অন্য বসন্ত

0
1325

বিজয় নামটা আমার বাবা-মায়ের দেওয়া হলেও, বাস্তবে আমি যে সবসময় বিজয়ের মুকুট পড়েছি তেমনটা নয়। নিয়মিত কলেজে যাওয়া-আসা করলেই যে ভালো ছাত্র হওয়া যায় না, আমিই তার বাস্তব উদাহরণ! তবে এখন বি.কম পাশ করার পর সামান্য একটা চাকরি করছি। আমার রোজকার রুটিন, সকালে বাড়ি থেকে অফিস এবং বিকেলে অফিস শেষ হলে বাড়ি; এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ সুতরাং ভালোবাসা বা ভালো লাগা বিষয়টা আমি বাবা-মা এবং কাজের বাইরে কখনোই অনুভব করিনি। কিন্তু সময়ের খেলায়, সেই অনুভূতির আঁচ আমি সামান্য হলেও পেয়েছি। যার কথা বলতে গেলে, মনে পরে যায় সেই সবে মাত্র চাকরিতে ঢোকার দিন গুলোর কথা।

হ্যাঁ! তখন রোজ ট্রেনে বাসে চেপেই অফিস যেতাম আর ওই দিন আবহাওয়া ছিল অনেকটাই মেঘলা, তাই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে কিছুটা পথ পাড়ি দিতে না দিতেই দুর্যোগের ঘনঘটার সম্মুখীন হলাম। অর্থাৎ মেঘ না চাইলেও, তখন বৃষ্টি নামল। অবশ্য এর জন্য আমাকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। কারণ আমার ব্যাগে সবসময়ই একটা ছাতা উপস্থিত থাকে, কাজেই স্টেশনে অটোরিকশা থেকে নেমেই ছাতাটা নিজের মাথার ওপর তুলে ধরলাম। অতঃপর ছাতা মাথায় কয়েক পা সামনে যেতে না যেতেই, এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখার সুযোগ পেলাম। দেখলাম রাস্তার অপর দিক দিয়ে একটি ছেলে আর মেয়ে বোধ্যয় কলেজ পড়ুয়া, পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে শুধুমাত্র একটি ছাতার সাহায্যে দিব্বি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

কিন্তু এরপর যে সেই ঘটনা ঘটবে, তা হয়ত আমি এক মুহূর্তের জন্যও কল্পনা করিনি। আমার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল এক তরুনীর উপর। তার কাছে ছাতা না থাকায়, সে অটোরিকশা থেকে নেমে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই হেঁটে যাচ্ছে। মেয়েটির চেহারা সামনা-সামনি না দেখলেও সে যে বিরাট সুন্দরীই হবে, এতে আমার কোন সন্দেহ নেই। তার পরনে হলদে চুড়িদার, মাথার দীর্ঘ কালো কেশ, কানের দুল, হাতের বালা আর বৃষ্টি ভেজা শরীর দেখেই মেয়েটির সৌন্দর্য অনুমান করতে পারছিলাম। আবার দেখলাম, হাঁটার সুবিধার্থে মেয়েটি তার পায়ের জুতো দুটো খুলে হাতে নিয়ে নিজের কোমড় দুলাতে দুলাতে হাঁটছে। সেই দৃশ্য আমার চোখে শুধু সুন্দরই নয়, অপূর্ব লাগল!

তখনই ঠিক করলাম, যে করেই হোক আমাকে ওই মেয়ের মুখটা একবার দেখতেই হবে। অতএব অফিস ভুলে, আমি দ্রুত মেয়েটির পিছনে হাঁটা শুরু করলাম। কিন্তু একি! মেয়েরা যে এত জোরে হাঁটতে পারে তা আমার জানা ছিল না। আর জানা থাকবেই বা কি করে? আগে কোনদিন এভাবে কোন মেয়ের পিছু নেওয়ার অভিজ্ঞতা নেই যে! এরপর আসতে আসতে উপলদ্ধি করতে লাগলাম, আমি এক পা এগোলেই মেয়েটি আমাকে দুই পা পেছনে ফেলে আগে চলে যাচ্ছে! এদিকে, ভেজা পায়ে দ্রুত হাঁটার কারণে আমার পা বার বার স্লিপ কাটছে। যার ফলে, উপায় না দেখে আমিও মেয়েটির মত নিজের বুট জোড়া পা থেকে খুলে হাতে নিয়ে নিলাম। এরপর বুট জোড়া বগলতলে নিয়ে আবারও মেয়েটির পিছনে হাঁটতে লাগলাম। কিন্তু হায়…! খালি পায়ে যখন দুই কদম সামনে গেলাম তখন মনে হচ্ছিল আমি বুঝি সীতার মত অগ্নিপরীক্ষা দিচ্ছি! সেদিন আমি অজান্তেই নিজের গণ্ডির বাইরে প্রথম পা রেখেছিলাম।

ওইদিন বাড়ি ফেরার পরও সেই দৃশ্য আমার চোখের সামনে থেকে কিছুতেই সরছিল না। সেই রাতে ঘুম না আসায়, জানি না কিভাবে আমার অন্তর থেকে কিছু কবিতার লাইন বেড়িয়ে এল। ওই লাইন গুলো একটা খাতার পাতায় লিখেও ফেললাম।

‘বৃষ্টি তুই নেমে এলি পৃথিবীর ডাকে,
বৃষ্টি তুই ভিজিয়ে দিলি আমার শুখনো মনটাকে।
বৃষ্টি তোর স্পর্শে জীবনে এক অন্য মানে খুঁজে পেলাম,
বৃষ্টি তাই বসন্তের আগে, বসন্তের ডাক শুনলাম’।

তারপর বেশ অনেক দিন কেটে গেল কিন্তু আমার যাতায়াতের পথে ওই তরুণীর আর দেখা পেলাম না। মনে হল তার সঙ্গে আর হয়ত আমার দেখা হবে না।

এদিকে তখন মধ্য বর্ষাকাল, রোজই অফিস থেকে ফিরতে দেরি হচ্ছিল। তবে সেদিন অফিস থেকে একটু আগেই বেড়িয়েছিলাম কিন্তু বৃষ্টিতে প্রায় অনেকটাই ভিজে গিয়ে মেজাজ তখন চরম বিগরে ছিল, কি করব একটিও অটোরিকশা পাচ্ছিলাম না যে। এদিকে স্টেশন থেকে মন্দিরতলা আমার বাড়ি, অনেকটা পথই যেতে হবে।

দূর থেকে একটা অটোরিকশা আসতে দেখে আমি একটু এগিয়ে গিয়ে বললাম,“ও ভাই, মন্দিরতলা যাবে?”

প্রথমে অনেক দর হাঁকাবার পর অবশেষে ওই অটোরিকশাচালক চল্লিশ টাকা ছাড়া যেতে রাজি হল না। আর আমাকেও যেতে হত সুতরাং আর দেরি না করে উঠে পড়লাম অটোরিকশাতে। তবে ওই অটোরিকশাতে ওঠা মাত্রই আবারও ওই মেয়েটির সঙ্গে দেখা!

না! সে আমার দিকে একবারও তাকায়নি ঠিকই কিন্তু আমার মনে তখন যেন হারনো সূর ফিরে পাওয়ার মত অবস্থা। এতদিন যাকে হন্য হয়ে খুঁজছিলাম, সেদিন না চাইতেই সে হঠাৎ আমার সামনে এসে ধরা দিল। আমি ঠিক করলাম ওইদিন যে কোন ভাবে হক, কথা আমি বলবই। আর তাই অনেকটা নার্ভাস ফিলও করছিলাম।

আমি কখনো প্রেম করিনি। প্রেম যে আসলে কিভাবে করে, তাও বুঝি না। ছেলে মেয়েরা একসঙ্গে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কিভাবে যে পার করে দেয়, আমার মাথা ঢুকে না! এত কথা তারা পায় কোথা থেকে?

এই বিষয় আমি একবার এক দাদাকে জিজ্ঞেস করলেছিলাম এবং সে উত্তরে বলেছিল,”আগে প্রেম কর তারপর বুঝবি, কোথা থেকে এত কথা আসে”।

হুম… প্রেম! তখন ভাবতাম, ওটা আবার আমি করব! এর থেকে আশ্চর্যজনক ব্যপার আর হয়ত হতে পারে না।

ব্যাস, আমার সব কিছু উলটপালট হয়ে গেল। এখনও মনে আছে; ওর সেই চাউনিতে ছিল কি একই রকম প্রশ্ন, কি উত্তর যেন খুঁজে পেতে চাইছিল আমার চোখে। এক বিশাল আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে ছিল সে।

এখনও মাঝে মধ্যে ভাবলে শিউরে উঠি। সেদিন আমার আবেগকে আমি পাত্তা দিতে চাইনি। ভেবেছিলাম এটা হয়ত মোহ। সেদিন তাই চেয়েও অনেক কথাই বলা হয়নি, এমনকি নামটাও জানা হয়নি। এদিকে, ইদানীং আমার কি যে হল কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। খেতে, বসতে, শুতে এমনকি ঘুমাতে পর্যন্ত ইচ্ছে করে না। ভাগ্যিস! পোশাক বদলানোর সময় এমন অনীহা হয়নি। হলে যে কি বিব্রতকর অবস্থায় পড়তাম তা স্বয়ং ঈশ্বরই জানেন! তা আমার এই অনীহার মূল কারণ যে প্রেম, এটা বোধহয় আজকালকার ফিডিং বোতলে দুধ খাওয়া শিশুরাও অনুমান করতে পারত।

ওই দিনের পর প্রায় রোজই তখন অফিস থেকে ফেরার সময় ওই মেয়েটির সঙ্গে আমার দেখা হত এবং অনেকটা ইচ্ছাকৃত ভাবেই আমি অফিসের বড় বাবুকে ফাঁকি দিয়ে ৫টার মধ্যে বেড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম, শুধুমাত্র ওই টানে। যেই টান শুধু ওই তরুণীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। তাকে রোজ নিজের স্বচক্ষে দেখার জন্যই এত ঝক্কি নিতাম।

তখনও ভাবতাম এটা হয়ত এক প্রকার ভালো লাগা ঠিক যেমন কলেজে পড়ার সময় আমার বন্ধুদের এরকম রোজই কোন না কোন মেয়েকে দেখলে মনে হত আর তাদের প্রেমেও তারা পড়ে যেত। সেই সময় আমার এই বিষয় কোন ইন্টারেস্ট না থাকলেও, তাদের সেটা ভালো লাগত। ফলে, আমার ধারণা হল বিগত কিছুদিন ধরে আমার মনের ভেতর যা ঘটে চলেছে, তা হয়ত ওরকমই কিছু হবে।

কিন্তু আসল ব্যাপারটা টের পেলাম অনেকদিন পর। তখন সবসময় কি রকম এক অস্থিরতায় যেন ভুগতাম! বিশেষ করে প্রতি সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফেরার মুহূর্তে তার কথা ভীষণ মনে হত। সন্ধ্যের সময় যখন সূর্য অস্ত যায় চারিদিক বিষন্ন করে এবং পাখিরা ডেকে উঠে, ঠিক সেই সময়ই আমার তার কথা খুব মনে পড়ত। তার চেনাজানা লোকের সঙ্গে একই অটোরিকশাতে যাওয়ার সময় তার মাথা নিচু করে কথা বলার ভঙ্গিমাটা, গালে লাজুক রঙয়ের খেলা, যেন সবসময় আমার চোখের সামনে ভাসত। সে হয়ত চুড়িদার পড়তে ভালোবাসত কারণ তাকে যখনই দেখেছি, তখনই সে চুড়িদার পড়ে থাকত। একেক সময় একেক ডিজাইনের; কিন্তু সবই চুড়িদার। মজার ব্যপার, তাই না!

আর এর মাঝে প্রায় চার মাস কেটে গেল। জানুয়ারির শুরুর দিক থেকে হঠাৎ তার আর কোন দেখা নেই। অনেকদিন এমনও হয়েছে যে অফিস থেকে হাফ ডে করে বেড়িয়ে এসেছি এবং তার অপেক্ষায় স্টেশন চত্বর সহ অটোরিকশার স্ট্যান্ডে ঠায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছি কিন্তু একদিনও তার দেখা পাইনি। এদিকে, তার দেখা না পেয়ে কেমন যেন অস্থির হতে লাগল মন এবং অবশেষে, আর সহ্য করতে পারলাম না। ঠিক করলাম যে কোনভাবে যোগাযোগ করবই। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে খোঁজ নিয়ে জানলাম সে আমার ছেড়ে আসা ইউনিভার্সটিতেই পড়ে। কিন্তু নাম জানতে পারিনি বলে, সেই সময় আর বেশি দূর এগোনো গেল না।

বেশ কিছুদিন পেরিয়ে যাওয়ার পর, একদিন সকালে অফিস যাওয়ার সময় অটোরিকশাতে উঠতে গিয়ে হঠাৎ তাকে দেখতে পেলাম। তবে এবার তার দেখা পাওয়ার পর, বুকের ভেতরটা কেমন ছ্যাঁদ করে উঠেছিল। চোখের সামনে দেখি সেই তরুণী এক মাঝবয়সী যুবকের খুব কাছাকাছি বসে তার সঙ্গে হেসে কথা বলছে। বুকের ভেতরে চেপে থাকা আগুনটা যেন তখন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। ঠিক করলাম ওই অটোরিকশা থেকে নেমে যাব এবং সেই ভাবনা অনুযায়ী কাজও করলাম।

আমি মাঝ রাস্তাতেই অটোরিকশা থেকে নেমে পড়লাম এবং অনেকটা অভিমানেই রাস্তা দিয়ে একা একাই হেঁটে গেলাম। সেদিন অফিসে আমি কারোর সঙ্গেই ঠিক মত কথা বলে উঠতে পারিনি। সারাক্ষণ ওই অটোরিকশার দৃশ্যটা যেন চোখের সামনে ভাসছিল। জানি! এই অভিমানের কোন অর্থ হয় না কিন্তু এটা যে মানুষের মন, তাই এরকম অর্থহীন অভিমান থেকেই যায়। ওই দিন এক মনে কাজ করে গেলাম, এমনকি টিফিনটাও খাইনি।

সেদিন বাড়ি ফেরার সময় হঠাৎ এক পসলা বৃষ্টি হয়ে গেল। অসময় ওই বৃষ্টি দেখে আমার মনে হচ্ছিল, আকাশও বোধহয় আমার দুঃখ আর সইতে না পেরে চোখের জল ফেলছে। সেদিনের ওই নিঃসঙ্গ ভেজা হাইওয়ে আর মৃদু বাতাসে দুলতে থাকা তার দু-পাশে শারি শারি গাছের মাঝে, আমি একাই শুধু হেঁটে চলেছি। মাঝে এক বড় পাথরের উপর বসে কিছুটা মনের দুঃখে, নিজের চোখের জলকে ওই বৃষ্টির জলে লোকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম আর ঠিক তখনই চোখে পড়ল এক সুদর্শন দৃশ্য!

ছাতা মাথায় নিঃসঙ্গ পথ ধরে আপন মনে হেটে চলেছে আমাদের পাশের বাড়ির মেয়ে রোদ্দুর। বর্ষণ বোধহয় সেদিনও দেরি করেছে সুতরাং বিরক্ত হয়ে রোদ্দুর, হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার পাশে একটা গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়াল। দু-চোখ ভরে দেখতে লাগল ভেজা প্রকৃতির অদ্ভুত সৌন্দর্যকে। আর হঠাত্‍ পিছন থেকে সুন্দর গলায় কে যেন দু-লাইন গেয়ে উঠল।

“বৃষ্টি নেমেছে আজ, আকাশ ভেঙ্গে, হাঁটছি আমি এই রাজপথে।
মনের ক্যানভাসে ভাসছে তোর ছবি, বহুদিন ধরে তোরে দেখি না যে।”

গানটা এবং গান গাওয়া কন্ঠটা রোদ্দুরের খুবই পরিচিত। ঝট করে সে পিছন ফিরতেই দেখে বর্ষণ তার সামনে দাঁড়িয়ে।

এই অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্যটি দেখার পর আমার সেই লুকনো কান্না যেন কোথায় হারিয়ে গেল। সত্যি! একেই হয়ত প্রেম বলে। এরকম কিছু অনুভূতি প্রেমে না ভিজলে হয়ত স্বাদ পাওয়া যায় না। ওই দিনের পর নিজেকে আরও বদলে ফেললাম এবং ঠিক করলাম আর নয়, অনেক হল মরীচিকার পিছনে হাটা। ফলে, সব ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু আবারও, এ যে মানুষের মন তাই বায়োস্কোপের মত দ্রুত নিজেকে পালটাতে পারিনি।

এদিকে, অফিসে আমার এক বন্ধু, প্রলয় বেশ কিছুদিন ধরে আমার স্বভাব লক্ষ্য করে আসছিল এবং একদিন তাই বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই সে আমায় ফোন করেছিল আর ফোন ধরতে না ধরতেই বুঝতে পেরেছিলাম প্রলয় আমার ব্যাপারে অনেক কিছুই আন্দাজ করেছে।

অনেকক্ষণ ফোনে আমার আওয়াজ না পেয়ে সে বলেছিল,”তোর যখন সারা পাচ্ছিনা তখনই বুঝেছি, কিছু একটা গণ্ডগোল আছে”।

আমি বললাম,”না মানে ওই”।

“কি মানে মানে করছিস? কি হয়েছে ঠিক করে বল তো”,বলল প্রলয়।

আমি আর নিজেকে সামলাতে না পেরে সব উগড়ে দিলাম ওর কাছে এবং সব শুনে প্রলয় বলল,”জীবনে আমরা যেমন অনেক কিছু ভাবি, ঠিক তেমন অনেক ক্ষেত্রেই আবার সফল হইনা। তবে এর মানে এই নয়, যে জীবন সেখানেই শেষ”।

আমি ওকে থামিয়ে বললাম,”আরে, না! তুই আমার কথার মানে বুঝছিস না। সেই ভাবনা আর আমার ওকে ভালো লাগার মধ্যে এক বিস্তর পার্থক্য আছে। ওকে ঘিরে হয়ত আমার মনে এক অন্য দুনিয়া তৈরি হয়েছে”।

তারপর প্রলয়  বেশ রেগেই বলল,”তোকে না মাঝে মাঝে থাপরাতে ইচ্ছা করে। এতদিন ধরে একটা মেয়েকে ভালো লাগে আর তার সঙ্গে আজ অবধি একবারও কথা বলে উঠতে পারলি না। এমনকি নাম ঠিকানা কিছুই জানতে পারলি না”।

আমি মৃদু স্বরে বললাম,”চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি”।

প্রলয় বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল,”অনেক হয়ছে, যা যা। মেয়েটা এবার সামনে এলে, একটু সাহস করে নিজের মনের কথা বলে দিস”।

“কিন্তু প্রলয় শোন…”। আমার কথা শোনার আগেই প্রলয় ফোন কেটে দিল। ওর কথাগুলো শুনে আমার যেন বুকে ব্যাথা শুরু হয়ে গেল। তখন মনে হচ্ছিল আশেপাশের সব কিছু যেন থেমে গেছে।

কিছুদিন পরে আবারও একই অটোরিকশাতে ওই মেয়েটির সঙ্গে আমার দেখা হয় কিন্তু আমি এড়িয়ে যাওয়ারই চেষ্টা করলাম। কানে হেডফোন গুঁজে গান শোনার তখন ভান করছিলাম। তবে সেদিন দেখালাম একটু অন্য রকমই কিছু ঘটল। হ্যাঁ! সে নিজেই এগিয়ে এল কথা বলতে। না! অন্য কিছু নয়। সে শুধু বলেছিল,”এক্সকিউজ মি শুনছেন, পঞ্চাশ টাকা খুঁজরো হবে?”

আমি তো গত সাক্ষাতের সেই ঘটনার কথা ভেবেই রাগে বলে দিলাম,”না! হবে না”।

তারপর কিছুক্ষণ বাদে শুনতে পেলাম ও যেন কার সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। ওই সময় একটু মনে রাগও হচ্ছিল, ভাবলাম বুঝি সেই ছেলেটাই ফোন করেছে। কিন্তু না। ওপাশে, দিয়া বলে কোন এক মেয়ে ছিল এবং ওকে বলতে শুনলাম,”এবার বসন্ত উৎসবে জোড়াসাঁকোতে আসছিস তো? বেশি দেরি করিস না, আমায় আবার একা ফিরতে হবে। তোদের মত তো আমার আর দোসর নেই, কি করব বল! আমার তো প্রথম থেকেই পোড়া কপাল”।

এই কথাগুলো শোনা মাত্রই আমার মনে দিনের পর দিন জমে থাকা অভিমানের পাথরটা, এক ঝটকায় যেন ভেঙে চুরচুর হয়ে গেল। তখন অবশ্য বড্ড আফসোস হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল কেন যে খুঁজরোটা রাগের বশে দিলাম না! হয়ত ওই পঞ্চাশ টাকা খুঁজরো দিয়েই আমাদের কথা বলা শুরু হতে পারত। কিন্তু হায় আমার পোড়া কপাল! নিজের ব্যবহারের ফল তখন নিজেকেই ভোগ করতে হল। একবার ভাবলাম অটোরিকশা থেকে নেমে আজ কথা বলবই কিন্তু সেটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে ভেবেই নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিলাম।

সেদিনের পর ওই তরুণীর সঙ্গে বেশ অনেকদিন আর দেখা সাক্ষাৎ হল না। এবারের বিরতিটা অনেক দিনের সুতরাং একটা সময় আর দেখা হবে না ভেবে বসেছিলাম কিন্তু ওই বসন্ত উৎসবে ঠাকুরবাড়ি যাওয়ার ব্যাপারটা আমার মাথায় ছিল। ফলে, সেই অনুযায়ী আমি পরিকল্পনাও করে ফেললাম এবং ঠিক করলাম এবার প্রলয়ের কথা মত আর সময় নষ্ট না করে নিজের মনের কথা বলে ফেলবই। তবে মুখে নয়, চিঠির মাধ্যমে সুতরাং তাই লিখে ফেললাম এক বিরাট চিঠি।

মনে, হ্যাঁ না নিয়ে একটা আশঙ্কা ছিলই সুতরাং অনেক ভেবে ঠিক করলাম যদি তার চিঠির উত্তর ‘না’ হয়, তাহলে ওটাই হবে আমার তার সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ। সেই দিনের পর, ওই তরুণী আমার কাছে কোন এক রূপকথার রাজকন্যা হয়েই থেকে যাবে।

সময় যেন প্রায় থমকে গেছিল। দিনগুলো যেন কিছুতেই কাটছিল না। তাকে আবার রোজ দেখছি অটোরিকশাতে অথচ কথা বলার মত সাহস একদিনও আমার মধ্যে আর জন্মালো না। এদিকে, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির বসন্ত উৎসবের কথা মাথায় রেখে কিছুদিন আগে থাকতেই অফিসে ছুটির জন্য আবেদন করে রেখেছিলাম। এই বিষয় অবশ্য প্রলয় আমাকে বড্ড সাহায্য করেছিল। অবশেষে ওই দিন এসে উপস্থিত, আমি সেদিন অফিসে এক জরুরি কাজের বাহানায় বাড়ি থেকে জলদি বেড়িয়েছিলাম যাতে সময়ের আগেই আমি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি পৌঁছে যেতে পারি। ফলে, অফিসের ব্যাগে ওই চিঠি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম এক স্বপ্ন ছোঁয়ার নেশায়।

প্রলয়ের আমার সঙ্গে যাওয়ার কথা থাকলেও, শেষ মুহূর্তে সে আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল সুতরাং আমাকে একাই ওই হাজার ছেলেমেয়ের ভিরে সামিল হতে হল। সেখানে রবীন্দ্র সংগীতের তালে, নানা রঙয়ের আবীরে রাঙ্গানো শত তরুণীর মাঝে আমি যেন সেই তরুণীকেই চারিদিকে খুঁজে চলেছিলাম। তবে হঠাৎ এক তরুণী ওই ভিরের মধ্যে থেকে বেড়িয়ে এসে, আমার দিকে যেন ছুটে এল। আমি ভাবলাম সেই তরুণী হয়ত সে, কিন্তু না। সে সামনে আসতেই বুঝতে পারলাম আমার দেখা ওই তরুণী সে নয়। সে আমার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা, তার ভালোবাসার সঙ্গীটিকে ওই প্রাঙ্গণে স্বাগত জানাতেই ছুটে এসেছিল।

অনেকক্ষণ চুপচাপ একভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর, অবশেষে তার দেখা পেলাম। সেদিন আর চুড়িদার নয়, তার পরনে ছিল হলদে শাড়ি। মাথার দীর্ঘ কালো কেশ ওইদিন খোপায় আবদ্ধ ছিল, যার মধ্যে দিয়ে উঁকি দিচ্ছিল এক সূর্যমুখী ফুল। তার কানে দুল আর হাতের বালা সেদিনও ছিল বটে। কিন্তু আমার দেখা তার সেই বৃষ্টি ভেজা শরীর, ওইদিন যেন নানা আবীরের রঙয়ে মেতে উঠেছিল। সত্যি! তার সৌন্দর্য যে কোন পুরুষকেই, খুব সহজে তার দিকে আকৃষ্ট করতে পারে। আমি দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর, তাকে সামনে পেয়ে আর যেন নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। ভিতর থেকে এক অন্য আমি যেন বেড়িয়ে এল এবং সাহস নিয়ে এই প্রথমবার তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

আমাকে দেখা মাত্রই সে এগিয়ে এসে বলল,”আপনি এখানে?”

উত্তর দেব কি! আমার সব সাহস যেন তার সামনে যেতেই অদৃশ্য হয়ে গেল। কি বলব বুঝে উঠতে না পেরে বললাম,”না! আসলে আমার এক বন্ধু এখানে আসবে বলেছিল, তাই ওর সঙ্গেই দেখা করতে এসেছি”।

আমার কথা শুনে ওই তরুণী শুধুই হাসল এবং তার হাসি দেখে আমি চিঠির কথা ভুলে দিব্বি হারিয়ে গেছিলাম আমার নিজের তৈরি করা সেই রূপকথার নগরে। সে অবশ্য ভেবেছিল আমি হয়ত কিছু বলব কিন্তু আমার ঘোর তখনও কাটেনি সুতরাং সে আবারও তার মিষ্টি গলার স্বরে বলেছিল,”আপনি আর কিছু বলবেন?”

আমার মনে এতদিন ধরে জমে থাকা হাজার এক কথা সেদিন বেরিয়েও বেরল না, এমনকি তার নামটাও জিজ্ঞেস করতে পারিনি। তাকে শুধু বলতে পেরেছিলাম,”ভালো থাকবেন”।

হ্যাঁ! এই ‘ভালো থাকবেন’ কথাটা বলেই আমি সেদিন বাড়ি ফিরে এসেছিলাম এবং ওই চিঠি আমার কাছে আজও রয়ে গেছে। এখন মাঝে মধ্যে ভাবলে অবাক লাগে যে শুধুমাত্র ওই দুটো কথা বলতেই আমার এতগুলো মাস লেগে গেছিল। তবে সেদিনের পর আমাদের আজও যখনই দেখা হয়, তখনই আমরা পরস্পরকে দেখে হাসি। সেই সরল হাসির মধ্যেই তখন আমি আমার ভালো লাগাকে খুঁজেনি এবং ওই হাসিতেই আমার ভালোবাসা সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। আমি আর কোনদিনই তাকে নিজের মনে কথা বলতে পারিনি, সেটা অবশ্য অনেকটা ইচ্ছা করেই বলিনি কারণ সেই উত্তর যদি ‘না’ হত, তাহলে ওই মুহূর্তেই আমার ভালোবাসার মৃত্যু ঘটত এবং রোজ এই দেখা হলেই যে হাসির আদান-প্রদান ঘটে, সেটা হয়ত একেবারেই থেমে যেত সুতরাং এই একে-অপরে প্রতি এই সরল হাসিটুকুই এখন আমার কাছে ওই ‘হ্যাঁ’ শব্দের চেয়েও অনেক বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আজকাল হয়ত ভালোবাসা খুব সহজে প্রকাশ করা যায় কিন্তু বাস্তবে এমন অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে ভালোবাসা কেবল মাত্র ওই সামান্য ‘ভালো থাকবেন’ কথাটির মত কিছু অল্প শব্দের মধ্যেই চিরকাল সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। বসন্তের পাখি জেগে উঠলেও, চিরনিদ্রায় চলে গেছে। সেবার বসন্তের রঙ আমার গায়ে লাগলেও, পূর্ণতা পায়নি ঠিকই কিন্তু আমাকে অনেক কিছুই শিখিয়ে গেছে। যার ফলে, গোটা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি সেবার বসন্ত উৎসবে মেতে উঠলেও, আমার জীবনে ওই বসন্ত এক অন্য বসন্তের সূচনা করেছিল।

 

লেখক পরিচিতি : রনিত ভৌমিক, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পড়াশোনা করেছেন ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড কমিউনিকেশন নিয়ে। বর্তমানে পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার হলেও, লেখালিখি তার নেশা। তার লেখা বই ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন
পত্রিকা ও ই-ম্যাগাজিনেও তার লেখা বেরিয়েছে।

SOURCEরনিত ভৌমিক
Previous articleএকলা আমি
Next articleউঁচু গলা
Avatar
Disclaimer: Monomousumi is not responsible for any wrong facts presented in the articles by the authors. The opinion, facts, grammatical issues or issues related sentence framing etc. are personal to the respective authors. We have not edited the article. All attempts were taken to prohibit copyright infringement, plagiarism and wrong information. We are strongly against copyright violation. In case of any copyright infringement issues, please write to us. লেখার মন্তব্য এবং ভাবনা, লেখকের নিজস্ব - কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত..................

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here