বেডরুমের আয়নাটা

কলমে গোবিন্দ মোদক

0
339

দত্তদের বাড়ির নিচতলার ভাড়াটিয়ারা আজ চলে যাচ্ছে। ওদের ফ্ল্যাট রেডি হয়ে গেছে। তাই এগারো মাসের কন্ট্রাক্টে ভাড়ায় আসলেও এক মাস আগেই ওরা ঘর ছেড়ে দিচ্ছে। জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদা হচ্ছিল। মেয়ে টুয়া বলল- বাবা দেখো, এই আয়নাটাকে না কিছুতেই আনা যাচ্ছে না! বাবা ব্যস্ত ছিল টুয়ার কথায় কোনও গুরুত্ব দিলো না। তখন টুয়া মায়ের শরণাপন্ন হলো। মা ছুটে এসে- “কই দেখি! দেখি!” বলে কাঠের আয়নাটা তাক থেকে নামানোর জন্য চেষ্টা করতেই বুঝতে পারলো আয়নাটা আসতে চাইছে না! কাউকে জোর করে আনতে গেলে সে যেমন বিপরীত বল প্রয়োগ করে তার দিকেই শক্তিটা রেখে দেয় — ঠিক তেমনই মনে হচ্ছিল আয়নাটাও বুঝি বিপরীত দিকে টান ধরে আছে অর্থাৎ সে আসতে চায় না! আশ্চর্য! এমনটাও হয়! ব্যাপারটা তো তাহলে টুয়ার বাবাকে বলতেই হচ্ছে!

টুয়ার বাবা ব্যাপারটা দেখলো। তারও কেমন খটকা লাগলো যখন আয়নাটাকে টেনে আনতে চাইলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বল প্রয়োগ করে আয়নাটাকে এনে সে পিচবোর্ডের পেটির মধ্যে রাখলো। যত্ন করে নিতে হবে। পাছে ভেঙে যায়!

গোছগাছ শেষ। সব মালপত্র তোলা হয়ে গেছে। শেষবারের মতো টুয়া ওর ঘরখানা দেখে নিচ্ছিল। তখনই টুয়ার চোখে পড়লো আশ্চর্য ঘটনাটা! টুয়া দেখলো আয়নাটা যেখানে থাকতো ঠিক সেখানেই অবস্থান করছে! এ কী করে সম্ভব! একটু আগেই তো বাবা ওটাকে কাঠের প্যাকিং বাক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়েছে এবং গাড়িতে তোলা হয়েও গেছে! তাহলে! 

— টুয়া দেরি করছো কেন? শীঘ্র এসো! আমাদের গাড়ি ছেড়ে দেবে!

টুয়া ছুটে বাইরে গেলো, তারপর এই আশ্চর্য ঘটনাটা বলবার জন্য প্রস্তুত হলো। কিন্তু ততক্ষণে ড্রাইভার তাগাদা দিচ্ছে। কাজেই টুয়াকেও উঠে পড়তে হলো — ঘটনাটা আর বলা হলো না!

       *****               *****               *****

দত্তদের বাড়ির নিচতলায় আজ আবার নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। এরাও তিনজন — মা-বাবা আর টুম্পা। টুম্পা ওর সহজাত স্বভাববশতঃ নেচে নেচে ঘরগুলো দেখছিলো। দেখা শেষ হলে একসময় এসে বলল- দেখো বাবা, এই ঘরে একটি আয়না রয়েছে। বোধহয় আগে যারা থাকত তারা নিয়ে যেতে ভুলে গেছে! 

— উঁহু! ওসবে একদম হাত দেবে না! আমি দেখছি! ওটাকে বাইরে নিয়ে গিয়ে ফেলে আসি। কারও ব্যবহার করা জিনিস নিতে নেই বাবা!

টুম্পার বাবা আয়নাটিকে নিয়ে বাইরে জঞ্জালের পাশে রেখে আসে। তারপর নিজেদের জিনিসপত্র গোছাতে মন দেয়।

বিকেল বেলা টুম্পার বাবা অবাক হয় — তাকের যেখানে আয়নাটিকে দেখেছিল ঠিক সেইখানেই আয়নাটিকে এনে কেউ বসিয়ে রেখেছে! নিশ্চয়ই টুম্পার কাজ!

— টুম্পা! এই টুম্পা! তুই আবার দুষ্টুমি শুরু করেছিস!

— কি হয়েছে বাবা! কই, আমি তো কিছু ভাঙিনি! দুষ্টুমিও করিনি!

— না, ভাঙোনি বটে – এটা ঠিক! কিন্তু তুমি ওই আয়নাটিকে এনে আবার যথাস্থানে রেখেছো, সেটা তো ঠিক করোনি! 

— সে কি! আমি আবার কখন আয়না আনতে গেলাম! আমি তো আয়না-টায়না আনিনি!

— তাহলে কি আমি এনেছি! নইলে আমি আয়নাটাকে বাইরে বের করে দিলাম, অথচ তার কি হাত-পা গজালো যে সে আবার নিজের জায়গায় এসে গ্যাঁট হয়ে বসলো! নিশ্চয়ই তুমি হাতে করে এনেছো! আবার এখন মিথ্যে বলছো!

— ওঃ বাবা! আমি মিথ্যে বলছি না! আমি কষ্মিনকালেও ওই আয়নাটিকে ঘরে আনিনি!

টুম্পার বাবা যথারীতি টুম্পার কথা বিশ্বাস করলো না! যাইহোক টুম্পাদের জীবনে এভাবেই চলতে লাগলো। একদিন টুম্পাদেরও এগারো মাসের মেয়াদ শেষ হলো। ওদেরও জিনিস গোছগাছ হতে লাগলো। টুম্পা ভাবলো ঐ কাঠের আয়নাটিকে সে নিয়ে যাবে। আয়নাটির উপর বড়ো মায়া পড়ে গেছে। ওর সঙ্গে টুম্পা অনেক কথা বলে। আয়না বোধহয় ওর কথা বুঝতে পারে। সেজন্য যখন খুশি হয় আয়নাটা, তখন ঝকঝকে হয়ে ওঠে। আবার যখন আয়নাটার মন খারাপ হয় তখন আয়নাটা কেমন যেন ঘোলাটে অস্পষ্ট হয়ে ওঠে! এর সঠিক কারণ টুম্পা জানে না। কিন্তু আয়নার এই আচরণে টুম্পা অবাক হয়েছে। বস্তুতপক্ষে  ওটার সঙ্গে টুম্পার বেশ বন্ধুত্ব হয়েছে বটে, কিন্তু ওকে ঠিক চিনতে পারেনি। তাই টুম্পা ঠিক করলো আয়নাটিকে নিয়ে যাবে ওদের নতুন বাড়িতে।

কিন্তু আয়নাটিকে নিতে গিয়েই বিপত্তি হলো। আয়নাটি কিছুতেই যেতে চায় না। সে যেন পিছন দিকে টানছে! ভয় পেয়ে গেল টুম্পা। সে ভয়ে ভয়ে আয়নাটিকে ছেড়ে দিল। আয়না যথাস্থানেই বিরাজ করতে লাগলো।

      *****               *****               *****

দত্তদের বাড়ির নিচতলায় এভাবে ভাড়াটিয়া যায় … ভাড়াটিয়া আসে …। ওদের বাড়ির ভাড়াটিয়া এতো বার বদল হয় যে লোকের চোখে লাগে। কিন্তু এর কারণটা কেউ ভেবে পায় না। কারণ দত্তরা খুব নির্বিবাদী মানুষ, ওরা কারও সাতে-পাঁচে থাকে না। ভাড়াটিয়াদের সঙ্গেও কখনোই ঝগড়াঝাঁটি হয় না। অথচ কি এক অজ্ঞাত কারণে ভাড়াটিয়ারা এই আসে … এই যায় …।

কিন্তু কালক্রমেঃ রহস্যভেদ হলো। বিভিন্ন উড়ো কথাবার্তায় এবং ভাড়াটিয়াদের বলা কথা থেকে যেটুকু বোঝা গেলো — তাতে সব রহস্যের মূলে হলো একটি আয়না! অতি সাধারণ পুরোনো মডেলের একটি কাঠের ফ্রেমের আয়না — অথচ তাতেই এতো রহস্য! ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হয় না কারোরই! অথচ এই আয়নাটিকে কেন্দ্র করেই রহস্য ঘনীভূত হয়ে ওঠে। তারপর দত্তদের বাড়ির নিচতলায় আসা বিভিন্ন ভাড়াটিয়ার সংসারের মধ্যে ঘটতে থাকে বিচিত্র সব ঘটনা!

    *****               *****               *****

এ মাসে আবার দত্তদের বাড়ির ভাড়াটিয়ারা উঠে গেলো। কয়েকদিনের মধ্যেই নতুন ভাড়াটিয়া এলো নববিবাহিত দম্পতি রাজেশ ও মানালি। তাদের কোনও ছেলে মেয়ে নেই, নেই মানে এখনও হয়নি, এই আর কি। তারা দু’জন বেশ গুছিয়ে সংসার করতে বসলো। কিন্তু সমস্যা বাধলো কয়েকদিন পর। রাজেশ অফিসে বের হয়ে যাওয়ার পরই মানালি পুরো একা। তার আর সময় কাটতে চায় না। বই পড়ে, গান শুনে, টিভি দেখে, ফেসবুক করে আর কতোক্ষণ সময় কাটে! হাঁপিয়ে উঠলো মানালি। 

ঠিক এরই মধ্যে একদিন এক ঘটনা ঘটলো। মানালি অলসভাবে বিছানায় শুয়ে ছিল। একটু তন্দ্রামতো এসেছিল। হঠাৎ তার মনে হলো কে যেন তাকে খুব আদর করছে — তার কোমরে হাত দিচ্ছে, তার নাভিতে হাত দিচ্ছে, তার স্তনবৃন্তদু’টি খোঁজবার চেষ্টা করছে। চমকে উঠলো মানালি, তার ঘুম ভেঙে গেলো! কিন্তু একি! কেউ তো কোথাও নেই! রাজেশ তো এখনও অফিস থেকে ফেরেনি! ঘরের দরজাও তো ভিতর থেকেই বন্ধ করা আছে। তাহলে? মানালি তার শোওয়া অবস্থা থেকে উঠলো, ঠিক সেই সময়েই সে লক্ষ্য করলো বিছানায় সেই পুরোনো আয়নাটা! হ্যাঁ, এই সেই আয়নাটা! ওরা যেদিন প্রথম এই বাড়িতে ভাড়ায় এসেছিল, সেদিনই তাকের ওপরে আয়নাটিকে দেখেছিল — বোধহয় আগের ভাড়াটিয়া এটাকে ফেলে রেখে গেছে। অন্যের ব্যবহার করা জিনিস ব্যবহার করা উচিত না — অন্তত মানালির প্রবৃত্তিতে তা বাধে। কাজেই সেটিকে মানালি বাইরে বের করে রেখে এসেছিল জঞ্জালের মধ্যে। কিন্তু কবে যেন আয়নাটিকে আবার যথাস্থানে দেখতে পেয়েছিল মানালি। আশ্চর্য! তাহলে কি রাজেশ আবার এনে রেখেছো আয়নাটাকে? রাজেশকে জিজ্ঞেস করতেই অবাক হয়েছিল রাজেশ — আরে! সামান্য আদ্যিকালের একটা আয়না সেটাকে আমি এনে তাকে গুছিয়ে রাখবো! তুমি ভাবলে কি করে! হেসে উঠেছিল রাজেশ। তারপর নিজের হাতে সেটিকে আবার বাইরে জঞ্জালের মধ্যে রেখে এসেছিল। কিন্তু ক’দিন পরে ওরা দু’জনেই খেয়াল করলো আয়নাটি যথাস্থানে এসে হাজির হয়েছে! কাজেই সেই আয়নাটিকে এখন বিছানায় দেখে ভয় পেয়ে গেল মানালি। তার গা-টা ছমছম করে উঠলো।

সেদিন রাজেশ ডিউটি থেকে ফিরতেই মানালি সব ঘটনা খুলে বললো। তার কেমন যেন ভয় করছে এটিও জানাতে সে ভুললো না। রাজেশ চিন্তিত মনে সব শুনলো। তারপর ‘ঠিক আছে, দেখছি!’ বলে শুয়ে পড়লো।

পরদিন রাজেশ অফিস চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরের ঘটনা। মানালি একা একা গুনগুন করে গান গাইছিল। হঠাৎ মনে হল মানালির গানের সুরের সঙ্গে সুর মিলিয়ে কে যেন ভায়োলিন বাজাচ্ছে! বেশ মিষ্টি সুর! মানালি গান বন্ধ করতেই বাজনাও থেমে গেল। আশ্চর্য! মানালি আবার গান ধরলো। অমনি বেজে উঠলো ভায়োলিন! মানালি আবার গান থামালো। আবারও থেমে গেল ভায়োলিন। আশ্চর্য! এবার রীতিমতো ভয় করতে লাগলো মানালির। তবুও মন্ত্রমুগ্ধের মতো সে পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ালো আয়নাটার সামনে। তারপর দুই হাতে আয়নাটিকে তুলে ধরলো। মুহূর্তে তার মনে হলো আয়নাটিতে কেমন যেন প্রাণ  সঞ্চারিত হয়েছে। ক্রমশঃ আয়নাটি যেন এগিয়ে আসছে তাকে চুমু খাওয়ার জন্য। এসব কি হচ্ছে! বলে আয়নাটিকে দূরে ছুঁড়ে ফেলতে গেল মানালি। কিন্তু আয়নাটি তার হাত থেকে একটুও সরলো না। বরং জোর করে এগিয়ে এলো তার ঠোঁটের উপর। তারপর একজন পুরুষ মানুষ আষ্টেপৃষ্টে চুমু খেলে যেমনটি হয় তেমনই একটা অনুভূতি হল মানালির। 

মানালি তো ভয়ে বিহ্বল হয়ে পড়লো, কি করা উচিত সে ভেবে পেলো না। সে পাশের ঘরে গিয়ে সোফাতে বসলো। তারপর হাঁপাতে লাগলো। কখন যেন তার ঘুম এসে গেছিল। হঠাৎ মনে হল কেউ তাকে আদর করছে, তার তলপেটে হাত দিচ্ছে, তার বুক দু’টোকে আলতো করে চেপে ধরছে এবং সেই সঙ্গে সেই সমস্ত কিছু করছে যাতে করে মানালির কামনা জেগে ওঠে! এক ঝটকায় সোজা হয়ে উঠে বসলো মানালি। একি তার সোফাতে আয়নাটা এলো কি করে! নাঃ! এ তো দেখছি অদ্ভুত ব্যাপার! আর এখানে থাকা নয়! এই ভুতুড়ে আয়নার সঙ্গে একই বাড়িতে একই ছাদের নিচে সে আর কখনোই থাকতে পারবে না!

রাজেশ বাড়ি ফিরতেই তার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো মানালি। তারপর আয়নার সমস্ত কাহিনী তাকে বললো এবং জানালো আর একটি রাতও সে এই বাড়িতে থাকতে পারবে না! রাজেশ তাকে শান্ত করলো।

পরদিন পাড়ার লোকজন দেখল একটি লরি এসে দাঁড়িয়েছে। দত্তবাড়ির নিচের ভাড়াটিয়াদের মালপত্র তোলা হচ্ছে।

কয়েকদিন পর আবার একটি লরি এসে দাঁড়ালো। আবার মালপত্র নামতে শুরু করলো। আবার নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। ভাড়াটিয়াদের ছেলেটি খুব সুন্দর দেখতে, একদম গাবলু যাকে বলে, নাম গাবলু! গাবলু ঘরে ঢুকেই মাকে বলে উঠলো — ওই দেখো মা,  তাকের ওপর একটি আয়না রয়েছে। আর কোত্থাও কিছু নেই। তার মানে আগের ভাড়াটিয়ারা এই আয়নাটি নিয়ে যেতে ভুলে গেছে। তাই না মা?

কলমে গোবিন্দ মোদক, কৃষ্ণনগর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here