিয়ে পুলি বক্তৃতা দেওয়ার ঢঙে বলল-
“একাধারে সুযোগ্য পুত্র, ভাগ্নে ও নাতি হওয়ার সুবাদে আজ আমি তোমাদেরকে একটা করে উপহার দেবো। এমন জিনিস কেউ কাউকে কখনও কোথাও দেয়নি আর দেবেওনা, কারণ এ জিনিস পাওয়াই যায়না। আমি পেয়েছি, তাই দিচ্ছি। তবে বেশ কিছু টার্মস অ্যান্ড কন্ডিসানস আছে। এক, দিদা, আমাকে ঠাকুরঘরে অবাধে যাতায়াতের সুবিধা দিতে হবে, বাড়তি এক বয়াম কদমাও বরাদ্দ করতে হবে। দুই, মা, আমাকে সপ্তায় তিনদিন ঘুড়ি ওড়ানো ও মাছ ধরতে যাওয়ার ছাড় দিতে হবে; আর তিন, ছোটমামা, যখন তখন আমার কান ধরে মোচড় দেওয়া চলবেনা আর তোমার ল্যাবরেটরিতে ঢুকলে ‘হেঁই হট হুর’ করে খেঁদিয়ে দেওয়ায় চলবেনা। রাজি?”
ছোটমামা ঘোঁত করে একটা শব্দ করলো নাক দিয়ে, কি একটা বলতে যাচ্ছিলো, চোখ টিপে মা চুপ করিয়ে দিলো। তিনজনেই ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ জানালো।
“এই, তোরা বেরিয়ে আয়” অদৃশ্য কারুর উদ্দেশ্যে কথাটা বলল পুলি, আর যেই না বলা অমনি ঘটলো আশ্চর্য ব্যাপারটা। দুপুর গড়িয়ে এসেছে। তিনজনের দুইহাত লম্বা তিনটে ছায়া সামনের দিকে এসে পড়েছিল। পুলির ডাক শুনে নড়েচড়ে উঠলো তারা। একজন প্রনাম করলে, একজন হাত নেড়ে ‘হাই’ করলে, আরেকজন দিব্বি কোমর দুলিয়ে নেচে নিলে খানেক! এ কি তাজ্জব ব্যাপার! পাথরের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো তিনজন। চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে তাদের, মায়ের একটা হাত মুখে উঠে গেছে, দিদা ত্রাসের ভঙ্গিতে আরও ঝুঁকে পড়েছে আর ছোটমামার মুখ এত্তবড় হাঁ।
“একটা করে ছায়া উপহার দিলুম তোমাদের তিনজনকে” কান পর্যন্ত চওড়া হেসে পুলি বলল।
বাঁই করে মাথা ঘুরে মা বোধয় অজ্ঞানই হয়ে যাচ্ছিল, ছোটমামা এসে তাড়াতাড়ি ধরে নিল।
ভাবছ এখানেই গল্পের শেষ? আসল প্রশ্নটা করলে না যে? তিনটে বাড়তি ছায়া পুলি কোথায় পেলো সেটা ভেবে দেখেছো? না, কবরডাঙা থেকে জোগাড় করেনি সেগুলো। ও জিনিস অমন মুড়িমুড়কির মতো যখন তখন পাওয়া যায়না; মানুষের ভূতই এতো বিরল, তায় আবার মানুষের ছায়ার ভূত!
নোটপত্র, দলীল-দস্তাবেজ তো হরহামেশাই জেরক্স করছে লোকজন, একটা কপি থেকে বানাচ্ছে আরও দশটা কপি, কিন্তু ছায়া জেরক্স করতে শুনেছ কাউকে? ভারত-অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ম্যাচটা দেখতে দেখতে সেই কথাটাই বিদ্যুতের মতো খেলে গেলো পুলির মাথায়।
হ্যাঁ, পুলি ছায়া জেরক্স করেছে! তবে সে কি আর যেমন তেমন করে হয় নাকি? তার আলাদা কল আছে; কালই সন্ধ্যেবেলা পুলি করে এনেছে সেটা।
হরকৃষ্ণবাবুর অনুদানের ঠেলায় এবারই ওদের হরিণডাঙা ক্লাবের ফুটবল মাঠের চারকোনে চারটে লাইটপোস্টের খুঁটি পড়েছে, সাথে হ্যালোজেন লাইটও। তা সে ইডেন গার্ডেনের মতো জমকালো না হলেও আলো জ্বালিয়ে মাঠে এসে দাঁড়ালে মানুষের চারটে করে ছায়া এখানেও পড়ে। মানুষ এক, ছায়া চার, ঠিক যেন এক কপি আসলের তিন কপি জেরক্স। আর ঠিক সেটাই তো দরকার।
খেলা শেষে বিপক্ষ দলকে সাত গোলে হারানোর আত্মতৃপ্তি ছাড়াও আরও যে একটা জিনিস নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল পুলি; একটা নয় চারটে আসলে; সেগুলোই আজ ‘জন্মদিনের উপহার’ হিসাবে বিলিয়ে দিলো মা, দিদা আর ছোটমামার মধ্যে। একান্ত অনুগত, অত্যন্ত বিশ্বস্ত, একেবারে ব্যাক্তিগত একটা করে ছায়া।
কলমে সোহেল রেজা
Write and Win: Participate in Creative writing Contest & International Essay Contest and win fabulous prizes.