চম্পার আজ অনেক দেরী হয়ে গেল, যে বুড়ির বাড়িতে শেষে রান্না করে তাদের আজ বিয়ের পঞ্চাশ বছর হলো তাই কিছু বন্ধু আর আত্মীয় স্বজনদের ডেকেছেন ওরা অবশ্য রাগ করে বুড়ি বললেও মানুষ খুব ই ভালো ওনারা, নিঃসন্তান কিন্তু এই নিয়ে ওনাদের কোন দুঃখ নেই খুব হাসি খুশি মজার মানুষ জেঠু জেঠিমা। জেঠিমা আসার সময় ওকে ফ্রায়েড রাইস, চিকেন, লুচি, ছোলার ডাল, দই মাছ, বেগুনী ,মিষ্টি সব দিয়েছেন, যাক বুড়ো বাপটা আজ একটু ভালো মন্দ খেতে পাবে। মা টাতো কবেই মরেছে অসুখে ভুগে ভুগে। বড় ভাই দুটো রোজগার করতে শুরু করেই বিয়ে করে পগাড় পার আর ছোট বোনটা পাশের পাড়ার স্বপনকে বিয়ে করেছে, ওর মুদির দোকান আছে, খেয়ে পরে ভালোই আছে শম্পা। মাঝে মাঝে আসে ওর হাতে দুশ, পাঁচশ টাকা দিয়ে যায় বা পুরানো শাড়ি ব্লাউজ শুধু চম্পা ই রয়ে গেছে বাপের কাছে এর মধ্যে বাপের প্রতি টান কতোটা সন্দেহ আছে কারন চম্পা কুৎসিত কালো, বেটে ,নাক বোঁচা ,দাঁত একটু উঁচু এমন মেয়েকে কে পছন্দ করবে তার উপর লেখাপড়া ও জানে না বাপের টাকা নেই
অবশ্য ওর বিয়ের চেষ্টা ও কেউ করেনি ।
থাকার মধ্যে আছে ওর গতর তাই অগ্যতা লোকের বাড়িতে রান্না করে সময় পেলে বিড়ি বাঁধে, সেলাইয়ের কাজ করে। পাশের বাড়ির তনুদিদির পরামর্শে ও ব্যাঙ্কে একটা পাশ বই খুলেছে তাতে একটু একটু পয়সা জমাচ্ছে। পয়সা জমলে ও
নিজে একটা দোকান করবে।
বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে বুঝলো বাপটা আজ চলে এসেছে পাশের বাজারে ঝালমুড়ি বিক্রি করে। মা লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করতো তার থেকেই এতো বড়ো সংসারের
নুন ভাত কোনদিন জুটতো কোনদিন জুটতো না।
কিন্তু আজ বাপ যেন কার সাথে বকবক করছে, ঘরে ঢুকে দেখলো তক্তার উপর একটা লোক শুয়ে আর বাপ জলপট্টি দিচ্ছে বুঝলো লোকটা অসুস্থ ,ওকে দেখিয়ে বাপ বললো,
- ‘বাজারে সব্জি বেঁচে নিতাই দুদিন ধরে জ্বরে অজ্ঞান কেউ দেকার নেইকো তাই নে এলুম।’
- ‘উদ্ধার করেচ।’
মুখ ঝামটা দেয় চম্পা, ওর মাথা গরম হয়ে যায়। কোথাকার কাকে জুটিয়ে এনেছে কে জানে দিনকাল ভাল না, কেমন লোক, এই বাপটাকে নিয়ে আর পারা যায় না। একটাই ঘর সামনের বারান্দায় রান্না করে এরমধ্যে আরেকটা আপদ জুটেছে তার উপর অসুস্থ।
চম্পা বকবক করতে করতে বেরিয়ে পাশের কল থেকে দুমগ জল ঢালে কিন্তু আজ আর ভেজা কাপড়ে ঘরে না ঢুকে তনুদিদির ঘরে গিয়ে শুকনো কাপড়টা পড়ে নেয়
ঘরে গিয়ে বাপকে খেতে দেয়, নিজেও দুমুঠো খেয়ে নেয়। বাপের জন্য নীচে বিছানা পেতে দেয় আর নিজে গিয়ে তনুদিদির ঘরে শুয়ে পড়লো ।
সকাল হতেই বারান্দায় ছোট গ্যাসটা জ্বেলে রুটি আর চা বানিয়ে বাপকে দিয়ে নিজেও খেয়ে নেয় আর ওই নিতাইয়ের জন্য দুধসাবু বানিয়ে রাখে।
বাপকে বলে যায় বেলার দিকে যেন একবার কবিরাজের কাছে নিয়ে যায়।
পাঁচবাড়ি রান্নার কাজ করে চম্পা, ঘরে ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে যায় ওর।
অন্যদিন বাপ ডাল ভাত ফুটিয়ে রাখে তরকারি বা অন্য কিছু চম্পা এসে রান্না করে আজ কিছুই হয়নি ।জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে নিতাই ওকে নিয়ে বাপ হয়রান। তাড়াতাড়ি চম্পা মাথায় জল ঢালে ,অসহায় ছেলেটাকে দেখে ওর মায়া হয় ।কবিরাজের থেকে আনা পুড়িয়া একটা খাইয়ে দেয়। প্রায় এক ঘন্টা পরে জ্বর একটু কমে নিতাইয়ের।
চম্পা চান করে এসে সবার জন্য খিচুড়ি বসিয়ে দেয়, কতদিন খায়নি ঠিক করে নিতাই কে জানে।
বাপের কাছে শুনেছে বেচারা একা থাকে সব্জি বিক্রি করে, ওখানেই দুটো ভাত ফুটিয়ে খায়, ঘুমায়। বড়ভাই আছে একটা ওর বউ টা দজ্জাল বিয়ে হয়ে এসে নিতাইকে তাড়িয়েছে তারপর থেকে একাই ও।
একটু খিচুড়ি আস্তে আস্তে খাইয়ে দেয় চম্পা নিতাইকে বিকেলের পর থেকে একটু সুস্থ হয়ে ওঠে নিতাই ।আজ আর বিকেলে রান্না করতে যায় না চম্পা একটু চিড়ে ভাজা করে দেয় সন্ধেবেলায়
নিতাইকে রাতে আবার দুধসাবু।
পরের দিন সকালে নিতাই বলে ঘরে যাবো চম্পার কাছে ওকে বিরক্ত করার জন্য মরমে মরে আছে। বার বার বলে, ও আসতে চায় নি ঝালমুড়ি বাবু জোর করে নিয়ে এসেছে। চম্পা বলে এই অসুস্থ শরীরে একা কোথায় যাবে! ঠিক হলে যাবে।
ধীরে ধীরে একমাস পেরিয়ে যায় আজ যাবো কাল যাবো করে এখনো নিতাইয়ের যাওয়া হয় নি। বাপ ঝালমুড়ি বিক্রি করতে গেলে নিতাই ও যায় সব্জি বিক্রি করতে। আসার সময় কোনদিন কুমড়ো ফুল কোনদিন তেলাপিয়া মাছ নিয়ে আসে
চম্পার রান্না খুব তৃপ্তি করে খায় এইকদিনেই বেশ খোলতাই হয়েছে চেহারা।
এখন সামনের বারান্দায় একটা খাটিয়া পেতে ঘুমায় নিতাই।
যে জেঠিমার বাড়িতে রান্না করে ওখানে নিতাইয়ের গল্প করেছে ও। জেঠিমা বলেছেন এরকম একটা জোয়ান ছেলে ঘরে থাকলে লোকে নানা কথা বলবে ।মজা করে চম্পাকে বলেছেন, ‘হ্যাঁ রে তোকে পছন্দ করে নিতো !! তবে তো ভাল ই বিয়ে করে নে।’
-ধ্যাত কি যে বলো।’
বলে সরে যায় চম্পা । আসার পথে ভাবে একসময় সে ও তো চাইতো একটা সংসার, স্বামী কিন্তু এখন বোঝে তা হবার নয় তাই সব ইচ্ছেকে মাটি চাপা দিয়েছে ও।
ঘরে ঢুকে দেখে নিতাই চুনোমাছ বাচছে ওকে দেখে বলে
-‘ খুব তাজা বটে সরষে বাটা দিয়ে রাঁধো খাসা হবেক খেতে।’
দুম করে বলে চম্পা
- ‘তুমি লিজের বাড়িতে যাও ইখেনে নোকে নানা কুথা বলবেক হুশ লাইকো তুমার ।’
নিতাই চুপ করে ঘরে চলে যায় সত্যি তো পরের বাড়িতে কদিন থাকবে হক কথাই বলেছে চম্পা কিন্তু এই ঘর ছেড়ে নিজের ওই খালি ঘরে যেতে মন চায় না একজন মহিলা থাকলে ঘরটা ভরে থাকে ওর সাধ হয় কেউ ওকে রেঁধে যত্ন করে খাওয়াবে কিন্তু ওর বিয়ে দেবে কে…..
নিতাইয়ের কথা শুনে বাজারের নন্দ বলে
-‘তু চম্পা কে বে করে নে। ঝালমুড়ি বাবু একা ওদের ও
দেকার কেউ নেইকো।’
- ‘কিন্তু চম্পা বড্ড বেশি কালোপানা আর ও কি রাজি হবেক?’
- ‘ইটা তু আমার উপর ছেইড়ে দে দেক।’
- হুম ।
নন্দ চম্পার বাপকে বুঝায় নিতাইয়ের সাথে চম্পার বিয়ে দিতে। বলে তুমি একা থাকো বিপদে আপদে দেখার লোক হবে আর মেয়েটার ও হিল্লে হবে।
বাপের মুখে এই কথা শুনে চম্পা অবাক হয়ে যায় তার মতো কুৎসিত কেও কেউ বিয়ে করতে চায়। সোজা চলে যায় নিতাইয়ের কাছে
- ‘তুমি ভাবো লাই তো আমার বাপের টাকা আছেক বটে, সেসব কিচ্ছু লাই তুমি আমার মতো কুৎসিতকে বে করবেক কেন?’
নিতাইয়ের চোখে আজ যেন চম্পা পরমা সুন্দরী হলুদ শাড়ি, লাল ব্লাউজ মাথায় এক ঢাল চুল
- ‘তুই আমার চোকে সুন্দরী বটিস আমি তুকেই বে করবো।’
চম্পার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে যায় তাড়াতাড়ি ঘরে চলে আসে ।
এর কদিন পর চম্পা আর নিতাইয়ের বিয়ে হয়ে যায় ।
বিয়েতে নিতাইয়ের দাদা এসে রুপোর চেন দিয়ে আশীর্বাদ করে গেছে চম্পাকে, শম্পা ও এসেছিল বরের সাথে দিদির বিয়ে হচ্ছে বলে খুব খুশি ।
জেঠিমা বিয়েতে চম্পাকে একটা সোনার চেন আর দশ হাজার টাকা দিয়েছেন ,এই টাকা দিয়ে চম্পা আর একটা ঘর তুলেছে। জেঠিমার বাড়ি ছাড়া সব বাড়ির রান্নার কাজ ছেড়ে দিয়েছে নিজের
জমানো টাকা দিয়ে ঘরের সামনে একটা মুদির দোকান
দিয়েছে আর চম্পা এখন মন দিয়ে সংসার করছে। ওর যত্ন আত্তিতে নিতাই ও খুশি সারাদিন চম্পু চম্পু করছে।
আর এই দুজনকে দেখে বুড়ো বাপটাও খুশি যাক মেয়েটা এতোদিনে সুখের মুখ দেখেছে।
লেখক পরিচিতি : জয়শ্রী দাস মিত্র ,আমি বহু বছর প্রবাসী, কিন্তু বাংলা আমার হৃদয়ের সাথে জুড়ে আছে আর বাংলা সাহিত্য ও। চেষ্টা করি মনের কথাকে শব্দের মালায় বাঁধতে।