“…ওরে এপার ওপার ভাটি উজান
কীর্তন আর মনসা ভাসান
উদাস সুরে উদাসী পরাণ
আমার ভাঙা বাংলার ছেঁড়া তারে
মন বাউলা বসত করে
ভুলি নারে ভাটিয়ালি গান
বুকের মাঝে ভাটিয়ালি গান…।”
শীতকালের নরম রোদ গায়ে মাখলে যেমন মিঠেকড়া অনুভূতি হয়, তেমনই অনুভূতি আছে বাংলার লোকসঙ্গীতে--- যে লোকসঙ্গীতে বাউল আছে, ঝুমুর আছে, ভাটিয়ালি আছে, ভাওয়াইয়া আছে... আছে বাংলার কত শত মানুষের সুখ-দুঃখ, ওঠা-নামার গল্প। সারাদিনের ক্লান্তিতে যখন আমারা অবসন্ন হয়ে দু'চোখের পাতা এক করি, তখন হয়তো কোনো এক মাঝি নিজের ক্লান্তি দূর করার জন্য ভাটিয়ালির সুরে ডুব দেয়। বাংলার লোকসংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হল আমাদের বাংলার লোকগীতি। বিশেষ বিশেষ লোকগীতির মধ্যে রয়েছে- উত্তরে ভাওয়াইয়া, পূর্বে ভাটিয়ালি, মধ্য ও দক্ষিণে বাউল এবং পশ্চিমাংশে ঝুমুর। এছাড়াও সারি গান, মুর্শিদি গান, ভাদু-টুসুর গান, কীর্তন ইত্যাদি আঙ্গিকের সংমিশ্রণে বাংলার লোকসঙ্গীত হয়ে রয়েছে চির সমৃদ্ধ। লোকসঙ্গীতের বিভিন্ন আঙ্গিকের মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত বাউল গান নিয়ে আলোচনা করা যাক।
বাংলার লোক সম্প্রদায়ের যে সাধন গোষ্ঠী সাদামাটা জীবন যাপন করে আর একতারা বাজিয়ে গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে ঘুরে বেড়ায় তাদেরকে বাউল নামে আখ্যায়িত করা হয়। বাউল একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়। বাউল সম্প্রদায়ের মানুষরা নিজেরাই নিজেদেরকে বাউল আখ্যা দেননি। তাঁদের গায়নশৈলী, গানের ভাষার অর্থ বিশ্লেষণ করে তাঁদের বাউল বলা হয়ে থাকে। বাউল শব্দের উৎপত্তি প্রসঙ্গে বহু মতামত আছে। তবে মনে করা হয় সংস্কৃত "বাতুল" শব্দ থেকে বাউল শব্দের অভ্যুদয় ঘটেছে, যার অর্থ 'পাগল'। বাউলরা প্রধানত ভাব পাগল বা ভাব বৈরাগী হয়ে থাকেন। তাঁরা ঈশ্বরে নয়, মানুষে বিশ্বাসী। সাধন সঙ্গীত বাউলের তাই বিষয়বস্তু হয় দেহ তাত্ত্বিক। ধনী-গরিব, জাত-পাত নির্বিশেষে সকলেই যে মানুষ সেই ভাবাদর্শ হল বাউল সঙ্গীতের মূল দর্শন। 'সবার উপরে মানুষ সত্য' এই তত্ত্ব প্রকাশ পায় লালন ফকিরের একটি গানে-
“ব্রাহ্মণ চন্ডাল চামার মুচি
একই জলে শব হয় শুচি
দেখে শুনে হয় না রুচি
যমে তো কাউকে ছাড়বে না
জাত গেল জাত গেল বলে এ কি আজব কারখানা।”
বাউল গানে মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর দর্শনের ভাবাবেগ ফুটে উঠেছে। বাউলরা সদা আত্মভোলা, ভাবের ঘরে ভব সংসারে তাঁরা গেরুয়াধারী বৈরাগ্যপন্থী। বাউল গানে বলা হয়েছে-
ও বাউল গেরুয়া তো পরেছো
একতারাটি ধরেছো
দিকে দিকে ঘুরেছো, ফিরেছো
বলো না কোথায় পেলে তারে
নাকি খুঁজেই গেলে তারে…।”
বাউলরা ‘যা নাই ভান্ডে, তা নাই ব্রহ্মান্ডে’-তে বিশ্বাসী—- এখানে ভান্ড অর্থে শরীরকে বোঝানো হয়েছে। বাউল গান লৌকিক সাধনা, মনুষতত্ত্বে আস্থাশীল। তাঁদের গানের ‘মনের মানুষ’ একপ্রকার প্রতীকি ব্যঞ্জনা। বাউলদের কাছে মানুষই ঈশ্বর, আবার এই মানুষরূপী ঈশ্বর সন্ধানে ভাববৈরাগী হয়ে থাকেন এই বাউলরা। তাঁদের ‘মনের মানুষ’ প্রকৃত অর্থে মানুষের দেহেই অবস্থান করে। বাউলরা যার সন্ধানে আত্মভোলা সেটি ‘অনামক’। বাউল সঙ্গীতে কখনো তাকে ‘মনের মানুষ’, আবার কখনো ‘অচিন পাখী’ বা ‘দরদী সাঁই’ বলা হয়ে থাকে। এই ‘অনামক’-এর সন্ধানে তাঁরা থাকেন আত্মমগ্ন।
বাউল কতগুলি তত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সেগুলি হল-
রূপ-স্বরূপ তত্ত্ব: রূপ বলতে আকার-কে বোঝানো হয় এবং এই রূপের অভ্যন্তরে রূপকে আশ্রয় করে যে বৈশিষ্ট্য থাকে তা-ই হল স্বরূপ। বাউল গানে এই স্বরূপকে আজীবন সন্ধান করা হয়। মানব দেহকে আশ্রয় করে সাধন-ভজনের মাধ্যমে স্বরূপ খোঁজার চেষ্টা করেন তাঁরা। দেহকেই ব্রহ্ম জ্ঞানে কল্পনা করে প্রাকৃত দেহকে অপ্রাকৃত রূপে বিবেচনা করে তাঁরা পরমতত্ত্বকে উপলব্ধি করেন, স্বত্বার রূপকল্প নির্মাণের মধ্য দিয়ে আত্মরূপ উপলব্ধি করেন।
গুরুতত্ত্ব: বাউল গানে গুরু বা মুর্শিদ-কে সর্বোচ্চ স্থানে রাখা হয়। বাউল সাধনা পদ্ধতি কোনো গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা নেই, সেই হেতু কোনো গুরু বা মুর্শিদের থেকে তাঁরা সাধন পদ্ধতি অনুসরণ করেন। মানবরূপী গুরুকে না ভজলে পরমগুরুর সাধনা বিফলে যায়, তাই বাউল গানে মানবগুরু এবং পরমগুরুর মেলবন্ধন ঘটে।
প্রেমতত্ত্ব: বাউলরা ভাব পাগল অর্থাৎ প্রেম-ভাব পাগল। প্রেমহীন জীবন তাঁদের কাছে সাধনার অন্তরায়। মানুষের দেহ হল একটি ক্ষুদ্র বিশ্ব – এই তত্ত্বকে তাঁরা প্রেমের মধ্য দিয়ে উপলব্ধির চেষ্টা করেন। তাঁরা কল্পিত স্বর্গলোক ব্যতীত বাস্তবিক মনুষ্য অন্তর্লোকে বিচরণ করতে সদা প্রত্যাশী। অজানাকে জানার জন্য এইসমস্ত সর্বত্যাগী বাউলরা প্রেমের মাধ্যমে মনের অন্তরালে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে সেই প্রেমানলে হয়ে পড়েন বাতুল অর্থাৎ পাগল।
দেহতত্ত্ব: বাউল সাধনা দেহকেন্দ্রিক। মনুষ্য দেহেই আত্মা, পরমাত্মা, পরমতত্ত্ব বিরাজমান। পরমাত্মাকে জানতে গেলেও সর্বাধিক যার প্রয়োজন তা হল আত্মোপলব্ধি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কন্ঠেও এই একই সুর বেজেছিল-
“সীমার মাঝে অসীম তুমি
বাজাও আপন সুর
আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ
তাই এত মধুর।”
সৃষ্টি বিনা স্রষ্টা শূন্য এবং এই সৃষ্টি ও স্রষ্টা সবই দেহকেন্দ্রিক। বাউলরা সর্বতভাবে বিশ্বাস করেন যে, এই বিশ্বে যা কিছু অধরা সবকিছুই এই স্থূল দেহ এবং সূক্ষ্ম দেহের মধ্যে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে লালন গান বেঁধেছেন এইভাবে-
“আমার এ ঘরখানায় কে বিরাজ করে
আমি জনমভর একদিন দেখলাম না রে
নড়ে চড়ে ঈশান কোণে
হাতের কাছে যার ভবের হাটবাজার
আমি ধরতে গেলে পাইনে তারে।।”
বাউল সঙ্গীতের মূল দর্শন হল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাবলম্বী না হয়ে সরাসরি স্রষ্টার সাথে সংযোগ স্থাপন করা। গোটা বাংলা জুড়ে লোকসঙ্গীতের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বহুলাংশে বিস্তৃত আঙ্গিক হল এই বাউল সঙ্গীত। বাউল গান সৃষ্টি হয়েছে বাংলার মাটিতে। এইসব বাউল ফকিরদের আবাসস্থলের নাম আখড়া, যা পল্লীগ্রামের লোকালয়ের থেকে দূরে অবস্থিত। এইসমস্ত বাউলরা কোনো বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ভুক্ত নয়, তাঁরা বাংলার স্বাধীন মতাবলম্বী।
বাউলবাদ বাংলার শ্রেষ্ঠ সম্পদ। বাউল গানের মধ্য দিয়ে বাংলার দর্শন, চিন্তাধারা প্রকাশ পায়। লোকালয় থেকে বহুদূরে অবস্থিত এসব বাউল আখড়ায় যদি যাওয়া যায়, তবে একতারা-দোতারার সুরে যে সত্যানুসন্ধানী আউলা-বাউলাদের আমরা পাই, তাঁদের আকুতি আজও আমাদের মনকে নাড়া দেয়। এই বাউলবাদ বাংলার মাটিতে "মানুষে সকল মেলে" তত্ত্বের উপস্থাপক রূপে কাজ করে। এইভাবে বাংলার লোকসঙ্গীত মানুষের মনকে যেভাবে প্রভাবিত করেছে, তার প্রমাণস্বরূপ একটি লোকসঙ্গীতের কথা বলা যায়-
“ও তোর বাউলা গানেতে আউলা গানেতে
ভাওয়াইয়া মুর্শিদি সারি
মন বাউলার এ ঘর বাড়ি
প্রাণ পড়ে রয় হাসন লালনে।”
কলমে সৃজিতা ধর, হাবড়া
বি.এড শেষ করে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে স্নাতকোত্তর পড়ছি। ছোট থেকেই লেখালেখির শখ। বর্তমানে বিভিন্ন পত্র পত্রিকার সাথে যুক্ত হয়ে লেখালেখি করছি।