ঝোলা কাঁধে মানুষটাকে বাসরাস্তার দিকে চলে যেতে দেখে চিৎকার করে ডাকতে গেল শিখা, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোলো না কিছুতেই , কেমন একটা চিঁচিঁ শব্দ ! ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। দুপুর থেকে কেবল ঘর-বার করেছে, সঙ্গে দুশ্চিন্তা থেকে থেকে মনটা কেবলই কু গেয়েছে-‘কিছু হলো না তো, এত দেরি কেন হচ্ছে, এমন তো হয়না! ‘ক্লান্ত হয়ে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছিল, ঝিমুনি এসে চোখ লেগে গেছিল ,আর তার মধ্যেই এইরকম স্বপ্ন। উদ্বেগে অস্থির হয়ে কেবলই ঘর বার করেছে শিখা। কেন যে মরতে একা যেতে দিলো মানুষটাকে! একদণ্ড স্থির হয়ে বসতে পর্যন্ত পারে নি। তিনদিন ধরে জ্বরে ভুগছে শিখা। না হলে মানুষটাকে একা ছাড়ত না কিছুতেই। মাসে একবার হলেও শহরে যেতে হয় পেনশনের টাকা তুলতে আর প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধপত্রও নিয়ে চলে আসে তখনই। শিখা সেসময় সঙ্গেই থাকে তার।
পাহাড়তলির এদিকটায় জনবসতি খুব একটা নেই, ফাঁকা ফাঁকা কিছু ঘর, একটার পর একটা পাথর সাজিয়ে দেয়াল আর তার উপর ডালপালা দিয়ে লতাপাতার ছাওয়া। কিন্তু বড়ো মনোরম আর শান্ত পরিবেশে মনের সব জ্বালা জুড়িয়ে জল! চারদিক কোমল পেলব, সবুজ মখমলে মোড়া। খানিক দূরে একটা ঝরণা, স্বচ্ছ জলের স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায় পৃথিবীর যত দুঃখ বেদনা শোক।এখানে এই ঝর্ণাধারার পাশে দাঁড়িয়ে একদিন শিখা বলেছিল -“ভাসিয়ে দিলাম দুখের পশরা নির্ঝরিণীর স্রোতে ।”
কলেজের পড়া শেষ হবার আগেই আচমকা হৃৎপিন্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে চলে গেলেন বাবা। শিখার জীবনের সব দরজাও বুঝি বন্ধ হয়ে গেল সেদিন।
একটা পুরানো সেলাই মেশিন ঘরেই ছিল,সেলাইয়ের কাজ আর বাচ্চাদের পড়ানো, এর উপরেই ভাই আর মায়ের দায়িত্বে অবিচল থেকেছে বরাবর। নিজের কথা ভাববার অবসর মেলেনি তার। মাও চলে গেলেন একসময়। ভাইও ব্যস্ত তার সংসার নিয়ে, শিখাও ব্যস্ত থেকে গেছে আগের জীবনেই ।বুকের ভেতরটা শুধু ফাঁকা ঠেকতো সবসময় । শিখা ব্যাঙ্কে গেছিলো ভাইঝির স্কুলের বেতন জমা করতে। সেখানেই পরিচয় তপনবাবুর সঙ্গে। সে পরিচয় একদিন ভালোবাসায় পরিণত হলো,দুজনেরই একে অপরকে ছেড়ে থাকা প্রায় অসম্ভব বলে মনে হলো। তখন শিখা সাতচল্লিশ আর তপনবাবুর বাষট্টি। শিখা অবিবাহিত হলেও তপনবাবুর ভরা সংসার। তপনবাবু শিখাকে আঁকড়ে ধরতে চাইলেও শিখা সেদিন রাজি হতে পারে নি, তপনবাবুর সম্মান ক্ষুন্ন হবার কথা ভেবেই।বুকে পাথর বেঁধে তপনবাবুকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। কষ্ট কী কিছু কম হয়েছিল তার! আর আজ! সেই তো তার সঙ্গেই রয়ে গেল শেষ পর্যন্ত। জীবনের গতি বড়ো বিচিত্র।কার জীবনে কখন যে কী ঘটবে বলা মুশকিল! এ বোধহয় অমোঘ নিয়তির নির্দেশ ,নাহলে শিখার পক্ষে এ জীবন যাপন তো কল্পনাতীত ছিল।
ঠাকুমা বলতেন-” সেই যদি পায়ের মল খসালি, তবে কেন লোক হাসালি! ” শেষ পর্যন্ত তাই তো হলো। বড়ো একা লাগতো তার! বড়ো ভয়ানক এই নিঃসঙ্গতা ! একটা হতাশা ক্রমশ গ্রাস করে ফেলছিল। এরকম একটা সময়েই তার দেখা হয়েছিল তপনবাবুর সঙ্গে। তারপর একটু একটু করে ভালোলাগায়, ভালোবাসায় জড়িয়ে গেছিলো শিখা। জীবনের প্রথম প্রেম! মনে তার জোয়ার এসেছিল। আশ্চর্য একটা অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে গেছিল সমস্ত সত্তা । সম্বিৎ ফিরলো যেদিন, তপনবাবুর সংসার আর সম্মানের কথা ভেবে নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকলো। আকুল উদ্বেগে দিনগুলো কাটছিল। মোরাং আসতো বনমোরগ বেচতে। আসতো শিখাদের বাড়ীতেও।ওই একদিন এসে বললো ‘আমাদের উখানে যাবে দিদি,আমাদের ছেইল্যা দিগে পড়াবে। সবাই তুমাকে মাথায় করে রাখবেক ! এককথায় রাজি হয়ে গেছিল সেদিন। হয়তো পালাতেই চেয়েছিল সে!বলেছিল-‘ চলো না দিদি একবার দেইখ্য আসবা না হয়!’ সেই মন কেমনের দিনগুলোয়, বুকের ভেতর আর্ত হাহাকার জেগে ছিল তখনো। গেছিল শিখা সেই নিবিড় শান্ত পরিবেশে,সেই মৌন স্তব্ধতার মাঝে দর্শনের ছাত্রী শিখা স্বস্তি খুঁজে পেয়েছিল সেদিন। সেই থেকে রয়ে গেছিল সেই বনবাসে! গোটা দশেক বাচ্চাকে পড়াশোনা শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছিল। নিজের কিছু জামাকাপড়, বই আর জমানো কিছু টাকা ছাড়া আর কিছুই আনেনি। প্রকৃতির মাঝে কত কিছুই না পেয়ে যেত! খানিক দূরে একটা মাত্র চায়ের দোকান!সারাদিনে মাত্র দুবার বাস যাওয়া আসা করে। মাসে একবার হাট বসে যখন, আশপাশের গাঁ গঞ্জ থেকে লোক এসে হাটে যাবতীয় বেচাকেনা সেরে নেয়।মোরাং শিখার ভাইকে বলেছিল-‘দিদির জন্য কুনো চিন্তা করার দরকার নাই , আমি তো রইলুম। ‘মোরাংদের গ্রামে যাবার বছরখানেক পর শহরে গেছিলো,টাকার দরকারে ব্যাঙ্কে গিয়ে তপনবাবুর সঙ্গে আবারো হঠাৎ করেই দেখা হয়ে গেছিল সেদিন।
ব্যাঙ্কের চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসেছিলেন, বড়োই ক্লান্ত আর অসহায় লাগছিল তাকে।সে চেহারা আর নেই, চোখ বুজে বসে ছিলেন। পাশে বসে গায়ে হাত দিয়ে ডাকতেই চোখ খুলে শিখাকে দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। ক্লান্ত দুচোখের গভীর দৃষ্টিতে শুধুই অভিমান! মনে হলো শিখাকে দেখে কিছু একটা খুঁজে পেয়েছেন । স্ত্রী চলে গেছেন, ছেলেরা বাইরে, বাবাকে নিয়ে যেতে চাইলেও যাননি তিনি,মনের গভীরে বোধহয় সুপ্ত আশা ছিল শিখাকে খুঁজে পাওয়ার। একটা কাজের মেয়ে সকালে এসে বাড়ীর কাজ,রান্না করে রেখে চলে যায় । যেদিন আসে না পাউরুটি ভরসা।সব শুনে শিখা তাকে নিজের কাছে নিয়ে চলে গেল। যাবার আগে কাজের মেয়ের বেতন, দোকানের টুকটাক জিনিস কেনার টাকা, দুধের টাকা সব মিটিয়ে দিয়ে গেল। শিখা খুব যত্নে রেখেছে তাকে। এতটুকুও অযত্ন হতে দেয় না। মুক্ত প্রকৃতির অঙ্গনে শিখার ভালোবাসা আর যত্নে তপনবাবুর স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটেছে। শিখার মনেও খুশির অন্ত নেই ,বুকের গভীরে ইমনের আনাগোনা। মনটা আনন্দে আত্মহারা। যখন তখন বুকের ভেতর থেকে উচ্চকিত আনন্দের অণুরণণ “মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি,”দুজন দুজনকে এত কাছে পেয়ে অদ্ভূত অনুভূতিতে আপ্লুত ! আশ্চর্য একটা আকুলতা পরস্পরকে গভীর ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে।শিখার মাথায় হালকা হাতে তেল মাখিয়ে দিতে দিতে বলেন-‘দেখো, পারলে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে! সেই তো কাছে আসতেই হলো ! ”এটাই যে নিয়তি, ঈশ্বরের ইচ্ছেতেই আমাদের দেখা হয়েছে, তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে পারি নি। না হলে আমার জীবনের পথে কারো ছায়াই পড়লো না, আর তোমার সাথে দেখা হবার পর আমার জীবন আমূল বদলে গেল । তোমার প্রেমে পাগল হলাম কিন্তু তোমার সম্পর্কে আমার মনোভাব কখনোই প্রকাশ করতে পারি নি আমি।”বড়ো অন্যায় করেছিলে,যদিও সবই বুঝতে পেরেছিলাম। এত ভালোবেসেও সেদিন আমায় যখন ফিরিয়ে দিলে,বড়ো অভিমান হয়েছিল। তোমার সঙ্গে কতদিন পর দেখা হলো ,আমাকে নিয়ে এলে। নিজের কাছে আগলে রাখলে পরম মমতায়! বলো কোনদিন আমায় ছেড়ে যাবে না তো! তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না শিখা, কথা দাও কোনদিন ছেড়ে চলে যাবে না।’
তাড়াতাড়ি মুখে হাত চাপা দিয়ে শিখা বলে -‘নাগো এমন করে বলো না, আমিও তো তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না। কেউ কাউকে ফেলে চলে যাবো না, দেখো। যখন যাবো একসাথেই যাবো না হয়! “
তপনবাবু বলেছিলেন ‘এই স্মৃতি বিজড়িত দিনের মধুর রোমন্থনেই আমাদের ক্ষণিক সুখের উৎসব।আমাদের পথ হারানোর খেলা নিছক দুর্ঘটনা নয়! সাজানো সংলাপ,যা সময়ের সাথে বলাতাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া তুমি জানো!আমায় ভুল বুঝোনা আমিও তো মানুষ!দোষ গুন পাপ পূণ্য অভীপ্সা নিয়ে নিজেকে নিজের কাছে লুকিয়ে রেখেছিলাম,জীবনটা অবক্ষয়ের কবলে পড়ে নিঃস্ব,রিক্ত !আর কিইবা চাইবো মুঠোভর দিন যাপনে!বসন্ত এসে রাঙিয়ে দিক শেষের দিনগুলো।’
এসব কথা আজ এত মনে পড়ছে!. মনটা বড়ো কু গাইছে। বেলা পড়ে এলো, বাচ্চাগুলোকেও আজ মন দিয়ে পড়াতে পারেনি। মন লাগবে কী করে! একটু বেরিয়ে দেখবে কিনা, ভাবতে ভাবতেই তপনবাবুকে আসতে দেখল । শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে শিখার বুকের মধ্যে মোচড় পড়ে, তাড়াতাড়ি সামনে মুখ হাতধোয়ার জল দিয়ে চা করতে লাগল। চা খেতে খেতে শুনলো মাঝপথে বাস খারাপ হয়ে কীরকম দুর্ভোগ পোয়াতে হয়েছে যাত্রীদের।
সন্ধ্যার পরেই ঝমঝমিয়ে নামলো বৃষ্টি। হালকা করে খিচুড়ি আর হাঁসের ডিমের ডালনা ,বড়ো তৃপ্তি করে খেলো দুজনেই।
সর্বত্রই কেমন যেন একটা মনকেমনের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে ,বেশ একটা ঠাণ্ডা আমেজে মনটা জুড়িয়েদিচ্ছে।লণ্ঠনের স্তিমিত আলোয় ঘরের আলো আঁধারির পরিবেশ আর পাশের জলভর্তি ডোবায় বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যাঙ গুলোর সেই ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ,ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ শুনতে শুনতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে শিখা । ভোর বেলা নিজেকে আবিষ্কার করে তপনবাবুর বুকের মাঝে কুঁকড়ে শুয়ে থাকা অবস্থায়। তপনবাবুর হাতের সস্নেহ বন্ধনে আবদ্ধ তখনো। মেঘলা আকাশটা মনের আঁচল দুলিয়ে দিতে চাইছে। কী যেন একটা চাই অথচ কী চাই তা বলতে পারবে না। , ‘এ আবার কেমন কথা? ‘ সত্যিই তো এ কেমন পাগলামি ! দুজনে আজ কত আপন হয়ে উঠেছে পরস্পর।
কলমে সাবিত্রী দাস, বর্ধমান